“আমি লোকটার গলায় ছুরি ধরলাম, ধীরে ধীরে পোচ দিয়ে জবাই করলাম।”
-“এ তুই কী করলি!”
“ কেন?”
-“জবাই করলি কেন?”
-“এভাবেই তো মজা!”
-“মজার বাচ্চা, তুই কোপ দিয়ে মারলি না কেন? এইভাবে …”
আর জবাই করনেওয়ালার গলা এক কোপে আলাদা হয়ে গেল।
উপরের লেখাটি একটি উর্দু গল্পের অনুবাদ। এই অনুবাদ পুরোটা পড়ে শেষ করার পর আপনার মাথার ভেতর কেমন দৃশ্য ভাসছে? চোখের সামনে কি দেখতে পাচ্ছেন ধারালো তলোয়ার হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বিকৃত মস্তিস্কের একজন মানুষকে? তার তলোয়ার দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা গাঢ় লাল রক্ত। তার চেহারাটা হয়তো দেখা যাচ্ছে না, শুধু বোঝা যাচ্ছে, মানুষটা এইমাত্র একজনকে হত্যা করেছে বিকৃত আনন্দ সাথে নিয়ে।
১৯১২ সালের ১১ মের এক রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে সাদাত হাসান মান্টো পাঞ্জাবের লুধিয়ানার এক সুন্নী মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার কৈশোর সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় না।
জাতিগতভাবে মান্টো ছিলেন কাশ্মিরী। তার সম্পর্কে একটি গল্প শোনা যায় যে, কাশ্মিরী হবার কারণে তিনি এতই গর্বিত ছিলেন যে, একবার পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুকে এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘সুন্দর’ শব্দটি আসলে ‘কাশ্মিরী’র প্রতিশব্দ।
১৯৩৩ সালে তার বয়স যখন একুশ বছর, তখন তার পরিচয় হয় আবদুল বারি আলিগের সঙ্গে। এই পরিচয়ই তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ক্রমান্বয়ে পণ্ডিত আবদুল বারি আলিগ হয়ে ওঠেন মান্টোর পরামর্শদাতা। আবদুল বারির পরামর্শেই মান্টো ফরাসি এবং রাশিয়ান লেখকদের লেখা পড়তে শুরু করেন। ফরাসি এবং রাশিয়ান যেসব সাহিত্য তিনি পড়েছিলেন, সেগুলো তাকে অনুবাদের কাজে উদ্বুদ্ধ করে। বেশ কয়েক বছর তিনি এসব ফরাসি এবং রাশিয়ান সাহিত্য উর্দু ভাষায় অনুবাদ করেন। আবদুল বারির পত্রিকাতেই ছদ্মনামে তার প্রথম গল্প ‘তামাশা’ প্রকাশিত হয়।
১৯৩৪ সালে মান্টো সাহিত্য এবং লেখালেখি বিষয়ে পড়ার জন্য আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালে তিনি ছোটগল্প লেখালেখি শুরু করেন। তার সেসময়কার ছোটগল্পগুলোর মধ্যে ‘ইনকিলাব পসন্দ’ নামে একটি প্রকাশিতও হয়। এখানে তিনি বেশ কয়েকজন মানুষের সাথে পরিচিত হন, যারা তার জীবনে পরবর্তীতে বেশ কিছু ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন।
এ সময় ধীরে ধীরে মান্টো ভারতে অন্যতম প্রভাবশালী সাহিত্যিক হয়ে উঠতে থাকেন। ১৯৪১-১৯৪৩ সালের মধ্যে তিনি বেশ কয়েকটি রেডিও নাটকও লিখে ফেলেন। ১৯৪৫ সালের মধ্যে ‘ধুয়া’, ‘কালো সালোয়ার’ এবং ‘বু’ নামে তার অন্যতম বিখ্যাত কিছু ছোটগল্প প্রকাশিত হয়।
