এনটিআর অভিনয়ের পাশাপাশি একসময় রাজনীতির ময়দানে উৎরে যান (তার অভিনয় জীবন নিয়ে বিস্তারিত জানতে দেখুন ‘এই কাহিনী মহানায়ক এনটিআর এর‘ লেখাটি)। ১৯৮২ সালে তিনি তার রাজনৈতিক দল ‘তেলেগু দেশম পার্টি’ গঠন করেন। এনটিআর হন দলের প্রধান। নব্য উদারতাবাদকে দলের আদর্শ হিসেবে ঠিক করা হয়। এনটিআরের হায়দ্রাবাদের বাড়ি এনটিআর ভবনে পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয় স্থাপন করা হয়। ১৯৮৩ সালের বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে মধ্য-ডানপন্থী দলটি এবং এনটিআর ব্যাপক প্রচারণা শুরু করে।
এনটিআর এ সময় নির্বাচনী প্রচারের জন্য এক দারুণ পদ্ধতি বের করেন। রথ যাত্রা। তিনিই ভারতের প্রথম কোনো রাজনীতিক যিনি নির্বাচনী প্রচারের কাজে রথ যাত্রার ব্যবস্থা করেন। যাত্রার নামকরণ করা হয় ‘চৈতন্য যাত্রা’। একটি মডিফাইড চেভারলেট ভ্যানের খোলা ছাদ দিয়ে এনটিআর বের হয়ে ভাষণ দিতেন এবং জনগণের সাথে ভাব বিনিময় করতেন যেটি চালিয়ে নিয়ে যেত তার পুত্র নান্দামুড়ি হরিকৃষ্ণা।
এনটিআরের কৃষ্ণ ও রাম চরিত্রে অভিনয়ের বিষয়টি তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার গঠনে মারাত্মক সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। যেখানেই যেতেন সেখানেই লোকজন তাকে দেখে দৌড়ে এসে নমস্কার করা শুরু করত। এভাবে এনটিআর ও টিডিপি (তেলেগু দেশম পার্টি) একটি জনবান্ধব দলে পরিণত হয়। ছাদখোলা গাড়ি থেকে হাত নেড়ে নির্বাচনী প্রচারণা পদ্ধতির উদ্ভাবক মূলত তামিলনাড়ুর এমজিআর হলেও এনটিআর একে সাজিয়ে গুছিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক ও মর্যাদাময় রূপ দান করেন। ‘চৈতন্য যাত্রা’-র স্লোগান ছিল ‘তেলেগু ভারী আত্মা গৌরবম’ (তেলেগু জাতির আত্ম-মর্যাদা)। ১৯৮৪-র নির্বাচনে টিডিপি ২৯৪টি আসনের মধ্যে ২০১টি আসন লাভ করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
১৯৫৬ সালে গঠিত হওয়া অন্ধ্রপ্রদেশে প্রথমবারের মতো অকংগ্রেসী কোনো দল বিধানসভা নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। রাজ্যের গভর্নর টিডিপিকে সরকার গঠনের আহ্বান জানান। এনটিআর প্রথমবারের মতো মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন সাথে সাথে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর চক্ষুশূলেও পরিণত হন। সরকার গঠনের পরে এনটিআরের দল প্রথম যে বিলটি পাশ করেছিল সেটি হচ্ছে অন্ধ্রপ্রদেশ উপ-লোকপাল বিল। যার ফলে প্রতিটি জনগণকে মুখ্যমন্ত্রীসহ যেকোনো জনপ্রতিনিধি বা সরকারি আমলার বিরুদ্ধে বিচারবিভাগ ও নিরপেক্ষ নেতৃবর্গের মাধ্যমে তদন্তের ক্ষমতা দেওয়া হয়।
পিতার সম্পত্তিতে মেয়েদের সমান অধিকারের পক্ষে ছিলেন এনটিআর। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার নয় মাসের মাথায় এনটিআর করোনারি বাইপাস সার্জারির উদ্দেশ্যে আমেরিকা গেলে ১৯৮৪ সালের স্বাধীনতা দিবসে রাজ্যের গভর্নর ঠাকুর রাম লাল ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে (টিডিপি ও তার সমর্থকদের দাবি) এনটিআরকে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে আরেক কংগ্রেসফেরত টিডিপি নেতা ও এনটিআর মন্ত্রীসভার অর্থমন্ত্রী নাদেন্দলা ভাস্করা রাও-কে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। রাজ্যজুড়ে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। ভাস্করা রাওকে বিশ্বাসঘাতক বলে প্রচার করা হয়।
