টাইটা কাঁদছে। ভোর হচ্ছে। নীল নদের জলে গা ভিজিয়ে এসে উঁকি দিচ্ছে সূর্য।
প্রায় তিনশ বছর বয়সী মানুষটা শেষ কবে এভাবে কেঁদেছে, কেউ ঠিক মনে করতে পারে না। সম্ভবত প্রায় দুইশ বছর আগে, রানী লসট্রিসের মৃত্যুর সময়। টাইটার অসম্ভব প্রিয় মানুষ ছিল লসট্রিস। খোজা দাস হিসেবে তাকে নিজের করে পাওয়ার উপায় ছিল না টাইটার। সেজন্য ইতিহাস নিশ্চিন্তে সাক্ষ্য দেয়, লসট্রিসের প্রতি তার ভালোবাসার সবটা ছিল সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ। লসট্রিসও তাকে ভালোবেসেছিল। আর এই কিংবদন্তীর গল্প লিখে গেছেন যে মানুষ, তিনি তাদের প্রত্যেককে বড় ভালোবাসতেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিখুঁতভাবে তিনি তাদের গল্প লিখে গেছেন নিজের মস্তিষ্কের ভেতরে গড়ে ওঠা এক স্ক্রল অনুসারে। কল্পনার এমনই শক্তি! এত বিস্তৃত পরিসরে তিনি লিখেছেন, পড়ে কেউ অবাস্তব, নিছক কল্পনা বলে ভেবে নেয়নি টাইটা-লসট্রিসকে। গল্পের চরিত্রের জন্য এরচেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে!
সেই মানুষ, সেই লেখক ছেড়ে গেছেন পৃথিবী। উইলবার স্মিথ ৮৮ বছর বয়সে মারা গেছেন নিজ বাসায়। টাইটা ধীরে ধীরে চোখের পানি মুছে নেয়। এক হাতে পানির ঝাপটা দেয় মুখে। মেলে ধরে পাশে পড়ে থাকা পাকানো স্ক্রলটা। এই স্ক্রলে সে লিখবে মানুষটার গল্প। উইলবার স্মিথের গল্প।
১
উইলবার স্মিথের জন্ম ১৯৩৩ সালের ৯ জানুয়ারি। সেন্ট্রাল আফ্রিকার উত্তর রোডেশিয়ায় (বর্তমানে জাম্বিয়া)। আঠারো মাস বয়সে তিনি সেরেব্রাল ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। ডাক্তাররা বলেছিল, ছেলেটার মরে যাওয়াই ভালো। বেঁচে থাকলেও তার মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ইংরেজিতে যাকে বলে ব্রেন ড্যামেজ। স্মিথ নিজে পরে মজা করে লিখেছেন,
“আফ্রিকার সে সময়ের চিকিৎসা ব্যবস্থা ভালো ছিল না ঠিক, কিন্তু ডাক্তারদের এ অনুমান সত্যি হয়েছিল। বেঁচে গেলেও আমার মাথায় হালকা সমস্যা রয়ে গেল। অন্তত হালকা ছিটগ্রস্ত না হলে কেউ গল্প লেখাকে পেশা হিসেবে নেয়?”
