সময় পরিভ্রমণ নিয়ে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। ভবিষ্যৎ দেখতে কেমন? কী হবে ভবিষ্যতের পৃথিবীতে? আমরা কি কোনোভাবে টাইম ট্র্যাভেল করে অতীতের ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো দেখে আসতে পারি? তার চেয়েও বড় কথা, ভবিষ্যতের কোনো মানুষ যদি সময় পরিভ্রমণ করে আমাদের কাছে এসে বলে সে ভবিষ্যৎ ঘুরে এসেছে, তবে কি আমরা তাকে বিশ্বাস করব? সেরকমই একজন মানুষ ছিলেন ২০১১ সালে মারা যাওয়া আল বিলেক। তিনি দাবি করে বসেন, তিনি ভবিষ্যৎ ঘুরে এসেছেন। শুধু এটাই না, বলেন আরো অবিশ্বাস্য সব কথা! বলা বাহুল্য, তাকে চিহ্নিত করা হয় গত শতাব্দীর সেরা মিথ্যেবাদী হিসেবে, কিন্তু আল বিলেক ভক্তরা কিন্তু সে কথা মানতে একদম নারাজ! বিলেকের বক্তব্য অনুযায়ী কী তার সে অবিশ্বাস্য ঘটনাগুলো?
সত্য মিথ্যের হিসেবে আমরা লেখার শেষ দিকে আসবো। কিন্তু শুরুতে আমরা আল বিলেকের নিজের ভাষ্যই শুনব। বিলেকের জন্ম ১৯২৭ সালের ৩১ মার্চ। তার প্রথম স্মৃতি তার নয় মাস বয়সের কোনো এক পারিবারিক ক্রিসমাস পার্টির ঘটনার। বিলেকের মতে, তার নাকি মনে আছে পিয়ানোর চারপাশে কে কী বলছিলেন। কিন্তু কীভাবে? সে কথায় আসছি একটু পরেই।
বিলেক স্কুলে পড়াকালীন সময়ে পরিচিত ছিলেন চলন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া নামে। হাই স্কুল পাশের আগেই তিনি ইলেক্ট্রনিক্স পরীক্ষায় বসেন ও পাশ করে যান। মার্কিন নেভির নজরে আসেন তিনি, তারা তাকে নেভিতে নিয়ে নেয়।
বিলেক পড়াশোনা শেষ করবার পর ইলেক্ট্রনিক্স সম্পর্কিত নানা কাজ করেন তাঁর কর্মস্থলে। মিলিটারির সাথে কাজ করতে গিয়ে তিনি ভিনগ্রহী প্রাণী বা এলিয়েনদের সাথে মার্কিং সরকারের সংযোগ আর মাইন্ড কন্ট্রোল প্রযুক্তি নিয়ে সরকারের কাজকর্ম নিয়ে জানতে পারেন বলে বিলেক জানান।
শীঘ্রই গোপন মন্টক প্রোজেক্টে (Montauk Project) তাকে নেয়া হয়। মিলিটারির সাথে তার গোপন কাজগুলো জনসম্মুখে বলা বারণ ছিল। তার স্বাভাবিক চাকুরি ক্যালিফোর্নিয়াতে করে তিনি আন্ডারগ্রাউন্ড সাবওয়ে দিয়ে চলে আসতেন দূরের মন্টক লং আইল্যান্ডে (Montauk Long Island), যা কিনা নিউ ইয়র্কে। সময় লাগত দু’ঘণ্টা, ট্রেনটি ছিল ম্যাগনেটিক লেভিটেশন ট্রেন। সেখানে কাজ চলছিল টাইম ট্র্যাভেল এবং টেলিপোর্ট নিয়ে। (টেলিপোর্ট বলতে বোঝায় নিমেষেই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পদার্থের স্থানান্তর) কাজের অগ্রগতির সাথে সাথে যখন টাইম টানেল বা সময় সুরঙ্গ বানানো হয়ে যায় ঠিক মতো, তখন থেকে তিনি সরাসরি নিজের ফ্ল্যাট থেকেই কাজে যেতেন সুরঙ্গ ব্যবহার করে, আবার ফিরে আসতেন এতটা পথ নিমেষেই।
