১৯২৪ সালে যখন জোসেফ স্তালিন সোভিয়েত ইউনিয়নের হর্তাকর্তা বিধাতা হয়ে বসলেন, তখন পার্টি তথা দেশের যেকোনো প্রান্তে কেউ কোনো টু শব্দটি করলেই ব্যস, চালান হয়ে যেতে হত সাইবেরিয়ার বিরান অঞ্চলে অথবা গুলি খেয়ে মরে পড়ে থাকতো কোন অন্ধকার জেলের প্রকোষ্ঠে। এই সব ন্যাক্কারজনক অত্যাচারের মূল পরিকল্পনাকারী কিন্তু স্তালিন ছিলেন না। তিনি ছিলেন আদেশদাতা, আর সেই আদেশকে কর্মে রূপান্তরিত করতেন যিনি, তিনি হলেন স্তালিনেরই অঞ্চল, জর্জিয়ার এক অধিবাসী। লোকটির নাম ছিল ল্যাভরেন্তি পাভলোভিচ বেরিয়া।
ক্ষমতায় আরোহণ
১৮৯৯ সালের মার্চে জর্জিয়ার কুতাইস অঞ্চলে বেরিয়ার জন্ম। বর্তমানে অঞ্চলটি আবখাজিয়া নামে পরিচিত, রাশিয়া সমর্থিত একটি পুতুল সরকার সেখানে শাসন করে। গণিত ও বিজ্ঞানে পাকা বেরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় জড়িয়ে পড়েন বলশেভিক দলের সাথে। ১৯১৭ সালে রুশ সাম্রাজ্যের পতনের পর নানা জটিলতা দেখা দেয় ককেশাস অঞ্চলে। আজারবাইজান ১৯১৮ সালের দিকে স্বাধীন হয়ে যায়। বেরিয়া গোপনে বলশেভিক দলের সাথে যুক্ত ছিলেন, আবার একইসাথে আজারবাইজান সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর জন্যও কাজ করতেন। ১৯২০ সালে লাল ফৌজ আজারবাইজান দখল করে নিলে সুযোগসন্ধানী বেরিয়া পাকাপাকিভাবে বলশেভিকদের সাথে ভীড়ে যান, যোগ দেন বলশেভিকদের গোপন পুলিশ বাহিনী ‘চেকা’তে। কিছুদিন পরে, পাশ্ববর্তী জর্জিয়াতে সোভিয়েত রাজ প্রতিষ্ঠিত হলে বেরিয়া জর্জিয়াতে চলে যান। ততদিনে চেকার নাম বদলে রাখা হয়েছে ‘ওগপু’। বেরিয়া ওগপুর জর্জিয়ান ব্রাঞ্চের প্রধান হিসেবে নিয়োগ পান।
১৯২৪ সালে জর্জিয়ায় কঠোর হাতে এক বিদ্রোহ দমন করার পুরস্কারস্বরূপ পুরো ককেশাস অঞ্চলের ওগপু প্রধান হয়ে বসেন তিনি। ককেশাসে তুরস্ক আর ইরানী প্রভাব খর্ব করে তিনি দারুণ প্রশংসা পান। আর এই সময়েই তার সাথে পরিচয় হয় লোসেফ যুগোশভিলি নামের আরেক জর্জিয়ানের সাথে। লোকটি পরে তার ছদ্মনামেই বেশি পরিচিত হয়ে ওঠেন, স্তালিন। ককেশাস অঞ্চলে ব্যাপক ধরপাকড় আর গুপ্তহত্যা চালিয়ে বেরিয়া স্তালিনের সুনজরে চলে আসেন। ১৯৩৮ সালে বেরিয়াকে মস্কোতে এনে ওগপুর উত্তরসূরী এনকেভিডির দায়িত্ব দেওয়া হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
১৯৪০ সালে বেরিয়া যুক্তি দেখান, পোলিশ যুদ্ধবন্দীরা সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য হুমকিস্বরূপ। ফলাফল? কাতিন বনে রাতারাতি গায়েব হয়ে গেল ২২,০০০ পোলিশ যুদ্ধবন্দী। ১৯৪১ সালে জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করলে বেরিয়া লাল ফৌজের মধ্যে জার্মান গুপ্তচর ঢুকেছে এই সন্দেহে ব্যাপক গুপ্তহত্যা চালান। এদের মধ্যে ছিলেন ১৭ জন জেনারেল। জার্মানি হেরে গেলে বেরিয়া চড়াও হন বাল্কার, কারাচাই, চেচেন, তাতার আর ভোলগা জার্মানদের ওপরে। অভিযোগ ছিল, এরা নাৎসি বাহিনীকে সহায়তা করেছে। সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর লক্ষ লক্ষ মানুষকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো মধ্য এশিয়ার ঊষর ভূমিতে। রোগে ভুগে আর না খেতে পেয়ে মারা গেল হাজারো মানুষ।
পরমাণু বোমা
