চেনা মানুষগুলোর অজানা গল্পের কথা আমরা বলেছিলাম একদিন। না জানা সেই গল্পগুলো শুনতে গেলেই আমরা বুঝতে পারি পরিচিত এই নামগুলো, চিরচেনা এই মানুষগুলোকেই প্রকৃতপক্ষে জানতে এখনো কতো বাকি! এদেশের প্রতিটি শিশুর সবচেয়ে পরিচিত নাম কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর জীবনের অজানা অধ্যায়গুলো নিয়ে সাজিয়েছিলাম আমাদের এর আগের আয়োজন। তবে সেখানে প্রাধান্য পেয়েছিলো মূলত কবির জীবনের প্রথম ও মধ্যম দিককার আড়ালে চলে যাওয়া বাস্তবতাগুলো। আজ আমরা শুনবো তাঁর জীবনের শেষের অংশের অজানা কথা।
কবির জীবনের পুরোটাই আসলে বলতে গেলে এক কঠোর সংগ্রামের গল্প। সে সংগ্রাম দারিদ্র্য, অর্থলিপ্সা, লোভ, প্রতারণা আর শোষণের বিরুদ্ধে ভালোবাসা, স্নেহ-মমতা আর মানবতাকে জেতানোর সংগ্রাম। বিশেষ করে কবির জীবনের শেষের অধ্যায়টুকু ছিলো কবি আর কবি পরিবারের জন্য সবচেয়ে কঠিন সময়। কবি অসুস্থ হয়ে যাবার পর কবির সন্তানরা ও তাঁর পরিবার হাতে গোণা মাত্র কয়েকজন ছাড়া পাশে পায়নি তাঁর কোন বন্ধু-শুভানুধ্যায়ীকেই, বরং কবির লেখা বইয়ের স্বত্ত্ব বিক্রয় বা কবিতা ছাপাতে গিয়ে পরিচিত মানুষদের দ্বারাই বারবার হয়েছে প্রতারিত।
কবির জীবনের মাঝামাঝি থেকে শেষ দিককার না জানা কিছু কথাই জানি এবার চলুন।
১৯৩০ সালের ৭ মে নজরুলের ত্রুটিহীন যত্ন, সেবা ও চিকিৎসাকে ব্যর্থ করে বসন্ত রোগে অসহনীয় কষ্ট পেয়ে কবির দ্বিতীয় পুত্র বুলবুলের (অরিন্দম খালেদ) মৃত্যু হয়। পুত্রশোক এত প্রবল হয়েছিলো যে নজরুল পরে গভীরভাবে আধ্যাত্মিক সাধনার দিকে ঝোঁকেন এবং দীক্ষা নেন। উল্লেখ্য, এই শিশুর রোগশয্যার পাশে বসেই কবি মূল ফারসি থেকে রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ বাংলায় অনুবাদ করেন এবং এই কাব্য বুলবুলের নামে উৎসর্গ করেন।
একবার ঢাকায় এসে কবি সংগীতের সুকণ্ঠী ছাত্রী রাণু সোম (পরে প্রতিভা বসু) ও ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ সুরেন্দ্রনাথ মৈত্রের কন্যা উমা মৈত্র (নোটন) এর সাথে ঘনিষ্ঠ হন এবং তাদের গানের তালিম দিতে শুরু করেন। রাণুর প্রতিভায় মুগ্ধ কবি নিজে ছাত্রীর বনগ্রামের বাসায় যেতেন তাকে গান শেখানোর জন্য। কিন্তু স্থানীয় রক্ষণশীল যুবকদের মধ্যে তা বিরূপ মনোভাব তৈরি করে। এভাবেই একদিন ঘটে যায় অপ্রিয় এক ঘটনা। বনগ্রাম থেকে ফেরার সময় একদিন রাতে তারা নজরুলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, যদিও একদা সৈনিক কবির সাথে তারা ঠিক পেরে ওঠে না। পরে রাণুই কলকাতায় যেয়ে কবির কাছে গান শেখে।
কবির যখন ভয়ানক অর্থসংকট, তাঁর দুইপুত্র সানি ও নিনি তখন বালক এবং প্রমীলা নজরুল প্যারালাইসিস নিয়ে শয্যাশায়ী। এই অবস্থায় কবিকে ঠকানোর লোকের কিন্তু অভাব হয়নি! চরম অর্থকষ্টের সুযোগে কবির বইয়ের কপিরাইট কিনে নিয়ে তাঁকে যেমন অবিশ্বাস্যভাবে বঞ্চিত করেছে প্রকাশকরা (কলকাতার বিখ্যাত পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা ডি. এম লাইব্রেরীর নাম এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য), তেমনি খবরের কাগজ ও মাসিক পত্রিকার মালিকগণ দিন শেষে মাত্র ৫/৬ টাকা দিয়ে কবিকে বিদায় করতেও কার্পণ্য করেননি। অনেক সময় কবিকে কেবল চা-পান খাইয়ে লিখিয়ে নেওয়া হতো।
১৯৬৩ সালের ৩০ শে জুন দীর্ঘ ২২ বছর পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী থাকার পর কবির প্রিয়তমা স্ত্রী প্রমীলা নজরুল মারা যান। প্রমীলার নির্দেশ মতো তাঁকে কবির জন্মস্থান চুরুলিয়াতে ইসলামিক রীতি অনুসারে সমাহিত করা হয়। এই মৃত্যু যে শুধু কবিই সহজভাবে নিতে পারেননি তা না, এর সাথে তা সানি-নিনির মানসিক ভারসাম্যকেও চরমভাবে নাড়া দেয়।