স্মিথের ছোটবেলা কেটেছে বাবার র্যাঞ্চে। প্রায় ২৫ হাজার একরের বিশাল বন-জঙ্গল আর পাহাড়ে সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠা। মস্তিষ্কের ভেতরে মানুষটার যে গল্প বাসা বাঁধবে, তা আর বলতে! র্যাঞ্চের কর্মচারীদের সঙ্গে হাসি-খেলার পাশাপাশি ছিল গুলতি দিয়ে পাখি শিকার, ছোটখাট স্তন্যপায়ী প্রাণি শিকার। আর বনের মাঝে আগুন জ্বেলে নিজেরা রান্না করে, বারবিকিউ করে খাওয়া।
মাঝে মাঝে বাবার পিকআপ ট্রাকের পেছনে বসার সুযোগ পেতেন। বাবা যেতেন ব্যবসার কাজে, ছেলেকে নিয়ে যেতেন শিখিয়ে-পড়িয়ে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে। সবচেয়ে বড় শিক্ষাগুলোর একটি ছিল অযথা বাড়তি কথা না বলা। আস্তে-ধীরে ব্যবসা বুঝতে শিখলেন স্মিথ। গরু ব্র্যান্ডিং করাও শিখে গেলেন।
বাবাকে বড় পছন্দ করতেন শিশু স্মিথ। তাই বাবার সঙ্গে সময় কাটানো তার কাছে ছিল বড় পাওয়া। তবে দুষ্টুমি করলে বাবা কিন্তু ছাড়তেন না। পরনের বেল্ট খুলেই বসিয়ে দিতেন পশ্চাদ্দেশে। তা নিয়ে অবশ্য স্মিথের আপত্তি ছিল না। নিজেই বলে গেছেন, ওটুকু আমার প্রাপ্যই ছিল।
মাত্র আট বছর বয়সে বাবা তার হাতে .২২ রেমিংটন রাইফেল তুলে দেন। নিজ হাতে শেখান গুলি ছোড়া। শেখান গুলি ব্যবহারের নিয়মনীতি। অন্যায় ব্যবহার যেন না হয়, সে দীক্ষাও দেন। এভাবেই স্মিথ প্রেমে পড়ে যান আগ্নেয়াস্ত্রের।
স্মিথের রাইফেলটা আগে ছিল তার দাদার। ভদ্রলোকের নাম কোর্টনি জেমস স্মিথ। জুলু যুদ্ধের সময় তিনি একটি ম্যাক্সিম সশস্ত্র দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা থেকে স্মিথ নিজের প্রথম উপন্যাস হোয়্যেন দ্য লায়ন ফিডস-এর নায়কের নাম রাখেন কোর্টনি।
বাবা যদি হয়ে থাকেন পরম পূজনীয়, মা ছিলেন স্বর্গের দেবী। অন্তত স্মিথের ভাষ্য তা-ই বলে। বাবার রাগ থেকে ছেলেকে বাঁচিয়ে রাখাই শুধু না, প্রকৃতিকে ভালোবাসতেও শিখিয়েছিলেন তিনি। আর প্রতিরাতে ঘুমানোর আগে গল্প পড়ে শোনানো তো আছেই। এর মাধ্যমে স্মিথ গল্পের প্রেমে পড়ে গেলেন। যে মানুষটির বই পড়ায় হাতেখড়ি হয়েছে জাস্ট উইলিয়াম, সি. এস. ফরস্টার, হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড পড়ে, তার মাথায় যে গল্পেরা পাখা মেলে দিবে, এ আর আশ্চর্য কী!
মায়ের আদর, বাবার শাসনের ইতি ঘটল কিছুদিন পরেই। স্মিথের নিজের আগ্রহও ছিল অবশ্য। বাবাও রাজি। সব মিলে তাকে ভর্তি করে দেওয়া হলো দক্ষিণ আফ্রিকার নাটালের কর্ডওয়ালেস বোর্ডিং স্কুলে, বাড়ি থেকে তিন দিনের ট্রেন ভ্রমণের দূরত্বে।
আগ্রহ অবশ্য কিছুদিনের মধ্যেই বাতাসে মিলিয়ে গেল। প্রথম সপ্তাহ কেটে যাওয়ার পরেই ‘ভয়ংকর অপরাধ’-এর জন্য পিঠে তিন ঘা লাগিয়ে দিল তার এক শিক্ষক। অপরাধ- বাতি নিভিয়ে দেওয়ার পর কথা বলা! স্মিথ নিজের ভাষ্যে লিখেছেন,
‘আমি কিছুতেই এ শাস্তি মেনে নিতে পারিনি। বাবাও তো এত অন্যায় করেননি আমার সঙ্গে! তাই হেডমাস্টারের কাছে গেলাম অভিযোগ নিয়ে। বললাম, “কিছু মনে না করলে বলি, আমার বোধ হয় নিজেদের র্যাঞ্চে ফিরে যাওয়াই ভালো।” দেখা গেল, তিনি ঠিকই কিছু মনে করেছেন! আমার আইডিয়া তার মোটেই পছন্দ হয়নি। ফলাফল, পরের আট বছর ওই বোর্ডিং স্কুলের ঘানি টানা। এখানে আপনি যদি খেলাধুলা পছন্দ না করেন কিংবা অপছন্দ করেন লাতিন বা গণিত, আপনার নাম পড়ে যাবে অলস ও কাপুরুষ। ভয়ংকর ব্যাপার! কেউ আপনার সঙ্গে আসতে মিশতে চাইবে না। তাতে অবশ্য আমার কিছু আসে-যায়নি। বই আছে না?’
