সঙ্গীতজগতের সাথে পরিচয় আছে অথচ ওস্তাদ রবিশঙ্করের নাম শোনেনি এরকম মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। একসময় পুরো বিশ্বব্যাপী ভারতীয় উপমহাদেশের সঙ্গীতের পতাকা বহন করেছিলেন বিংশ শতাব্দীর এই কিংবদন্তী সেতার বাদক। সঙ্গীতের অনেক ক্ষেত্রেই কাজ করেছেন তার বর্ণাঢ্য জীবনে। সঙ্গীত রচনাকে উপাসনা করার পর্যায়ে রাখতেন তিনি।
তিনি বলেন,
যে সঙ্গীত আমি শিখেছি এবং নিজে করছি, এটা প্রভুকে উপাসনা করার মতো। আমার কাছে একটা বাদ্যযন্ত্র দেবতার মতো সম্মান পায়। আমি আমার রচনা করা সঙ্গীতকে আধ্যাত্মিক গুণ দেয়ার চেষ্টা করি, যাতে করে আপনি বুঝে উঠার আগেই সঙ্গীত আপনার আত্মার সাথে গভীর আত্মিক সম্পর্ক স্থাপন করে। এটাই সঙ্গীতের মূল দায়িত্ব।
প্রাথমিক জীবন
১৯২০ সালে ভারতের বেনারসে একটি বাঙালি ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম ওস্তাদ রবিশঙ্করের। বাবা ছিলেন লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়া উকিল। জন্মের আগেই বাবা লন্ডনে চলে যাওয়ায় আট বছর বয়সে বাবার সাথে প্রথম দেখা হয় তার। শৈশব থেকেই ছোট্ট রবির নাচ গানের প্রতি আলাদা ঝোঁক ছিল।
১৯৩০ এর দিকে মাত্র ১০ বছর বয়সেই ভাইয়ের নাচের দলের সদস্য হয়ে প্যারিসে ঘুরে আসেন তিনি। এত কম বয়সেও নাচের দলের সদস্য হিসেবে দর্শকদের মনে রাখার মতো নাচ উপহার দিয়েছিলেন। এ সময়টাতে পশ্চিমের সঙ্গীতের সাথে প্রথম পরিচয় হয় রবিশঙ্করের। এ কারণে পরবর্তী সময়ে তার সঙ্গীত রচনার ক্ষেত্রেও কিছুটা পশ্চিমা ধাঁচ দেখা গিয়েছে। ১৯৩৪ এর দিকে একটি সঙ্গীতের কর্মশালায় ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সাথে পরিচয় হয় রবিশঙ্করের। আলাউদ্দিন খাঁ অনেক বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারতেন। রবিশঙ্কর তার শিষ্য হয়ে সঙ্গীতের মূল অর্থের খোঁজ করতে লাগলেন।
সেতারের সাথে রবিশঙ্করের পরিচয় হয় ১৮ বছর বয়সে, কলকাতার এক উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের কনসার্টে। তরুণ রবি সেদিন মুগ্ধ হন অমিয়া কান্তি ভট্টাচার্যের সেতার বাজানো শুনে। তখনই তিনি ঠিক করেন, যে করেই হোক অমিয়া কান্তির গুরুর কাছেই সেতার শিখতে হবে। যে-ই ভাবা সে-ই কাজ, অমিয়া কান্তির গুরু ওস্তাদ এনায়েত খানের কাছে সেতারের হাতেখড়ি হয় রবিশঙ্করের। সে-ই যে শাস্ত্রীয় বাদ্যযন্ত্রটি নিজের করে নিলেন, মৃত্যুর আগপর্যন্ত এই সেতারকে আর হাতছাড়া করলেন না।
