১৯১২ সালের ১৫ অক্টোবর। সেদিন ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ভারতের মধ্যপ্রদেশের (বর্তমান ছত্রিশগড় রাজ্য) রাজনানগাঁও শহরে জন্মগ্রহণ করেন উপমহাদেশের প্রথম বাঙালি মুসলিম নারী চিকিৎসক ডা. অধ্যাপক জোহরা বেগম কাজী। স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যায় তিনি এক কিংবদন্তীতুল্য চিকিৎসক ছিলেন। স্ত্রীরোগের উপমহাদেশীয় সমস্ত কুসংস্কারের খোলস ভেঙে তিনি এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিলেন। তিনিই প্রথম ধাত্রীবিদ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করে এই অঞ্চলের অজ্ঞ ও অবহেলিত নারী সমাজকে নিজেদের চিকিৎসার অধিকারের ব্যাপারে সচেতন করেছেন।
নারীশিক্ষা, কুসংস্কার ও ভ্রান্তপ্রথা বিরোধিতা, সমাজসেবা ও অধিকার সচেতনতার যে আলোর মশাল তিনি জ্বেলেছিলেন তা আজও এদেশের বাঙালি মুসলিম নারীদের অনুপ্রাণিত করে। চিকিৎসাশাস্ত্রে এদেশের বর্তমানে লাখ লাখ মুসলিম নারী দেশে-বিদেশে অধ্যয়ন করছে অধ্যাপক ডা. জোহরা বেগম কাজীর মতো কিংবদন্তীর অবদানেই। তার পৈতৃকভূমি বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলার কালকিনি উপজেলার গোপালপুর গ্রামে।
শিক্ষাজীবন
ডা. জোহরা বেগম কাজীর শৈশব-কৈশোর কাটে তার মানবতাবাদী পিতার কর্মস্থল মহাত্মা গান্ধী প্রতিষ্ঠিত সেবাশ্রম ‘সেবাগ্রাম’-এ। রাজনানগাঁওয়ের রানি সূর্যমুখী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘পুত্রিশালায়’ তার প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু হয়। একটু বড় হলে তাকে রাজনানগাঁয়ের মিশনারীদের ‘বার্জিস মেমোরিয়াল’ নামের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করানো হয়। সেখানকার পাঠ চুকিয়ে ভর্তি হন আলীগড় মুসলিম গার্লস কলেজে। সবশেষে দিল্লির ‘লেডিহাডিং মেডিকেল কলেজ ফর উইমেনস’ এ ভর্তি হন। এই মেডিকেল কলেজটি ছিল এশিয়া মহাদেশের এমবিবিএস লেভেল পড়ার মতো প্রথম নারীদের মেডিকেল কলেজ।
জোহরা কাজী ছিলেন সেই কলেজের প্রথম ব্যাচের এবং একমাত্র মুসলিম ছাত্রী। সে হিসেবে তিনিই প্রথম মুসলিম নারী এমবিবিএস ডিগ্রিধারী। ১৯৩৫ সালে সেই কলেজ থেকে এমবিবিএস পরীক্ষা দিয়ে তিনি সর্বভারতীয় মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থানটি দখল করে নিয়েছিলেন। তখন তাকে সম্মানজনক ‘ভাইসরয়’ পদক প্রদান করা হয়। কর্মজীবনের এক ফাঁকে বৃত্তি নিয়ে চিকিৎসাশাস্ত্রে উচ্চশিক্ষা লাভ করার জন্য লন্ডনে পড়াশোনা করেছেন তিনি। তখনকার দিনে চিকিৎসাশাস্ত্রের সর্বোচ্চ ডিগ্রি ‘এফআরসিওজি’ লাভ করেন।
পরিবার
পিতা ডা. কাজী আবদুস সাত্তার এবং মাতা আঞ্জুমান নেছার দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার প্রভাবে জোহরা বেগম কাজী এত বড় মাপের একজন চিকিৎসক হতে পেরেছিলেন। কারণ সেই সময়ে নারীরা ডাক্তারী পড়ালেখা তো দূরের কথা, নিজেদের রোগ নিরাময়ের জন্য চিকিৎসকের কাছে যেতেও লজ্জাবোধ করতো।
জোহরা কাজীর পিতা ডাক্তার আবদুস সাত্তার মাত্র ৮-৯ বছর বয়সেই কোরআনে হাফেজ হয়েছিলেন। এরপর তার দাদা কাজী জমিরউদ্দিন তার পিতাকে ‘মাওলানা’ বানানোর জন্য পাঠান বর্তমান ভারতের ‘দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসায়’। সেখানকার শিক্ষা ব্যবস্থা তাকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। ফলে এক বছরের মধ্যেই তিনি দেশে ফিরে আসেন। পরিবারের সবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঢাকায় এসে নিজেই ভর্তি হয়ে যান তখনকার পোগস স্কুলে। এরপর মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করে এলএমএফ ডাক্তার হন। এরপর চলে যান কলকাতায় এবং উচ্চতর ডাক্তারি ডিগ্রি ‘সার্জন অব ইন্ডিয়া’ (বর্তমানে এমবিবিএস সমমানের) লাভ করেন।