এখানেই বইয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব তার গাঢ় হলো। জনৈক জনাব ফোর্বস হয়ে গেলেন তার দীক্ষাগুরু। ইংরেজি শেখাতেন, পাশাপাশি স্মিথ যেসব বই পড়তেন, আলোচনা করতেন সেসব নিয়ে। ইংরেজদের নিয়মানুসারে, নামের প্রথম অংশ ধরে ডাকা মানে ঘনিষ্ঠতা ও সম্মান দেওয়া। ফোর্বস স্মিথকে ডাকতেন ‘উইলবার’ বলে। স্মিথ এটা বেশ পছন্দ করতেন। ফলে তাদের মধ্যে একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ফোর্বসের হাত ধরে স্মিথ বুঝতে পারেন কোন ঘরানার বইগুলো তার বেশি পছন্দ, এ ধরনের বই আরও কী কী আছে ইত্যাদি। সে বছরের শেষে ফোর্বস তাকে ‘সেরা ইংরেজি রচনা’ লেখার জন্য পুরস্কার দেওয়ার প্রস্তাবও দেন। এই প্রস্তাবের হাত ধরে স্মিথ জিতে নেন নিজের প্রথম ‘সাহিত্য পুরস্কার’—সমার মমের টু মডার্ন ইংলিশ লিটারেচার, যার বাংলা করলে দাঁড়ায়, আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয়।
প্রাথমিক পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে স্মিথ ভর্তি হন ‘সেন্ট মাইকেল’স অ্যাকাডেমি ফর ইয়াং জেন্টেলমেন’-এ। স্মিথের ভাষ্যমতে,
সত্যিটা হলো, এখানে একজন ভদ্রলোকও ছিল না! আগের সব সমস্যাতে পড়তে হলো আমাকে আবার। তবে এবারেরটা আরও ভয়াবহ!
তবে এই স্কুলে উইলবার স্মিথ নিজে একটি সাপ্তাহিক স্কুল পত্রিকা খুলে বসেন। খেলার পাতা ছাড়া আর সব লিখতেন তিনি নিজেই। তার লেখা স্যাটায়ার বা বিদ্রুপাত্মক লেখাগুলো বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আশেপাশের দুটো মেয়েদের স্কুলেও চাহিদা তৈরি হয় এ পত্রিকার। অথচ বছর শেষে এই পত্রিকার জন্য পুরস্কার পায় তার এক সহপাঠী। সে আসলে প্রিন্ট মেশিন চালাত! হেডমাস্টার স্মিথকে ডেকে বলেছিলেন, পত্রিকার সবার পক্ষ থেকে একজনকে দেওয়া হয়েছে পুরস্কারটা, আর কিছু না। স্মিথ বিদ্রুপ করে এ নিয়ে লিখেছেন,
সবাই আর কই, আর তো ছিলামই আমি!
তারপর বিশ্ববিদ্যালয়। সেন্ট রোডস ইউনিভার্সিটি। কীভাবে কেটে গেল এই সময়টা, স্মিথ নিজেও টের পাননি। পড়াশোনা না করলেও ছুটিতে স্মিথ কাজ করতেন এক স্বর্ণখনিতে। এই অর্থে তিনি টি ফোর্ড মডেলের একটি গাড়িও কিনে ফেলেন।
জীবনের প্রতিটি অধ্যায়, প্রতিটি ছোট ছোট ঘটনা মানুষকে পরিণত করে। যতদিনে উইলবার স্মিথ বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে জীবনের কঠিন অধ্যায়ে পা রেখেছেন, তার মাথায় গেড়ে বসেছে গল্পের প্রতি ভালোবাসা। আফ্রিকার জীবন, স্বর্ণখনি বা র্যাঞ্চে কাজ করার অভিজ্ঞতা, পাহাড় ও জঙ্গলে বেড়ে ওঠা তাকে দিয়েছে গল্পের উপাদান। উইলবার স্মিথ যে গল্পকার হবেন, নিয়তি তা মোটামুটি ঠিক করে ফেলেছে ততদিনে।
২
পৃথিবীর সব গল্পেই বাঁক থাকে। জীবন বাঁক নেয় অপ্রত্যাশিতভাবে। স্মিথেরও তাই হলো। লেখালেখির কথাটা বাবাকে তিনি জানালেন একটু ঘুরিয়ে। বললেন, সাংবাদিক হতে চান। না পারলে হয়ে যাবেন শিকারী। বাবা বকে দিলেন আচ্ছামতো। বললেন, না খেয়ে মরতে হবে এ ধরনের পেশা বেছে নিলে। ফলে বাধ্য হয়ে স্মিথ হয়ে গেলেন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। এর কিছুদিন পরেই তার বিয়ে হয়ে গেল, বাচ্চা হলো দুটো। কিন্তু বিয়েটা টিকল না। অ্যালিমোনি বা ডিভোর্সের পর স্ত্রীর খোরপোশের অর্থ দিতে দিতে হয়ে গেলেন শূন্যহাত। একদিকে অনিচ্ছায় নেওয়া চাকরি, আবার বাসায় ফিরে জেঁকে ধরা নিঃসঙ্গতা। মানসিকভাবে বিক্ষত, বিদ্ধস্ত স্মিথ ফিরে গেলেন নিজের প্রথম প্রেমের কাছে। গল্প।
তবে এবারে পড়ার চেয়ে লেখায় মন-প্রাণ ঢেলে দিলেন তিনি। কিন্তু কে নেবে তার গল্প? এসব লিখে কি অর্থ আয় করা যাবে? অবাক হয়ে স্মিথ টের পেলেন, এমনটাও হয়। আর্গসি নামের এক ম্যাগাজিন তার প্রথম গল্প কিনে নিল। মাসিক বেতনের দ্বিগুণ অর্থ পেলেন তিনি এ গল্প লিখে। এভাবে লিখলেন আরও কিছু গল্প।
এতদিনে বেশ আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন। সে সাহসে ভর করে লিখে ফেললেন নিজের প্রথম উপন্যাস, দ্য গডস ফার্স্ট মেক ম্যাড। কথাটা এসেছে প্রাচীন এক বাক্য থেকে। সর্বপ্রথম কথাটা কে বলেছেন, তা জানা যায় না। তবে এই বাক্যাংশ হেনরি ওয়াডসোর্থ লংফেলোর কবিতা ‘দ্য মাস্ক অব প্যান্ডোরা’ থেকে। পুরো বাক্যটি হলো, ‘হুম দ্য গডস উড ডেসট্রয়, দে ফার্স্ট মেক ম্যাড’। মানে, সৃষ্টিকর্তা যাকে ধ্বংস করে দিতে চান, তাকে প্রথমে পাগল বানিয়ে দেন। উইলবার স্মিথের নিজের ভাষ্যমতে, ‘জঘন্য এক বইয়ের ভয়ংকর এক নাম!’ কিন্তু সে ভাবনা তখনও আসেনি মাথায়।
