কাঠমিস্ত্রি থেকে জগদ্বিখ্যাত অভিনেতা হয়ে ওঠা এক নায়কের গল্প

জীবনের শুরুতে ছিলেন কাঠের মিস্ত্রি। স্ত্রী কলেজ জীবনের প্রেমিকা মেরি মার্কোয়ার্ট আর দুই সন্তান নিয়ে তখন তার টানাটানির সংসার। দিনরাত ভেবে কিছুতেই কূল পান না কবে হাল ফিরবে তার ব্যবসার, পরিবারের সবার মুখে ফুটবে এক চিলতে রোদ্দুরের হাসি। এর মধ্যে মনের সুপ্ত বাসনা খেলা করে হলিউডের একজন বড় অভিনেতা হবেন। কিন্ত বাস্তব জীবন বড় নির্মম। কিছুতেই তার সংসারের হাল ফিরাতে পারছেন না। বিধাতা কি তার দিকে ফিরে চাইবে না? না, বিধাতা তাকে নিরাশ করেন নি। হঠাৎই একদিন একটা বড় কাজের বরাত পেয়ে গেলেন। কোটিপতি জর্জ লুকাসের বাড়ির ক্যাবিনেট বানিয়ে দিতে হবে। সেসময় লুকাস ছিলেন  হলিউডের সেরা পরিচালকদের মধ্যে একজন।

মিস্ত্রির কাজ দেখে লুকাস তো মহাখুশি। হঠাৎ লুকাসের চোখ পড়লো মিস্ত্রির দু’চোখের দিকে। কী গভীর চাহনি! এরকম ‘ইন্সটেন্স লুক’ এর একজন অভিনেতাই তো এতদিন ধরে তিনি খুঁজছিলেন।

“অভিনয় করেছ কখনো?”- লুকাসের প্রশ্ন। জবাবে মিস্ত্রি বলল, “আগে অভিনয়ই ছিল আমার পেশা। কলম্বিয়া পিকচার্স এর সঙ্গে হপ্তায় ১৫০ ডলারের চুক্তিতে ছোটখাটো ফালতু রোল করেছি। তাতে সংসার চলছিল না। তাই বাধ্য হয়ে এই পথে। নেমে পড়েছি কাঠের কাজে”।

হলিওউডের একাধারে চলচ্চিত্র নির্মাতা, পরিচালক ও প্রযোজক জর্জ লুকাস। ছবিসূত্র: microgiving.com

দয়া পরবশ হয়ে নিজের দুটো গুরুত্বপূর্ণ ছবিতে মিস্ত্রিকে সুযোগ দিয়ে দিলেন লুকাস। মোটামুটি উৎরেও দিলো মিস্ত্রি। সেটা ঐ পর্যন্তই ছিল সমাপ্তি। আবারও মিস্ত্রি ফিরে গেলো নিজের কাজে। এবার কিন্তু স্টুডিওর কাঠের কাজ। আবার একদিন লুকাসের বন্ধু স্পিলবার্গের নজরে আসলো মিস্ত্রি।

স্টিভেন স্পিলবার্গ। ছবিসূত্র: Mirror

লুকাসের কাছ থেকেই স্পিলবার্গ জানতে পারলো মিস্ত্রির পরিচয়। লুকাসের হাত চেপে ধরে তিনি বলেন, “‘হ্যান সোলো’ হবে ও। ওর মধ্যেই কিন্তু আছে স্টার ম্যাটেরিয়াল”। বন্ধুর কথা ফেলতে পারলেন না লুকাস। ১৯৭৫ সালে মুক্তি পেলো ‘স্টার ওয়ারস’, কিস্তি মাত। ছবি হিট, তার চেয়েও বড় হিট হ্যান সোলো।

সেই কাঠের মিস্ত্রি আর কেউ নন, কিংবদন্তি অভিনয়শিল্পী হ্যারিসন ফোর্ড।

‘স্টার ওয়ারস’ অভিনয়ের মধ্য দিয়ে বাজিমাত করা মিস্ত্রি হ্যারিসন ফোর্ড। ছবিসূত্র: CinemaBlend

অভিনয় ছিল তার রক্তে। জন্ম ১৩ জুলাই, ১৯৪২ শিকাগোর সুইডিশ কনভেন্ট হাসপাতালে। মা ডরোথি ছিলেন প্রাক্তন রেডিও অভিনেত্রী। বাবা পেশায় অ্যাডভার্টাইজিং এক্সিকিউটিভ হলেও এক সময় চুটিয়ে অভিনয় করেছেন। ফলে অভিনয়ের নেশা বা হাতেখড়ি যা-ই বলি না কেন তা ফোর্ড মা-বাবার কাছ থেকে পান।

