১৯৭১ সালের মাঝামাঝি সময়কার কথা। বাংলাদেশে তখন চলছিল ভয়ংকর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। চারদিকে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পর্যাপ্ত অস্ত্র নেই, তাদের খাবার জন্য খাদ্য নেই। চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই। অগণিত মানুষ শহীদ হতে লাগলো, আর কোটি কোটি মানুষ ভিটেছাড়া। ঠিক এই সময় বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়ালেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। জর্জ হ্যারিসনের সাথে মিলে আয়োজন করলেন ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ । ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে অনুষ্ঠিত হলো বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যার্থে প্রথম চ্যারিটি কনসার্ট। বিশ্বে যত চ্যারিটি কনসার্ট হয়েছে তার মাঝে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ এর প্রভাব অনেক।
কে এই পণ্ডিত রবিশঙ্কর?
পণ্ডিত রবিশঙ্কর ছিলেন একজন ভারতীয় বাঙালি সঙ্গীতজ্ঞ ও প্রখ্যাত সেতারবাদক । তিনি তাঁর সেতারবাদনের জন্য ছিলেন বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে তিনি এক অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন। বিশ্ব সঙ্গীতে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে তিনি ধীরে ধীরে গানের জগতে সত্যিকার পণ্ডিত হয়ে ওঠেন। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত যে কোনো সংগীতের চেয়ে কম নয়, তিনি তা প্রমাণ করে দিয়েছেন।
পণ্ডিত রবিশঙ্কর ১৯২০ সালে ৭ এপ্রিল ভারতের উত্তর প্রদেশের বেনারসে জন্মগ্রহণ করলেও তাঁর আদিনিবাস ছিল বাংলাদেশের নড়াইল জেলায়। জীবিকার্জনের জন্য তাঁর বাবা শ্যামশংকর চৌধুরি নড়াইল থেকে বেনারসে চলে যান। তিনি ছিলেন ঝালওয়ারের মহারাজার একজন কর্মী।
রবিশঙ্করের পণ্ডিত হয়ে ওঠার গল্প
প্রখ্যাত এই পণ্ডিত সেতারবাদক হিসেবে বিশ্বজয় করলেও তাঁর শুরুটা ছিল একটু অন্যরকম। ১০ বছর বয়সে ১৮৩০ সালে তিনি তাঁর বড় ভাই প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী উদয় শংকরের নাচের দলের সাথে প্যারিসে যান। এর ঠিক তিন বছর পর তিনি এই নৃত্য সংগঠনের সদস্য হন এবং নাচ শিখতে শুরু করেন। নৃত্যে পারদর্শীতার কারণে তিনি বড় ভাইয়ের সাথে ইউরোপ, আমেরিকা ভ্রমণ করেন। এরকমই একটা অনুষ্ঠানের জন্য তিনি ইউরোপ ভ্রমণ করেন। এ সময় এই দলে ছিলেন মাইহার রাজদরবারের প্রধান সংগীতশিল্পী ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান। তিনি রবিশঙ্করকে দেখেই বুঝতে পারলেন, ঠিকমতো তালিম পেলে ছেলেটা একদিন বিশ্বজয় করবে। তিনি রবিশঙ্করকে একজন একক সেতারবাদক হিসেবে তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন। এবং একটা শর্ত দিয়ে বসেন, শিক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই শিক্ষায় তাঁকে একনিষ্ঠ থাকতে হবে। এজন্য ইউরোপ ভ্রমণ শেষে নৃত্যদল ত্যাগ করে তালিম নিতে মাইহারে চলে যান রবিশঙ্কর।