এনায়েত খানের কাছে কিছুদিন শেখার পর আবার আলাউদ্দিন খাঁর কাছে ফিরে আসেন রবিশঙ্কর। পরবর্তী ছয় বছর তার কাছেই সেতার নিয়ে পড়াশোনা করতে থাকেন। আলাউদ্দিন খাঁকে রবি নিজের গুরু থেকে বন্ধু সবই মানতেন। ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী গুরুকে শ্রদ্ধা করে তিনি ‘বাবা’ ডাকতেন। এই ছয়টি বছর রবিশঙ্কর একজন সাধারণ মানুষ থেকে এক অসাধারণ সেতার বাদক হয়ে ওঠেন।
সঙ্গীত জগত
সাল তখন ১৯৪৪। ওস্তাদের কাছ থেকে সেতার শিখবার পর মুম্বাইতে পাড়ি জমান রবি, যেখানে তিনি ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটারে কাজ শুরু করেন। সেখানে তার কাজ ছিলো নাচের জন্য বিশেষ সঙ্গীত রচনা করা। ২ বছর সেখানে কাজ করবার পর তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিও স্টেশনে সঙ্গীত পরিচালকের পদে যোগ দেন। এই রেডিও স্টেশনে কাজ করার সময় রবিশঙ্কর অর্কেস্ট্রার জন্য সঙ্গীত রচনা করতে শুরু করেন। সেতারসহ আরো কিছু শাস্ত্রীয় বাদ্যযন্ত্রের সাহায্যে কিছুটা পশ্চিমা ধাঁচের সঙ্গীত উল্লেখযোগ্য ছিলো এর মধ্যে। ১৯৫৪ থেকে রবিশঙ্কর বিশ্বব্যাপী কনসার্ট করতে থাকেন, যার মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশও ছিলো।
কিছু সিনেমার আবহ সঙ্গীত তৈরি করেন, যার মধ্যে সত্যজিৎ রায়ের অপু ট্রিলজিও (পথের পাঁচালী, অপরাজিত, অপুর সংসার) ছিল। ট্রিলজির এই সিনেমা তিনটির মধ্যে পথের পাঁচালী ১৯৫৫ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাম ডি’অর পায়। একই সময়ে রবি ‘ইহুদি মেনোউইন’ নামক এক আমেরিকান বেহালা বাদকের সাথে সঙ্গীত রচনা করা এবং বিভিন্ন কনসার্টে বাজানো শুরু করলেন। পরবর্তী সময়ে এই দুজনের গ্র্যামি জয়ী অ্যালবাম ‘ওয়েস্ট মিটস ইস্ট (১৯৬৭)’ সহ ‘ওয়েস্ট মিটস ইস্ট: ভলিউম টু (১৯৬৮)’ এবং ‘ইম্প্রোভাইজেশন ওয়েস্ট মিটস ইস্ট (১৯৭৬)’ নামে আরো দুটি এলবাম বের হয়। অ্যালবামগুলো পশ্চিমের সঙ্গীত জগতে রবিশঙ্করের জনপ্রিয়তা আরো বাড়িয়ে দেয়।
ষাটের দশকে পশ্চিমে ভারতীয় সঙ্গীতের বাহক হিসেবেই রবিশঙ্কর নিজেকে তৈরি করে নেন। ১৯৬৬ এর দিকে বিখ্যাত ব্যান্ড ‘দ্য বিটলস’ এর সদস্য জর্জ হ্যারিসনের সাথে পরিচয় হয় রবিশঙ্করের। দুজনেই খুব তাড়াতাড়ি বন্ধু বনে যান। জর্জ হ্যারিসনের ভারতীয় সঙ্গীতের প্রতি খুব আগ্রহ ছিলো, যে কারণে জর্জ রবিশঙ্করের কাছ থেকে সেতারের তালিম নেয়া শুরু করেন। বিটলসের ‘নরওয়েজিয়ান উডস’ নামের একটি গানে সেতার বাজান রবিশঙ্কর। জর্জ হ্যারিসনের এই সেতারপ্রীতির জন্য দ্য বিটলসের কিছু সঙ্গীতেও পরিবর্তন আসে, জন্ম নেয় ‘রাগা রক’ নামে নতুন একটি সঙ্গীত জনরা!
