সন্তানের মৃত্যুতে মায়ের কষ্ট হয়। সেটাই স্বাভাবিক। তবে মা নিজেই যদি হন সন্তানের ঘাতক তাহলে ব্যাপারটা একটু অন্যরকম হয়ে যায়। মা হিসেবে তখন তার কি আর কোনো কষ্ট হয়? শিশু সন্তানকে স্বেচ্ছায় মেরে ফেলেন যে মা তার শাস্তিটাই বা কী হওয়া উচিৎ? এই প্রশ্ন যে কাউকে ভাবিয়ে তুলবে। আর এমনই এক প্রশ্ন ভাবিয়ে তুলেছিল গোটা যুক্তরাষ্ট্রকেও।
১৯৯৪ সালের ২৫শে অক্টোবরের কথা। আমেরিকার ইউনিয়ন সাউথ ক্যারোলিনায় হঠাৎ করে প্রচন্ড সাড়া ফেলে দেয় এক মায়ের সন্তান হারানোর বুক ফাটা কান্না। মায়ের নাম সুজান স্মিথ। ক্যারোলিনার বাসিন্দা সুজান পুলিশকে জানায় গাড়ি করে বাড়ি ফেরার সময় হঠাৎ এক কালোদর্শন ব্যক্তি তাকে ভয় দেখিয়ে গাড়ি থেকে বের হতে বাধ্য করে আর গাড়ির ভেতরে বসে থাকা সুজানের দুই সন্তানকে নিয়ে পালিয়ে যায়।
শিশু দুটির বয়স খুবই কম। মাইকেল ড্যানিয়েল স্মিথের বয়স ছিল ৩ বছর আর এ্যালেক্স টেইলার স্মিথের বয়স ছিল মাত্র ১৪ মাস। কিছুদিন আগেই নিজের প্রথম জন্মদিন পালন করেছিল এ্যালেক্স। কেক নিয়ে তার আনন্দে ভরা মুখের হাসি চোখের পলকে নাড়িয়ে দেয় আমেরিকাসহ পুরো পৃথিবীকে। শুরু হয় খোঁজ। পুলিশ, সাধারণ মানুষ- সবাই নিজের মতো করে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে শুরু করে মাইকেল আর এ্যালেক্সের খোঁজ। নিষ্পাপ শিশুদের হারিয়ে যাওয়া- এটুকুই হয়তো যথেষ্ট ছিল। কিন্তু তদন্তে খুঁজে পাওয়া যায় এমন আরো কিছু যেগুলো চিন্তায় ফেলে দেয় আইন বিভাগকে।
কলম্বিয়ার ভীড়-বাট্টায় ভরা শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে অবস্থিত ইউনিয়ন, সাউথ ক্যারোলিনায় কখনোই খুব বেশি ঝামেলা দেখা যায়নি। এমন একটি শান্তিপূর্ণ স্থানে বাস করছিল সুজান স্মিথ আর তার পরিবার। ১৯৯৫ সালের ২৫শে অক্টোবর বিকেল ৩টা বেজে ৩০ মিনিটে কসনো নামক একটি ফেব্রিক এন্ড ম্যানুফেকচার কোম্পানি থেকে বেরিয়ে আসে সুজান। কোম্পানিটির সেক্রেটারি হিসেবে তখন কাজ করছিলো সে। কোম্পানির মালিকের ছেলে টম ফিন্ডলির সাথে কিছুদিন যাবত ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো তার। কিছুদিন হচ্ছিলো টম আর সুজানের সম্পর্কে টানাপোড়েন উঁকি মারছিল। ফলে সম্পর্কটি শেষ হয়ে যায়। আর সেটাও সুজানের দুই সন্তান হারিয়ে যাওয়ার কিছুদিন আগেই।
