নায়িকা হতে হলেই গায়ের রং হবে ফর্সা- এমন ধারণাকে ভেঙে দেয়া নায়িকাদের মধ্যে অন্যতম একজন স্মিতা পাতিল। শ্যামলা বরন দিয়েই তিনি জিতে নিয়েছিলেন হাজারো দর্শকমন। এমনও হয়েছে যে, একটি শব্দও মুখ থেকে বেরোয়নি অথচ তিনি বলে গেছেন কত না কথা, তার অভিব্যক্তি জাগিয়ে তুলেছে নীরবতাকেও। স্মিতা প্রথম ক্যামেরার সামনে আসেন ১৯৭০ সালে। অভিনয়ে আসবার আগে তিনি দূরদর্শনের সংবাদপাঠিকা ছিলেন। মারাঠি ভাষায় সংবাদ পাঠ করতেন স্মিতা। সে হিসেবেও তার জনপ্রিয়তা কম ছিলো না। অভিনয়জগতে আসার আগেই তাই তার জুটে গিয়েছিলো বেশ কিছু ভক্ত।
সত্তর ও আশির জগতে বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের সাথে সমান্তরাল ধারায় চলমান শিল্পশোভন চলচ্চিত্রের অত্যন্ত জনপ্রিয় দু’টি মুখ ছিলেন স্মিতা পাতিল ও শাবানা আজমী। বহুবার এমনও হয়েছে যে নির্মাতারা স্মিতাকে মাথায় রেখে চরিত্র তৈরি করেছেন। শুধু দেহাবয়ব বা চাকচিক্যই নয়, শুদ্ধতম অভিনয়শিল্পের মধ্য দিয়ে উঠে আসা একটি নাম- স্মিতা পাতিল। তিনি একাধারে অভিনয় করেছেন হিন্দি, তামিল ও মালায়লাম চলচ্চিত্রে। বড় পর্দার মতো ছোট পর্দায়ও একসময় তিনি রাজত্ব করেছেন। পুনে ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট থেকে পড়াশোনা সেরে তিনি টিভি উপস্থাপিকা হিসেবে তার ক্যারিয়ার শুরু করেন। তার ক্যারিয়ার এক দশকের বেশি বিস্তৃত হতে পারেনি। কিন্তু এই স্বল্প পরিসরেই তিনি অভিনয় করেন ৮০টিরও বেশি হিন্দি ও মারাঠি সিনেমায়। অভিনয়ের প্রতি তার নিষ্ঠা সত্যিই উল্লেখযোগ্য। চরিত্রের দাবিতে তিনি নিজেকে প্রস্তুত করে নিতেন। কোনো সীমায় নিজের অভিনয়শিল্পকে বাঁধতে তিনি রাজি ছিলেন না। অভিনয়ের ব্যাপারে তার মধ্যে কোনো সংস্কার কাজ করতো না, কোনো চরিত্র পছন্দ হলে নিজের সবটুকু দিয়েও সেটিকে ফুটিয়ে তুলতে বদ্ধপরিকর ছিলেন স্মিতা পাতিল। ‘চক্র’ সিনেমায় অভিনয়ের সময় তিনি প্রায়ই মুম্বাইয়ের বস্তিগুলোতে যেতেন চরিত্রকে আরো ভালো ফুটিয়ে তোলার জন্য।
১৯৫৫ সালের ১৭ অক্টোবর জন্ম নেয়া এই নায়িকা দর্শকদের নায়িকাদের নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটাই বদলে দিতে পেরেছিলেন। চাকচিক্য থেকে বেরিয়ে দর্শকেরা অভিনয়কে আরো বেশি গ্রহণ করতে শেখে। তার অভিনয়শৈলীর প্রমাণস্বরূপ তিনি উপহার দিয়েছেন ‘ভূমিকা’, ‘অর্থ’, ‘আক্রোশ’, ‘মন্থন’ এবং ‘বাজার’, ‘আকালের সন্ধানে’, ‘চোখ’-এর মতো সিনেমা।
চলচ্চিত্র নির্মাতা শ্যাম বেনেগালের মতে, তিনি ছিলেন বহুমাত্রিক এক নারী। তিনি খুব সহজেই একটি গল্পের অংশ হয়ে যেতে পারতেন। সব দৃশ্যে অভিনয় করতেন খুব সাবলীলভাবে, অভিনয় ছিল স্মিতা পাতিলের সহজাত একটি বৈশিষ্ট্য। ক্যামেরার সাথে তার রসায়নও অনবদ্য। ক্যামেরা যেন তাকে সকলের মাঝ হতে বেছে নিতে পারতো। এবং এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল স্মিতার অভিনয়ের।