এনটিআর বাইপাস সার্জারির পরেই দ্রুত দেশে ফিরে আসেন। তার অনুগত বিধায়কদের নিয়ে তিনি গভর্নরের কাছে যান এবং ভাস্কর রাওকে অপসারণের দাবি জানান। গভর্নর সে দাবি নাকচ করে দেন। এনটিআর পুনরায় ‘চৈতন্য রথম’ বের করেন। কংগ্রেস বিরোধীদের একত্র করেন। সুশীল সমাজ ও বুদ্ধিজীবীগোষ্ঠী, গণমাধ্যম গভর্নরের এহেন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধাচরণ করে। কংগ্রেস বা ভাস্করা রাও যাতে ভাগিয়ে নিয়ে না যায় সেজন্য এনটিআরের অনুগত বিধায়কদের এক নিরাপদ জায়গায় অজ্ঞাতবাসে রাখা হয়। কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী রামাকৃষ্ণা হেজের সহায়তায় মাইশোরের এক বিলাসবহুল হোটল দাস প্রকাশে বিধায়কদের রাখা হয়।
পুরো ব্যাপারটি তদারকি করেন এনটিআরের জামাতা ও টিডিপির প্রভাবশালী নেতা চন্দ্রবাবু নাইডু। একমাসের দোলাচলে শেষমেশ ইন্দিরা গান্ধী হার মানেন। তিনি রাম লালকে সরিয়ে আরেক ঝানু কংগ্রেসী শঙ্কর দয়াল শর্মাকে অন্ধ্রপ্রদেশের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেন। শঙ্কর দয়াল শর্মা এনটিআরকে পুনরায় মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেন।
পরের মাসে ইন্দিরা গান্ধী আততায়ীর হাতে নিহত হন। তার পুত্র রাজীব গান্ধী নাটকীয়ভাবে জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রে চলে আসেন। ১৯৮৪ সালের নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কংগ্রেস সহানুভূতি ভোট পেয়ে লোকসভায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলে পরিণত হলেও অন্ধ্রপ্রদেশে কংগ্রেসের ভরাডুবি হয়। লোকসভার জন্য অন্ধ্রপ্রদেশে বণ্টনকৃত আসনগুলোর সিংহভাগ পায় টিডিপি। সেবার ৩০টি আসন পেয়ে লোকসভায় একক বৃহত্তর বিরোধী দলে পরিণত হয়েছিল টিডিপি। একই মাসে তামিলনাড়ুতে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
এনটিআরের প্রিয় মিত্র এমজিআর ছিলেন দু’বারের নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী। ১৯৮৪ সালের নির্বাচনের আগে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং আমেরিকা গমণ করেন উচ্চতর চিকিৎসার জন্যে। এনটিআর বন্ধুর নির্বাচনী প্রচারণায় যাতে ভাটা না পড়ে সেজন্য তামিলনাড়ু ছুটে যান। স্বভাবসুলভ প্রীতি ও প্রেমপূর্ণ আচরণ দিয়ে এমজিআরের দল অল ইন্ডিয়া আন্না দ্রাভিদা মুন্নেত্রা কাঝাগামের (এআইএডিএমকে) পক্ষে প্রচারকার্য চালান। সেবারের নির্বাচনেও এমজিআরের দল জিতেছিল এবং তামিলনাড়ুতে সরকার গঠন করেছিল।
১৯৮৯ সালের অন্ধ্রপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে টিডিপি জিততে পারেনি। এনটিআর তার তিনটি নির্বাচনী এলাকার একটিতে পরাজিত হয়েছিলেন। একবার সরকার গঠনের পরেরবার বিরোধী দলে অবস্থানের উপমহাদেশীয় রাজনৈতিক পরম্পরার প্রতিফলন ঘটে অন্ধ্রপ্রদেশে। টিডিপির ভাষ্যমতে, এনটিআর অসুস্থ থাকার দরুন ইলেকশন ক্যাম্পেইনে অসমর্থ ছিলেন এবং ফলস্বরূপ পরাজয় ঘটেছিল টিডিপির। এনটিআর বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে বিধানসভায় গমন করেন। সরকারদলীয় বিধায়করা বাক-বিতণ্ডার মাঝে তাকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করতে থাকে। এনটিআরও যুক্তির মাধ্যমে তাদের প্রশ্নের উত্তর দেন। বিরোধীদলীয় নেতা থাকাকালে এনটিআর তেলেগু লেখিকা লক্ষ্মী পার্বতীকে বিয়ে করেন ১৯৯৩ সালে। তার দ্বিতীয় বিয়েকে পরিবারের ভেতরেই অনেকে মেনে নেয়নি।
একই বছর জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কংগ্রেস বিরোধীরা জাতীয় ফ্রন্ট (National Front) নামক কংগ্রেস বিরোধী জোট গঠন করে। এনটিআরের টিডিপি, এমজিআরের আন্না দ্রাভিদা মুন্নেত্রা কাঝাগাম, ইন্ডিয়ান কংগ্রেস (সমাজতান্ত্রিক), ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি), আসাম গণ পরিষদ (এজিপি) জোটে শরিক হয়। ভি পি সিং-কে প্রধানমন্ত্রী করে ন্যাশনাল ফ্রন্টের গঠন করা কোয়ালিশন সরকার ১৯৮৯-৯০ সালে লোকসভায় বিরাজমান থাকে।