সত্তরের দশকে বিলেক ছিলেন ছিলেন সেখানের একজন প্রোগ্রাম ডিরেক্টর। সেখানে যাদের সাথে তার নিয়মিত কাজ করতে হত তাদের মাঝে ছিলেন ডানকান ক্যামেরন (Duncan Cameron) ও প্রেস্টন নিকলস (Preston Nichols)। ডানকানের বিষয়ে কথা একটু পরে আবার বলা হবে।
আশির দশকে যখন সময় পরিভ্রমণের যন্ত্রপাতি পুরোপুরি কার্যকরী হয়ে যায়, তখন বিলেক নিজেই কিছু পরীক্ষায় অংশ নেন। তিনি ও ডানকান দুজনেই বেশ কয়েকবার মন্টকের সময় সুরঙ্গ ব্যবহার করে মঙ্গল গ্রহে অবতরণ করেন। তিনি তার দল নিয়ে খ্রিস্টপূর্ব এক লক্ষ বছর আগেও গিয়েছিলেন। এমনকি এমন গ্রহেও গিয়েছিলেন যেখানে আলো আর আঁধারের শক্তি সংগ্রহ করা যেত। তাছাড়া ভবিষ্যতের পৃথিবীতে তো প্রায়ই যাওয়া হত।
ফিলাডেলফিয়া এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে একটি মুভি ১৯৮৮ সালে দেখবার পর তার কিছু স্মৃতি ফেরত আসতে থাকে। তার মনে পরে যে তিনি নিজেই ফিলাডেলফিয়া এক্সপেরিমেন্ট এর একজন ছিলেন। এ এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে রোর বাংলার বিস্তারিত পোস্ট পড়তে ক্লিক করুন এখানে। ১৯৪৩ সালের ২৮ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়া নেভাল শিপইয়ার্ডে ইউএস নেভির ডেস্ট্রয়ার ইউএসএস এল্ড্রিজ জাহাজে চালানো হয় এ পরীক্ষা। উদ্দেশ্য ছিল জাহাজটিকে অদৃশ্য করে দেয়া রাডারের চোখেও, এবং এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় টেলিপোর্ট করা। বিলেকের মতে, এ পরীক্ষায় ব্যবহার করা হয়েছিল আলবার্ট আইন্সটাইনের ইউনিফাইড ফিল্ড থিওরি।
তার স্মৃতি ফিরে আসবার পর তার সাথে যোগাযোগ করেন জন ভন নিউমান (John von Neumann)। জন ভন নিউম্যানকে বিশ্ব চেনে একজন ভুবনবিখ্যাত গণিতবিদ হিসেবে। হাঙ্গেরিয়ান এ সব্যসাচী মানুষটি একই সাথে একজন পদার্থবিদ, কম্পিউটার গবেষকও ছিলেন। অবশ্য তিনি ১৯৫৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি মারা যান। কিন্তু, বিলেক বলেন, আসলে তার মৃত্যু ভুয়া ছিল, লোকজনকে ধোঁকা দেবার জন্য। আসলে তিনি এরপর থেকে মার্কিন সরকারের গোপন প্রজেক্টে কাজ করতেন। এভাবেই ১৯৮৮ সালে বিলেকের সাথে যোগাযোগ করেন তিনি। কারণ, নিউমান কথা দিয়েছিলেন যে বিলেকের স্মৃতি ফিরে এলে তিনি তার সাথে আবার যোগাযোগ করবেন।
১৯৮৯ সালে বিলেক তার ফিরে পাওয়া স্মৃতি জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। তিনি জানান, সরকার তাকে এখনও হত্যা করেনি একটা কারণেই, আর তা হলো, তাকে হত্যা করলে স্থান-কালের হিসেবে গণ্ডগোল সৃষ্টি হবে, কারণ তিনি এতবার টাইম ট্র্যাভেল করেছেন!