একটা দীর্ঘ সময় জুড়ে সীমাহীন কষ্ট, লাঞ্ছনা আর অবহেলা সহ্য করেছেন কবি ও তাঁর পরিবার। কবি যখন পরিবার নিয়ে চরম অর্থসংকটে, সেই সুযোগে অনেক লাইব্রেরীর মালিক ও স্বত্ত্বাধিকারীরা আত্মভোলা কবিকে প্রায়ই সামান্য কিছু টাকা দিয়ে তাঁর বইগুলোর সর্বসত্ত্ব কিনে নিয়েছিল। কবিও এসব বইয়ের স্বত্ত্ব বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। বিশেষ করে নজরুল যখন অসুস্থ, প্রমীলা যখন শয্যাশায়ী, তখন কবির বড় ছেলে কবির পরিচিত প্রায় সকল বন্ধু-বান্ধব ও প্রকাশক, শুভানুধ্যায়ীদের কাছে সাহায্যের জন্য যান। খুবই কাছের হাতেগোণা কিছু মানুষ ছাড়া আর কারোর কাছেই কোনো সাহায্য তিনি পাননি, বরং কবিতা আর বইয়ের পান্ডুলিপি নিয়ে পরে আর টাকা না পাওয়া বা নামমাত্র মূল্য পাওয়ার ঘটনা ঘটেছে অনেক। কবির ওই বিপদের দিনেও কবিকে ঠকাতে পিছপা হননি সমাজের অনেক নামজাদা মানুষও।
এবার আসি প্রথমবার যখন নজরুলকে বাংলাদেশে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয় সে প্রসঙ্গে। কিছু মানুষের আন্তরিক চেষ্টায় (এক্ষেত্রে কবি ফয়েজ আহমেদ, মুহাম্মদ নুরুল হুদার নাম উল্লেখযোগ্য) বুলবুল ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে প্রস্তাবিত নজরুল সঙ্গীত সম্মেলনের জন্য পাকিস্তান সরকার এক সময় কবি নজরুলসহ আমন্ত্রিত ২৫ জন অতিথির জন্য বিমানে যাতায়াত ও অন্যান্য খরচের জন্য চার হাজার টাকা মঞ্জুর করে।
উৎসাহী ও আনন্দিত সকলে যখন সকল আয়োজন সম্পন্ন করে টিকিটের পর্যন্ত ব্যবস্থা করে ফেলেছে, তখন ঘটলো বিনা মেঘে বজ্রপাত। ভারত সরকার নজরুল ও প্রমীলা ছাড়া বাকি ২৩ জনের পাসপোর্ট প্রদান করে। কোনোভাবেই কবি ও কবিপত্নীর পাসপোর্টের ব্যবস্থা করা যায়নি আর। পরে জানা যায় ১৯৫০ সালে যখন করাচিতে নজরুলের ৫২ তম জন্ম দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত সভায় এমন কথা ওঠে যে, কবি ঢাকা বা পাকিস্তানের কোথাও এলে তাঁকে কলকাতা ফিরে যেতে দেওয়া হবে না, তখন সেখানে ভারতের তৎকালীন হাই-কমিশনার সি সি দেশাই উপস্থিত ছিলেন আর পরে তাঁর পরামর্শেই ভারত সরকার কবি ও প্রমীলার পাসপোর্ট ইস্যু করেনি।
২৪ মে, ১৯৭২ নজরুলকে প্রথম সরকারিভাবে ঢাকায় আনা হয়। তবে এরকমটাও শোনা যায় যে, ১৯৭৬ সালে কবিকে যখন একুশে পদক দেওয়া হয়েছিলো, তখনো তিনি একজন ভারতীয় নাগরিক হিসাবে বাংলাদেশে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। আর একুশে পদক দেওয়ার সেই অনুষ্ঠানের একজন প্রত্যক্ষদর্শীর পরবর্তী সময়ে লেখা বই থেকে জানা যায় যে, কবির গান আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামের জন্য দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করে, যাঁকে আমরা সত্য, সুন্দর ও ন্যায়ের কবি হিসেবে এনেছিলাম, দেশে এনে ‘জাতীয় কবি’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছিলাম, সেই নজরুলকে সেখানে ভিড়ের মধ্যে অন্য দশজনের সাথে পদক পরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অবশ্য ১৯৭৬ সালেই নজরুলকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। তার শেষ সমাধি এই স্বাধীন বাংলার মাটিতেই হলো।
শিশুকবিকে মা-বাবা শিশুকালে ভালোবেসে যে ‘দুখু মিয়া’ নাম দিয়েছিলেন, সারা জীবন কবির কষ্টে, সংগ্রামে সে নাম আসলেই সার্থক হয়ে ওঠে। নজরুলের জীবনের অজানা কয়েকটি গল্পের কথা এখানে বলা হলো। তারপরও হয়তো থেকে গেলো তাঁর জীবন সংগ্রামের না জানা কত কথা!
এত কষ্ট ও সংগ্রামের কথার পর যেতে যেতে তাঁর জীবনের একটা ছোট্ট আনন্দের কথা দিয়েই বরং শেষ করি- এত দারিদ্র্যের আঘাত সত্ত্বেও ১৯৩১ সালের সেপ্টেম্বরে কবি শুধু শখ মেটাতেই হঠাৎ করেই কোনোভাবে একটা ক্রাইসলার মডেলের চোখে পড়ার মতো গাড়ি কিনে বসেন। আসলেই অবাক করা নজরুল আমাদের!
তথ্যসূত্র
১) নজরুল তারিখ অভিধান- মাহবুবুল হক
২) চিরঞ্জীব নজরুল- মুহাম্মদ নুরুল হুদা