১৯৪৪ সালে বেরিয়াকে দায়িত্ব দেওয়া হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের পরমাণু বোমা বানানোর প্রজেক্ট শুরু করবার জন্য। ধূর্ত বেরিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে তোলেন এক শক্তিশালী এসপিওনাজ নেটওয়ার্ক। ম্যানহাটন প্রজেক্ট থেকে চুরি হয়ে যায় রাশি রাশি তথ্য। যেসব মার্কিন বৈজ্ঞানিক এই কাজে সাহায্য করেছিলেন, তাদের মধ্যে হ্যারি গোল্ড আর ক্লাউস ফচ উল্লেখযোগ্য। ১০,০০০ টেকনিশিয়ান আর ৩ লক্ষের ওপরে লোককে কাজে নামিয়ে মাত্র ৫ বছরের মাথায়, ১৯৪৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বের দ্বিতীয় পরমাণু শক্তিধর দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়।
মার্শাল বেরিয়া
১৯৪৫ সালে বেরিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘মার্শাল অব দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন’ খেতাব পান। ১৯৪৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ডেপুটি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর তাকে এনকেভিডির পদটি ছেড়ে দিতে হয়। এ সময়ে ক্রমশ অন্যান্য নেতারা, এমনকি স্বয়ং স্তালিন পর্যন্ত তার ক্ষমতা হ্রাসের চেষ্টা করতে থাকেন। বস্তুত সিক্রেট পুলিশ সহ অন্যান্য শক্তিশালী সংগঠনগুলিতে বেরিয়ার দারুণ প্রভাব ছিল, কাজেই সবাই ভয় পেত কখন বুঝি বেরিয়া নিজেই ক্ষমতা দখল করে বসেন। মরিয়া বেরিয়া ‘লেনিনগ্রাড অ্যাফেয়ার’ নামের এক নাটক সাজিয়ে লোপাট করে দেন বহু নিরপরাধ প্রতিদ্বন্দীকে। এদিকে ১৯৫৩ সালের ২ মার্চ ৩টায় স্তালিন স্ট্রোক করেন। ঘরে সাথে সাথে উপস্থিত হন বেরিয়া, খ্রুশ্চেভ, মলোটভ, বুলগানিন, মিকোয়ান সহ উচ্চপদস্থ নেতারা। স্তালিন তখনো জীবিত ছিলেন, কিন্তু ক্রমশই ক্ষমতা হারাতে থাকা বেরিয়া এই সুযোগ ছেড়ে দেবেন কেন? পুরো ১২ ঘণ্টা সোভিয়েত নেতার ঘরে কোনো ডাক্তার প্রবেশ করতে দিলেন না তিনি। অবশেষে স্তালিন মারা গেলে বেরিয়া নাকি খুশিতে চিৎকার করতে করতে বেরিয়ে যান ক্রেমলিনের দিকে। পলিটব্যুরোর মিটিং এ নাকি সদম্ভে স্বীকারও করেছিলেন যে, স্তালিনের মৃত্যু তার কারণেই হয়েছে এবং এখন তিনিই সর্বেসর্বা। অনেকে ধারণা করে, স্তালিনের মৃত্যু হয়েছে বিষক্রিয়ার কারণে। যদিও বেরিয়া কখনোই নেতাকে বিষপ্রয়োগে হত্যার কথা স্বীকার করেননি।
বেরিয়ার অত্যাচার
বেরিয়া প্রচণ্ড পরিশ্রমী, বুদ্ধিমান আর একরোখা লোক ছিলেন। প্রশাসক হিসেবে তার অতুলনীয় দক্ষতার কথা অতি বড় শত্রুও অস্বীকার করতে পারতো না। কিন্তু তার এই সমস্ত গুণ ঢাকা পড়ে গিয়েছিল নিষ্ঠুরতার কাছে। কুখ্যাত সোভিয়েত গুলাগগুলো পরিচালিত হত তার নির্দেশে। ১৯৩৯ সালে এসব গুলাগে বন্দীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১৬ লক্ষ। সিক্রেট পুলিশের প্রধান হিসেবে ১৫ বছর দায়িত্বে ছিলেন বেরিয়া, এ সময়ে লক্ষ লক্ষ লোককে পাঠানো হয়েছে গুলাগে। মানবেতর পরিবেশ আর হাড়ভাঙা পরিশ্রম কেড়ে নিয়েছে লাখো জীবন। হাজার হাজার জর্জিয়ান খুন হয়েছে তার নির্দেশে। যখনই কোনো পদ দখল করেছেন, মৃত্যুর খড়গ নেমে এসেছে তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের উপরে। তার হাতে মারা পড়েছে জিমেনেভ, কামেনেভ, বুখারিন সহ অসংখ্য প্রথম সারির বলশেভিক নেতা, যারা কিনা লেনিনের সাথে অংশ নিয়েছিলেন বলশেভিক বিপ্লবে। বেরিয়ার পাশবিক অত্যাচার না সইতে পেরে এসব নেতারা অনেকেই তাদের বিরুদ্ধে আনা মিথ্যা অভিযোগ মেনে নিতেন। একটি সূত্রের মতে, বুখারিনের বিচারের সময় বেরিয়া দম্ভোক্তি করেছিলেন, ‘আমার হাতে বুখারিনকে ছেড়ে দাও, উনি নিজেকে ইংল্যান্ডের রাজা বলে স্বীকার করে নেবেন। ‘ বিখ্যাত লাল ফৌজ সংগঠিত করেছিলেন যে লিয়ন ট্রটস্কি, তিনিও বেরিয়ার পাঠানো ঘাতকের হাতে প্রাণ দেন ১৯৪০ সালে। অনেকে বলে সোভিয়েত সিক্রেট পুলিশের সাবেক প্রধান নিকোলাই ইয়াজভকে বেরিয়া নিজের হাতে খুন করেছিলেন।