পাঠালেন এক লিটারেরি এজেন্সিতে। তারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রকাশনীতে পাণ্ডুলিপি পাঠাতে লাগল। আর আসতে লাগল একের পর এক প্রত্যাখ্যানপত্র। লেখালেখির ভূত পালিয়ে গেল। স্মিথ আবার ফিরে গেলেন আগের কাজে।
৩
কিছুদিন পরেই আবার ভূতে ধরল। কী যেন একটা খোঁচায় সারাক্ষণ। মাথা থেকে ভূত তাড়াতে স্মিথ লিখতে বসলেন শন কোর্টনির গল্প। যার বেড়ে ওঠা আফ্রিকার এক র্যাঞ্চে। নিজের বাবা-মায়ের গল্পটাই বললেন তিনি, লিখলেন আফ্রিকার ইতিহাস। শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের কথা। স্বর্ণখনি ও আফ্রিকান নারীদের গল্প। ভালোবাসা ও ঘৃণা। নিজে যেসব ভালোবাসতেন, সেসবই উঠে এলো তার লেখায়। অযথা অপরিণত দার্শনিকতা, রাজনীতি ইত্যাদির ধারেকাছেও গেলেন না। সবশেষে বইয়ের নাম ঠিক করলেন, হোয়্যেন দ্য লায়ন ফিডস।
লণ্ডনের আরসেলা উইনান্ট এজেন্সিতে নিজের এজেন্টের কাছে পাণ্ডুলিপি পাঠিয়ে দিলেন উইলিয়াম স্মিথ। এক লেখায় তিনি লিখেছেন, অনেক পরে শুনেছিলেন, সেই এজেন্ট উইলিয়াম হিনেম্যান প্রকাশনীর ম্যানেজিং ডিরেক্টর চার্লস পিককে ফোন দিয়ে বলেছিল, “আমার কাছে একটা পাণ্ডুলিপি আছে। ওটা আমি তোমাকে পড়তে দিতে পারি তিন শর্তে। এক, তুমি লেখককে অগ্রীম এক হাজার পাউণ্ড দিবে। (প্রথম উপন্যাসের জন্য এ অঙ্ক অনেক বড়।) দুই, প্রথম মুদ্রণে তুমি চার হাজার কপি ছাপাবে। ( যেকোনো প্রখ্যাত লেখকের জন্য সে সময় এই পরিমাণ ছিল সম্মানজক।) তিন, সাড়ে সাত পার্সেন্ট রয়্যালটি দিতে হবে লেখককে।” চার্লস পিক উত্তরে বলেছিলেন, “আগে পাঠাও। পড়ার পরে বাকি কথা হবে, সমস্যা নেই।”
পরের সাপ্তাহিক ছুটির দিনে চার্লস ফোন দিলেন আরসেলাকে। বললেন, “তোমার তিনটা শর্তের একটাও রাখা সম্ভব না। কারণ, লেখককে আমি অগ্রীম দুই হাজার পাউণ্ড দিতে চাই। প্রথম মুদ্রণে ছাপতে চাই দশ হাজার কপি! আর রয়্যালটি দিতে চাই দশ পার্সেন্ট!”
দুদিন পর ডাকপিয়ন খাম নিয়ে এল উইলবার স্মিথের বাসায়। চার ব্যাচেলরের সঙ্গে থাকতেন তিনি তখন। স্বাক্ষর করে ডাকপিয়নের হাত থেকে খাম বুঝে নিলেন স্মিথ। খুললেন, আর বদলে গেল তার জীবন।
আই লাভ ইউ, ম্যান নামের এই বই পাঠককে শুধু মুগ্ধই করেনি। প্রেমে ফেলেছে, কাঁদিয়েছে, কাঁপিয়ে দিয়েছে লাখো পাঠকের বুক।