১৯৩৮ সালে ১৮ বছরের এক যুবক মাইহারে আসেন অমর শিল্পী আচার্য আলাউদ্দিন খানের কাছে সেতারের দীক্ষা নিতে। আচার্য রবিশঙ্করের একনিষ্ঠতা আর ভক্তি দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছিলেন। দীক্ষা গ্রহণকালে তিনি আচার্যের পুত্র সরোদের অমর শিল্পী ওস্তাদ আলী আকবর খানের সহচার্যে আসেন। এরপর আর কখনো পিছনে তাকাতে হয়নি এই কালজয়ী পণ্ডিতকে। ওস্তাদ আলী আকবর খানের সাথে পরবর্তীতে বিভিন্ন স্থানে সেতার-সরোদের যুগলবন্দী বাজিয়েছিলেন। ১৯৩৮-৪৪ সাল পর্যন্ত গুরুর বাড়িতে থেকেই তিনি তার শিক্ষাগ্রহণ সম্পন্ন করেন। গুরুর দেয়া সেই শর্ত তিনি পালন করেন অক্ষরে অক্ষরে।
পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও প্রথম স্ত্রী অন্নপূর্ণা দেবী
অন্নপূর্ণা দেবী ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের কন্যা ও একজন গুনী সংগীতজ্ঞ হবার কারণেই তাদের বৈবাহিক জীবন নিয়ে সবার আগ্রহ ছিল আকাশছোঁয়া।
রবিশঙ্কর যখন মাইহারে দীক্ষা নিতে আসেন, তখন অন্নপূর্ণা দেবী ছিলেন ১৩ বছরের লাজুক এক কিশোরী। রবিশঙ্করের ভাষায়, “খুব উজ্জ্বল আর দারুণভাবে নজরকাড়া। চোখ দুটো ভারি মিষ্টি, আর গায়ের রঙ আলুভাইয়ের (ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ) চেয়ে ফর্সা” । ১৯৪১ সালের ১৫ মে সন্ধ্যাবেলা বিয়ে হয় তাদের। এই সময় পণ্ডিত রবিশঙ্কর ছিলেন ২১ বছরের এক যুবক।
পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও দেবী অন্নপূর্ণা একই জায়গাতে থাকার কারণে সবাই ধারণা করতো তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিলো। কিন্তু দেবী অন্নপূর্ণা মাইহারে বাবা-মায়ের সাথে আশ্রমের মতো একটা পরিবেশে বড় হয়েছিলেন, তাই কোনো প্রশ্নই ছিলো না পণ্ডিতজির আকর্ষণে জড়িয়ে পড়ার। পণ্ডিত রবিশঙ্করও তাঁর আত্মজীবনী রাগমালাতে লিখেছেন, “আমাদের মাঝে প্রেম, রোম্যান্স বা লুকোচুরির কিছুই ছিল না। ওই সময় অনেকে অবশ্য এ রকমই ভাবতো। বিয়ের আগে এ ব্যাপারে ওর সত্যিকার মনোভাব কী ছিল সেটা আমি জানতাম না। আমাকে বলা হয়েছিল ওর মত আছে।”
প্রথমে সবকিছু ঠিক থাকলেও কিছুদিন পর থেকে তাদের সাংসারিক জীবনে টানাপোড়ন শুরু হয়। এর একটি প্রধান কারণ ছিলো অন্নপূর্ণা দেবীর জনপ্রিয়তা। বলা হয়ে থাকে, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের ৮০ ভাগ পেয়েছিলেন অন্নপূর্ণা, ৭০ ভাগ আলী আকবর খাঁ, আর ৪০ ভাগ পেয়েছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। এই বিষয়টা ভালোভাবে নিতে পারতেন না পণ্ডিতজি। কোনো অনুষ্ঠানের পর ভক্তদের অন্নপূর্ণা দেবীকে ছেঁকে ধরাটা পছন্দ ছিলেন না পণ্ডিতজির। তাই একসময় বাজানোই ছেড়ে দিলেন দেবী অন্নপূর্ণা। এই টানাপোড়নের আরেকটা কারণ ছিল তাদের পুত্র শুভঙ্করের জন্ম। জন্মের কিছুদিন পরেই শুভঙ্করের এক ভয়ানক অসুখ ধরা পড়ে। সারারাতই কান্নাকাটি করতো সে। সারাদিন ১০ ঘন্টা পরিশ্রম করার পর রাত জাগাটা তাদের মাঝে নতুনভাবে ঝামেলার কারণ হলো। বোম্বেতে তাদের দাম্পত্য কলহ চরমে পৌঁছালে একদিন অন্নপূর্ণা জানতে পারলেন, রবিশঙ্করের জীবনে নতুন কারো আগমন হয়েছে। নৃত্যশিল্পী কমলা শাস্ত্রীর সাথে রবিশঙ্করের প্রেম চলছে। এই কারণে সব ছেড়ে তিনি ছেলে শুভকে নিয়ে মাইহারে চলে আসলেন। পরে কমলার বিয়ের পর তিনি ফিরে গিয়েছিলেন পণ্ডিতজির কাছে। কিন্তু এই সংসার আর টেকেনি। ১৯৬৭ সালে ইতি ঘটে তাদের সংসারের।