নিজের আর ফিন্ডলির সম্পর্ক নিয়ে মানসিক কষ্টে ভুগছিলো সুজান। স্বামী ডেভিডের সাথেও সম্পর্ক ভালো চলছিলো না তার। বিবাহ বিচ্ছেদ চলছিল দুজনের। অফিস থেকে বেরিয়েই গাড়িতে চড়ে বসে সুজান স্মিথ। মাইকেল আর এ্যালেক্স তখন ডে-কেয়ার হোমে। কাজ থেকে সরাসরি সেখানে গিয়ে সুজান ছেলেদের নিয়ে গাড়িতে ফিরে আসে। পথে একবার নিজের সহকর্মী বন্ধুর সাথে কথা বলেন তিনি। ফিন্ডলির ব্যাপারটা নিয়ে কষ্ট পাচ্ছিলো সুজান। এরপর কয়েকবার চেষ্টা করেন তিনি ফিন্ডলির সাথে সম্পর্কটা স্বাভাবিক করার। কোনো লাভ হয় না।
সন্ধ্যা প্রায় ৬টার দিকে নিজের বাড়িতে ফিরে আসেন সুজান। ছেলেদের জন্য পিজ্জা বানিয়ে আবার বন্ধুর সাথে কথা বলেন তিনি। সুজানের মনে ক্ষীণ আশা ছিল তখন, হয়তো ফিন্ডলি তার নাম উচ্চারণ করেছে, তার কথা ভেবেছে। কিন্তু সেরকম কোনো কিছুই হয়নি তখনো। টম ফিন্ডলি নিজের জীবন থেকে একেবারে বাদ দিতে চেয়েছিলেন সুজানকে। সাড়ে ৭টা পর্যন্ত তা-ও আশা নিয়ে অপেক্ষা করে সুজান। এই হয়তো টম ফিন্ডলি ফোন দিল! কিন্তু ফোন আর আসেনি। শেষমেশ রাত ৮টার দিকে ছেলেদেরকে নিয়ে ১৯৯০ সালের গাড়ি মাজদা পোর্টজেতে চড়ে বসে সুজান। আশেপাশে কিছুক্ষণের জন্য ঘুরে আসার ইচ্ছে ছিল তার। কিন্তু সুজান আর তার দুই শিশুপুত্রের সেদিনটা কেবল ঘোরাঘুরিতেই শেষ হয়ে যায়নি। মাঝে কিছু কেনাকাটার জন্য ওয়ালমার্টে থামে সুজান। তারপর সেখান থেকে বন্ধুর বাসায় যাওয়ার জন্য রওনা দেয়। তবে সুজান আর সেই বন্ধুর বাসায় যায়নি সেদিন। কিংবা বলা ভালো যেতে পারেনি।
কী হয়েছিল সেদিন? মূল কাহিনীর দুটো বর্ণনা আছে। সুজানের ভাষ্যমতে, মোনার্ক মিল টেক্সটাইল প্ল্যান্টের কাছাকাছি যাওয়ার পরপরই সিগন্যালে আটকে যায় তার গাড়ি। জায়গাটা ছিল প্রধান সড়ক থেকে প্রায় দুই মাইল দূরে। সিগন্যালে থাকার সময় হঠাৎ করে এক কালো লোক এসে গাড়ির কাঁচ ভেঙে সুজানকে পিস্তল দেখায়। তারপর মানুষটিকে সাথে নিয়েই হাইওয়ে ফোর্টি নাইনের দিকে যায় সুজান। ১০ মিনিট পর জন ডি লং লেকের রাস্তায় এসে পড়লে সুজান নিজেকে আর সন্তানদেরকে বাঁচানোর জন্য বারবার অনুরোধ করতে থাকে। পেছনের সিটে বাচ্চারা কাঁদছিল তখন। বিরক্ত হয়েই হয়তো কালো লোকটি সুজানকে বাইরে বের করে দেয় আর বাচ্চাদেরকে নিয়ে চলে যায়।
কী করবে বুঝতে না পেরে সুজান পাশের একটি বাড়িতে গিয়ে সাহায্য চায়। কিন্তু কিছুতেই কোনো লাভ হয় না। এটাই ছিল সুজানের স্বীকারোক্তি। এদিকে ঘটনাটি ঘটার কয়েক মিনিটের ভেতরেই ইউনিয়নের শেরিফ হাওয়ার্ড ওয়েলস কাজে নেমে পড়েন। তিনি এফবিআই আর সাউথ ক্যারোলিনার আইন বিভাগকে সবকিছু জানান আর শিশু দুটিকে খুঁজে বের করতে তাড়া দেন। সাউথ ক্যারোলিনা আইন বিভাগ বা স্লেড খুব দ্রুত কাজ শুরু করে দেয়। শেরিফকে সাহায্য করার জন্য নিজেদের বিশেষজ্ঞদের পাঠায় তারা। ইতিমধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায় সুজানের স্বামী ডেভিড। সুজানের অবস্থা আর দুই সন্তানের নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে জানতে পেরে মুষড়ে পড়েন ডেভিড। তবে ডেভিডের চাইতেও বাজে অবস্থায় ছিল তখন সুজান। সন্তানদের হারিয়ে একরকম পাথর হয়ে পড়েছিল সে। পরদিন সকালের ভেতরেই ইউনিয়নের সবাই মিলে এ্যালেক্স আর মাইকেলকে খোঁজা শুরু করে। টানা নয় দিন ধরে খোঁজাখুঁজি চলে। রাস্তা, বন, খাল- কোনোকিছুই বাদ রাখেনি সাধারণ মানুষ আর পুলিশ। তবুও এত খুঁজেও এলেক্স বা মাইকেলের কোনো হদিস মেলেনি।
শুরু থেকেই একটু একটু সন্দেহ কাজ করছিল পুলিশের সুজানের উপর। সুজানের উপর করা পলিগ্রাফের পর ট্রুথ সিরাম দেওয়া হলে সেখানে আবার নিজের উপর সবার সন্দেহ টেনে আনে সুজান। সুজানের ভাষ্যমতে, তার গাড়িতে পিস্তল দেখিয়ে কালো মানুষটা যখন উঠছিল, তখন সেখানে আর কোনো গাড়ি ছিলো না। তাই এই ঘটনাটি কেউ দেখতে পায়নি। আর একইসাথে সে এটাও বলছিল যে, লাল আলো জ্বলেছিলো বলেই সে গাড়ি থামাতে বাধ্য হয়েছিল। সুজানের এই কথা শুনেই খটকা লাগে পুলিশের। কারণ রাস্তায় যদি গাড়ি না থাকে তাহলে অন্য রাস্তা বন্ধ করে সেই রাস্তা খুলে দেবে কেন কেউ? সুজানের গাড়ি যদি লাল আলো জ্বালানোর কারণে থামে তাহলে নিশ্চয়ই রাস্তার অন্য পাশে গাড়ি ছিল তখন। কিন্তু সুজানের কথামতো সেখানে এরকম কিছুই ছিলো না তখন। তবু সুজানের উপর কোনোরকম অভিযোগ আনেনি পুলিশ তখনো।
নিজেদের এই চিন্তা আর সন্দেহকে পাত্তা দেয়নি তারা। ভেবেছে কেন নিজের বাচ্চাদের সাথে এমন করবে সুজান? বিভিন্ন সংগঠনের সাথে জড়িত ছিল সুজান, বন্ধুদের সাথে বেশ হাসিখুশি ছিলেন। তাই তাকে সন্দেহ করাটাও খুব অপ্রত্যাশিত ছিল। মিডিয়ার কাছে কেঁদে কেঁদে নিজের সন্তানদেরকে ভিক্ষা চায় সুজান একটা সময়। সবার সমবেদনা চলে যায় সন্তানহারা মা সুজানের প্রতি। ফলে সরাসরি কোনো অভিযোগ ছাড়াই একইসাথে কালো কোনো