গল্প, উপন্যাস, কিংবা রহস্য কাহিনী- যেকোনো ধরনের সাহিত্যের ক্ষেত্রেই সমগ্র চিত্রায়ন আবর্তিত হয় নারী চরিত্রকে নিয়ে, এমনটা খুব কমই দেখা যায়। সুপারহিরো থেকে শুরু করে দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা, সফলতার উচ্চ শীর্ষে অবস্থানরত কোনো চরিত্র কিংবা রাজনৈতিক মারপ্যাঁচে আবর্তিত কেউ, এমন ধরনের চরিত্রে নারী চরিত্রের দেখা মেলা ভার। ঠিক এই ব্যাপারেই গত শতকেই আলাদা দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী চরিত্রগুলোর সৃষ্টিকর্তা হলেন সিডনি শেলডন।
সিডনি শেলডন থ্রিলার লেখক এবং প্রযোজক হিসেবেই সর্বাধিক পরিচিত। কিন্তু এছাড়াও তিনি চলচ্চিত্র-নাটকের চিত্রনাট্যকার ও গীতিকার ছিলেন।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা
তিনি ১৯১৭ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন, জন্মস্থান ছিল যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো অঙ্গরাজ্যের ইলিনয়ে। তার মা নাটালি মার্কাস ও বাবা অটো শেচটেল। মা ছিলেন রুশ বংশোদ্ভূত; রাশিয়ায় তার পরিবারের উপর হামলা হলে নাটলির মা পালিয়ে আমেরিকা আশ্রয় নেন।
জন্মের পর সিডনির নাম দেওয়া হয়েছিল সিডনি শেচটেল। তিনি বেড়ে ওঠেন খুবই বৈচিত্র্যময় পরিবেশে ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে। বাবা ছিলেন সেলসম্যান। বাবার কাজের কারণে বছর বছর তাদের শহর বদলাতে হতো। ১৭ বছর বয়সেই ৮টি ভিন্ন শহরে বসবাস করার অভিজ্ঞতা লাভ হয়েছিলো তার। তার শৈশবকাল থেকেই আমেরিকার অর্থনীতিতে ভয়াবহ মন্দা চলছিলো। যার প্রভাব পড়ে তার পরিবারের ওপরেও। এছাড়াও পারিবারিক কলহ, বারংবার শহর বদলানোর ফলে বন্ধু বান্ধবের অভাব, একাকিত্ব ইত্যাদি তার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে তার জীবনের প্রথমাংশে। তারপরও ছোটবেলা থেকেই নানা সৃজনশীল কাজ করে গেছেন। পারিবারিক সমস্যা থেকে দূরে গিয়ে মানসিক শান্তি লাভের জন্য স্কুলে পড়াকালীনই গণ পাঠাগারে গিয়ে বই পড়া শুরু করেন। এখান থেকেই হয়তো লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু হয়েছিলো। দশ বছর বয়সেই তার লেখা কবিতা প্রথম ছাপা হয় wee wisdom পত্রিকায়। বারো বছর বয়সে মার্শাল ফিল্ড গ্রামার স্কুলে পড়াকালীন তিনি প্রথম নাটক লিখেন। সেই নাটক স্কুলে মঞ্চস্থ করার নাট্য নির্দেশনাও দেন নিজেই।
পরবর্তী সময়ে আর্থিক অনটনের কারণে তিনি ওষুধের দোকানে ডেলিভারি বয় এবং হোটেলের হ্যাংবয় হিসেবেও কাজ করেছেন। অর্থাভাবে কলেজের পড়তে না পারাসহ নানা জটিলতার কারণে তিনি আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত ও নেন। যদিও পরে তার বাবা বুঝিয়ে শুনিয়ে তাকে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত রাখেন।