বিলেকের স্মৃতি ফিরে এলে তিনি মনে করতে পারলেন যে, তার আসল নাম এডওয়ার্ড ক্যামেরন। আর ডানকান ক্যামেরন আসলে তার সৎ ভাই। ডানকানের ছিল অতিমানবীয় ক্ষমতা। বিশ বছর বয়সের পর থেকে তারা কাজ করতেন মন্টক প্রোজেক্টে, যার একটা ক্ষুদ্র পরীক্ষা ছিল ফিলাডেলফিয়া এক্সপেরিমেন্ট। ১৯৪৩ সালে জাহাজটিতে থাকা অবস্থায় তিনি দেখতে পান যে একটি ওয়ার্মহোল সৃষ্টি হয়েছে, যা কিনা বর্তমান আর ভবিষ্যতের দুটো সময়বিন্দুকে যুক্ত করেছে। একটা বিন্দু ১৯৪৩ এ হলেও, আরেকটি বিন্দু সুদূর ১৯৮৩ সালে।
পরীক্ষার গণ্ডগোলের কারণে দুই ভাই পৌঁছে যান ১৯৮৩ সালে সে ওয়ার্মহোলের ভেতর দিয়ে। তখন মিলিটারি তাদেরকে আবার ফেরত যাবার আদেশ করে এবং তারা যেন ফেরত গিয়ে জাহাজটির সকল যন্ত্রপাতি ধ্বংস করে দেন; কারণ এ ভুল পরীক্ষার কারণে অনেক হিসেবে গোলমাল হয়ে গেছে। দুই ভাই আদেশ অনুযায়ী তাই করলেন, কিন্তু কাজ শেষে একটি দুর্ঘটনার মাধ্যমে আবার ওয়ার্মহোলে পড়ে যান। এবার তারা নিজেদের আবিষ্কার করলেন ২১৩৭ সালে।
২১৩৭ সালে তারা ছয় সপ্তাহ ছিলেন হাসপাতালে। সময় সুরঙ্গের হাইপারস্পেসের সাথে সংস্পর্শে আসার কারণে তাদের শরীরে ছ্যাঁকাসুলভ ক্ষতগুলোর চিকিৎসা চলছিল।
কিন্তু বিধিবাম, সেখান থেকে ফিরে যাবার জন্য তৈরি হলেও, ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আল বিলেক একাই নিজেকে আবিষ্কার করেন ২৭৪৯ সালে। জ্ঞান ফিরলে দেখেন তিনি এক হাসপাতালে। অত্যাধুনিক সব যন্ত্রপাতি। তিনি দেখলেন, তখন পৃথিবীতে বাতাসে ভাসমান শহর আছে, সেগুলো পৃথিবী জুড়ে ঘুরে বেড়াতেও পারে। অভিকর্ষ নিয়ে গবেষণার ফসল- শহরগুলো মাটি থেকে আড়াই মাইল উঁচুতে। কিন্তু তখন পৃথিবীর জনসংখ্যা মাত্র ৩০০ মিলিয়ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তখন ৫০ মিলিয়ন মানুষ। দু’বছর থাকেন তিনি সেখানে।
পৃথিবীতে কোনো যুদ্ধ ছিল না। তবে রাশিয়ান আর চাইনিজদের মাঝে তখন মহাদ্বন্দ্ব, এমনকি আমেরিকা ও ইউরোপের মাঝেও। যেহেতু মিলিটারি, নেভি কিংবা এয়ারফোর্স বলতে পৃথিবীতে কিছু তখন নেই, তাই যুদ্ধও অসম্ভব। সত্যি বলতে, তখন কোনো সরকারও নেই, এক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সারা পৃথিবী চালায় নিখুঁতভাবে, যাকে সৃষ্টি করা হয় ২৬ শতকে। টাকার খেলা তখন বিলেক দেখেননি, যে যখন যা চায় তাই পায়। তবে তিনি সমুদ্রস্তরের উচ্চতা অনেক বেড়ে যেতে দেখেছেন, যেমন ফ্লোরিডার দুই-তৃতীয়াংশ পানির তলে।
অবশেষে যখন বিলেক ফিরতে সক্ষম হন বিংশ শতকে, তখন ১৯৮৩ সাল। বিলেকের কাহিনী শুনে মিলিটারি বুঝতে পারে যে, তাকে চুপ করাতে হবে। তারা তাকে কোনোভাবে বয়স কমানোর প্রযুক্তি দিয়ে ছোট্ট শিশুর রূপ দান করে। এরপর মন্টক প্রোজেক্টের সময় পরিভ্রমণের মাধ্যমে তাকে রেখে আসেন বিলেক পরিবারের কাছে, ক্যামেরন পরিবার নয়। বিলেক পরিবারের এক মৃত সন্তানের পরিবর্তে তাকে গ্রহণ করা হয়। সেখানে তিনি বেড়ে ওঠেন আল বিলেক নামে, হারান তার এডওয়ার্ড ক্যামেরন নাম। ছোট থাকলেও তার মাঝে বেসিক জ্ঞানগুলো ছিল, যদিও তার স্মৃতি প্রায় পুরোটাই কেড়ে নিয়েছিল মন্টক প্রোজেক্টে। তিনি ছোট হলেও ভাষা বুঝতে পারতেন, এ কারণেই ক্রিসমাসের দিন মানুষগুলোর কথা বুঝতে পারছিলেন এত ছোট হওয়া সত্ত্বেও। আদতে তার জৈবিক বয়স সবে ‘নয় মাস’ হলেও।