পরের কয়েক সপ্তাহ ডাকপিয়ন আসতেই থাকল। কখনো নিউ ইয়র্কের ভাইকিং প্রেসের বইয়ের স্বত্ব কিনে নেওয়ার প্রস্তাব গ্রহণের খবর নিয়ে, কখনো জার্মানি বা ফ্রান্সে অন্য কোনো প্রকাশনীর রাজি হওয়ার সংবাদ নিয়ে। পরের তিন বছর স্মিথ আগের চাকরি ছাড়েননি। কোনো ছুটি নেননি। সব অর্থ জমিয়েছেন ঠাণ্ডা মাথায়। যখন নিশ্চিত হয়েছেন, এই অর্থে পরের পাঁচ বছর কোনো কাজ না করেও চলতে পারবেন, তখন চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। আবার সংসার করার চেষ্টাও করেছিলেন। লাভ হয়নি। এক সন্তান হয়েছে, কিন্তু বিয়ে ভেঙে গেছে আবারও।
৪
বর্ণাঢ্য এক জীবন কাটিয়েছেন উইলবার স্মিথ। সেই গল্প সবিস্তারে শোনাতে গেলে বই লিখতে হবে। এই ছোট্ট লেখায় শেষ করা যাবে না। তাই স্মিথের গল্পের এই ধাপে তার সৃষ্টির গল্প বলি।
একের পর এক ঢাউস সব বই লিখে গেছেন উইলবার স্মিথ। তবে সবসময় লিখেছেন মন থেকে। লিখেছেন নিজের জানাশোনার গণ্ডির ভেতরে। তাই নিয়মিত বাড়িয়ে গেছেন জ্ঞানের পরিধি। পড়েছেন প্রচুর।
স্মিথের বিস্ময়কর সৃষ্টি প্রাচীন মিশর নিয়ে লেখা রিভার গড। টাইটা নামের যে চরিত্র তিনি গড়েছেন, মাটির মানুষের চেয়ে তাকে কোনো অংশে কম বাস্তব মনে হয় না। পরের বইগুলোতে একে একে উঠে এসেছে বিভিন্ন ফারাওয়ের অধীনে টাইটার অভিযানের গল্প। ওয়ারলক, দ্য কোয়েস্ট, ডেজার্ট গড, ফারাও, নিউ কিংডম— একের পর এক দুর্দান্ত অভিযানের গল্প শুনিয়েছেন তিনি। যদিও পরেরদিকে এসে টাইটার চরিত্রকে তিনি অতিমানবীয় বানিয়ে ফেলেছেন। তবু মিশরকে তিনি এত রোমাঞ্চকর ও বাস্তব করে হাজির করেছেন পাঠকের সামনে যে, এ সিরিজ পড়ে মিশরের প্রেমে পড়েনি, লসট্রিসকে ভালোবাসেনি— এমন পাঠক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে। এটা বোঝার জন্য আলাদা জরিপ করার দরকার নেই। গুডরিডস আছে, আছে আফ্রিকা থেকে এত দূরে ছোট্ট বাংলাদেশে স্মিথ-মুগ্ধ হাজারো পাঠক।
এই সিরিজের দ্বিতীয় বইতে স্মিথ চমৎকার আরেক কাজ করেছেন। রিভার গড-এর গল্পকে বাস্তব করে তোলার জন্য সেভেন্থ স্ক্রল নামের এ বইতে দেখিয়েছেন, কীভাবে বর্তমান সময়কার মানুষ জানতে পারল টাইটার গল্প। দেখিয়েছেন, মূল্যবান এই স্ক্রলগুলোর জন্য কীভাবে মানুষের জীবন ঝুঁকিতে পড়ে যেতে পারে। প্রাচীন পৃথিবীর সঙ্গে বর্তমান সময়কে এত চমৎকারভাবে বাঁধার কথা ভাবা ও এর বাস্তবায়ন করা খুব সহজ কাজ নয়!