একজন মানুষকে খুঁজতে থাকে পুলিশ। সেই সাথে চোখ রাখে সুজানের উপরও। স্টেটের পক্ষ থেকে রবার্ট স্টুয়ার্ট কাজ করতে থাকেন কেসটি নিয়ে। সবখানে খোঁজা হয় সুজানের সেই গাড়িটিকে। পুলিশের বিশ্বাস ছিল, যদি সুজান তার সন্তানদেরকে লুকিয়ে রাখে তাহলে এ্যালেক্স আর মাইকেল এখনো বেঁচে আছে। সুজান জানে তারা কোথায় আছে।
ঘটনার কিছুদিন পর সুজানের গাড়ির মতো একটি গাড়ি খুঁজে পায় পুলিশ। তবে সেটি আসল গাড়ি ছিল না। ইতিমধ্যে ইউনিয়নের বাসিন্দারা বাচ্চাদের খুঁজতে পুলিশকে সাহায্য করতে শুরু করে। প্রায় হাজারখানেক পোস্টার ছাপায় তারা। বিভিন্ন স্থানে হলুদ রিবন বাঁধে। ঘোড়ায় চড়ে জঙ্গলে খুঁজে দেখে। শেষমেশ জন ডে লং লেকে খোঁজে পুলিশ। তীরের থেকে ১০০ ফুট দূর পর্যন্ত ড্রাইভাররা খুঁজে ফেরে গাড়ি এবং মৃতদেহগুলোকে। এর ভেতরে এফবিআই সুজানের ঘরে তল্লাশী চালায়। কিন্তু সেখানেও কিছু খুঁজে পায়নি তারা। ঘটনার এক সপ্তাহ পর টিভির সামনে আবার এসে হাজির হয় সুজান আর ডেভিড। নিজের বাচ্চাদেরকে আবার ফেরত চায় সুজান। ঘটনা ঘটার ৮ নম্বর দিনে সুজানের কথায় আরো কিছু অসঙ্গতি খুঁজে পায় পুলিশ।
প্রথমত, আগে থেকেই রাস্তার ট্রাফিকের রেড লাইট নিয়ে বেশ সন্দেহ কাজ করছিল পুলিশের সুজানের প্রতি। এবার সেটা আরো জোরদার হয় যখন তদন্ত করে জানা যায় যে, ২৫ অক্টোবর রাতে সুজান ওয়ালমার্টে যায়ই নি। এমনকি সে যে বন্ধুর বাড়িতে যাবে বলে রওনা দিয়েছিল সেই বন্ধুটিও ২৫ তারিখে বাসায় ছিল না। তাহলে কি পুলিশকে একেবারেই মিথ্যো বলেছিল সুজান? জানতে চাইলে পুলিশকে দেওয়া নিজের স্টেটমেন্ট বদলে ফেলে সুজান। নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে থাকে সে। তবে এবার কেবল পুলিশ বা এফবিআই নয়, সুজানকে সন্দেহ করতে থাকে মিডিয়াও। বিশেষ করে যখন বারবার টিভিতে বলা কথাগুলোতে সুজান মাইকেল আর এ্যালেক্সকে “আমি তোমাদের খুব ভালবাসতাম” ধরনের শব্দগুলো ব্যবহার করছিল তখনই মানুষের মনে প্রশ্ন উঠে আসে কেন এমন করছে সুজান। কেন এভাবে অতীতের কথা বলছে? এখন কি আর তাহলে নিজের বাচ্চাদেরকে ভালোবাসে না সে? কেন বাসে না? তার মানে কি সুজান এমন কিছু জানে যেটা অন্যকেউ জানে না? অন্যদের মনে তখনো আশা, না! ছোট্ট শিশু দুজন হয়তো মারা যায়নি। কিন্তু সুজান কী করে এত নিশ্চিত হয়ে গেল সুজান? কীভাবে এত সহজে বলছে সে যে তার ছেলেরা আর নেই?
