প্রাচ্যের জ্ঞান ও বিজ্ঞানের অগ্রগতির ইতিহাস নিয়ে আমাদের আগ্রহ হয়তো একটু বেশিই, সে তুলনায় প্রাপ্ত সম্পদ সীমিত বলা চলে। শূন্যের আবিষ্কার শুধু নয়, আজ থেকে হাজারখানেক বছর আগে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ এগিয়ে গিয়েছিল গণিত, বিজ্ঞান ও জ্যোতিষশাস্ত্রেও। প্রাচীন ভারতবর্ষের অমূল্য জ্ঞানসম্পদ থেকে একটি গ্রন্থ নিয়েই আজ আমরা ঘুরে আসবো আমাদের অতীতের গণিত ও বিজ্ঞানরাজ্য থেকে, নাম তার ‘সিদ্ধান্ত শিরোমণি’, লিখে গিয়েছেন বিজ্ঞানী ভাস্করাচার্য (১১১৪-১১৮৫) বা ভাস্কর-২।
বিজ্ঞানী ভাস্করাচার্য
জন্ম ১১১৪ খ্রিস্টাব্দে, ভারতের কর্ণাটক প্রদেশে পশ্চিমঘাটে সহ্য পর্বতের নিকট প্রাচীন বিজুবিড় (বর্তমান বিজাপুর) এলাকায় এক বিখ্যাত বংশে। গণিত ও জ্যোতিষশাস্ত্রে ছিল তাঁর অসামান্য অবদান। প্রকাশ থাকে যে, ১২০২ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপে প্রথম গণিতের বই প্রকাশিত হয়েছিল লিওনার্ডো দা পিসা’র হাত ধরে। এদিক থেকে বিচার করলে ভাস্করাচার্য রচিত ‘সিদ্ধান্ত শিরোমণি’ই পৃথিবীর প্রথম গণিতগ্রন্থ!
এ বইটি ছাড়াও ভাস্করাচার্য রচনা করেছেন ‘করণকুহুতল’ এবং ‘সর্বতোভদ্র’ নামে দুটি গ্রন্থ। মহারাষ্ট্রের চালিসগাঁও থেকে সামান্য দূরে প্রাপ্ত একটি শিলালিপিতে ভাস্করাচার্য সম্পর্কে বলা হয়েছে,
“ভট্র পারদর্শী তিনি সাংখ্য, তন্ত্র, বেদে মহাপণ্ডিত। তাঁর তুল্য জ্ঞান আর কারও নেই। কাব্যে, কবিতায়, ছন্দে অতুলনীয়। গণিতে তিনি মহাজ্ঞানী, তাঁর চরণে প্রণাম জানাই” (অনূদিত)
সিদ্ধান্ত শিরোমনি
ভাস্করাচার্য ‘সিদ্ধান্ত শিরোমনি’ গ্রন্থটি ১১৫০ খিস্টাব্দে অর্থাৎ ৩৬ বছর বয়সে লেখা শুরু করেন।এ গ্রন্থটিতে চারটি অধ্যায় পাওয়া যায়- লীলাবতী, বীজগণিত, গ্রহ গণিতাধ্যায় ও গোলধ্যায়। গণিত ও জ্যোতিষশাস্ত্র নিয়ে লেখা অসাধারণ এ বইটি এখনও আধুনিক বিজ্ঞানীদের মাঝে সমানভাবে সমাদৃত হয়ে আসছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভাস্করাচার্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে কোথাও সিদ্ধান্ত শিরোমনি ও লীলাবতীকে আলাদা গ্রন্থ হিসেবে দেখানো হয়েছে; আবার কোথাও লীলাবতীকে সিদ্ধান্ত শিরোমনির অংশ হিসেবে বলা হয়েছে। সে বিতর্কে আমরা যাচ্ছি না, আলোচনাতে ফিরে আসি।
লীলাবতী
প্রথমেই আলোচনা হবে ‘লীলাবতী’ নিয়ে। বইয়ের প্রথম ভাগের নাম লীলাবতী। মহামতি আকবর গ্রন্থটির পারসিক অনুবাদ করার দায়িত্ব যাকে দিয়েছিলেন, সেই ফৈজির লেখা থেকে এ গ্রন্থের নামকরণের একটা সুন্দর কাহিনী পাওয়া যায়। কাহিনী এরকম:
ভাস্করাচার্যের কন্যা লীলাবতীর ভাগ্য গণনা করে পিতা দেখেন যে মেয়ে চিরকুমারী ও সন্তানহীনা থাকবেন। মেয়ের ভাগ্য পরিবর্তন করে ব্রহ্মমূহুর্তে বিয়ে দেবার জন্য পিতা তৈরি করলেন জলঘড়ি। তো জলঘড়ি অনুসারে ঠিক সময়ে বিয়ে দেবার সব আয়োজন সমাপ্ত হলো, এদিকে শেষ সময়ে কন্যার জলঘড়ি দেখার ইচ্ছে জাগল। নিয়তির কী পরিহাস, মেয়ের গলার দুল জলঘড়ির ওপর পড়ে গিয়ে সময় গণনায় ঘটল বড় ধরনের সমস্যা। বাবা বুঝলেন বিধির লেখা পরিবর্তন সম্ভব না। কন্যাকে আশ্বাস দিলেন তার নামে বিখ্যাত একটি গ্রন্থ রচনা করে কন্যাকে অমর করে রাখবেন।
গল্পটি কতটুকু সত্য, জানা যায় না। তবে সত্য হলো এই, পুরো গ্রন্থটি জুড়ে রয়েছে সংখ্যার খেল, অনেকটা অ্যাপ্লায়েড ম্যাথমেটিকসের মতো। পাটীগণিত নিয়ে আজকাল পরীক্ষায় যে জটিল ধাঁধার মতো অঙ্ক দেওয়া হয়, বইটিতেও এরকম অসংখ্য অঙ্ক গল্পের আকারে বোঝানো হয়েছে।
লীলাবতী অধ্যায়ে রয়েছে তেরোটা ভাগ। তাতে আলোচনা করা হয়েছে-
- শূন্য কী,
- ঋণাত্মক রাশি সংক্রান্ত সমস্যা ও সমাধান,
- পাই-এর মান,
- ৩, ৫, ৭, ৯ এই সংখ্যাসমূহের গুণ, বর্গ, রেসিপ্রোকাল ইত্যাদি বের করবার পদ্ধতি
- সমান্তর ও গুণোত্তর ধারার অঙ্ক, তল ও ত্রিমাত্রিক জ্যামিতি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা।
তাছাড়া এ অধ্যায়ে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব ভাস্করাচার্য রেখে গেছেন, তা হলো:
“যেকোনো নির্দিষ্ট সংখ্যাকে শূন্য দিয়ে ভাগ করলে তার ফল অসীম হয়, অসীমের সঙ্গে যে কোনো সংখ্যা যোগ করলে যোগফল অসীম হয়।”
‘বীজগণিত’ সমাচার
বীজগণিত নিয়ে আলোচনার সময় ভাস্করাচার্য দেখিয়েছেন কোনো রাশিকে শূন্য নিয়ে ভাগ করলে কী ফলাফল আসে। এছাড়া ধনাত্নক ও ঋণাত্নক রাশির গুণফল ঋণাত্মক হবে, কিন্তু ঋণাত্মক ও ঋণাত্মকের গুণফল যে ধনাত্মক হবে, তা-ও বের করে দেখিয়েছেন। পুরোটা আলোচনা দ্বিঘাত সমীকরণ নিয়ে করেছেন, তবে ক্ষেত্রবিশেষে ত্রিঘাত সমীকরণেরও আশ্রয় নিয়েছেন তিনি।
কিম লেসলি প্লফকার নামে একজন আমেরিকান গণিতবিদ তাঁর Mathematics in India বইতে দেখিয়েছেন ক্যালকুলাসের উৎস ভারতবর্ষেই, সপ্তম শতাব্দীতে; পশ্চিমে তখনও ক্যালকুলাস পৌঁছেনি। পরে একাদশ শতাব্দীতে এর বিস্তৃতি ঘটতে থাকে। তিনি মূলত ভাস্করাচার্যের ‘সিদ্ধান্তশিরোমনি’কেই বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন তাঁর আলোচনায়।
‘গ্রহ গণিতাধ্যায়’ ও ‘গোলধ্যায়’