তিনি বিয়ে করেন শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের খালাতো বোন আঞ্জুমান নেছাকে। এই রত্নগর্ভার কোলেই আসেন জোহরা বেগম। মা আঞ্জুমান নেছা রায়পুর পৌরসভার প্রথম নারী কমিশনার নিযুক্ত হয়েছিলেন। বড় ভাই অধ্যাপক কাজী আশরাফ মাহমুদ একজন কবি। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ছিলেন। ছোটবোন ডা. শিরিন কাজী হলেন উপমহাদেশের দ্বিতীয় বাঙালি মুসলিম নারী চিকিৎসক।
জোহরা বেগম ৩২ বছর বয়সে তৎকালীন আইনজীবী ও সংসদ সদস্য রাজু উদ্দিন ভূঁইয়ার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি দেশভাগের ঘোরবিরোধী মওলানা আবুল কালাম আজাদের আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তিনি পছন্দ করতেন না। ফলে গান্ধীজীর মানবতাবাদী রাজনৈতিক আদর্শ ধীরে ধীরে প্রতিফলিত হতে থাকে অসাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত কিশোরী জোহরার মননে ও চেতনায়। উল্লেখ্য, কাজী পরিবার ও গান্ধী পরিবারের ঘনিষ্ঠতা এতটাই গভীর ছিল যে, এ দুই পরিবারে প্রণয়ঘটিত ব্যাপার ঘটেছিলো। যদিও তা গান্ধীজীর অমতে কোনো বাস্তবিক রূপ লাভ করতে সক্ষম হয়নি।
কর্মজীবন
জোহরা বেগম কাজীর কর্মজীবন আর অভিজ্ঞতার ব্যাপ্তি ছিলো বৃহৎ। দুই দুইটি বিশ্বযুদ্ধ, বৃটিশ শাসনামল, ‘৪৭ এর দেশভাগ, পাকিস্তান শাসনামল, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন বাংলাদেশ ও পরবর্তী ৩৬ বছরের ঘটনাপ্রবাহর তিনি ছিলেন প্রত্যক্ষ সাক্ষী। কর্মজীবন তিনি শুরু করেছিলেন ইয়োথমাল উইমেন্স (পাবলিক) হাসপাতালে ডাক্তার হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে। এরপর বিলাসপুর সরকারি হাসপাতালে যোগ দেন। নাগপুরে মানুষের সেবার জন্য মহাত্মা গান্ধী নির্মাণ করেন সেবাগ্রাম। এই সেবাগ্রামে অবৈতনিকভাবে কাজ করেন জোহরা বেগম কাজী। এছাড়া অবিভক্ত ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালে ১৩ বছর কর্মজীবন কাটিয়েছেন তিনি।
১৯৪৮ সালে গান্ধীজীর নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জোহরা কাজীর পরিবার প্রচণ্ড কষ্ট পায়। পরবর্তীতে তারা সপরিবার মাতৃভূমি বাংলাদেশে চলে আসেন। সে বছরই তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে প্রফেসর হিসেবে যোগদান করে গাইনি বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিযুক্ত হন বিভাগীয় প্রধানের পদে। এছাড়াও তিনি মিটফোর্ড মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গাইনোকোলজি বিভাগের প্রধান ও অনারারি প্রফেসর ছিলেন।
পরবর্তীতে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) অনারারি কর্নেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে কনসালটেন্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ‘৪৭ এর দেশভাগ পরবর্তীতে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশের চিকিৎসাবিজ্ঞানে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেন। গর্ভবতী মায়েরা হাসপাতালে এসে যেন চিকিৎসাসেবা নিতে পারেন, সেজন্য তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নারীদের জন্য পৃথক চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন।