পরবর্তীতে হ্যারিসন রবিশঙ্করের সঙ্গীতের প্রযোজক হিসেবেও কাজ করেন। হ্যারিসনের কাছে রবিশঙ্কর ছিলেন ‘বিশ্ব সঙ্গীতের গডফাদার’। হ্যারিসন থেকে ২৩ বছরের বড় রবি নিজেদের সম্পর্ককে পিতা-পুত্রের সম্পর্ক হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন!
কনসার্ট ফর বাংলাদেশ
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের সময়ের বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) মানুষের কষ্ট, নিপীড়ন ওস্তাদ রবিশঙ্করের মন ছুঁয়ে যায়। তিনি তখনই বন্ধু জর্জ হ্যারিসনের কাছে এই মানুষদের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরেন। তারপর দুজন মিলে ঠিক করেন এসব মানুষের জন্য কিছু করা উচিত। এ ধারণা থেকেই পণ্ডিত রবিশঙ্কর এবং জর্জ হ্যারিসন ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ এর আয়োজন করেন। ইতিহাসে প্রথম কোনো যুদ্ধরত দেশের সহায়তায় বৃহৎ পরিসরে দাতব্য কনসার্ট ছিলো এটি। বিখ্যাত ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে আগস্টের ১ তারিখে এই কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয়।
রবিশঙ্কর, জর্জ হ্যারিসন ছাড়াও এরিক ক্ল্যাপটন, আলী আকবর খান এবং বব ডিলানের মতো সঙ্গীতজ্ঞরা গান গেয়েছিলেন এই কনসার্টে। জর্জ হ্যারিসন তার বিখ্যাত ‘বাংলাদেশ’ গানটি গেয়েছেন এখানেই। এই কনসার্টটির অডিও রেকর্ড করে পরবর্তীতে অ্যালবাম আকারে ছাড়া হয়। অ্যালবামটি ১৯৭৩ সালে গ্র্যামি আওয়ার্ড জিতে নেয়। অ্যালবাম থেকে প্রাপ্ত অর্থও দাতব্য কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। এই কনসার্টটি তৎকালীন সময়ে বাংলাদেশের জন্য বিরাট এক গুরুত্ব বহন করে। কনসার্ট থেকে উঠে আসা ভালো অঙ্কের অর্থ ছাড়াও পুরো বিশ্ব বাংলাদেশের ব্যাপারে জেনে যায়।
শেষ জীবন
১৯৭০ থেকে একুশ শতক পর্যন্ত ধীরে ধীরে রবিশঙ্করের অর্জন এবং জনপ্রিয়তা আরো বাড়তে থাকে। ১৯৮২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ‘গান্ধী’তে আবহ সঙ্গীতের কাজ করেন তিনি, যা আবহ সঙ্গীতের জন্য অস্কারের মনোনয়ন পায়। পরবর্তীতে তিনি ইলেক্ট্রিক সঙ্গীতের সঙ্গে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মিশ্রণ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন, যার ফলস্বরূপ ১৯৯০-এ ‘প্যাসেজেস’ নামে একটি অ্যালবাম মুক্তি দেন ফিলিপ গ্লাসের সঙ্গে। এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সারা জীবন অনেকের কাছে সমালোচনা শুনে গিয়েছেন তিনি। খাঁটি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত তৈরি করতেন না বলে নিন্দুকদের অনেক কথা শুনতে হয়েছে। কিন্তু এসব কথা তাকে দমিয়ে রাখেনি।
নিজের জীবনে বহু পুরষ্কার পেয়েছেন, যার মধ্যে তিনবার গ্র্যামি, ১৪টি সম্মানসূচক ডিগ্রিসহ অনেক কিছুই রয়েছে। নিজের শেষ অ্যালবাম বের করেছেন কন্যা আনুশকা শঙ্করের সাথে, যাকে তিনি নিজেই সেতারের তালিম দিয়েছেন। সেতারের রাজকুমার ২০১২ সালের ডিসেম্বরে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যান।
“রবিশঙ্কর-বিলায়েৎ একটি অশ্রুত যুগলবন্দি” বইটি সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন।