রবার্ট ব্লেক; ‘ইন কোল্ড ব্লাড’, ‘লস্ট হাইওয়ে’ সহ বেশ কিছু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন সাবেক এ আমেরিকান তারকা। ১৯৩৯-৪৪ সালের মধ্যে কাজ করেন প্রচুর পরিমাণ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে। আমেরিকান টিভি সিরিজেও দেখা যায় তাকে। তবে ব্লেককে সবার আলোচনায় এনে দিয়েছিল যে কাজটি সেটি তার চলচ্চিত্রের সাথে জড়িত কিছু নয়, বরং চলচ্চিত্রের বাইরে ব্যক্তিগত জীবন নিয়েই বেশি আলোচিত-সমালোচিত হয়েছিলেন এই তারকা।
চলচ্চিত্রে মারামারি কিংবা হত্যার ঘটনাগুলো খুব স্বাভাবিকভাবেই হজম করি আমরা। রবার্ট ব্লেকের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি চলচ্চিত্রের পর্দায় আটকে ছিল না। ২০০১ সালের কথা। নিজের দ্বিতীয় স্ত্রী বোনি লী বাকলির সাথে দাম্পত্যজীবন অতিবাহিত করছিলেন রবার্ট। আর ঠিক সেসময়েই মৃত্যু হয় বোনি লীর। হত্যার দায়ভার পড়ে রবার্ট ব্লেকের ঘাড়ে।
২০০১ সালের ৪ মে। রবার্ট এবং বোনিকে শেষবারের মতো দেখতে পাওয়া যায় স্টুডিও সিটির একটি রেস্টুরেন্টে। এর কিছুক্ষণ পরের কথা। বোনিকে মাথায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায় রেস্টুরেন্টের কয়েক ব্লক দূরে ভিড়িয়ে রাখা এক গাড়িতে। মাত্র ছয় মাস আগে, আগের বছরের নভেম্বর মাসে বিয়ে করেছিলেন রবার্ট এবং বোনি। তাদের ছোট্ট একটি শিশু সন্তানও ছিল। ব্লেকের কাছে তার নিজস্ব পিস্তল ছিল। তাই প্রাথমিকভাবে স্ত্রীর হত্যাকারী হিসেবে তাকেই আটক করা হয়। ব্লেক অবশ্য নিজের অপরাধ স্বীকার করতে চাননি একেবারেই। ঘটনাস্থলে তিনি গুলি করার সময় উপস্থিত ছিলেন না বলে জানিয়ে দেন। নিজের পিস্তলটিও রেস্টুরেন্টে ফেলে এসেছিলেন বলে জানান রবার্ট পুলিশকে। পরবর্তীতে অবশ্য পরীক্ষার মাধ্যমে পুলিশ বোনির মাথায় গুলি করা হয়েছে যে পিস্তল থেকে এবং রবার্ট যে পিস্তল রেস্টুরেন্টে ফেলে এসেছিলেন বলে জানান, এ দুটোকে এক বলে শনাক্ত করে। ফলে পাকাপাকি অভিযোগ আনা হয় রবার্টের উপরে। সেসময় বোনি এবং রবার্টের সম্পর্কও যে খুব ভালো চলছিল তা নয়। ফলে রবার্টকে দোষী বলে সন্দেহ করে পুলিশ। তাকে আটক করা হয়। পরবর্তীতে আদালতে মামলা চলাকালীন সময়ে মৃত বোনির উপরেও আসে বেশ কিছু অভিযোগ।
রবার্ট ব্লেকের আইনজীবী আদালতকে জানান যে, বোনি কেবল ব্লেক নয়, নিজের নগ্ন ছবি পাঠিয়ে অনেক ধনীকেই ফাঁসানোর চেষ্টা করেন এবং কিছু ক্ষেত্রে সফলও হন। এই ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে ব্লেক একজন- এমনটাই দাবি করা হয়। ২০০০ সালে জন্ম নেওয়া ব্লেক এবং বোনির সন্তান রোজি যে ব্লেকের সন্তান নয়, বরং তারকা মারলোন ব্র্যান্ডোর ছেলে ক্রিস্টিয়ান ব্র্যান্ডোর, সেটা নিয়ে বেশ শোরগোল হয়। কিন্তু ডিএনএ টেস্টে সত্য কথা বেরিয়ে আসে এবং রোজি যে রবার্ট ব্লেকের সন্তান সেটাও জানতে পারা যায়।