নিজেকে নির্দোষ বলে দাবী করে সুজান। তবে পরের বৃহস্পতিবারে প্রশ্নোত্তর পর্বের সময় একেবারে ভেঙে পড়ে সুজান। কান্নামাখা গলায় কেবল বলতে থাকে তার সন্তানেরা ভালো নেই। এরপর পুলিশকে সে নিজেই জন ডে লং লেকের পানির নিচে নিজের গাড়ি আর বাচ্চাদের খুঁজতে বলে সে। সুজানের কথামতো তীর থেকে প্রায় ১২২ ফুট দূরে পানির নিচে খুঁজে পাওয়া যায় হারানো গাড়ি। আর কেবল গাড়িই নয়, গাড়ির ভেতরে পেছনের সীটে বসে থাকা মৃত মাইকেল আর এ্যালেক্সকেও আবছাভাবে দেখা যাচ্ছিলো তখন। গাড়ির ফ্ল্যাশলাইট তখনও জ্বলছিল। মৃতদেহগুলো তখনো গাড়ির ভেতরে ডুবন্ত অবস্থাতেই ছিল। জানালা বন্ধ থাকায় সেখানে পানি প্রবেশ করতে পারেনি এতদিনেও। পরবর্তীতে সুজানকে নিয়ে পুলিশ চার্চে আসে আর সেখানেই লিখিত একটি স্বীকারোক্তি দেয় সুজান।
নিজের সন্তানদের সাথে করা নিকৃষ্টতম ব্যবহারকে মেনে নেয় সে। আর নিজের এই নতুন লেখায় সে জানায় ঘটনার দিন ২৫শে অক্টোবর সে আত্মহত্যা করার চিন্তা করছিল। একজন মা হিসেবে সুজান চায়নি যে তার মৃত্যুর পর তার সন্তানেরা একা হয়ে যাক বা খারাপ থাকুক। আর তাই নিজেকে মারার আগে সন্তানদের মেরে ফেলতে চেয়েছিলো সে। প্ল্যান সব ঠিক করাই ছিল। গাড়ি নিয়ে সোজা লেকের কাছে চলে যায় সুজান। সেখান থেকে সোজা গাড়ি নামিয়ে দেয় লেকের পানিতে। তবে তার আগে একবার ব্রেক কষে গাড়ি থামিয়ে দেয় সে। তারপর নিজে নেমে যায় গাড়ি থেকে আর বাইরে থেকে গাড়িকে আবার সামনের দিকে এগিয়ে দেয়। ঢালু স্থানে দ্রুত গাড়ি নেমে যায় পানিত অতলে। সেখানেই মৃত্যু হয় ৩ বছর বয়সী মাইকেল আর ১৪ মাস বয়সী এ্যালেক্সের। সেদিন সন্ধ্যায়ই শেরিফ ওয়েলস সবাইকে জানিয়ে দেন সুজান স্মিথের অপরাধ সম্পর্কে আর সুজানকে নিজের দুই সন্তানের খুনী হিসেবে প্রকাশ করেন। এই ঘোষণা শোনার পর পুরো ক্যারোলিনা আর পৃথিবীর মানুষ অবাক হয়ে যায়। সেই সাথে এতদিন ধরে যারা সুজানকে সমবেদনা জানিয়েছিলো আর তার সন্তানদেরকে খুঁজতে সাহায্য করছিলো অর্থাৎ ইউনিয়নের সবাই প্রচন্ড ক্ষেপে ওঠে। সুজানের প্রতারণা ডেভিডকেও অবাক করে দেয়। একজন মা কীভাবে তার সন্তানকে খুন করতে পারে সেটা ভেবে স্তব্ধ হয়ে যায় পুরো পৃথিবী।
বিচার শুরু হল। সাউথ ক্যারোলিনা প্রশাসন সুজানের মৃত্যুদণ্ডের কথা বললেও ডিফেন্স থেকে বলা হয় সুজান নিজেও নিজের অপরাধের জন্য অনুতপ্ত। সে মারা যেতে চায়। তাই এই অবস্থায় তাকে বাঁচিয়ে রাখলে সেটাই হবে তার জন্য আরো বেশি শাস্তি। সাউথ ক্যারোলিনার হাজার হাজার মানুষ এই সময় শিশু মাইকেল আর এ্যালেক্সের শেষকৃত্যে অংশ নেয়। যে লেকের ভেতরে তাদের জীবন সমাপ্ত হয়েছিলো সেটার পাশে খেলনা, ফুল আর অনেক ভালোবাসা নিয়ে ভীড় জমায় সবাই। ১৯৯৪ সালের ৬ নভেম্বর, রবিবার মাইকেল আর এ্যালেক্সকে কবর দেওয়া হয়। তাদের দুজনের শরীর একই স্থানে দাফন করা হয়। সুজানকে এ্যারেস্ট করার সাথে সাথে এতদিন ধরে ইউনিয়নের যে মানুষগুলো তাকে সমর্থন করে এসেছিলো তারাই রাগে ফুঁসতে থাকে আর সুজানের বিরুদ্ধে র্যালি করে।
