সানী জুবায়ের: বিশুদ্ধ সংগীতের উপমা

শহরে এসেছে এক সুরের যাদুকর
চোখে তার স্বপ্ন করেছে এখন ভর
গানে গানে দেবে ভরে বিশ্ব চরাচর

কারও চোখ যদি ওঠে বিষাদে ভরে
কারও মন যদি হাহাকার করে মরে
আশার প্রদীপ জ্বেলে দেবে তার ঘরে
তার ছোঁয়াতে মরু হবে যে সরোবর…

সানী জুবায়ের (অজস্র কবিতা)

সানী জুবায়ের; Image Source: The Daily Star Archive

পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় শিল্পমাধ্যমগুলোর একটি হলো সংগীত। তবে যারা সংগীত চর্চা করেন, তাদের সবাই কি শিল্পী হয়ে উঠতে পারেন? সে প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়। কেউ কেউ শিল্পী হতে পারেন না, শুধু গায়ক-গায়িকা হয়েই রয়ে যান। কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন, “সবাই কবি নয়, কেউ কেউ কবি”। তেমনি সব গাইয়েই শিল্পী নয়, কেউ কেউ শিল্পী। যারা খ্যাতি, অর্থ কিংবা জনপ্রিয়তার মোহ ত্যাগ করে নিরন্তর সাধনার মাধ্যমে নিজের সংগীতসত্ত্বাকে মানোত্তীর্ণ থেকে কালোত্তীর্ণ পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারেন, তারাই সংগীত নামক শিল্পের সত্যিকারের শিল্পী।

দেশের সংগীতাঙ্গনে অডিও ক্যাসেট বা সিডির যুগ পার হয়েছে অনেক আগেই। এখন পৃথিবীব্যাপীই চলছে ইউটিউবের যুগ। গান এখন শুধু শোনার বিষয় নয়, দেখারও বিষয়। মিউজিক ভিডিও একটি বড় ব্যাপার এখন গানের ক্ষেত্রে। ডিজিটাল মাধ্যমে গান মুক্তি দেওয়ার জন্য এখন প্রায় সকল শিল্পীকেই গান গাওয়ার পর অভিনয়ও করতে হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, গানের অ-আ-ক-খ ভালো করে জানে না এমন শিল্পীও মিউজিক ভিডিওর কারণে রাতারাতি পেয়ে যাচ্ছেন তারকাখ্যাতি। অবশ্য এসব তারকাখ্যাতিই পরে কাল হচ্ছে অনেকের জন্য। আবার অনেকে রিয়েলিটি শো থেকে রাতারাতি ‘বড় শিল্পী’ হয়ে রাতারাতিই হারিয়ে যাচ্ছেন।

সংগীত, সাহিত্য, নাটক, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র থেকে শুরু করে সকল শিল্পেই এমন অনেক সাধক আছেন, যারা বিশুদ্ধ শিল্পচর্চা করে যান নীরবে, নিভৃতে। যারা স্রোতের জোয়ারে তো গা ভাসানই না, উল্টো স্রোতের বিরুদ্ধে লড়াই করে যান আজীবন। হয়তো সময় তাদেরকে মূল্যায়ন করতে পারে না যথাযথভাবে। কিন্তু তারাই একসময় যুগ আর কালকেও জয় করে চলে যান কালেরও উর্ধ্বে। আজ বলছি তেমনই একজন বিশুদ্ধ সংগীতের জাদুকরের কথা। যিনি সংগীতের একদম উচ্চতর জায়গায় গিয়েও খ্যাতির স্রোতে গা ভাসাননি। সুরের সাধনায় শিল্পের আরাধনা করে যাচ্ছেন বছরের পর বছর ধরে। সুরের অবাক করা সেই জাদুকরের নাম সানী জুবায়ের।

Image Source: surodhoni.com

শিল্পের জগতে গান আর কবিতা হাত ধরাধরি করে চলে। অনেক কবিতাই একসময় স্বার্থক গানে রূপ পেয়েছে। সানী জুবায়েরের গানের কথাগুলো এতই কাব্যিক যে, কেউ যদি গান না শুনে শুধু গানের কথা দেখে, সে নির্ঘাত কবিতা বলে ভুল করবে। শুধু গান নয়, অ্যালবামগুলোর নামগুলোও অসাধারণ। জীবনানন্দ দাশের কাব্যগ্রন্থের নামেও যে গানের অ্যালবামের নাম হয় তা অনেকেরই ভাবনার বাইরে। যেমন ‘নির্জন স্বাক্ষর’ অ্যালবামে সানী জুবায়ের গেয়েছেন,