বিলেক জানান, সময় পরিভ্রমণের প্রযুক্তি মানবজাতিকে উপহার দিয়েছে ওরায়ন নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে আগত ভিনগ্রহীরা, যারা রেপ্টিলিয়ান বা সরীসৃপ সদৃশ, মূলত তাদের উপপ্রজাতি লেভেরনরাই এ কৃতিত্বের দাবিদার। আর পৃথিবীতে যারা টেকনিকাল সাপোর্ট দিয়ে থাকে তারা লুব্ধক (Sirius) নক্ষত্রের গ্রহ থেকে আগত। মাইন্ড কন্ট্রোল প্রযুক্তির বিষয়েও তারা সাহায্য করে।
কিন্তু এলিয়েনদের মাঝে সবচেয়ে চমৎকার হলো গ্রে প্রজাতি, তারা এসেছে জেটা টু রেটিকুলাই নক্ষত্রের চতুর্থ গ্রহ থেকে। আকারে ছোট, আর চুল-লোমবিহীন এ প্রজাতিকে মানুষ ইউএফও সংক্রান্ত ঘটনার কারণে বেশি চেনে। মূলত ১৯৪৭ সালের রজওয়েল (Roswell) ইউএফও ক্র্যাশ থেকে মার্কিনিরা অনেক সুবিধা পায় বলে বিলেকের ধারণা। Roswell Incident খ্যাত সে বহুশ্রুত ঘটনা নিয়ে পরবর্তীতে কোনো পোস্টে জানানো হবে।
সত্তরের দশক থেকেই মন্টক প্রোজেক্টের সহায়তায় মঙ্গল গ্রহে কলোনি করা হচ্ছে বলে জানান বিলেক। তার মতে, আমেরিকা ১৯৬৯ সালে সবাইকে জানিয়ে প্রথম চাঁদে গেলেও, আসলে প্রথম গিয়েছিল জার্মানরা, সেই ১৯৪৭ সালে। ১৯৬৯ এর আগেই, ১৯৬২ সালে রাশিয়ানদের সাথে জয়েন্ট মিশনে চাঁদে পা রেখেছিল মার্কিনিরা। আর প্রথম মঙ্গল গ্রহে পা রাখা হয় ১৯৬২ সালের ২২ মে। সেখানে আগে থেকেই সভ্যতার চিহ্ন পাওয়া যায়, একটা ভাঙা শহরও।
হিটলারের নির্দেশে বেভারিয়ান আল্পসে একটি ইউএফও ক্র্যাশ করানো হয়, যেখান থেকে তারা প্রযুক্তি পেয়ে এগিয়ে যায় আমেরিকা থেকে। সে যানটি ছিল প্লাইডিয়ান এলিয়েনদের। অবশ্য প্লাইডিয়ানদের সাথে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ১৯৩৪ সালে চুক্তি করেছিলেন বলে জানান বিলেক।
বিলেক আরো অনেক কিছুই বলেছেন। ১৯৮৯ সাল থেকে তিনি অসংখ্য রেডিও প্রোগ্রাম করেছেন, ভিডিওতে কথা বলেছেন, বইও লিখেছেন। তিনি The Philadelphia Experiment Chronicles এর রচয়িতা। The Montauk Project: Experiments in Time-ও তার অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে লেখা। তার বর্ণিত কাহিনী বিশ্বাস করেছেন অনেক মানুষ, রয়েছে তার ভক্তকুল।
কিন্তু তিনি যে বড় একজন মিথ্যেবাদী এবং তার কাহিনীতে যে কত গলদ রয়েছে, সেটা নিয়েও কথা বলেছেন অনেকেই।
আল বিলেক মারা যান ২০১১ সালের ১০ অক্টোবর মেক্সিকোতে ৮৪ বছর বয়সে। সেখানের এক গোরস্থানেই তাকে কবর দেয়া হয়।
আল বিলেকের গল্প শুনে আপনার কেমন লেগেছে?
ফিচার ইমেজ: PixelsTalk.Net