রাস্তার হলুদ রিবনগুলো তুলে সেখানে সাদা আর নীল রিবন লাগিয়ে দেয় তারা। একদিনের ভেতরেই সুজানের প্রতি সবার ভালোবাসা ঘৃণায় পরিণত হয়। বিশেষ করে কালো চামড়ার মানুষেরা বিনা কারণে দোষ দেওয়ার জন্য আরো বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে যায় সুজানের প্রতি। ১২ই ডিসেম্বর খুনের দায় আনা হয় সুজানের উপর। ১৬ই জানুয়ারি ইউনিয়ন কাউন্টি আইনজীবী টমি পোপ যিনি এই মামলার প্রসিকিউটর হিসেবে কাজ করছিলেন সুজান স্মিথের মৃত্যুদন্ডের কথা বলেন। সুজান স্মিথ একজন পাবলিক ডিফেন্ডার জুডি ক্লার্ককে নিয়োগ করেন নিজের জন্য। সুজানের মা এবং সৎ বাবা পরবর্তী আইনজীবী ডেভিড ব্রুককে নিয়োগ দিতে নিজেদের বাড়ি বন্ধক রাখেন।
বিচারক উইলিয়াম হাওয়ার্ড কেসের সাথে জড়িত সমস্ত খুঁটিনাটি নিয়ে কাজ করা শুরু করেন। এমন একটি কেসের ব্যাপারে রায় দেওয়ার জন্য সঠিক বিচারক পাওয়া খুব বেশি কঠিন হয়ে পড়েছিলো। ডেভিড ব্রুক ইচ্ছে করলেই স্থান পরিবর্তন করতে পারতেন। কিন্তু তিনি বিচারক হিসেবে স্থানীয়দেরকেই বাছাই করেন। খুব দ্রুততার সাথেই চলতে থাকে কোর্ট রুমের কাজ। সুজান স্মিথের বিচার শুরু হয় ১৯৯৫ সালের ১৭ই জুলাই। হয়তো আরো তাড়াতাড়ি ও সহজে পুরো কাজটা হতে পারতো। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রসিকিউশন নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারে। যদিও কোনো দরকার ছিলো না, তবুও কেন সুজান নিজের সন্তানদেরকে খুন করেছেন সেই মোটিভ হাজির করার চেষ্টা করছিল প্রসিকিউশন। প্রতিদিন কোর্টের বাইরে শয়ে শয়ে মানুষের লাইন লেগে থাকাটা যেন অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে পড়েছিলো।
সাউথ ক্যারোলিনের বিচার ব্যবস্থা দুই ভাগে বিভক্ত। একটি অংশ নির্ধারণ করে ব্যক্তি দোষী নাকি নির্দোষ। আর অন্য অংশটি ঠিক করে দেয় কোন ধরনের শাস্তি হতে পারে। প্রথম অংশটির ক্ষেত্রে সুজান স্মিথ পুরোপুরি দোষী হিসেবে বিবেচিত হয়। এছাড়া তার লিখিত বিবরণের মাধ্যমেও সেটা পুরোপুরি প্রমাণিত হয়। তবু প্রসিকিউশন এমন কোনো জায়গা রাখতে চায়নি যেটার মাধ্যমে আবার নতুন করে কিছু বলা যায় বা আঙ্গুল তাক করা যায় বিচার পদ্ধতির দিকে। আর তাই প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি বজায় করতে শুরু করে তারা। খুনের মোটিভ হিসেবে বলা হয়, সুজান তার সন্তানদেরকে হত্যা করেছিলো নিজের ধনী প্রেমিককে ফিরে পেতে। হত্যার কিছুদিন আগে সুজানকে লেখা টমের কিছু চিঠিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে টম যে, তাদের সম্পর্ক শেষ করার পেছনে অন্যতম কারণ হল সুজানের সন্তান। টম ফিন্ডলি সুজানের আগের ঘরের বাচ্চাদের বাবা হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে চাচ্ছিলো না। আর এই কারণেই নিজের সন্তানদেরকে খুন করেছিলো সুজান- এমনটা ধারণা করে প্রসিকিউটর। সন্তান না থাকলে কোনো দায়িত্ব থাকবে না। টম ফিরে আসবে। ব্যাপারটা ছিল অনেকটা এরকম।
কিন্তু ডিফেন্স এক্ষেত্রে একেবারেই অন্য একটি ব্যাপার তুলে আনে। তাদের বক্তব্য অনুসারে, মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, সুজানের মানসিক অবস্থা খুব একটা ভালো কখনোই ছিলো না। ছোটবেলা থেকেই মানসিক চাপে ভুগতে হয়েছে সবসময় সুজানকে। মাত্র ৬ বছর বয়সে সুজান তার বাবাকে হারায়। আত্মহত্যা করে মারা যায় সুজানের বাবা। আর আর যে ব্যক্তিদের পরিবারে আত্মহত্যার নজির থাকে তাদের ভেতরেও এই প্রবণতা দেখা দেয় অনেক বেশি হারে। ফলে ঠিক এই একই জিনিস কাজ করেছে সুজানের ভেতরেও। বাবার মৃত্যুর পর সুজানের মা অন্য একজনকে বিয়ে করেন। সবকিছু মিলিয়ে হতাশায় ভুগতো সুজান সবসময়। কিন্তু সেটা আরো একটু বেশি মাত্রা পায় যখন সুজানের সৎ বাবা তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। সুজানের সৎ বাবা বেভারলি রাসেল বিয়ের পর সুজানের সাথে জোর করে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তখন সুজানের বয়স ছিল ১৫ বছর। সেসময় একবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে সুজান স্মিথ। হাসপাতালে জায়গা হয় তার। অবশ্য বেঁচে ফেরে সুজান সেবার। এমনকি মাইকেল আর এলেক্স খুনের ঘটনার তিন মাস আগেও সৎ বাবা জোর করে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে সুজানের সাথে।
মোট দু’বার আত্মহত্যার চেষ্টা করে সুজান। সফল না হওয়ায় তার হতাশা আরো বেড়ে যায়। মানসিকভাবে একেবারেই সুস্থ ছিলো না সুজান, এটা বলতে বেগ পেতে হয় না। তাই তার মানসিক অসুস্থতার কথা ভেবে আর নিজের কৃতকাজ নিয়ে অনুশোচনা দেখে বিচারের রায় প্রদান করতে অনুরোধ করে ডিফেন্স। সুজানের এই কর্মকান্ড যে কোনো পরিকল্পিত হত্যা নয়, বরং হুট করে আবেগ, মানসিক অবসাদ আর আত্মহত্যার প্রবণতা থেকে করা একটি কাজ সেটা প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়। পরিস্থিতি তখন অনেকটা ডিফেন্সের দিকে চলে গিয়েছিলো। কোর্ট অবশেষে সিদ্ধান্ত নেয় নতুন একজন মনরোগ বিশেষজ্ঞকে এই কেসের ব্যাপারে অন্তর্ভুক্ত করার। তিনি সুজানকে পরীক্ষা করেন। কিন্তু তাতে করেও প্রশ্ন থেকেই যায়, যদি সুজান নিজে আত্মহত্যা করবে বলেই সন্তানদের মারার মতো কাজ করতে পারে, তাহলে সে পরবর্তিতে কেন একবারের জন্যও আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেনি?