প্রাথমিকভাবে খুনী না হওয়া এবং ব্ল্যাকমেইল হওয়ার যে দুটো অজুহাত দেওয়া হয় রবার্ট ব্লেকের পক্ষ থেকে, তার কোনোটাই সফল হয়নি। ফলে তার নিজের বিরুদ্ধেই সমস্ত ব্যাপারটি চলে যেতে থাকে। তবে তখনই প্রতিপক্ষ কোনো সরাসরি প্রমাণ দেখাতে পারেনি এ ব্যাপারে। দুজন বডি ডাবলকে আনা হয় আদালতে। তাদের দুজনকে অর্থের বিনিময়ে বোনি লীকে খুন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল এমন অভিযোগ জানানো হয়। ম্যাকলার্টি নামক একজন জানান, ঘটনার প্রায় চার মাস আগে রবার্ট ব্লেক জানান যে, নিজের স্ত্রীর প্রতি তিনি বিরক্ত হয়ে পড়েছেন এবং তাকে সরিয়ে ফেলতে চান। এ কাজের জন্য ১০,০০০ মার্কিন ডলার দেয়ার আগ্রহও প্রকাশ করেন রবার্ট। তবে সেটাও তখন প্রমাণ করা যায় নি।
ম্যাকলার্টি প্রচুর পরিমাণে কোকেন গ্রহন করতেন এবং দৃষ্টিভ্রম হওয়ার সমস্যা তার আগে থেকেই ছিল। এছাড়াও এ ঘটনার সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য হাম্বলটন নামক আরেকজন সাক্ষীকে হাজির করা হয় আদালতে। তিনি অকপটে জানান যে, ব্লেক তাকে খুন করতে নির্দেশ দেন এবং কয়েকবার ব্যাপারটিকে এড়িয়ে গেলেও পরবর্তীতে সন্তান রোজের ভালো ভবিষ্যতের কথা ভেবে এ কাজে রাজী হয়ে যান হাম্বলটন। অবশ্য তিনি মেথাঅ্যাম্ফেটামিন ব্যবহারকারী হওয়ায় তার সমস্ত বক্তব্যও আদালত আমলে নিতে চায়নি। ব্লেকের আইনজীবী পরিষ্কারভাবে দেখিয়ে দেন যে, হাম্বলটন প্রথম পুলিশী জেরায় সমস্ত কথা স্বীকার করতে অস্বীকার করলেও পরবর্তীতে হত্যা সংক্রান্ত সমস্ত কথা বলেন তিনি। বাস্তব কোনো অভিজ্ঞতার আলোকে নয়, বরং পত্রিকায় পড়ে এ সমস্ত ঘটনা বানিয়েছেন হাম্বলটন- এমনটাই দাবী করা হয়। খুনের ঘটনাটির সাথে জড়িত কোনো হাতের ছাপ, রক্তের দাগ কিংবা সংশ্লিষ্ট কিছু না পাওয়ায় সরাসরি ব্লেকের প্রতি আঙুল তোলা সম্ভব হচ্ছিল না। ব্লেকের হাতে গান পাউডার পাওয়া গেলেও সেটি যে তার নিজস্ব বন্দুক থেকেই আসেনি, বরং স্ত্রীকে খুনের ফলেই এসেছে, সেটা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিল আদালত।