শিকাগো তে তিনি হোটেলের হ্যাংবয় হিসেবে এবং আফ্রিমোর ঔষধের দোকানে ডেলিভারি বয় হিসেবে কাজ করে যেতে থাকেন। এরই মধ্যে তিনি ইহুদী দাতব্য প্রতিষ্ঠান B’nai B’rith থেকে ‘নর্থ ওইয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়’ এ পড়ার জন্য স্কলারশিপ পান। ভর্তি হয়েই তিনি বাসবয় হিসেবে কাজ নেন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাগাজিন ‘Daily North Western’ এর স্টাফ হিসেবে কাজ শুরু করেন।
এছাড়া ভয়াবহ মন্দার বছরে জুতার দোকানে সেলসম্যানের কাজ ও অটোমোবাইল কারখানায় কর্মচারীর কাজ ও করেছেন। একটি অ্যামেচার প্রতিযোগিতায় ঘোষক হিসেবে অংশগ্রহণের সময় তার শেচটেল পদবী পরিবর্তন করে শেলডন ব্যবহার করেন। এবং এরপর হতে তার পরিবারের সদস্যরাও এই পদবী গ্রহণ করে।
তিনি গান লেখার কাজ অব্যাহত রাখেন। তার লেখা গান প্রথম অন এয়ার প্রচারিত হয় রেডিও তে হোরেস হেইডটের ‘অ্যালেমাইট’ নামক প্রোগ্রামে। গানটির নাম ‘মাই সাইলেন্ট সেলফ’।
১৯৩৬ সালে গীতিকার হবার স্বপ্ন নিয়ে নিউ ইয়র্কে পাড়ি জমান তিনি। সাথে সম্বল ত্রিশ ডলার এবং মাকে হাড়ভাঙা খাটুনি থেকে মুক্ত করার আকাঙ্ক্ষা। কখনো সিনেমা হলের টিকিট চেকার কিংবা বার্কার হিসেবে কাজ করে থাকা খাওয়ার খরচ চালাতেন। সেইসাথে গান লিখতেন এবং বিভিন্ন প্রকাশকের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াতেন তার লেখা গানের অ্যালবাম প্রকাশের জন্য। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে শিকাগো ফিরে যান।
পেশাগত জীবন
এরপরে পাড়ি জমান হলিউডে। নানা স্টুডিও ঘুরে ঘুরে ব্যর্থ হয়েও ফিরে যাননি। পেশাদার লেখক হিসেবে প্রথম কাজ শুরু করেন স্টুডিওর রিডার হিসেবে। প্রথম প্রথম খণ্ডকালীন রিডারের কাজ করলেও চুক্তিবদ্ধ কাজও পেয়ে যান। এরপরেই বেন নামের এক বন্ধুর সাথে একত্রে মৌলিক গল্প লেখার কাজ শুরু করেন। এভাবেই চিত্রনাট্য লেখার কাজ পেয়ে যান। ‘ডেঞ্জারাস হলিডে’র মাধ্যমে এ কাজে অভিষেক হয় তার। এরপর একের পর এক চিত্র্যনাট্য লেখার কাজ করতে থাকেন। এর মধ্যে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো। তিনি সেনাবাহিনীতে যোগদান করলেন। ফিরেই ব্রডওয়ের হয়ে লেখা শুরু করেন। ‘দ্য মেরি উইডো’, ‘জ্যাকপট’, ‘ড্রিম উইথ মিউজিক’ দ্বারা পরিচিতি লাভ করতে থাকেন ধীরে ধীরে। উত্থান পতন নানা ঘটনার জের ধরে এবং নিজের মৌলিক গল্প লেখার স্বপ্ন নিয়ে ফের হলিউডে ফিরে যান। ‘দ্য ব্যাচেলর এন্ড দ্য ববি- সক্সার’ হলিউডে তার প্রথম মৌলিক কাজ। এখান থেকেই তার জীবনের