২৪ জুলাই সুজান স্মিথের পেনাল্টির পর্যায় শুরু হয়। প্রসিকিউটর পুরো ব্যাপারকে আরো ভালোভাবে পর্যালোচনা করতে চাচ্ছিলো। প্রসিকিউটর এটা প্রমাণ করতে চাচ্ছিলো যে, আবেগের বশে এমন কাজ করেনি সুজান। যদি আবেগের বশে করে থাকতো তাহলে এত ঠান্ডা মাথায় সে এটা করতে পারতো না। সামনে নিজের সন্তানেরা মারা যাচ্ছে সেটা বোঝার সাথে সাথে তাদেরকে বাঁচাতে পারতো। আবার ঘটনার পুনরাবৃত্তি করা হয়। একটা গাড়িকে ঠিক সেভাবেই ঢালের দিকে এগিয়ে দিয়ে খানিকটা ব্রেক কষে আবার চালু করে লেকের পানিতে ফেলে দেওয়া হয়। ভেতরে রাখা হয় একটি ক্যামেরা। পুরো গাড়িটা ডুবতে, গাড়ির ভেতরে পুরোপুরি পানিতে ভরে যেতে সময় লাগে ৫ মিনিট ৫২ সেকেন্ড। এই সময়ের ভেতরে বাচ্চাদেরকে বাঁচানো হয়তো সম্ভব ছিল সুজানের।
ডিফেন্স অবশ্য জানায় যে, প্রসিকিউটর এই ব্যাপারটা দেখিয়েছে দিনের আলোতে। কিন্তু সুজান সেটা করেছিলো রাতে। রাতের বেলায় ওভাবে গাড়িটাকে ঠিক করে ঠাহর করাটাও যেখানে সম্ভব ছিল না সেখানে চেষ্টা করলেও বাচ্চাদেরকে বাঁচানো সম্ভব ছিলো না। তবুও পুরো ব্যাপারটা জুরি এবং সবার কাছে পরিষ্কারভাবে বোঝাতে কোর্টে ঐ গাড়ি ডুবে যাওয়ার ভিডিওটা দেখানো হয়। ভিডিও দেখা শেষে কোর্টরুমের প্রত্যেকটি মানুষ চোখ ভেজাতে বাধ্য হয়েছিলো। হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিলো মাইকেল আর এ্যালেক্সের বাবা ডেভিড। আর সেইবার প্রথম সুজান নিজের ভুল স্বীকার করে, স্যরি বলে। জুরিদের বেশিরভাগই সুজানকে পরিষ্কারভাবে দোষী বলে মত প্রদান করে। তবে সুজানের মৃত্যু তার প্রকৃত শাস্তির চাইতে কম হয়ে যাবে বলে মনে করেন সবাই।
অবশেষে ২৮শে জুলাই প্রায় আড়াই ঘন্টা আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, সুজান যাবজ্জীবন কারাদন্ডে থাকবে। মৃত্যু নয়, বেঁচে থাকার শাস্তি দেওয়া হয় তাকে। নিজের সমস্ত দোষ স্বীকার করে নেয় সুজানের সৎ বাবা। কিন্তু তাতে সিদ্ধান্ত পরিবর্তিত হয়নি। কলম্বিয়ার সাউথ ক্যারোলিনাতে অবস্থিত নারী সংশোধানাগার কেন্দ্রে সুজান স্মিথকে বন্দী হিসেবে রাখা হয়।
ফিচার ইমেজ : WPXI.com