ড্যানিয়েল রেডক্লিফ নামটির চাইতেও তার হ্যারি পটার পরিচয়টি আমাদের কাছে বেশি চেনা। হ্যারি পটারের কথা বললে নিমেষেই চোখের সামনে ভেসে উঠবে গোল ফ্রেমের চশমা পরা এক বালকের চেহারা। জাদুর ছড়ি হাতে নিষ্পাপ চেহারার এই বালকটির কথা আমাদের সকলেরই মনে আছে। হ্যারি পটার সিনেমায় অভিনয়ের মাধ্যমে বিশ্বজোড়া খ্যাতি পেয়েছেন এই ইংরেজ অভিনেতা। তার জীবনের কিছু কথা নিয়েই আজকের লেখা-
রূপালী পর্দার হ্যারি পটার চরিত্রে অভিনয় করা এ ব্যক্তির পুরো নাম ড্যানিয়েল জ্যাকব রেডক্লিফ। ১৯৮৯ সালের ২৩ জুলাই পশ্চিম লন্ডনের ফুলহাম শহরে তার জন্ম। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান তিনি। বাবা অ্যালান রেডক্লিফ এবং মা মার্সিয়া গ্রেসামও অভিনয় জগতের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। অ্যালান রেডক্লিফ ছিলেন আয়ারল্যান্ডের অধিবাসী এবং মার্সিয়া গ্রেসাম ছিলেন সাউথ আফ্রিকান। ধর্মীয় দিক দিয়ে ড্যানিয়েল মিশ্র ধর্মাবলম্বী। ড্যানিয়েলের বাবা একজন সাহিত্য প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। বিভিন্ন লেখককে তাদের লেখা প্রকাশ করায় সহযোগিতা করাই তার কাজ। ড্যানিয়েলের মা একজন কাস্টিং ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেন। ফিল্ম মেকারদের বিভিন্ন সিনেমা এবং টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের জন্য পারফর্মার খুঁজে দেয়াই তার কাজ।
ড্যানিয়েলের শিক্ষাজীবন শুরু হয় লন্ডনের সাসেক্স হাউস স্কুলে ভর্তি হওয়ার মাধ্যমে। এরপর ভর্তি হন সিটি অফ লন্ডন স্কুলে। ২০০৬ সালে হঠাৎ করেই শিক্ষাজীবনের ইস্তফা ঘোষণা করেন। অভিনয় জগতে নিজের স্থান করে নেয়ার প্রয়াসে তার এই শিক্ষাবিরতির ঘোষণা।
ড্যানিয়েল ছোটবেলা থেকেই অভিনেতা হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু বাবা-মা কখনোই চাননি তাদের একমাত্র সন্তান অভিনয় জগতে প্রবেশ করুক বা অভিনয়কে পেশা হিসেবে গ্রহণ করুক। প্রফেশনাল রোলে লোক নেয়ার জন্য প্রায়শই অডিশন হত, কিন্তু এ ধরনের অডিশনে কখনোই তার বাবা-মা তাকে যেতে দিতেন না। স্কুলে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন নাটকে সে অভিনয় করত। ছয় বছর বয়সে স্কুলের একটি নাটকে সে বানরের চরিত্রে অভিনয় করে ব্যাপক মজা পায়। এরপর তার বাবা-মায়ের কাছে অভিনয়ের আবদার বেড়ে গেল বহুগুণে। কিন্তু বাবা-মা তাদের সিদ্ধান্তে অনড়।
কিছুদিনের মধ্যেই উনিশ শতকের লেখক চার্লস ডিকেন্সের লেখা অলিভার টুইস্টের জন্য কাস্টিং শুরু হল। ড্যানিয়েলের পীড়াপীড়ি আবারো শুরু হয়ে গেল। ছেলের বয়স কম বিধায় প্রথমে কিছুতেই রাজি ছিলেন না তারা, কিন্তু পরিশেষে ছেলের আবদারের কাছে হার মানতে হল তাদেরকে। শেষমেশ তারা রাজি হলেন ঠিকই, কিন্তু অনেকটা দেরি হয়ে গেছে, ততদিনে কাস্টিং হয়ে গেছে।
