ভারতের হায়দ্রাবাদ থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিলো, একইসঙ্গে প্রতিশ্রুতিশীল ও সাদামাটা এক যাত্রা। ২৫ বছর পার হয়ে গেছে। যাত্রা এসে থেমেছে সিলিকন ভ্যালিতে, মাইক্রোসফটের সদর দপ্তরে। ততদিনে ‘যাত্রা’র আগে ‘জয়’ শব্দটি বসিয়ে দেবার সব আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠানের একটিতে সাধারণ চাকুরে হিসেবে ঢোকা ব্যক্তিটি আজ প্রতিষ্ঠানের সিইও। কোনো ম্যাজিক নয়, দীর্ঘ ২২টি বছর নিজেকে প্রতিটি ধাপে প্রমাণ করে করে মেধা ও অধ্যবসায়ের গুণেই মাইক্রোসফটের প্রধানের নামটি আজ সত্য নাদেলা। অনুপ্রেরণার অপার আধার এই কৃতির জীবনীই আজ থাকছে লেখায়।
বেড়ে ওঠা: জয়যাত্রার ভারত পর্ব
সত্য নাদেলার পুরো নাম সত্যনারায়ণ নাদেলা। জন্ম ১৯৬৭ সালের ১৯ আগস্ট ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের হায়দ্রাবাদের এক তেলুগু ব্রাহ্মণ পরিবারে। তার বাবা বুক্কাপুরাম নাদেলা যুগন্ধর ভারতীয় সরকারী প্রশাসনিক (IAS) কর্মকর্তা ছিলেন। ২০০৪ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত তিনি ছিলেন কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের একজন সদস্য। অন্যদিকে, মা প্রভাবতী যুগন্ধর। শহরের বেগম্পটে অবস্থিত হায়দ্রাবাদ পাবলিক স্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ১৯৮৪ সালে নাদেলা ভর্তি হন ম্যাঙ্গালোর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীভূক্ত কর্নাটক তথা দক্ষিণ ভারতের অন্যতম সেরা প্রযুক্তি ও প্রকৌশল বিদ্যাপীঠ মনিপাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে। আজন্ম কম্পিউটার প্রকৌশলকে ভালোবাসা নাদেলা সেখানে তড়িৎ প্রকৌশল নিয়েছিলেন খানিকটা বাধ্য হয়েই, কেননা কম্পিউটার প্রকৌশলে পড়ার সুযোগ সেখানে তখন ছিলো না।
উচ্চশিক্ষার নতুন স্বপ্ন: জয়যাত্রার যুক্তরাষ্ট্র পর্ব
১৯৮৮ সালে স্নাতক সম্পন্ন হবার পর তিনি ভাবলেন, উচ্চশিক্ষার্থে পাড়ি জমাবেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। যেই ভাবা সেই কাজ। সেই বছরেই ভর্তি হয়ে গেলেন আমেরিকার খ্যাতনামা উইসকনসিন-মিলওয়াকী বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং যথারীতি ভর্তি হলেন তার প্রথম প্রেম কম্পিউটার বিজ্ঞানেই। ১৯৯০ সালে সেখান থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করবার পর তিনি প্রকৌশল চাকুরিতে যোগ না দিয়ে সাজালেন আরো বিস্তৃত পরিকল্পনা। ক্যারিয়ার নিয়ে উচ্চাভিলাষী নাদেলা আমেরিকা আসার পর থেকেই স্বপ্ন দেখছিলেন কর্পোরেট জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করবার। প্রযুক্তিনির্ভর কর্পোরেট এ জগতে টিকে থাকতে হলে প্রকৌশল বিদ্যার সাথে সাথে ব্যবসার জ্ঞানটাও জরুরী। সেই চিন্তা থেকেই তিনি চাইলেন এমবিএ করতে।
