রবিন ঘোষ: পাকিস্তানে সম্মানিত, বাংলাদেশে ব্রাত্য এক সুরের জাদুকর

‘আয়নাতে ওই মুখ দেখবে যখন’, ‘পিচঢালা এই পথটারে ভালোবেসেছি’, ‘আমি রূপনগরের রাজকন্যা’, ‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো’, ‘ফুলের কানে ভ্রমর এসে’–বাংলা সিনেমার হারানো দিনের কালজয়ী এই গানগুলো কে না শুনেছেন! এ দেশীয় চলচ্চিত্রের একেকটি অমূল্য সম্পদ যেন এই গানগুলো। কিন্তু গানগুলোর কারিগর যে মানুষটি, তাকে সম্ভবত অনেকেই চেনেন না। তিনি রবিন ঘোষ।

বাংলাদেশিরা এই অসামান্য প্রতিভাধর মানুষটিকে তেমন একটা না চিনলেও, পাকিস্তানিরা কিন্তু জীবদ্দশায় তাকে মাথায় করে রাখত। সে দেশের সংবাদমাধ্যম তো তাকে ভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক আর ডি বর্মণের সাথেই তুলনা করে। কেউ কেউ আবার আখ্যায়িত করে ‘পাকিস্তানের নওশাদ’ হিসেবেও। আর করবে না-ই বা কেন! তিনি যে দীর্ঘদিন ধরে তার সুরের জাদুতে মাতিয়ে রেখেছিলেন পাকিস্তানের চলচ্চিত্র জগতকে।

রবিন ঘোষের উল্লেখ করার মতো পরিচয় রয়েছে আরো। প্রথমত, বিখ্যাত অভিনেত্রী শবনম ছিলেন তারই সহধর্মিণী। ২০১২ সালে পাকিস্তান টেলিভিশনের ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে এই দম্পতিকে দেয়া হয় লাল গালিচা সংবর্ধনা। তাদের হাতে আজীবন সম্মাননা তুলে দেন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি। দ্বিতীয়ত, তার বড় ভাই অশোক ঘোষও ছিলেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের নামকরা পরিচালক।

স্ত্রী শবনমের সাথে রবিন ঘোষ; Image Source: somewhereinblog

রবিন ঘোষের জন্ম ১৯৩৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর, ইরাকের বাগদাদে। তার বাবা এস এম ঘোষ ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী, এবং কাজ করতেন ইন্টারন্যাশনাল রেড ক্রসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে তার পোস্টিং ছিল বাগদাদে। সেখানকার কনভেন্ট স্কুলেই শিক্ষাজীবন শুরু হয় রবিনের। তিনি ছিলেন খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী, কেননা তার মা আসনাত জিয়া ঘোষও ছিলেন একজন বাগদাদি ক্যাথলিক খ্রিস্টান। 

১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ছয় বছর বয়সী রবিনকে সপরিবারে চলে আসতে হয় ঢাকায়। সেটি তখন অবিভক্ত ভারতবর্ষের অংশ। কিন্তু কিছুদিন পরই তার বাবা তাদেরকে ফেলে চলে যান, বিয়ে করেন অন্য এক নারীকে। সেই থেকে পুরান ঢাকার ওয়ারীতে মায়ের কাছেই বড় হন রবিন।

ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীতের প্রতি রবিনের ছিল অদম্য আগ্রহ ও কৌতূহল। চার্চে নিয়মিত যাতায়াত ছিল তার, এবং সমবেত সঙ্গীতের সাথে ছিল ভালোই পরিচয়। এছাড়া তিনি গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রহ করতেন। নিজে হারমোনিয়াম বাজিয়ে সেসব গান গাইতেন ও সুর তুলতেন। পরবর্তীতে ঢাকার সেগুনবাগিচায় মিউজিক কলেজে তিনি শিক্ষাগ্রহণ এবং সংগীত বিষয়ে গ্র্যাজুয়েশন করেন।