দ্বিতীয় সুযোগটি আসে ১৯৯৯ সালে, যখন চার্লস ডিকেন্সের লেখা আরেকটি উপন্যাস ডেভিড কপারফিল্ড চিত্রায়নের জন্য অভিনেতা খোঁজা শুরু হয়। এবার ড্যানিয়েলের বাবা-মা তাকে অডিশনের জন্য কোনোরূপ বাধা দেননি। ড্যানিয়েল জুনিয়র ডেভিড কপারফিল্ডের জন্য অডিশন দেন এবং নির্বাচিতও হন। এ সময় তার বয়স ছিল ১০ বছর। ড্যানিয়েলের বাণিজ্যিকভাবে অভিনয় জীবনের শুরু এখান থেকেই। সিনেমাটি ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশন (বিবিসি) এবং পাবলিক ব্রডকাস্টিং সার্ভিস (পিবিসি) এর যৌথ প্রযোজনায় সেই বছরই আমেরিকায় প্রচারিত হয়।
প্রথম ছবিতেই তিনি ব্যাপক সুনাম অর্জন করেন। ২০০১ সালে তিনি অভিনয় করেন ‘দ্য টেইলর অফ পানামা’ নামে একটি থ্রিলারধর্মী সিনেমায়। এ ছবিতে জ্যফরি রাশ ও জ্যামি লি কার্টিসের ছেলের চরিত্রে অভিনয় করেন। এখানে তার চরিত্রটি অবশ্য মুখ্য ছিল না। ছবিটি মুক্তি পাওয়ার আগেই তিনি জে কে রোলিংয়ের হ্যারি পটার সিরিজের প্রথম সিনেমা ‘হ্যারি পটার এন্ড দ্য সরসারার’স স্টোন’ এর জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। এ ছবিটিতে তার সহ অভিনেতারা ছিলেন রুপার্ট গ্রিন্ট (রন) এবং এমা ওয়াটসন (হারমায়োনি)।
২০০১ সালে ছবিটি মুক্তি পায় এবং মাত্র ১১ বছর বয়সে ড্যানিয়েল এক অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেন। হ্যারি পটার সিরিজের প্রত্যেকটি সিনেমা বক্স অফিসে তুমুল সাফল্যের ঝড় তোলে। প্রতিটি ছবিই গড়ে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি আয় করেছিল। এই সিরিজের সবগুলো সিনেমায় ড্যানিয়েল অভিনয় করেছেন। তার জীবনের একটি বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ সময় কেটে গেছে এই সিরিজটি শেষ করতে। দর্শকরা তাকে বাল্যকাল থেকে কৈশোরে ধাপে ধাপে রূপান্তরিত হতে দেখেছে পুরো সিরিজটি জুড়ে। পুরো সিরিজটি শেষ করতে প্রায় ১১ বছর লাগে।
এই সিনেমাতে অভিনয় করতে গিয়ে ড্যানিয়েল গ্যারি ওল্ডম্যান, অ্যালান রিকম্যান, এমা থম্পসন, হেলেনা বোনহাম কার্টার সহ আরো অনেক বিখ্যাত মানুষের সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন। ২০১১ সালে ‘হ্যারি পটার এন্ড দ্য ডেথলি হ্যালোজ: পার্ট টু’ রিলিজের সাথে সাথে হ্যারি পটার সিরিজের সমাপ্তি হয়। এর সাথে সাথেই ড্যানিয়েলকে চিরবিদায় জানাতে হয় তার প্রিয় এবং বিখ্যাত চরিত্র হ্যারি পটারকে।
২০০৬ সালে রিকি জারভেইসের কমেডি সিরিজ ‘এক্সট্রাজ’-এ অভিনয় করেন তিনি। এরপর একজন অসংলগ্ন কিশোরের চরিত্রে অভিনয় করেন ‘ইকুস’ মুভিতে। ২০১১ সালে নিজেকে একটু ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেন দর্শকদের সামনে। ‘হাউ টু সাকসীড ইন বিজনেস উইদাউট রিয়েলি ট্রাইং’ সিনেমায় একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী তরুণের ভূমিকায় তাকে দেখা যায়।
২০১২ সালে একটি হরর থ্রিলার মুভিতে তাকে একজন আইনজীবীর ভূমিকায় দেখা যায়। সিনেমাটির নাম ছিল ‘দ্য ওমেন ইন ব্ল্যাক’, সিনেমাটির গল্পে দেখা যায়, তদন্ত করতে গিয়ে আইনজীবীরূপী ড্যানিয়েল অনেক অতিপ্রাকৃত ঘটনার সম্মুখীন হন এবং ঘটনাপ্রবাহ এভাবেই এগিয়ে চলে। একইবছর কমেডি শো ‘স্যাটারডে নাইট লাইভ’ এ তিনি উপস্থাপনা করেন।