সুযোগের পেছনে মেধাবীকে দৌড়াতে হয় না, বরং সুযোগই মেধাবীর হাতে এসে ধরা দেয়- কথাটি বাস্তব হলো নাদেলার ক্ষেত্রে যখন তিনি সুযোগ পেলেন আমেরিকার সেরা বিজনেস স্কুলের একটিতে। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিখ্যাত বুথ স্কুল অব বিজনেস থেকে এমবিএ শেষ করে চাকরিযুদ্ধে নামার আগে বেশ ভারী রকমের একটি প্রোফাইল তৈরি করে ফেললেন।
প্রথম খেলেই বাজিমাত
কথায় বলে, ‘মর্নিং শৌজ দ্য ডে’। এজন্য ওস্তাদ নাদেলা মারটা শেষ রাতের জন্য উঠিয়ে না রেখে সকাল সকালই দিয়ে দিলেন! প্রথমেই তিনি চাকরি পেয়ে গেলেন বিখ্যাত সান-মাইক্রোসিস্টেমে। সেখানে অবশ্য বেশি দিন স্থায়ী হননি নাদেলা, হবেনই বা কেন, পরবর্তী সুযোগটি যে সিলিকন ভ্যালিতে! সেই সিলিকন ভ্যালি, যা কিনা প্রযুক্তিনির্ভর কর্পোরেট দুনিয়ার প্রাণকেন্দ্র। সেখানে চাকরির সুযোগ কে-ই বা হাতছাড়া করবে! নাদেলাও লুফে নিলেন, সালটা ১৯৯২। বলা বাহুল্য, চাকরিটা তাকে দিয়েছিলো – মাইক্রোসফট।
প্রাথমিকভাবে তিনি সেখানে উইন্ডোজ এনটি এর বৈশিষ্ট্য উন্নয়ন নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন, যা ছিলো মূলত একটি ব্যবসায়ী-বান্ধব প্রজেক্ট। সেখানকার কর্মদক্ষতায় ধীরে ধীরে পদের নানান সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে থাকেন নাদেলা। ১৯৯৯ সালে তিনি মাইক্রোসফটের ‘বি-সেন্ট্রাল স্মল বিজনেস সার্ভিস’ বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট হন। ঠিক তার দুই বছরের মাথায় তিনি হয়ে গেলেন মাইক্রোসফট বিজনেস সলিউশনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট।
বিপ্লবের নাম ক্লাউড কম্পিউটিং
যত উপরের পদ, তত দিক বদলকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা মত প্রদানের স্বাধীনতা! সেই স্বাধীনতার উপযুক্ত ব্যবহার নাদেলা তার আরো কিছু সহকর্মীকে নিয়ে করেছিলেন বটে। তাদের ভাবনা-চিন্তা থেকেই মাইক্রোসফট নিজেদের ক্লাউড কম্পিউটিং ব্যবস্থা গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়। এ সিদ্ধান্ত ও তদনুযায়ী কাজের ফলাফলই ছিলো মাইক্রোসফট অ্যাজিউর, যা বিশ্বের সবথেকে বড় ক্লাউড ভিত্তিক ব্যবস্থা।
২০০৭ সালে তিনি মাইক্রোসফটের অনলাইন সার্ভিসের গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগদান করেন। চার বছর সেখানে দায়িত্ব পালনের পর ২০১১ সালে মাইক্রোসফটের সার্ভার ও টুল বিজনেস বিভাগের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি দায়িত্ব নেবার পর মাইক্রোসফটের মোট তহবিলে সবচেয়ে বেশি রাজস্বদায়ী খাত হিসেবে পরিণত হয় এই বিভাগ, যার পরিমাণ বাৎসরিক প্রায় ১৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৩ অবধি সেই দায়িত্ব সফলভাবে পালন করেন নাদেলা।