প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা শেষে পঞ্চাশের দশকে রবিন এক বন্ধুর মাধ্যমে চাকরির প্রস্তাব পান ঢাকা রেডিও স্টেশনে। ওই বন্ধুর বোন ঝর্ণা বসাক তখন বাংলা চলচ্চিত্রে টুকটাক অভিনয় করতেন। ঝর্ণা বসাকই পরবর্তীকালে পরিচিতি পান বিখ্যাত অভিনেত্রী শবনম হিসেবে। বন্ধুর সূত্রে শবনমের সাথে রবিনের পরিচয় ও হৃদয়ের দেয়া-নেয়া হয়, এবং দুই পরিবারের সম্মতিক্রমে তারা ১৯৬৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

যা-ই হোক, পঞ্চাশের দশকে রবিন যখন রেডিওতে যোগ দেন, তখন দেশভাগের পর ঢাকা রেডিও স্টেশন সদ্যই নতুন করে গড়ে উঠতে শুরু করেছে। সেখানে কাজ করতেন লেখক শামসুদ্দিন আবুল কালামসহ অনেক গুণী ব্যক্তি। এখানেই রবিনের সাথে যোগাযোগ ঘটে বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা এহতেশামের। ফলে চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনার সুযোগ এসে যায় তার সামনে।

‘বন্ধন’ ছবির সেঁটে রবিন; Image Source: The Wall

১৯৬১ সালে এহতেশাম পরিচালিত ‘রাজধানীর বুকে’ ছবিতে কাজ করেন রবিন। ছবিটি বাণিজ্যিকভাবে বেশ সফল হয়। তাছাড়া এই ছবিতেই ছিল ‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো’ গানটি। কে জি মোস্তফার লেখা, তালাত মাহমুদের কণ্ঠে গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এরপর থেকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি রবিনকে। একের পর এক বাংলা ও উর্দু ছবিতে কাজের প্রস্তাব পেতে থাকেন তিনি, এবং সেগুলো লুফেও নেন।

‘তালাশ’, ‘চকোরি’, ‘হারানো দিন’, ‘পিচ ঢালা পথ’, ‘নতুন সুর’, ‘নাচের পুতুল’ ইত্যাদি ছবির গানে সুর দেন তিনি। তার সুরে ফেরদৌসী রহমান, মাহমুদুন নবী, আবদুল জব্বার, তালাত মাহমুদসহ তৎকালীন জনপ্রিয় সব শিল্পীরা কণ্ঠ দেন। এরই মধ্যে ‘তালাশ’ ছবির জন্য ১৯৬৩ সালে প্রথমবারের মতো নিগার অ্যাওয়ার্ড পেয়ে যান তিনি। ১৯৬৭ সালে ‘চকোরি’ ছবির জন্যও পান। এটি ভারতের ফিল্মফেয়ারের সমতুল্য পুরস্কার। 

বাণিজ্যিক সফলতার মুখ দেখা ‘চান্দা’, ‘তালাশ’, ‘প্যায়সা’, ‘ভাইয়া’, ‘তুম মেরে হো’ ইত্যাদি জনপ্রিয় উর্দু ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করতে থাকেন তিনি। এদিকে উর্দু ছবির জনপ্রিয় নায়িকা হওয়ার সুবাদে পাকিস্তানে শবনমের তৈরি হয় দারুণ জমজমাট এক ক্যারিয়ার। তাই ১৯৬৮ সালে ‘তুম মেরে হো’ ছবিটি মুক্তির পর রবিন স্ত্রীর সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে চলে যান। সেখানে থেকেই কাজ করতে থাকেন উর্দু ছবিতে।

১৯৭৭ সালের ‘আয়না’ ছবিতে তিনি সঙ্গীত পরিচালনা করেন। এ ছবিটি ছিল পাকিস্তান চলচ্চিত্র ইতিহাসের প্রথম প্ল্যাটিনাম জুবিলি ছবি। আর এমন সাফল্যের পেছনে বড়সড় অবদান ছিল রবিনেরই। আজও পাকিস্তানের অনেক গণমাধ্যম দেশটির সেরা সঙ্গীতনির্ভর ছবির তালিকায় এক নম্বরে রাখে একে। গজল সম্রাট মেহেদী হাসানের কণ্ঠে এ ছবির ‘মুঝে দিলসে না ভুলানা’ এবং ‘ওয়াদা করো সাজনা’ এখনও পাকিস্তানের আপামর জনগণের মুখে মুখে ফেরে।