১৯৯৪ সালের অন্ধ্রপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে এনটিআরের টিডিপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। টিডিপি এবার বামপন্থীদের সাথে নিয়ে সরকার গঠন করে। এনটিআর তৃতীয়বারের মতো মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন। কিন্তু এবার তিনি তার পত্নী লক্ষ্মী পার্বতীকে রাজনীতিতে অভিষিক্ত করার চেষ্টা করেন। এনটিআরের পরিবারের অনেকেই এটি ভালো চোখে দেখেনি। তারা টিডিপিতে লক্ষ্মী পার্বতীর উপস্থিতি ও কর্তৃত্ব একদম সহ্য করতে পারেনি। গুজব রটে– আগামী নির্বাচনে এনটিআর পার্টিপ্রধান হিসেবে লক্ষ্মীকে মুখ্যমন্ত্রীর করার চিন্তা-ভাবনা করছেন।
এ ঘটনায় তার পরিবার নড়েচড়ে বসে। ভুবনেশ্বরীর স্বামী চন্দ্রবাবু নাইডু এনটিআরের আরো দুই ছেলের সমর্থন নিয়ে বিদ্রোহ করে বসেন। লক্ষ্মী পার্বতীকে দল থেকে বহিষ্কারের দাবি জানান। বিধায়ক এবং দলের আধিকারিকগণ চন্দ্রবাবু নাইডুর পক্ষে অবস্থান নেন। এনটিআর নিজের দলেই কোণঠাসা হয়ে পড়েন। পরে, তিনি দল ও মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তাফা দেন। চন্দ্রবাবু নাইডু টিডিপির প্রধান এবং মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তার কয়েকমাস পরে নিজ বাসভবনে এনটিআর হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেন।
এনটিআরের শবদাহ সম্পন্ন হওয়ার পরে তার পত্নী লক্ষ্মী পার্বতী প্রতিজ্ঞা করেছিলেন চন্দ্রবাবু নাইডু নির্বাচনে না হারা পর্যন্ত তিনি এনটিআরের চিতাভস্ম গঙ্গায় প্রবাহিত করে পিণ্ডদান করবেন না। ২০০৪ এ টিডিপি ও চন্দ্রবাবু নাইডু বিধানসভা নির্বাচনে হারার পরে লক্ষ্মী পার্বতী পতির মৃত্যুর আট বছর পরে শ্রীরঙ্গাপাটনায় তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করেন। লক্ষ্মী পার্বতী ‘এদুরেলিনি মানিশী’ ও ‘তেলেগু তেজম’ নামে দুই খণ্ডে এনটিআরের জীবনী লিখেছেন।
এনটিআর মারা যাওয়ার পরের বছর ‘এনটিআর তেলেগু দেশম পার্টি (লক্ষ্মী পার্বতী)’ নামে দল গঠন করেন এবং পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। মাত্র ৪২টি আসন লাভ করে বিরোধীপক্ষ হিসেবে বিধানসভায় গমন করেছিল লক্ষ্মীর দল।
২০১৯ সালে পরিচালক কৃষ এনটিআরের জীবনীর ওপর ‘এনটিআর: কাথানায়কুডু’ এবং ‘এনটিআর: মাহানায়াকুডু’ নামক দুটো চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। প্রথমটিতে দেখানো হয়েছে এনটিআরের জীবনের অভিনয়কাল এবং পরেরটিতে রাজনৈতিককাল। এনটিআরের ষষ্ঠপুত্র নান্দামুড়ি বালাকৃষ্ণা (এনবিকে) পিতা নান্দামুড়ি তাড়াকা রামা রাও (এনটিআর)-এর চরিত্রে এবং বলিউডের বিখ্যাত অভিনেত্রী বিদ্যাবালান এনটিআর পত্নী বাসাভা তাড়কামের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। টলিউডের আরেক জনপ্রিয় অভিনেতা যীশু সেনগুপ্তও সেখানে অভিনয় করেছেন মহান তেলেগু চলচ্চিত্রকার এল ভি প্রসাদের চরিত্রে।
তৎকালীন প্রচলিত সিনেমা স্টারদের ধারা থেকে এনটিআর অনেক বিষয়ে স্বতন্ত্র্য। বলিউডে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে দিলীপ কুমার, দেব আনন্দ, অশোক কুমার, রাজ কাপুরসহ আরো যারা রাজত্ব করেছেন তাদের থেকে এনটিআর প্রধান যে বিষয়গুলাতে আলাদা তা হচ্ছে সবধরনের চরিত্রে সমানতালে কাজ করার প্রবণতা, নিজেকে পর্দার আড়ালে আটকে না রেখে সরাসরি জনগণের সাথে সম্পৃক্ত করা।
এনটিআরের সাব-রেজিস্টারের চাকরির বেতন ছিল ১৯০ রূপি আর তিনি প্রথম যে ছবিতে মুখ্যচরিত্রে অভিনয় করেন সেখানে পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন ১০০০ রূপি। ২০১৩ সালে সিএনন-আইবিএন করা সর্বভারতীয় জরিপে এনটিআর ‘ভারতের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনেতা’ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। সবরকম চরিত্রে মুন্সিয়ানা অভিনয়দক্ষতার জন্য তেলেগু ভাষাভাষী গোষ্ঠী তাকে ‘নট অভিনেতা সার্বভৌম’ বলেও ডাকে।