এছাড়াও ব্রিটিশ টেলিভিশনের একটি ধারাবাহিক ‘এ ইয়াং ডক্টর’স নোটবুক’ এ তিনি প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন। সিরিয়ালটি এতটাই সফল হয় যে, দর্শকদের চাহিদা মোতাবেক পরবর্তী বছর এর দ্বিতীয় ধারাবাহিক প্রচার করতে হয়েছিল। ২০১৩ সালে কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের জীবনচরিতের আলোকে চিত্রায়িত সিনেমা ‘কিল ইয়োর ডার্লিং’-এ নেপথ্য চরিত্রে অভিনয় করেন। ২০১৪ সালে আবারো একটি হরর থ্রিলার ঘরানার সিনেমা ‘হর্ণস’ এ অভিনয় করেন। প্রেমিকাকে ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত প্রধান সন্দেহভাজন এক ব্যক্তির চরিত্রে অভিনয় করেন এতে। এরপর ‘হোয়াট ইফ’, ‘ডক্টর ফ্রানকেস্টেইন’ ইত্যাদি সিনেমায়ও তাকে অভিনয় করতে দেখা যায়।
এ তো গেল অভিনয় জগতে অবদানের কথা। এবার জেনে নেয়া যাক তার অর্জিত পুরষ্কার ও অর্জন সম্পর্কে-
- ২০১৫ সালে ‘হর্ণস’ মুভিতে অভিনয়ের জন্য চেইন স এওয়ার্ড পান (শ্রেষ্ঠ অভিনেতা)।
- ২০১৩ সালে ‘দ্য ওমেন ইন ব্ল্যাক’ সিনেমায় প্রধান চরিত্রে অভিনয়ের জন্য ব্লাড গাটস ইউকে হরর এওয়ার্ড পান। এছাড়াও এম্পায়ার হিরো এওয়ার্ড পান।
- ২০১২ সালে ‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য ডেথলি হ্যালোজ: পার্ট টু’ এর জন্য এমটিভি এওয়ার্ড (শ্রেষ্ঠ অভিনেতা) পান।
- ২০০৫ এবং ২০০৭ সালে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জন্য ব্রেভো অট্টো জার্মানি পুরষ্কার অর্জন করেন। একই বছর অর্থাৎ ২০০৭ সালে ন্যাশনাল মুভি অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন ‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য অর্ডার অফ দ্য ফিনিক্স’ মুভিতে (বেস্ট পারফরমেন্স বাই এ মেল) অভিনয়ের জন্য।
- ২০০১ সালে গোল্ডেন অ্যাপল পুরস্কার (ইয়ুথ মেল ডিসকভারি অফ দ্য ইয়ার) পান।
ড্যানিয়েল বহুদিন যাবত ডিসপ্রাকসিয়া নামক একটি রোগে আক্রান্ত। আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে হাত এবং চোখের সমন্বয় করতে কিছুটা সমস্যা হয়। ২০ বছর বয়সে তিনি প্রচন্ড পরিমাণে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন, এমনকি অনেক সময় শ্যুটিং স্পটেও মাতাল অবস্থায় চলে যেতেন এবং সেই সাথে প্রচুর পরিমাণে ধূমপান করতেন। বয়সের কারণেই হোক আর খ্যাতির কারণেই হোক, তার এমন অসংলগ্ন আচরণ ও চলাফেরা নানা রকম সমস্যার সৃষ্টি করছিল। একটা সময় ড্যানিয়েল সমস্যাগুলো উপলব্ধি করেন এবং নিজেকে শুধরে নেন। এখন তিনি বেশ ভালোই আছেন।
ড্যানিয়েলের জীবনে বাবা-মা ছাড়াও একজন বিশেষ ব্যক্তির বিচরণ রয়েছে। তিনি এরিন ডার্ক, ২০১২ সাল থেকে ড্যানিয়েল এবং এরিন ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। ‘কিল ইয়োর ডার্লিং’ সিনেমায় অভিনয়ের সময় তাদের পরিচয়। এরিন ড্যানিয়েলের চেয়ে ৫ বছরের বড়। তারা দুজনেই তাদের সম্পর্কটা গোপনে রেখেছেন, যার কারণে তাদের সম্পর্কের ব্যাপারে খুব বেশি কিছু জানা যায়নি। তবে তাদেরকে প্রায়শই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কিংবা পাবলিক প্লেসে একসাথে দেখা যায়। তাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে জানা যায়, এই প্রেমিক যুগল হয়ত খুব শীঘ্রই তাদের বৈবাহিক জীবনের শুরু করবেন।