এরপর নাদেলা কোম্পানির ক্লাউড কম্পিউটিং প্ল্যাটফর্মের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন। সত্য নাদেলাকে এই জায়গাটিতেই সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব দেওয়া হয় যে, তিনি অনেকটা একা হাতে মাইক্রোসফট অনলাইন সার্ভিসে ক্লাউড ওএস স্ট্র্যাটেজি গড়ে তুলেছেন। এই ক্লাউড সিস্টেম বিং, স্কাইড্রাইভ, এক্সবক্স লাইভ ব্রডব্যান্ড গেমিং নেটওয়ার্ক, উইন্ডোজ সার্ভার, অফিস থ্রিসিক্সটি ফাইভ, ভিজুয়াল স্টুডিও সহ বিভিন্ন মাইক্রোসফট সেবার অবকাঠামো তৈরি ও চালুকরণে মূল ভূমিকা রেখেছিলো। সেই সাথে এমএস-এসকিউএল সার্ভারের মতো মাইক্রোসফটের বেশ কিছু প্রজেক্ট ও অ্যাজিউরে কিছু টুল যোগ করবার কাজ তিনিই এগিয়ে নেন।
অবশেষে
বিশাল কর্মদক্ষতা ও দূরদর্শীতার গুণে তিনি আর দুই বছরের মধ্যেই মাইক্রোসফটের শীর্ষ পর্যায়ের নীতি-নির্ধারকদের সবচেয়ে আস্থাভাজন ব্যক্তিতে পরিণত হলেন। তারা ধরে নিলেন, এই নাদেলা তাদের কাঙ্ক্ষিত মানুষটি, যিনি দায়িত্ব পেলে খুব বেশি খবরদারি ফলিয়ে মাইক্রোসফটের অগ্রযাত্রায় কোনো বিঘ্ন তৈরি করবেন না; বরং একই পথেই এগিয়ে যাবেন। আস্থার প্রতিদান স্বরূপ ও ২২ বছরের কর্মনিষ্ঠার স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি তিনি মাইক্রোসফটের সিইও মনোনীত হন। উল্লেখ্য, সহ-প্রতিষ্ঠাতা বিল গিটস ও স্টিভ বলমারের পর মাইক্রোসফটের ৪০ বছরের দীর্ঘ ইতিহাসে তিনি তৃতীয় সিইও। বিল গেটসের এতটাই প্রিয় নাদেলা যে, গেটস স্বয়ং অবসর ভেঙে সাময়িক সময়ের জন্য মাইক্রোসফটে ফিরেছিলেন সত্য নাদেলার পরামর্শদাতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে।
নতুন সিইও’র নতুন চ্যালেঞ্জ
সিইও হয়েই তাকে একটি বিশাল চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হয়েছিলো। ৭.২ বিলিয়ন ডলারে নোকিয়া কর্পোরেশনের মোবাইল ফোন ব্যবসা কার্যক্রম অধিগ্রহণ সম্পন্নের পুরো প্রক্রিয়া তদারকের দায়িত্ব ছিলো তার! ২০১৪ সালের এপ্রিলে সেই কাজ সম্পন্ন হলে মাইক্রোসফটের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ছাঁটাইকর্ম সংঘটিত হয়। প্রায় ১৮,০০০ পদধারী কর্মী হন চাকরিচ্যুত, যাদের অধিকাংশই এসেছিলেন নোকিয়া হতে। এরপর ২০১৬ সালে মাইক্রোসফট কর্তৃক ব্যবসায় ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম লিঙ্কড ইনের অধিগ্রহণও তদারক করেছেন তিনি।
বিশাল এক কর্মীদলকে ছাঁটাই করায় সমালোচিত হতে গিয়েও বেঁচে গিয়েছিলেন নাদেলা, কারণ তা আখেরে কোম্পানির স্বার্থেই ছিলো। কিন্তু এত বড় পদে আসীন, আর বিতর্ক একবারও ছোঁবে না, তা কী করে হয়! সত্য নাদেলাকেও তাই অনলাইনে বেশ সমালোচিত হতে হয়েছিলো নারী কর্মীদের প্রতি ‘পক্ষপাতমূলক আচরণ’ ও ‘অনায্য বেতন বৃদ্ধির’ অভিযোগে।
আয়ের যত অঙ্ক