এই সিরিজটির জন্য উইলবার স্মিথ অসম্ভব বিখ্যাত সত্যি। কিন্তু তার চমৎকার বইয়ের সংখ্যা অনেক, অনেক বেশি। দ্য সানবার্ড নামের ঢাউস বইটি আফ্রিকার হারানো এক কিংবদন্তীর গল্প শুনিয়েছে পাঠককে। দ্য আই অব দ্য টাইগার পাঠকদের নিয়ে গেছে ছোট্ট এক দ্বীপে। স্মিথের অনেক বইয়ের মতো এই বইটিও রূপান্তরিত হয়েছে বাংলাভাষীদের জন্য মাসুদ রানায়। আই লাভ ইউ, ম্যান নামের এই বই পাঠককে শুধু মুগ্ধই করেনি। প্রেমে ফেলেছে, কাঁদিয়েছে, কাঁপিয়ে দিয়েছে লাখো পাঠকের বুক। স্মিথের আরও বেশ কিছু বই রূপান্তরিত হয়েছে মাসুদ রানায়। এর মধ্যে বিখ্যাত কয়েকটি হলো এ টাইম টু ডাই (রূপান্তর : শ্বাপদ সংকুল), ক্রাই উলফ (রূপান্তর : মুক্ত বিহঙ্গ), হোয়্যেন দ্য লায়ন ফিডস (রূপান্তর : দংশন), এলিফ্যান্ট সং (রূপান্তর : নরপিশাচ) ইত্যাদি। এই প্রতিটির একেকটি বই নিয়ে পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখতে গেলেও আলাদা নিবন্ধ লিখতে হবে। একেকটি বইয়ের শক্তি, মুগ্ধতা আজও রয়ে গেছে পাঠকের মনে। এর কোনোটিতে মাসুদ রানা স্মিথের গল্পের নায়কের জায়গায় দাঁড়িয়েছে ধর্ষণের শিকার নারীর পাশে, কোনোটিতে জীবন বাজি রেখে নেমে গেছে প্রকৃতি ও পৃথিবীকে বাঁচানোর যুদ্ধে। এই বইগুলোর কোনো কোনোটি স্মিথের ‘শন কোর্টনি’ সিরিজের বই। কখনো ব্যক্তিগত কারণে, প্রিয় মানুষ বা বন্ধুকে বাঁচাতে, কখনো পৃথিবী রক্ষায় আবার কখনো বিচিত্র কোনো কিংবদন্তীর সন্ধানে স্মিথের নায়কেরা ছুটেছে বইজুড়ে। সঙ্গে পাঠকদের নিয়ে ঘুরিয়ে এনেছে বিশাল ও রহস্যময় আফ্রিকার বিভিন্ন কোণ থেকে। এ এক অদ্ভুত মায়া। যে মায়ার জালে জড়িয়ে পড়েছে আফ্রিকার প্রায় সাত হাজার কিলোমিটার দূরের এক ছোট্ট দেশের মানুষ—বাংলাদেশের মানুষ।
৫
উইলবার স্মিথ একাধিকবার বিয়ে করেছেন, কিন্তু সংসার টেকেনি। অবশেষে তিনি মনের মানুষের খোঁজ পেয়েছেন। ৬৭ বছর বয়সে, ২০০০ সালে তিনি বিয়ে করেন তাজিকিস্তানের বংশোদ্ভূত মোখিনিসো রাখিমোভাকে। মৃত্যুর আগপর্যন্ত তারা একসঙ্গে কাঠিয়েছেন প্রায় একুশটি বছর।
৮৮ বছর বয়সে স্মিথ তার কেপ টাউনের বাড়িতে পৃথিবী ছেড়ে গেছেন। তবে মুগ্ধ পাঠকদের জন্য তিনি রেখে গেছেন বেশ কিছু সম্পূর্ণ ও অপ্রকাশিত উপন্যাস। কিছু অসম্পূর্ণ উপন্যাসও রয়েছে এ তালিকায়। এগুলো হয়তো লিখে শেষ করবেন অন্য কেউ।
স্মিথের সাহিত্য নিয়ে অনেক সমালোচনাও আছে। কেউ কেউ বলেছেন, তার লেখায় ইতিহাসের বিকৃতি ঘটেছে। কেউ বলেছেন, তার লেখায় সুপ্ত ছিল রাজনৈতিক এজেন্ডা। এসব সমালোচনার কতটা সত্যি, কতটা শুধুই অভিযোগ— সে ভার থাকুক সাহিত্য-সমালোচকদের কাঁধে।
টাইটা স্ক্রলটা গুটিয়ে ফেলে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। কিছু জীবনের কোনো শেষ নেই। উইলবার স্মিথ সেরকমই একজন। প্রাচীন মিশর, আফ্রিকান কিংবদন্তী, নীলনদের স্বপ্ন, প্রকৃতির ছোঁয়া ও রহস্য-রোমাঞ্চকর এক গল্পকার হিসেবে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে পাঠক হৃদয়ে।