তবে এই সবকিছুর পাশাপাশি মান্টোর জীবনের কিছু কালো অধ্যায়ও ছিলো। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পূর্বেই গল্পে অশ্লীলতা ছড়াবার দায়ে তিনবার তাকে অভিযুক্ত করা হয়। ‘৪৭ এর দেশভাগের পর তিনি যখন পাকিস্তানে চলে যান, তখন তাকে একই অভিযোগে আরো তিনবার অভিযুক্ত হয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে এই অভিযোগের জবাব দিতে গিয়ে তিনি একবার বলেছিলেন, “একজন লেখক তখনই কলম ধরেন, যখন তার সংবেদনশীলতা বা অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়।“
মান্টোর বাবার নাম খ্বাজা গুলাম হাসান। তিনি প্রথমে ছিলেন পাঞ্জাব সরকারের একজন মুন্সেফ। পরবর্তীতে তিনি জজও হয়েছিলেন। তৎকালীন রেওয়াজ অনুযায়ী, গুলাম হাসান দুটি বিয়ে করেছিলেন। তবে তার দুই স্ত্রীর প্রতি তিনি কখনো সমদর্শীতা দেখাতে পারেননি। গুলাম হাসানের দ্বিতীয় স্ত্রী সর্দার হাসানের গর্ভে জন্ম নেন মান্টো। খুব সম্ভবত ছেলেবেলা থেকেই পরিবারের এসব ব্যাপার দেখে তার মনে শিকড়হীনতার জন্ম হয়। এই অনুভূতিই পরবর্তী সময়ে তার জীবনের গতিপথ নির্ধারণ করে।
মান্টো ছাত্র হিসেবে খুবই খারাপ ছিলেন। জীবনের মধ্যভাগে এসে তিনি উর্দু সাহিত্যের সেরা ছোটগল্পগুলো রচনা করে গিয়েছেন। তবে শুনলে অবাক হতে হয়, এই উর্দুতেই তিনবার অকৃতকার্য হয়ে চতুর্থবারে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেছিলেন কোনোমতে। আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি আক্রান্ত হন যক্ষ্মায়। ফলে সেখান থেকেও তাকে বিতাড়িত করা হয়। তবে তার সাহিত্য প্রতিভার বিকাশ খুব সম্ভবত ছোটকাল থেকেই প্রকাশ পেতে শুরু করেছিল। কারণ খুব খারাপ ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও কলেজ পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব সর্বসম্মতিক্রমে তিনিই পেয়েছিলেন। একই সময়ে মান্টো সাম্রাজ্যবাদ ও মৌলবাদবিরোধী আন্দোলনেও যোগ দিতে শুরু করেছিলেন।
আবদুল বারির সাথে পরিচয়ের অনেককাল পর মান্টো একবার লিখেছিলেন,
আজ আমি যা, তার প্রস্তুতির ক্ষেত্রে প্রথম নাম বারি আলীগ সাহেবের। অমৃতসরে তিনমাস তার সাহচর্য না পেলে আজ আমি অন্য রাস্তায় হাঁটতাম। প্রকৃতপক্ষেই এক শেকড়চ্যুত, আদর্শহীন তরুণ, যে ততদিনে নিষিদ্ধ নেশাসমূহের এবং জীবনের অন্ধকার অলিগলিতে হাঁটবার পথের সন্ধান পেয়ে গিয়েছে, তাকে সাহিত্যের পথে টেনে আনবার যে মহৎ কাজ বারি সাহেব করেছিলেন, তার জন্য আজকের পাঠকও তার প্রতি কৃতজ্ঞ।
মান্টো কাশ্মীরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সুফিয়া নামের তরুণীকে বিয়ে করেন। তার তিন মেয়ে এবং এক ছেলে হয়েছিল। যদিও পুত্রসন্তানটি মাত্র এক বছর বেঁচেছিল।
এরপর আসে তার জীবনের মানসিকভাবে ভয়াবহ এক অধ্যায়। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের ভোরে তিনি হঠাৎ খেয়াল করেন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কী দ্রুতবেগে তার তৎকালীন বসতস্থল বোম্বেতে (বর্তমানে মুম্বাই) ছড়িয়ে পড়ছে। ঠিক ঐ সময়টাতেই তিনি একজন মুসলিম হবার অপরাধে বোম্বে টকিজ ফিল্ম থেকে তার স্ক্রিন রাইটারের চাকরি হারান। পরিবারের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তাকে বাধ্য হয়ে শহর ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়। শরণার্থী হিসেবে তিনি পরিবারসহ আশ্রয় নেন পাকিস্তানের লাহোরে।