এসবেই শেষ না। বেরিয়ার বিরুদ্ধে আরেক অভিযোগ ছিল এই যে, তিনি মেয়েদের ওপরে ভয়ানক অত্যাচার করতেন। বেরিয়া নিজেই তার বিচারের সময়ে ৬২ জন নারীর সাথে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক (মতান্তরে ধর্ষণ) স্থাপনের কথা শিকার করেছিলেন। গুলাগে বন্দী আত্মীয়দের মুক্তি দেওয়া হবে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে, কখনো স্রেফ জিজ্ঞাসাবাদের অজুহাতে তুলে নিয়ে যাওয়া হত মেয়েদের। এদের মধ্যে কাউকে কাউকে খুন পর্যন্ত করা হয়েছে। ‘৯০ এর দশকে বেরিয়ার বাসার বাগানে এমন কয়েকজন মেয়ের দেহাবশেষ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিলো। ছলচাতুরি, তোষামোদ, চক্রান্ত আর ধূর্ততা তাকে এনে দিয়েছিল অগাধ ক্ষমতা। বলা হয়, জীবিতকালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সব থেকে ঘৃণিত মানুষ ছিলেন ল্যাভরেন্তি বেরিয়া।
পতন ও মৃত্যু
স্তালিনের মৃত্যুর পর বেরিয়া আর ম্যালেনকভ এক শক্তিশালী জোট গঠন করেন। ম্যালেনকভ হন প্রধানমন্ত্রী। তার উপর বেরিয়ার প্রভাব ছিল অসীম। কাজেই বলা চলে, বেরিয়াই দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী লোক হয়ে ওঠেন। বেরিয়া খুব সম্ভবত জার্মানীর একত্রীকরণ সমর্থন করতেন। একইসাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতেও অন্যদের উৎসাহিত করেছিলেন। অন্যান্য নেতারা এটাকে ভালোভাবে নেননি। এছাড়া কুচক্রী বেরিয়ার হাতে কে যে কখন খতম হয়ে যাবে, এই ভয়ে সবাই একজোট হয়ে যান। তলে তলে ম্যালেনকভ নিজেও যে তাদের সাথে যোগ দিয়েছেন, এটা বেরিয়া জানতেন না। ১৯৫৩ এর ২৬ জুন এক পার্টি মিটিংয়ে আচমকা খ্রুশ্চেভ সহ অন্যান্য নেতারা বেরিয়ার প্রতি মারমুখী হয়ে ওঠেন। অপ্রস্তুত বেরিয়া কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে গ্রেফতার করে ফেলা হয়। একইসাথে গ্রেফতার হয়ে যায় বেরিয়ার ঘনিষ্ঠ সমস্ত সরকারি কর্মকর্তা আর নেতারা। মস্কোর ক্ষমতাকাঠামো থেকে এক ঝটকায় বেরিয়ার প্রভাব সম্পূর্ণ মুছে দেয়া হয়, শুরু হয় বিচার। বহু সাজানো বিচারের আয়োজক বেরিয়াকেই অভিযুক্ত করা হয় দেশদ্রোহীতা আর সন্ত্রাসী কার্যক্রমের অভিযোগে। এর সাথে তার যৌবনে আজারবাইজানের বলশেভিক বিরোধী দলের সাথে যুক্ত থাকার পুরানো অভিযোগও নতুনভাবে উত্থাপন করা হয়; ফলাফল মৃত্যুদণ্ড।
বেরিয়া নাকি আদালতেই ব্যাকুল হয়ে হাত জোড় করে কাতর অনুনয় করতে থাকেন, যেন তাকে মাফ করে দেয়া হয়। কিন্তু লাভ হয়নি। জেনারেল বাতিতস্কির গুলিতে স্তব্ধ হয়ে যায় ক্রুর চরিত্রের মানুষটির জীবন। হাফ ছেড়ে বাঁচে সোভিয়েত ইউনিয়নের মানুষ।
ল্যাভরেন্তি পাভলোভিচ বেরিয়ার দেহাবশেষ মস্কোর কাছের এক বনে গোপনে পুঁতে ফেলা হয়। অদ্যাবধি জায়গাটি অজানা রয়ে গিয়েছে।
ফিচার ইমেজ- garkolektiboa.blogspot.com