এ দুটো অধ্যায়ে তিনি জ্যামিতি ও পরিমিতি নিয়ে আলোচনা করেন। আমরা হয়তো জানি যে আর্যভট্ট পাই এর মান নির্ণয় করেছিলেন মূল মানের অনেক কাছাকাছি, আর ভাস্করাচার্য সমকোণী ত্রিভুজ ও সুষম বহুভুজের মাধ্যমে পাই এর মান বের করেন ৩.১৪১৬৬৬।
নিউটনের প্রায় পাঁচশত বছর পূর্বে নিউটনের আবিষ্কৃত ইনটিগ্র্যাল ক্যালকুলাসের মতো করে ভাস্করাচার্য গোলকের তলের পরিমাণ ও আয়তন নির্ণয় করেন। এ নিয়মে গোলকটিকে তিনি প্রথমে অনেকগুলো ছোট ছোট অংশে ভাগ করে পরে সবগুলোকে একত্রিত করে যোগ করেছেন। ত্রিকোণমিতির সাইন-কোসাইনের সারণির জনকও তিনি।
ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাস ব্যবহার করে ভাস্করাচার্য গ্রহের গতি, গ্রহের তাৎক্ষণিক গতি ইত্যাদি বের করার পাশাপাশি সময়কে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশে ভাগ করার নিয়ম দেখিয়েছেন। সময়ের সবচেয়ে ক্ষুদ্র অংশের নাম দিয়েছিলেন ‘ত্রুটি’ (১ সেকেন্ড সময়ের ৩৩৭৫০ ভাগ)।
‘সিদ্ধান্তশিরোমনি’র বিজ্ঞান আলোচনা
নিউটনের আবিষ্কৃত মহাকর্ষ বা অভিকর্ষ বল নিয়ে সিদ্ধান্তশিরোমনির একটি পংক্তি নিম্নরূপ:
“ আকৃষ্টি শক্তিশ্চ মহীতয়া যৎ
খসৃং গুরু স্বাভিমুখং স্বশক্ত্যা
আকৃষ্যতে তৎ পততীবভাতি
সমে সমস্তাৎ ক্ক পতত্বিয়ং খে !!”
অর্থাৎ আকর্ষণ বলসম্পন্ন পৃথিবী যখন কোন বস্তুকে নিজ অভিমুখে স্বশক্তিতে আকর্ষণ করে, তখন মনে হয় বস্তুগুলো পতনশীল। পৃথিবী নিজ অবস্থানে রয়েছে মহাকাশের বিভিন্নমুখী শক্তির কারণে!
এখানে মহাকর্ষ ও অভিকর্ষ বল নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। অবাক হচ্ছেন? তাহলে ফিরে যাই ‘গোলধ্যায়’-এ, এর আরেক অংশের অনুবাদ দেখে নিন-
“পৃথিবী যদি দর্পণোদরের ন্যায় সমতল হইত, তবে তদুপরি বহু উচ্চে ভ্রমণশীল স্বৰ্য্য নিরন্তর মানবগণের দৃষ্টিগোচর হইত। অর্থাৎ, কখনই রাত্রি হইত না ; গোল বলিয়াই দিবারাত্রি হইয়া থাকে”
পরিশেষে
শুধু সিদ্ধান্ত শিরোমনিই নয়, প্রাচীন সিন্ধু তীর হতে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় এভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অমূল্য জ্ঞানসম্ভার। তার কিয়দংশই মানুষের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। প্রাচীন প্রাচ্যে জ্বলে ওঠা বিজ্ঞানপ্রদীপ যেন বাংলাকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের পথে অনুপ্রেরণা যোগাতে পারে, সে লক্ষ্যে আমরা সবাই যেন কাজ করতে পারি, এই শুভ কামনায়, আজকের মতো, এটুকুই।