অন্নপূর্ণা দেবীর সাথে বিচ্ছেদ হবার পর তিনি এক আমেরিকান কনসার্ট উদ্যোক্তা স্যু জোন্সকে বিয়ে করেন এবং এই সংসারে নোরা জোন্স নামের একজন কন্যাসন্তানও আছে। নোরা জোন্স একজন পপ, জ্যাজ, পাশ্চাত্য লোকসংগীতের শিল্পী ও সুরকার। পরে রবিশংকর বিয়ে করেন সুকন্যা কৈতানকে, এখানে অনুশকা শংকর নামের আরো একটি কন্যাসন্তান আছে তাঁর।
সঙ্গীতজীবন
১৯৪৪ সাল পর্যন্ত তিনি নিষ্ঠার সাথে সকল যন্ত্র এবং ভারতীয় রাগ সঙ্গীতের উপর শিক্ষালাভ করেন। এরপর তিনি মাইহার থেকে মুম্বাই যান এবং সেখানকার ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশনের সাথে যুক্ত হয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৪৫ সালে কবি ইকবালের ‘সারে জাঁহা মে আচ্ছা’ কবিতার সুর করেন তিনি। কর্মক্ষেত্রে দায়িত্বশীল আচরণের জন্য ১৯৪৯ সালের প্রথমদিকে তিনি ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’-এর নয়াদিল্লি শাখার সঙ্গীত পরিচালকের দায়িত্ব পান। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত তিনি এই পদে কর্মরত ছিলেন।
১৯৫০ সালে সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত ছবি ‘অপু-ত্রয়ী‘ (পথের পাঁচালী, অপরাজিত, অপুর সংসার)-এর সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে ছিলেন। এছাড়াও তিনি বেশ কিছু হিন্দি ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন।
তিনি ১৯৫৪ সালে একটি সঙ্গীতদলের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নে যান এবং একক বাদ্য পরিবেশন করেন। ১৯৫৫ সালে ওস্তাদ আলী আকবর খানের মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্টের এক পরিবেশনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রোতাদের আগ্রহের সৃষ্টি হয় ভারতীয় রাগ সংগীতের উপর। ইউরোপ, আমেরিকায় ভারতীয় রাগ সঙ্গীতকে তুলে ধরার জন্য ১৯৫৬ সালে জানুয়ারি মাসে পণ্ডিত রবিশঙ্কর অল ইন্ডিয়া রেডিওর চাকরি ছেড়ে দেন এবং যুক্তরাজ্য, জার্মানি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ করেন। এই সফরে তিনি অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করেন। এরপর একেক পর এক তিনি বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করতে থাকেন এবং শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যান। ১৯৫৬ সালে লণ্ডন থেকে তাঁর তিনটি রাগের রেকর্ড প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কো সঙ্গীত উৎসবে অংশগ্রহণ করেন এবং একইসাথে তিনি কিছু পাশ্চাত্য চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনাও করেন। এই বছরেই তিনি মুম্বাইতে