যাদের স্নেহধন্য হয়েছেন
বিংশ শতাব্দীর বাঘা বাঘা সব ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের স্নেহভাজন ও সংস্পর্শ পেয়েছেন ডা. অধ্যাপক জোহরা বেগম কাজী। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মহাত্মা গান্ধী। তিনি জোহরা বেগম কাজীকে কন্যাতুল্য মনে করতেন। গান্ধী পরিবারের সাথে কাজী পরিবারের এতটাই ঘনিষ্ঠতা ছিলো যে নাগপুরে গান্ধীজী কর্তৃক সেবাশ্রমে বিনা পারিশ্রমিকে স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে সেবা প্রদান করতেন তিনি। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ছিলেন জোহরা কাজীর মামা।
এছাড়াও মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কমরেড মুজাফফর আহমদ, অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন ও মহাত্মা গান্ধীর স্নেহভাজন কংগ্রেসের অন্যতম কর্মী ডা. সুশীলা নায়ারসহ অসংখ্য মানবতাবাদী বিপ্লবী মানুষের সাহচর্য লাভ করেছেন তিনি।
পদক
জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পর ডা. জোহরা বেগম কাজী বিভিন্ন খেতাব ও পদকে ভূষিত হয়েছেন। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তার কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ‘তখমা-ই পাকিস্তান’ খেতাবে ভূষিত করেন। তিনি ‘ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল অব ঢাকা’ নামে পরিচিত ছিলেন। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) তাকে বিএমএ স্বর্ণপদক প্রদান করে। ২০০২ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ‘রোকেয়া পদক’ প্রদান করেন। ২০০৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সরকার তাকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক ‘একুশে পদক’ (মরণোত্তর) প্রদান করে সম্মানিত করেন। বাংলাদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস বিনির্মাণের লক্ষ্যে তিনি ২০০১ সালের ১১ জুলাই তার কাছে সংরক্ষিত মহাত্মা গান্ধীর ব্যক্তিগত ঐতিহাসিক পত্র, ভাইসরয় পদক, সনদসমূহ এবং আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতি-স্মারক জাতীয় জাদুঘরে দান করে গেছেন।
মৃত্যু
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জোহরা কাজীর এক খণ্ড স্মৃতি উল্লেখ করে আজকের এই লেখাটি সমাপ্ত করা যাক। একবার আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে জোহরা কাজী কিছু মুক্তিযোদ্ধাকে গোপনে নিয়ে যাওয়ার জন্য নিজের ব্যক্তিগত গাড়িটি দিয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের মাঝামাঝি একটি স্থানে তার গাড়িটি পরিত্যাগ করে পালিয়ে যান। গাড়ির নম্বর প্লেট দেখে খুঁজে খুঁজে পাক বাহিনী চলে এলো জোহরা কাজীর বাসায়। তিনি তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অনরারি কর্নেল। তার মুখ নিঃসৃত বিশুদ্ধ উর্দু ভাষা এবং তার পদমর্যাদার কথা শুনে পাক সৈন্যরা ক্ষমা চেয়ে বিদায় নিয়ে চলে যায়। বাঙালি নারী চিকিৎসকদের অগ্রপথিক, মানবতাবাদী ও সমাজ-সংস্কারক, আজীবন মানব সেবায় নিয়োজিত, প্রথম বাঙালি মুসলিম নারী চিকিৎসক ডা. অধ্যাপক জোহরা বেগম কাজী ২০০৭ সালের ৭ই নভেম্বর ৯৫ বছর বয়সে ঢাকায় নিজ বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
ফিচার ইমেজ- বাংলাপিডিয়া