দেশভাগের কারণে যে মানুষগুলোর জীবন তছনছ হয়ে গিয়েছিল, সাদাত হাসান মান্টো তার মধ্যে অন্যতম। পাকিস্তানে যে ক’বছর তিনি বেঁচে ছিলেন, সেই বছরগুলোতে লেখক হিসেবে তাকে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়নি। জীবিকা উপার্জনের জন্য পাকিস্তানেও যোগ দিয়েছিলেন ফিল্ম কোম্পানিতে। তবে পরপর দু-দুটো চলচ্চিত্র ফ্লপ হওয়ায় পাকিস্তানী ফিল্মেও খুব বেশি ভালো অবস্থান জোগাড় করে উঠতে পারেননি তিনি। মজার ব্যাপার হলো, একে অবশ্য দুঃখজনকও বলতে পারেন, পাকিস্তানে থাকাকালে লেখক হিসেবে তাকে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়া না হলেও তিনি সেসময় যেসব গল্প লিখেছিলেন, সেগুলোকেই তার সেরা সাহিত্যকর্ম হিসেবে ধরা হয়।
সে যা-ই হোক, কোনোদিক দিয়েই সুবিধা করতে না পারায় শেষপর্যন্ত তিনি ধরনা দিতে থাকেন বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদকীয় দপ্তরে। পত্রিকা দপ্তরগুলো সম্ভবত তার গল্পগুলোর মর্ম বুঝতো। খুবই অল্প পারিশ্রমিকে চটজলদি রম্যরচনা বা ছোটগল্প লিখে দিয়ে সেই অর্থে পরিবার চালাতেন।
তার ভালোবাসার শহর বোম্বে থেকে পালিয়ে আসতে হওয়ায় তিনি অতিমাত্রায় অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। এ সময় তিনি খুব বেশি মাত্রায় অ্যালকোহলে আসক্ত হয়ে পড়েন। দেশভাগ নিয়ে এ সময়টাতে ‘টোবা টেক সিং’ সহ আরো বেশ কিছু বিখ্যাত গল্প তিনি লেখেন। তার সেসময়কার গল্পগুলোতে উঠে এসেছিল দেশভাগ, নৃশংসতা, গ্যাংস্টার, পতিতাসহ আরো নানা শ্রেণীর মানুষের কথা।
শেষপর্যন্ত ১৯৫৫ সালের ১৮ জানুয়ারির কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে লাহোরের হল রোডে মাত্র ৪২ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
উপমহাদেশের আরো অনেক সাহিত্যিকের মতো মান্টোও তার জীবদ্দশায় অবহেলিত ছিলেন। অসাধারণ গল্প তিনি লিখতেন ঠিকই, তবে তার খুব বদনামও ছিলো। ধরাবাঁধা কোনো সংগঠনে তিনি কখনো অন্তর্ভুক্ত হননি। সারাজীবনই ছিলেন অস্থিরমতি, চঞ্চল। ছিলো অতিমাত্রায় অ্যালকোহল পানের অভ্যাস, এমনকি অশ্লীলতার অভিযোগেও হতে হয়েছিল অভিযুক্ত।
নিজের কাজের কৃতিত্বও পাননি জীবদ্দশায়। খুব গর্বের সঙ্গে জীবদ্দশায় নিজেকে মির্জা গালিবকে নিয়ে এক ছবির সৃষ্টিকর্তা হিসেবে পরিচিত করতেন। ছবিটির চিত্রনাট্যের কৃতিত্ব ছিলো তার প্রাপ্য। ছবিটি পরবর্তীতে পুরস্কারও পেয়েছিল। তবে জীবদ্দশায় মান্টো তা দেখে যেতে পারেননি।
মান্টো গালিবের একটি কবিতার লাইন উদ্ধৃত করে একটি প্রবন্ধের শিরোনাম দিয়েছিলেন, ‘কুছ নহী হ্যায় তো অদাওত হী সহী’ (কিছু না থাকলে শত্রুতাই থাক)।