পট দ্রুত বদলে যেতে লাগলো ১৯৪৭ সালে চলচ্চিত্রটি অস্কার লাভ করে। ‘ড্রিম ওয়াইফ’ চলচ্চিত্রের দ্বারা তার প্রযোজক হিসেবে হাতেখড়ি হয়। বেশ ক’বার বিভিন্ন চলচ্চিত্র ফ্লপের পর চাকরি হারান, হতাশায় দিন পার করেন। কিছুদিন পর আবারো পূর্ণোদ্যমে কাজ শুরু করেন। ১৯৭০ এর আগেই বহু সফল চলচ্চিত্র ও টিভি সিরিজ নিয়ে কাজ করেন। ‘দ্য প্যাটি ডিউক শো’, ‘আই ড্রিম অফ জিনি’, ‘ন্যান্সি’র মতো অসাধারণ কিছু টিভি সিরিজ উপহার দেন তিনি।
এরপর তিনি উপন্যাস লেখার কথা চিন্তা করেন। এবং ১৯৭০ সালে তার প্রথম উপন্যাস ‘দ্য নেকেড ফেস’ লিখেন। এরপরেই ১৯৭৩ সালে বের হলো তার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘দ্য আদার সাইড অব মিডনাইট’। এটি ইন্টারন্যাশনাল বেস্টসেলারে পরিণত হলো এবং শেলডনের আগেকার সব রেকর্ড ভেঙে দিয়ে ঔপন্যাসিক পরিচয়ের দিকে তাকে নিয়ে যেতে লাগলো। সিডনি যেন তার ছোটবেলার স্বপ্নকে সত্য হিসেবে পেলেন। এর পরে তিনি একের পর এক উপন্যাস লিখে যেতে থাকেন, যার সবগুলোই বেস্টসেলার ছিলো। তিনি উপন্যাসকে জীবন্ত করে তোলার জন্য নানান দেশে ঘুরে বেড়াতেন, চরিত্রকে বাস্তব রূপ দিতে দেশে দেশে বিভিন্ন মানুষের সাথে কথা বলতেন। তথ্য সংগ্রহের জন্য এমনকি যে সকল জায়গাকে কেন্দ্র করে লিখতেন, সেগুলো চষে বেড়িয়েছেন। তার উপন্যাসগুলো নারী চরিত্র কেন্দ্রিক। আশেপাশের সবকিছু ছাপিয়ে সংগ্রাম করে, নানা প্রতিকূল অবস্থায় থেকেও কীভাবে সফলতার শীর্ষে আরোহণ করা যায়, নারী চরিত্রের এমন দিকটা যেমন তিনি দেখিয়েছেন, অন্যদিকে বেপরোয়া, বিধ্বংসী কিছুক্ষেত্রে আত্মবিধ্বংসী রূপটিও অবলীলায় দেখিয়ে দিয়েছেন।
তার লেখা সবগুলো উপন্যাস:
১। দ্য নেকেড ফেস (১৯৭০)
২। দ্য আদার সাইড অফ মিডনাইট (১৯৭৩)
৩। অ্যা স্ট্রেঞ্জার ইন দি মিরর (১৯৭৬)
৪। ব্লাড লাইন (১৯৭৭)
৫। রেজ অফ অ্যাঞ্জেলস (১৯৮০)
৬। মাস্টার অফ দি গেম (১৯৮২)
৭। ইফ টুমরো কামস (১৯৮৫)
৮। উইন্ডমিলস অফ দি গড (১৯৮৭)
৯। স্যান্ডস অফ টাইম (১৯৮৮)
১০। মেমোরিজ অফ মিডনাইট (১৯৯০)
১১। দ্য ডমসডে কন্সপ্রিকেসি (১৯৯১)
১২। দ্য স্টারস সাইন ডাউন (১৯৯২)
১৩। নাথিং লাস্টস ফর এভার (১৯৯৪)
১৪। মর্নিং, নুন অ্যান্ড নাইট (১৯৯৫)
১৫। দ্য বেস্ট লেইড প্লানস (১৯৯৭)
১৬। টেল মি ইয়োর ড্রিমস (১৯৯৮)
১৭। দ্য স্কাই ইজ ফলিং (২০০১)
১৮। আর ইউ অ্যাফ্রেইড অফ ডার্ক (২০০৪)
তিনি তার উপন্যাসগুলোর মাধ্যমেই বিশ্ববিখ্যাত হয়েছেন। তার সকল পরিচয় ছাপিয়ে তার প্রধান পরিচয় বিশ্ববাসীর কাছে এখন একজন ঔপন্যাসিক হিসেবে। এদের মাঝেই তিনি বেঁচে আছেন অত্যন্ত সাধারণ ধারার মাঝেও ব্যতিক্রমের সৃষ্টিকর্তা হিসেবে।
Feature image: Digbooks.net