‘আয়না’ ছবির রেকর্ড হাতে রবিন ঘোষ; Image Source: The Wall

সব মিলিয়ে প্রায় একশোর বেশি হিট উর্দু ছবিতে সুর দিয়েছেন রবিন। এর মধ্যে পূর্বোল্লিখিত ছবিগুলোর পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য আরো রয়েছে ‘এহসাস’, ‘চাহাত’, ‘বন্দিশ’, ‘দুরিয়া’, ‘নাহি আভি নাহি’ ইত্যাদি। উর্দুতে তার সুর করা সেরা গানগুলোর তালিকা করতে বসলে আসবে ‘কাভি তো তুমকো ইয়াদ আয়েগি’, ‘হামে খোকর বহত পচতাওগে’, ‘সাওন আয়ে’, ‘পেয়ার ভারে দো শর্মিলে নয়ন’, ‘দেখো ইয়ে কোন আগায়া’, ‘মিলে দো সাথী’, ‘সোনা না চান্দি না কোই মহল’, ‘শাম্মা, উয়ো খোয়াব সা শাম্মা’ ইত্যাদির নাম।

রবিনের গানগুলোর সুরগুলো যেন ছিল সিরাপের মতো মিষ্টি। তাই পাকিস্তানে তার নামই হয়ে গিয়েছিল ‘সিরাপি’। ‘তালাশ’ ও ‘চকোরি’-র পর ‘চাহাত’ (১৯৭৪), ‘আয়না’ (১৯৭৭), ‘আম্বার’ (১৯৭৮) এবং ‘দুরিয়া’ (১৯৮৪) ছবিগুলোর জন্যও তিনি শ্রেষ্ঠ সুরকার হিসেবে নিগার অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। সব মিলিয়ে ছয়বার তিনি এই পুুরস্কার জেতেন।

আশির দশকে ফের স্ত্রীর সাথে ঢাকায় আসতে থাকেন রবিন, দিতে থাকেন বাংলা ছবিতে সুর। কিন্তু পাকিস্তানি ছবির চাপে খুব বেশি বাংলা ছবিতে কাজ করা হতো না তার। তবুও ১৯৮৭ সালে ‘আপোষ’ ছবিতে ‘ও আমার প্রাণেরও সুজন’ গানের মাধ্যমে ফের বাঙালিকে সুরের মূর্ছনায় বিমোহিত করেন তিনি। জীবনে শেষবারের মতো সঙ্গীত পরিচালনাও তিনি করেন বাংলা ছবিতেই, ১৯৯২ সালের ‘আমার সংসার’-এ।

১৯৯৮ সালে রবিন স্থায়ীভাবে ফিরে আসেন ঢাকায়, থাকতে শুরু করেন গুলশানের বাড়িতে। স্ত্রী শবনম ও পুত্র রনি ঘোষকে নিয়ে তার ছিল একান্ত সুখের সংসার। কিন্তু আর কাজ করতেন না তিনি। কেন কাজ করছেন না, এ প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন,

“গানের ধরন পাল্টেছে। নতুন সংগীতকার ও শিল্পী এসেছে। তারা ভালো করছে। দীর্ঘদিন কাজ করলাম, দর্শকশ্রোতার অফুরন্ত ভালোবাসা পেলাম। এখন বয়স হয়েছে। শরীরটা খুব ভালো যাচ্ছে না। তাই কোথাও তেমন বের হই না। বাসায় টিভি দেখে, গান শুনে আর পত্রিকা পড়ে সময় কাটে।”