শুধু কি অভিনয়? ভারতীয় নারীশক্তির উন্নয়নেও তিনি বেশ কিছু ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি একজন নারীবাদী ছিলেন। মুম্বাইয়ের ‘ওম্যানস সেন্টার’ এর একজন সক্রিয় সদস্যও ছিলেন। তার মতাদর্শের স্পষ্ট প্রতিফলন দেখা যায় অভিনীত চরিত্রগুলোতেও। সেই বুদ্ধিদীপ্ত নারী চরিত্রগুলোতে সবসময়ই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বস্তাপচা ধারণাকে ভেঙে গুড়িয়ে দেবার একটা তীব্র বাসনা দেখা যেত।
স্মিতা পাতিল সকলের আলোচনার বিষয় হয়েছিলেন রাজ বাব্বারের সাথে তার সম্পর্কের কারণে। ‘ভিগি পলকে’ সিনেমার সেটে তাদের প্রথম সাক্ষাৎ হয়। রাজ বাব্বরকে তিনি ভালোবেসে বিয়ে করেন। কিন্তু রাজ আগেই বিবাহিত ছিলেন এবং প্রথম স্ত্রীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদের পর তিনি স্মিতার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এ কারণে বহুলোকে তাকে ঘরভাঙার দায়ও দিয়েছে। কিন্তু সকল তর্ক-বিতর্ককে উপেক্ষা করে স্মিতা পাতিল তার দাম্পত্য জীবনে সুখী ছিলেন। তাদের একটি ছেলেসন্তানও হয়, নাম প্রতীক বাব্বর। কিন্তু মাতৃত্বকালীন কিছু জটিলতার দরুন প্রতীকের জন্মের মাত্র দু’সপ্তাহ পরেই, ১৯৮৬ সালের ১৩ ডিসেম্বর স্মিতা পাতিল মারা যান। মৃত্যুর আগে স্মিতা এক অদ্ভুত ইচ্ছার কথা বলে গিয়েছিলেন। তিনি বেঁচে থাকতে এ ইচ্ছা পূরণ হয়নি, তবে মৃত্যুর পর তার কাছের কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষী সেই মতোই করেছিলেন। স্মিতা ‘গালিয়ো কা বাদশা’ ছবির মেকআপ আর্টিস্ট দীপক সাওয়ান্তের কাছে আবদার করেছিলেন যে তাকেও যেন সহশিল্পী রাজ কুমারের মতো শোয়া অবস্থায় মেকআপ দেয়া হয়। কিন্তু নতুনের প্রতি পরম আগ্রহী স্মিতার পরখ করে দেখা হয়নি এই নতুন অভিজ্ঞতাটি। দেখতে অতটা ভালো দেখাবে না বলে অন্যরা তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে সাধারণভাবেই মেকআপ নিতে বাধ্য করেন। এই সিনেমাটি মুক্তি পাবার আগেই মৃত্যু হয় তার। শুধু এটিই নয়, তার মোট ১০টিরও বেশি সিনেমাই মুক্তি পায় তার মৃত্যুর পর। তার অকালমৃত্যু তাকে তার সব সাফল্য দেখে যেতে দেয়নি।
এদিকে দীপক সাওয়ান্তের প্রচন্ড মন খারাপ হয় স্মিতার শেষ অনুরোধ না রাখতে পারায়। তাই স্মিতার সৎকারের আগে হিন্দু বিবাহিত নারীর সাজে দীপকই তাকে সাজিয়েছিলেন। সেদিন শ্যুটিংয়ে যেমনটি চেয়েছিলেন, সেভাবেই শুইয়ে রাখা হয় এই নায়িকাকে। কতটা ভালোবাসা পেলে যে মানুষটির মৃত্যুর পরও সহশিল্পীরা আবদার রক্ষা করেন, এ যেন তারই এক দৃষ্টান্ত। সত্যিই স্মিতা পাতিলের অভিনয় ও আচার-ব্যবহারের ফলে তিনি বহু লোকেরই ভালোবাসা কুড়িয়েছিলেন।