হ্যারিসনের অভিনয়ে আগ্রহ কলেজে পড়তে পড়তেই। এই সময় ফোর্ড বয় স্কাউট অব আমেরিকার সক্রিয় সদস্য হন এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ র‍্যাঙ্ক, লাইফ স্কাউট অর্জন করেন। উইসকনসিনের রিপন কলেজে অধ্যয়নের সময় তিনি সিগমা ন্যু ভ্রাতৃসংঘের সদস্য হন। নিজের লজ্জাভাব দূর করতে শেষের দিকে ফোর্ড ড্রামা ক্লাসে অংশ নেন। এ প্রসঙ্গে তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমি শৈশবে কারো সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে ভয় পেতাম। কিন্তু কেউ একজন মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে গল্প বলছে, তা বেশ উপভোগ করতাম। ড্রামা ক্লাসে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ করতে বেশ সাহায্য করেছিল।” কলেজে তিনি খুব একটা মেধাবী ছিলেন না। গ্র্যাজুয়েট না হয়েই পেশাদার অভিনেতা হওয়ার জন্য তিনি লস অ্যাঞ্জেলসে চলে আসেন ।

ড্রামা ক্লাসে পড়ার সময় তোলা ছবি। ছবিসূত্র্র: Pinterest

ফোর্ড ১৯৬০ সালের মাঝামাঝি সময়ে চলে আসেন হলিউডে অভিনয়ের জন্য। সপ্তাহে ১৫০ ডলারের বেতনে কলম্বিয়া পিকচার্সের বেতনভুক্ত অভিনেতা হিসেবে অভিনয় করতেন। ফোর্ড প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে ‘ডেড হিট অন এ মেরি গো রাউন্ড’-এ ছোট একটি নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন। চলচ্চিত্রটি তেমন একটা সাফল্য পায়নি। সেসময় স্টুডিওর একজন কর্মী ফোর্ডকে বলেছিল- “এই পেশায় তোমার কিছু হবে না।”

১৯৭৩ সালে চলচ্চিত্র পরিচালক জর্জ লুকাস তার ‘আমেরিকান গ্রিফিথি’ চলচ্চিত্রে ফোর্ডকে প্রথম নাম ভূমিকায় অভিনয়ের সুযোগ দেন। কিন্তু সে চলচ্চিত্রটিও আশানুরূপ সাফল্য পায়নি। এ সময় আরো কিছু ছোট চলচ্চিত্রে অভিনয় করলেও খুব একটা সফল হননি ফোর্ড। ১৯৭৭ সালে জর্জ লুকাস ও স্পিলবার্গের যৌথ পরিচালনায় পারচালিত ‘স্টার ওয়ারস’ এর হ্যান সলো চরিত্রে অভিনয় ফোর্ডের চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারের একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে ধরা হয়। তার অভিনয় জীবনের আমূল পরিবর্তন ঘটে এই চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে। ‘স্টার ওয়ারস’ ফোর্ডের অভিনীত প্রথম সাফল্য পাওয়া চলচ্চিত্র।

‘স্টার ওয়ারস’ এর হ্যান সলো চরিত্রে হারিসন ফোর্ড। ছবিসূত্র: telegraph.co.uk

হলিউডের সর্বকালের অন্যতম ব্যবসা সফল ফ্র্যাঞ্চাইজি ‘স্টার ওয়ারস’র সাতটি পর্বে হ্যান সলো চরিত্রে অভিনয় করেন ফোর্ড। ২০১৫ সালে ‘স্টার ওয়ারস’র সর্বশেষ পর্ব মুক্তি পায়। ৭৩ বছর বয়সী ফোর্ডের সাবলীল অভিনয় দর্শকদের বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে।

‘স্টার ওয়ারস’ এর পর স্পিলবার্গের পরিচালনায় ফোর্ড অভিনয় করেন ‘ইন্ডিয়ানা জোন্স’ সিরিজের নাম ভূমিকায় একজন আর্কিওলজিস্টের চরিত্রে। ১৯৮১ সালে ‘ইন্ডিয়ানা জোনস’ সিরিজের প্রথম ছবি ‘রেইডার্স অব দ্য লস্ট আর্ক’ রিলিজ হয়। নাম ভূমিকায় অভিনয়ের সুবাদে ফোর্ড বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করেন। তার জনপ্রিয়তাকে অন্য এক মাত্রায় পৌঁছে দেয় এ চরিত্র। তিনি হয়ে উঠেন হলিউডের সবচেয়ে নামী দামী এক স্টার, কুড়িয়ে নেন সমালোচকদের অভিবাদন।