স্ত্রীর সাথে শেষ বয়সে রবিন ঘোষ; Image Source: Dawn

কিন্তু একটি কথা পরিষ্কার যে তার বুকভরা ছিল অভিমান। কেননা পাকিস্তানে যে সম্মান তিনি পেয়েছেন, তার ছিটেফোঁটাও পাননি বাংলাদেশে। তাছাড়া এমন একটা সময়ে তিনি ঢাকায় ফেরেন, যখন দেশের সঙ্গীতজগতে চলছে নকল গানের হিড়িক। নতুন যুগের পরিচালকরাও অধিকাংশই ছিলেন তার অপরিচিত। তাই তিনি আর যেচে কারো কাছে যাননি। কেউ ভালো কোনো প্রস্তাব নিয়েও তার কাছে আসেননি। ফলে একপ্রকার অভিমান নিয়েই দূরে থাকেন তিনি।

অভিমানের মাত্রা যে ঠিক কতটা ছিল, তা-ও বোঝা যায় তার মৃত্যুর পর। রবিন ২০১৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি, পহেলা ফাল্গুন গুলশানের কিউর মেডিক্যাল সেন্টারে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি ভুগছিলেন ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনিয়া ও হৃদরোগে। কিন্তু মৃত্যুর পর তার মরদেহ বিএফডিসিতে নেয়া যায়নি। এমনটিই নাকি ছিল তার শেষ ইচ্ছা। ওয়ারীস্থ খ্রিস্টান কবরস্থানে সমাহিত করা হয় তাকে।

বরেণ্য সঙ্গীত শিল্পী ফেরদৌসী রহমান বলেন,

“রবিন ঘোষ চমৎকার মেজাজের অত্যন্ত ভদ্র একজন মানুষ ছিল। পাকিস্তানে তো ইতিহাস সৃষ্টি করে এসেছেন। সেখানে যথেষ্ট সম্মানও পেয়েছেন। কিন্তু এদেশ তাকে কোনোই কাজে লাগাতে পারেনি। তার মতো একজন গুণী, দক্ষ সংগীত পরিচালককে এদেশ যথাযথভাবে সম্মানও জানাতে পারেনি, কাজেও লাগাতে পারেনি। এটা সত্যিই আমার খুব দুঃখ থেকে বলা।”

বুকভরা অভিমান নিয়ে চলে গেছেন রবিন ঘোষ; Image Source: Dawn

আরেক কিংবদন্তী শাহনাজ রহমতুল্লাহ বলেন,

“রবিন ঘোষ ছিলেন একজন কিংবদন্তি, একজন সুরের জাদুকর। তিনি চলে গেছেন। প্রচণ্ড অভিমান নিয়েই চলে গেলেন। আমরা তাকে সম্মান দিতে পারিনি। এ যে কত কষ্টের, কত লজ্জার তা বলে বুঝাতে পারবো না। দুঃখ হয় এই যে কেউ তার কোনো খোঁজখবরও নিত না, কোথাও কোনো অনুষ্ঠানে ডাকা হতো না। তাকে সত্যিই আমরা মূল্যায়ন করতে পারিনি।”

মানুষ হিসেবেও রবিন ছিলেন অতুলনীয়। তাই তো তার আরেক পরিচিতি ‘সাদা মনের মানুষ’ হিসেবে। এক সাক্ষাৎকারে শবনম বলেন, স্বামী হিসেবে তাকে খুব ভালো বুঝতেন রবিন, তার অনেক যত্ন নিতেন। কখনও তার চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারে নাক গলাতেন না। কাজ শেষে বাড়ি ফিরতে দেরি হলে এ প্রসঙ্গে কখনো কোনো প্রশ্নও করতেন না।

রবিন ঘোষ নামের সঙ্গীত সাধককে শেষ বয়সে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন কিংবা মূল্যায়ন করা হয়নি, এ কথা সত্যি। কিন্তু তার সৃষ্ট গানগুলোকে কি কেউ কখনো মুছে ফেলতে পারবে? একদমই না। নিজের গানগুলোর মধ্য দিয়েই তিনি বেঁচে থাকবেন চিরকাল।

রবিন ঘোষ এর বই সমূহ দেখতে ক্লিক করুন লিংকে

This article is in Bengali language. It is about the legendary music director Robin Ghosh. Necessary references have been hyperlinked inside.

Featured Image © Dawn

Related Articles

Exit mobile version