শাবানা আজমি ও স্মিতা পাতিল চলচ্চিত্রের দিক দিয়ে ছিলেন একই ঘরানার। একই পরিচালকের সিনেমায় অভিনয় করা, একই চলচ্চিত্র আন্দোলনে শরিক হওয়া- অনেক কিছুই মিল ছিলো তাদের। তবু তারা ঠিক বন্ধু ছিলেন না। এ কথা শাবানা আজমি নিজেই বলেছেন। স্মিতার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন যে প্রথম যেদিন তাকে দেখেন, তার মনে হয়েছিলো যে ওই মুখ ক্যামেরার জন্যই তৈরি। এছাড়া ‘নিশান্ত’ সিনেমায় তারা দুজন প্রথম একসাথে অভিনয় করেন, পরস্পরবিরোধী কিন্তু একই সুতায় গাঁথা দুটি চরিত্র। এছাড়াও ‘অর্থ’, ‘মন্ডি’, ‘উঁচ নিচ বিচ’ ইত্যাদি সিনেমায় তারা একসাথে কাজ করেন। ব্যক্তিজীবনে মিডিয়াসৃষ্ট এবং কিছুটা সত্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিরাজ করতো তাদের মধ্যে। কিন্তু তাদের পারিবারিক সম্পর্কে কখনোই এর আঁচ লাগেনি। স্মিতার পরিবারের সাথে শাবানা আজমির আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং স্মিতার একমাত্র পুত্র প্রতীকের দিকনির্দেশনার জন্য স্মিতার মা ও বোন শাবানা আজমিকেই বেছে নেন। প্রতীকের বলিউডে অভিষেক ঘটে আমীর খানের প্রযোজনায় ‘জানে তু ইয়া জানে না’ সিনেমায় একটি পার্শ্বচরিত্রের মাধ্যমে।
শাবানা আজমি স্মিতাকে বর্ণনা করেন এভাবে,
“আমার বলতে ভালো লাগে যে ভারত বহু শতাব্দী ধরে চলে আসা বহু বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ একটি দেশ। স্মিতাও ভারতেরই একটি ক্ষুদ্র প্রতিরূপ ছিলো- ঐতিহ্যবাহী এবং আধুনিকা, সবল এবং সংবেদনশীল, আত্মবিশ্বাসী এবং জেয়”।
শাবানার বর্ণনা থেকে স্মিতা পাতিলের বৈশিষ্ট্যের একটি দিক খুব স্পষ্ট করে ধরা পড়ে। বৈপরীত্যপূর্ণ সৌন্দর্য। মুদ্রার দু পিঠই প্রকাশ পেয়েছিলো তার চরিত্রে। তার সহ-অভিনেতা ও অন্য সহকর্মীরা সকলেই তাকে মনে করেন ‘ভারতের নিখুঁততম অভিনেত্রী’।
২০১৫ সালে মায়ের ৩০তম মৃত্যুদিনে আবেগাপ্লুত হয়ে প্রতীক বাব্বর বলেন,
“আমার মা ছিলেন ‘ঈশ্বরের সন্তান’। ঈশ্বরের তাই হিংসে হয়েছিলো তাকে আমাদের মাঝে রেখে দিতে। এ কারণেই তিনি তার প্রিয় সন্তানকে কাছে টেনে নিলেন। অল্প বয়সেই তাকে চলে যেতে হলো দুনিয়া ছেড়ে।”
১৯৮২ সালের আগে স্মিতা বাণিজ্যিক সিনেমায় অভিনয় করেননি। তিনি আর্ট ফিল্মেই অভিনয় করতে চাইতেন সবসময়। তার করা প্রথম বাণিজ্যিক ছবিটি ছিলো অমিতাভ বচ্চনের সাথে ‘নমক হালাল’।
অভিনয়ে অনন্য অবদানের জন্য তিনি দুটি জাতীয় পুরস্কার, একটি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার জেতেন। এছাড়াও তার অর্জনের ঝুলিতে ছিল ১৯৮৫ সালে পাওয়া ভারতের চতুর্থ শ্রেষ্ঠ সম্মান ‘পদ্মশ্রী পুরস্কার’ও।
ফিচার ইমেজ- retrobollywood.com