এরপর আরো তিনটি কিস্তিতে তাকে দেখা গেছে ইন্ডিয়ানা জোন্সের ভূমিকায়। এরপর এসেছে ‘ইন্ডিয়ানা জোন্স এন্ড দ্য টেম্পল অব ডুম’ (১৯৮৪) ও ‘ইন্ডিয়ানা জোন্স এন্ড দ্য লাস্ট ক্রুসেড’ (১৯৮৯)। সিরিজের সর্বশেষ ছবি ‘ইন্ডিয়ানা জোন্স এন্ড দ্য কিংডম অব দ্য ক্রিস্টাল স্কাল’ (২০০৮) মুক্তির সময় ফোর্ডের বয়স ছিল ৬৫ বছর। এটি সমালোচকদের ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করে। এতে জোন্সের প্রথম ছবির প্রেমিকা ম্যারিয়ন র‌্যাভেনউড হিসেবে ফিরে আসেন কারেন অ্যালেন। তাদের ছেলের ভূমিকায় যুক্ত হন শিয়া ল্যাবাফ। বিশ্বব্যাপী প্রায় ২০০ কোটি ডলারের ব্যবসা করে ছবিটি।

১৯৯৭ সালে যখন বিখ্যাত ‘এম্পায়ার’ পত্রিকা সর্বকালের সেরা ১০০ অভিনেতার তালিকা প্রকাশ করে, তাতে দেখা যায়, ১ নম্বরে জ্বলজ্বল করছে ‘হ্যারিসন ফোর্ড’ নামে এক তারকার নাম। ছয় দশক ধরে অভিনয় করে চলা হ্যারিসন ফোর্ড হলিউডের বেশ কিছু ব্লক বাস্টার ছবিতে অভিনয় করেছেন- এপোক্যালিপস নাউ (১৯৭৯), প্রিস্যুমড ইনোসেন্ট (১৯৯০), দ্য ফিউজিটিভ (১৯৯৩), এয়ার ফোর্স ওয়ান (১৯৯৭), হোয়্যাট বিনিথ লাইস (২০০০)।

সম্প্রতি হ্যারিসন ফোর্ডের মানবিক একটি দিক প্রকাশ পেয়েছে। ‘স্টার ওয়ারস’ সিরিজের ছবিতে নিজের পরা বাদামি রঙা একটি জ্যাকেট নিলামে তুলেন হলিউডের এই বর্ষীয়ান অভিনেতা । ১,৯১,০০ ডলারে বিক্রি হওয়ার সম্পূর্ণ অর্থ দান করা হয় নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ল্যাঙ্গোন মেডিকেল সেন্টারে। মৃগীরোগের প্রতিকার খুঁজতে তহবিল সংগ্রহই হ্যারিসন ফোর্ডের উদ্দেশ্য। নিলামের এই অর্থ হাসপাতালে থাকা মৃগী রোগীদের কল্যাণার্থে ব্যয় করা হবে বলে ফোর্ড জানান। এ প্রসঙ্গে একটি তথ্য না দিলেই নয়- ফোর্ডের কন্যা জর্জিয়া মৃগীরোগী হিসেবে গত আট বছর ধরে ল্যাঙ্গোন সেন্টারে চিকিৎসাধীন আছে।

হ্যারিসন ফোর্ড এক অনুপ্রেরণার নাম। ঘাত-প্রতিঘাতে জর্জরিত জীবনে কঠোর পরিশ্রমে আজ তিনি কেবল হলিউডের একজন বিখ্যাত অভিনেতাই নন, একজন সফল মানুষও বটে। জীবনের পথচলায় তার কর্মমুখর জীবন আমাদের প্রতিনিয়ত অনুপ্রেরণা জোগাবে এ কথা বলা যায় নিঃসন্দেহে।

Featured Image: superluchas.com

References: 

1. en.wikipedia.org/wiki/Harrison_Ford

2. biography.com/people/harrison-ford-9298701

3. businessinsider.com/harrison-ford-reddit-ama-from-carpenter-to-han-solo-in-star-wars-2014-4

4. cbr.com/movie-legends-revealed-how-did-harrison-ford-accidentally-audition-for-star-wars/

5. telegraph.co.uk/culture/film/film-news/11455239/Harrison-Ford-his-life-and-career.html

6. mirror.co.uk/3am/celebrity-news/harrison-ford-auctions-han-solo-7645592

Description: This is a Bangla article about story of a hero- from carpenter to become an actor.

Related Articles

Exit mobile version