সিইও হিসেবে দায়িত্ব নেবার প্রথম বছরটিতে বিশেষ প্যাকেজ হিসেবে তিনি আয় করেছিলেন ৮৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় ৭০ কোটি বাংলাদেশী টাকা। তার বর্তমান বাৎসরিক আয় ২০,০১৪,১৫২ মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ১৬৬ কোটি ৯০ লক্ষের সমতুল্য। এই আয়ের মধ্যে তার মূল মাসিক বেতনের পরিমাণ ১৪,৫০,০০০ মার্কিন ডলার (১২ কোটি ৯০ লক্ষ বাংলাদেশী টাকা)। মাসিক বেতনের বাইরে তিনি বোনাসই পান মূল বেতনের প্রায় ৭ গুণ, স্পষ্ট করে বলতে গেলে, ডলারের অঙ্কে তা ৭,০৩২,৪০৬ (১৫৪ কোটি বাংলাদেশী টাকা)। তার জন্য তহবিল হিসেবে জমার পরিমাণ ১১,৪৩৪,৫৫৭ মার্কিন ডলার (৯৫ কোটি ৪০ লক্ষ বাংলাদেশী টাকা) ও আনুষঙ্গিক ভাতার পরিমাণ ৯৭,১৮৯ মার্কিন ডলার (৮১ লক্ষ বাংলাদেশী টাকা)। তার সর্বমোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৮০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (৬৬৭ কোটি বাংলাদেশী টাকা)।
পেশার বাইরের নাদেলা
তের বছর বয়সে হায়দ্রাবাদের স্কুলে নাদেলার পরিচয় হয়েছিলো অনুপমা নামের এক মেয়ের সঙ্গে। পরবর্তীতে জানা গেলো, অনুপমা তার বাবার সহপাঠী ভেনুগোপালের মেয়ে। সেই থেকে কৈশোরের প্রেমের যাত্রা শুরু। দীর্ঘ বছর দশেকের প্রেম শেষে ১৯৯২ সালে মাইক্রোসফটে যোগ দিয়েই সত্য নাদেলা অনুপমাকে বিয়ে করেন।
দুই কন্যা ও এক পুত্র নিয়ে এখন নাদেলার পরিবার ওয়াশিংটনের বেলভিউয়ের স্থায়ী বাসিন্দা। সত্য নাদেলা বর্তমানে জাতীয়তায় একজন আমেরিকান। যেহেতু ভারতে দ্বৈত নাগরিকত্বের বিধান নেই। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী হতে গিয়ে তাকে খোয়াতে হয়েছে ভারতীয় পাসপোর্ট। কিন্তু মনে-প্রাণে এখনও যে তিনি ভারতীয়, তা কিন্তু ক্রিকেটে তার উৎসাহ দেখলেই বোঝা যায়। অবসর কাটান কোডিং আর সাহিত্যের বই পড়ে। সেই সাথে ওয়াশিংটনের সিয়াটল ভিত্তিক আমেরিকান ফুটবল দল ‘সিহক’-এর পাঁড়ভক্ত সত্য নাদেলা।
২০১৭ সালে সহলেখক হিসেবে গ্রেগ শ ও জিল ট্র্যাসি নিকোলসের সাথে তিনি লেখেন তার বই ‘হিট রিফ্রেশ: দ্য কোয়েস্ট টু রিডিস্কভার মাইক্রোসফট’স সোল অ্যান্ড ইমাজিন আ বেটার ফিউচার ফর এভ্রিওয়ান’। সেখানে উঠে এসেছে তার ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে প্রযুক্তির আলাপন এবং নেতৃত্ব প্রদানের দীর্ঘ যাত্রার কথা।
৫০ বছরের জীবনের ২৫টি বছরই উৎসর্গ করেছেন প্রিয় প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফটে। দীর্ঘদিনের কর্মী ও নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেও এই গুণীর ভেতর শেখার আগ্রহ এখনো অসম্ভব রকমের প্রবল। ডেকান ক্রনিকলসকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন,
“যদি আপনি শেখা ছেড়ে দেন, তবে ভালো কিছু করতেও ভুলে যাবেন।”
২৫ বছরের কর্মনিষ্ঠার গুণেই আজকের এই জায়গায় তিনি। এসেছিলেন সাধারণ কর্মী হয়ে, বেরোবেন কোম্পানির চল্লিশ বছরের ইতিহাসের তৃতীয় সিইও (সাবেক) হয়ে। অনুপ্রেরণার জন্য আর কী চাই?
সম্পূরক তথ্য: ২০ হাজার শ্রমিকের ২২ বছরের সাধনার ফল তাজমহল এবং একজন নিষ্ঠাবান কর্মীর ২২ বছরের সাধনার ফল আজকের এই সাফল্য গাঁথা!
ফিচার ইমেজ: yosuccess.com