শুধু শখের জন্য প্রাণের বদলে কিনেছি হাজার ফানুস
আকাশ বুঝেছে বাতাস বুঝেছে বুঝেনি কেবল মানুষ

শুধু প্রেমের জন্য জেতার বদলে হেরে গেছি অনায়াসে
পাহাড় বুঝেছে সাগর বুঝেছে বুঝেনি কেবল তা সে
যার পায়ের চিহ্ন রেখেছি আগলে শ্রীমহাদেবের মতো
সেই মেয়েটি বুঝলো না কেবল আমার বুকের ক্ষত

শুধু আলোর জন্য বন্ধ জানালা দিয়েছিলাম আমি খুলে
নিয়তির সাথে যুদ্ধ চলে না গিয়েছিলাম আমি ভুলে
যার প্রাণের জন্য গেয়েছি গান আমি মরু রাখালের সুরে
সেই মেয়েটি রয়েছে কী যেন এখনও একলা দূরে…

Image Source: surodhoni.com

কী অসাধারণ কথা! এমন কথার সাথে যখন ধ্রুপদী সুর, চমৎকার বাদ্যযন্ত্র আর দরাজ কণ্ঠ যোগ হয়, তখন গানটি শোনার সমর এক স্বর্গীয় আবেশ অনুভব হয়। ‘নির্জন স্বাক্ষর’ অ্যালবামের অন্য গানেই শিল্পী গেয়েছেন,

ওরে হৃদয় তুই এখনো এত বোকা
যেন মায়ের কোলে অবুঝ ছোট্ট খোকা

কেন খুঁজিস মিছে সোনার মতো হারিয়ে যাওয়া দিন
কেন ভাবিস বসে চেরাগ হাতে আসবে আলাদিন
কেন আঁকিস মনে বৃথাই কেবল অসঙ্গতির ছবি
কেন ‍বুঝিস না তুই যা শিখেছিস মিথ্যে ছিলো সবি

আজও বসে খেলে হন্যে হয়ে খুঁজিস শীতল পাটি
আজও কিসের খোঁজে হন্তদন্ত করিস ছুটোছুটি
আজও দিনের শেষে স্বপ্ন দেখিস জোনাক জ্বলা রাত
আজও ভিড়ের মধ্যে কেন ধরিস মিথ্যে কারো হাত…

কিংবা প্রেম তার কণ্ঠ থেকে ঝরেছিল এমন অপরূপ গীতিকবিতায়,

একটি পাওয়াই খুব করে পাই তোমায় ভালোবেসে
দুঃখ আহা দুঃখ তুমি যাও দিয়ে হেসে হেসে

একটি চাওয়াই খুব করে চাই তোমায় ভালোবেসে
তোমার চুলের ছায়ায় যেন আমার সন্ধ্যা আসে

বলো কে আর দেখে ব্যর্থ আমার এ মুখ অসীম ক্ষমায়
সে তো তুমি ওগো বন্ধু আমার জ্বলে আছ দূর তারায়… 

এরকম কথার গান সানী জুবায়ের প্রায় প্রতিটি অ্যালবামেই গেয়েছেন। সুরের অদ্ভুত মূর্ছনায় রাঙিয়েছেন সংগীতপ্রেমীদের হৃদয়। যারা সংগীতকে মনের গভীর থেকে অনুভব করেন, মনের আঙিনায় বিশুদ্ধ সংগীতের চাষ করেন, তাদের জন্য সানী জুবায়েরের গান এক অনিন্দ্যসুন্দর উচ্ছ্বাসের নাম।

Image Source: surodhoni.com

গীতিকার, সুরকার, সংগীত পরিচালক ও শিল্পী সানী জুবায়েরের জন্ম ১৯৭৩ সালের ২রা ডিসেম্বর, পুরনো ঢাকায়। তার বাবা মোহাম্মদ হামিদুল্লাহ ও মা খুরশিদ জাহান। পারিবারিকভাবেই ছোটবেলা থেকে এক শিল্প-সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে উঠেছিলেন তিনি। তার মা নজরুল-সংগীত গাইতেন, দাদা ছিলেন খ্যাতিমান কবি খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দীন। বিখ্যাত ‘কানা বগির ছা’ ছড়ার লেখক খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দীন ছিলেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে হুগলিতে একসাথে জেলও খেটেছিলেন তারা। সেই সূত্রে ছোটবেলা থেকেই সানী জুবায়ের নজরুলের প্রতি, তার গানের প্রতি আলাদা টান অনুভব করতেন, গাইতেনও তখন থেকেই। পারিবারিকভাবে সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে উঠলেও সংগীত সাধনায় জীবনের বড় একটি অংশ ব্যয় করেছেন সানী জুবায়ের। ভারতে হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতের ওপর শিক্ষা নিয়েছেন,  পশ্চিমা শাস্ত্রীয় সংগীতের ওপরও উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন সুইডেনের ‘রয়্যাল ইউনিভার্সিটি কলেজ অব মিউজিক’ থেকে। ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খান-এর দুই নাতি ওস্তাদ মাজাহার আলী খান ও জাওয়াদ আলি খান-এর কাছ থেকেও শাস্ত্রীয় সংগীতের পাঠ নিয়েছেন সানী।