কিন্নর স্কুল অফ মিউজিক প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৬৭ সালে তিনি দ্য মনেটারি পপ ফেস্টিভ্যালে সেতার বাজান এবং মেনহুইনের সাথে জার্মানির বেস্ট চেম্বার মিউজিক পারফর্মেন্স ফর ওয়েস্ট মিটস ইস্ট পুরস্কার পান। এরপর মুম্বাইয়ে প্রতিষ্ঠিত তাঁর কিন্নর সঙ্গীত বিদ্যালয়ের একটি শাখা খোলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস এবং ক্যালিফোর্নিয়াতে।
১৯৭৪ সালে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। এই কারণে তিনি কিছুদিন সঙ্গীত পরিবেশন থেকে বিরত থাকেন। ১৯৮২ সালের গান্ধী ছবির সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট অরিজিনাল মিউজিক স্কোরের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন তিনি। এর কয়েকবছর পর ১৯৮৯ সালে তিনি নৃত্যনাট্য ‘ঘনশ্যাম‘ তৈরি করেন। ১৯৯০ সালে এই নৃত্যনাট্যের অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৯২ সালের দিকে তিনি হৃদরোগের জন্য বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ায় সঙ্গীত বিষয়ক কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। এই সময় তাঁর পাশে ছিলেন জর্জ হ্যারিসন। হ্যারিসনের সম্পাদনায় ১৯৯৬ সালে তিনি রচনা করেন দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘রাগমালা‘।
পুরষ্কার ও সম্মাননা
পণ্ডিত রবিশঙ্কর অনেক পুরষ্কার পেয়েছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো-
- ১৯৬২ সালে ভারতীয় শিল্পের সর্বোচ্চ সম্মাননা ভারতের রাষ্ট্রপতি পদক
- ১৯৮১ সালে ভারতের সর্বোচ্চ সুশীল সমাজ পুরস্কার পদ্মভূষণ
- ১৯৯১ সালে ফুকোদা এশিয়ান কালচারাল প্রাইজেসের গ্র্যান্ড প্রাইজ
- ১৯৯৮ সালে সুইডেনের পোলার মিউজিক প্রাইজ
- ১৯৯৯ সালে ভারত সরকার কর্তৃক প্রদত্ত ভারতরত্ন
- ২০০০ সালে ফরাসি সর্বোচ্চ সিভিলিয়ান অ্যাওয়ার্ড লিজিয়ন অব অনার
- ২০০১ সালে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ কর্তৃক প্রদত্ত অনারারী নাইটহুড
- ২০০২ এ দুটি গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড
- ২০০৩ সালে আইএসপি এ ডিস্টিংগুইশ্ড আর্টিস্ট অ্যাওয়ার্ড, লন্ডন
- ১৪টি সম্মানসূচক ডক্টরেট
- ম্যাগাসাসে অ্যাওয়ার্ড, ম্যানিলা, ফিলিপাইন
- গ্লোবাল অ্যাম্বাসেডর উপাধি – ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম
- বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত দেশিকোত্তম
জীবনাবসান
বিশ্বখ্যাত এই পণ্ডিত ২০১২ সালের ১১ ডিসেম্বর ৯২ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে তাঁর অতিমাত্রায় শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে তাকে হাসপাতালে নেয়া হয় এবং হৃৎপিন্ডের ভাল্ব পরিবর্তন করা হয়। তাঁর দুর্বল শরীর এই অপারেশনের ধাক্কা সহ্য করতে না পারায় দেহত্যাগ করেন এই মহান কিংবদন্তী। পাশ্চাত্য সংগীতের তুলনায় যে ভারতীয় রাগসংগীত যে অনেক উচ্চস্তরের- এ কথা প্রমাণ করেছেন বিশ্ববিখ্যাত পণ্ডিত রবিশঙ্কর চৌধুরি।