আদালত এবং সবাই বোনির হত্যা নয়, বরং রবার্ট ব্লেকের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে বেশি আগ্রহী- এমনটাই মনে করছিলেন বিশেষজ্ঞরা। এমনকি রেস্টুরেন্টে থাকাকালীন সময়ে ব্লেক এবং বোনির মধ্যে কোনো সমস্যা চলছিল এমনটাও কেউ সাক্ষ্য দেয়নি। বোনি হত্যাকান্ডে ব্লেকের সাথে তার দীর্ঘদিনের দেহরক্ষী আর্ল কোল্ডওয়ালকেও আটক করা হয়। মনে করা হয়, এ পুরো ব্যাপারটিতে দেহরক্ষীরও কোনোরকম সম্পর্ক আছে।
২০০২ সালের এপ্রিলে রবার্ট ব্লেককে মোট দুটো কারণে দায়ী করা হয়। একদিকে তার বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ ছিল। আর অপরদিকে ছিল অন্যদেরকে হত্যা করানোর জন্য নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগ। আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করেন ব্লেক ও তার দেহরক্ষী কার্ল। প্রায় ১ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে ব্লেক নিজের দেহরক্ষীকে জামিন পাইয়ে দিতে সক্ষম হন। তবে সেসময় তার জামিন দিতে বিচারক সম্মত হননি। প্রায় ১ বছর হাজতবাসের পর ১.৫ মিলিয়ন ডলার জামিনের মাধ্যমে জেলের বাইরে বের হন ব্লেক। তবে পুরোটা সময় নজরদারীতে রাখা হয় তাকে। হত্যার নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগ সঙ্গত কারণেই একটা সময় সমাপ্ত হয়ে যায় কোনোরকম সমস্যা ছাড়া। তবে ২০০৪ সালে শুরু হয় হত্যার মামলা। একদিকে রবার্ট ব্লেকের আইনজীবী বলেন ব্লেক হত্যা করেননি, অন্যদিকে প্রতিপক্ষ জানায়, এই বিয়ের সম্পর্ক থেকে সরে যেতেই বোনিকে হত্যা করেন ব্লেক। হত্যাকান্ডের সময় বোনির মাথায় পরপর দুবার গুলি চালানো হয়। আর সেসময় তার পাশের জানালা অর্ধেক খোলা ছিল। প্রতিপক্ষ জানায়, অপরিচিত কেউ হলে বোনি লী কেন জানালা এভাবে খুলে রাখবেন? রবার্ট ব্লেকের আইনজীবীরা অবশ্য বোনি লীর যে কম শত্রু ছিল না তা জানিয়ে দেয় প্রতিপক্ষকে।
২০০৫ সালের নভেম্বর; অবশেষে আদালতে প্রমাণিত হয় যে, রবার্ট ব্লেক তার দ্বিতীয় স্ত্রী বোনি লীর খুনী নন। এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায় সবার মধ্যে। ক্যালিফোর্নিয়ার সামরিক আদালত অবশ্য ব্লেককে দায়ী করে বোনি লী বাকলির সন্তান রোজিকে ৩০ মিলিয়ন ডলার দেওয়ার নির্দেশ দেয়। টানা আট মাস ধরে বিচারকাজ চলার পর এই ফলাফল জানানো হয়। পরবর্তীতে এই পরিমাণ কমে ১৫ মিলিয়ন ডলারে নামিয়ে আনা হয়। রবার্ট ব্লেকের বড় সন্তান ডেলেনার উপরে রোজিকে দেখে রাখার দায়িত্ব দেয়া হয়। সবকিছু ঠিক থাকলে কিছুদিনের মধ্যেই তৃতীয়বারের মতো বিয়ের পিঁড়িতে বসতে যাচ্ছেন ৮৪ বছর বয়সী রবার্ট ব্লেক- এমনটাই গুজব ছড়িয়েছে। যদিও এই কথাগুলোকে নিছকই গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছেন এই তারকা।
ফিচার ইমেজ: CBS News