সানী জুবায়েরের গান এক অনিন্দ্যসুন্দর উচ্ছ্বাসের নাম; Image Source: Bengal Foundation

১৯৯৮ সালে প্রকাশ হয় তার প্রথম একক অ্যালবাম ‘সারা’। এরপর একে একে মোট আটটি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। নির্জন স্বাক্ষর, অজস্র কবিতা, অদ্ভুত আঁধার এক, যুগলসন্ধি নামের অ্যালবামগুলো তার মৌলিক গানের অ্যালবাম। এছাড়া ‘আপনা খায়াল’ নামে তার একটি গজলের অ্যালবাম ও ‘কেন মেঘেরও ছায়া’ নামে একটি নজরুল সংগীতের অ্যালবামও রয়েছে। তার অষ্টম ও সর্বশেষ অ্যালবাম ‘চাঁদের সরোবরে’ বের হয়েছে ২০১৫ সালে। এটিও একটি মৌলিক গানের অ্যালবাম।

শুধু গান গাওয়া নয়, সুর করা, গান লেখা ও সংগীত পরিচালক হিসেবেও সমান দক্ষ তিনি। বেশ কয়েকটি বাংলা চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করেছেন। তার মধ্যে মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত ‘অনিল বাগচীর একদিন’ সিনেমার জন্য শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক হিসেবে ২০১৫ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। বর্তমানে তিনি ঢাকার একটি সংগীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করছেন।

Image Source: surodhoni.com

নিভৃতচারী, প্রচারবিমুখ সানী জুবায়েরকে বর্তমান প্রজন্মের শ্রোতা তো দূরের কথা, অনেক শিল্পীও ভালো করে চেনেন না। এজন্য প্রচারণার অভাবটা যেমন দায়ী, তেমনি শিল্পীর উদাসীনতাটাও হয়তো কিছুটা হলেও দায়ী। আমাদের দেশে গুণীর কদর কতটুকু করা হয়, সেটা নিয়ে তর্ক খুব একটা কম হয় না। তবে সানী জুবায়েরের মতো উঁচুদরের শিল্পী অন্য কোনো দেশে জন্মালে যে তার কদরটা ঠিক এমনটা হতো না, সেটা বাংলা গানের সত্যিকারের বোদ্ধারা নিশ্চিতভাবেই স্বীকার করবেন। তবে আমরা সবাই তো আর কোনো সংগীত-বোদ্ধা নই, সাধারণ শ্রোতা। এই আমরাই যদি তার এত গুণমুগ্ধ হতে পারি; তাহলে যারা গান শেখেন, চর্চা করেন, গবেষণা করেন, পেশাদারভাবে গান গেয়ে বেড়ান, তারা তো সানী জুবায়েরকে নিয়ে, তার গান নিয়ে আরও বহু চর্চা করতেন অন্তত। কিন্তু সংগীতাঙ্গনের নিয়মিত খোঁজখবর যারা রাখেন, তারা জানেন, এই শিল্পীকে নিয়ে এই প্রজন্মের খুব কম শ্রোতারই আগ্রহ আছে। যদিও কারও আগ্রহ থাকা-না থাকায় শিল্প বা শিল্পীর কিছু যায় আসে না। কে চর্চা করল, কে শুনল সেই আলোচনা তাই তোলা থাকুক। সানী জুবায়ের বাংলা সংগীতের আকাশে বিশুদ্ধ গানের এক পাখি হয়েই থাকুন চিরকাল। এতে সাময়িক জনপ্রিয়তা হয়তো জুটবে না, কিন্তু মহাকালের বিচারে ঠিকই তিনি আসীন হয়ে থাকবেন শ্রদ্ধার আসনে।

This article is written on veteran Bangla Classic Musician Swani Zubayeer. 

Related Articles

Exit mobile version