ইংরেজি সাহিত্যে রোমান্টিক যুগের অন্যতম সেরা একজন কবি উইলিয়াম ব্লেক। একইসাথে তিনি ছিলেন কবি ও চিত্রকর ও খোদাইশিল্পী। জীবদ্দশায় অখ্যাত থাকা এই কবি বর্তমানে ইংরেজি সাহিত্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী কবিদের একজন। তার চিত্রকলাগুলোও রোমান্টিক যুগের সেরা চিত্রকলাসমূহের প্রতিনিধিত্ব করে। কিছু মানুষের সৃষ্টি তার সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে থাকে, ফলে সমসাময়িকরা বুঝে উঠতে পারে না তার মর্ম। ব্লেকের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তা-ই ছিল। বর্তমান সময়ের বিশিষ্ট ব্রিটিশ চিত্র সমালোচক জোনাথন জোনস এর মতে, উইলিয়াম ব্লেক ব্রিটেনে এ পর্যন্ত জন্ম নেয়া সবচেয়ে বড় চিত্রশিল্পী। ২০০২ সালের বিবিসি’র জরিপ অনুযায়ী, সর্বকালের সেরা ১০০ ব্রিটনের মধ্যে ব্লেক রয়েছেন ৩৮তম স্থানে। একজন আধুনিক শিল্পী কী এবং কেমন হন, উইলিয়াম ব্লেকের জীবন ও কর্ম বিশ্লেষণ করে তার সম্পর্কে বেশ ভালো ধারণা পাওয়া সম্ভব। চলুন কিছু জানা যাক এই কালজয়ী শিল্পী সম্পর্কে।
লন্ডনের সোহোতে গোল্ডেন স্কয়ারের ২৮ নং ব্রড স্ট্রিটে (বর্তমান ব্রডউইক স্ট্রিট) ১৭৫৭ সালের ২৮ নভেম্বর উইলিয়াম ব্লেক জন্ম নেন। তার বাবা জেমস ব্লেক ছিলেন কাপড়ের ব্যবসায়ী। আর তার মা ক্যাথেরিন রাইট আর্মিটেজ ব্লেক তাদের সাত ভাইবোনের দেখাশোনা করতেন। ব্লেক দম্পতির সাত সন্তানের মধ্যে দু’জন শৈশবেই মারা যায়। উইলিয়াম ব্লেক শুধু লেখাটা আর পড়াটা শিখতে যতদিন লাগে, ততদিনই স্কুলে গিয়েছিলেন। দশ বছর বয়সে তিনি স্কুল ছেড়ে দেন। বাকি শিক্ষালাভ বাড়িতে মায়ের পায়ের কাছে বসেই। এ বিষয়ে পরবর্তী জীবনে তিনি লিখেন, “ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে আমার স্কুলে যেতে হয়নি, বোকাদের ধরন-ধারণ অনুসরণ করতে বাধ্য হতে।”
সুযোগ পেলেই তিনি লন্ডনের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন। গভীর আগ্রহে চারপাশ অবলোকন করতেন। বাবার কিনে দেওয়া বইগুলো থেকে প্রাচীন গ্রিক চিত্রকর্মগুলো খোদাই করার চেষ্টা করতেন। এসব চিত্রকর্ম নিয়ে নাড়াচাড়া করতে গিয়েই রাফায়েল, মাইকেলেঞ্জেলো, হিমস্কার্ক, ডিউরার প্রমুখের ক্ল্যাসিকাল কর্ম দ্বারা তিনি প্রভাবিত হন। এসময় কবিতার প্রতিও ধীরে ধীরে তার আকর্ষণ জেগে ওঠে। তার প্রথম দিককার কাজগুলোতে বেন জনসন, এডমান্ড স্পেন্সার ও সাম (Psalm) এর জ্ঞান পরিলক্ষিত হয়। ‘সাম’ হলো ইহুদী ও খ্রিষ্টধর্মে প্রচলিত ধর্মীয় শ্লোক সংবলিত ভজনসঙ্গীত। বাইবেলের সুগভীর প্রভাব ছিল ব্লেকের উপর আজীবন। তার কর্মে, চিন্তায় ও কল্পনায় এর সম্যক প্রতিফলন বিদ্যমান। চিত্রকর্মের প্রতি ব্লেকের অনুরাগের কারণে বাবা-মা তাকে দশ বছর বয়সে একটি ড্রয়িং একাডেমিতে এবং পরবর্তীতে তরুণ শিল্পীদের একটি প্রিপারেটরি স্কুলে ভর্তি করে দেন।
ব্লেকের শৈশব শান্ত ও সুখদায়ক ছিল, কিন্তু আট বছর বয়স থেকে তিনি বিভিন্ন কাল্পনিক দৃশ্য দেখতে শুরু করেন। যেমন, গাছের ডালে দেবদূত দেখা বা ডানা গজানো তারকা। এসবই আসলে তার অতি কল্পনাপ্রবণ মনের চাঞ্চল্য ছিল। এই দৃশ্যপট কল্পনাক্ষম মন তার কাব্যচর্চার ক্ষেত্রে তাকে দিয়েছিল আলাদা সুবিধা। ব্লেকের কবিতাগুলো পড়তে গেলে পাঠকের মনে হবে, তারা কোনো খোদাই করা দৃশ্য দেখছেন। কাব্যে চিত্রাঙ্কনের এই অসাধারণ ক্ষমতা ব্লেককে তার সমসাময়িকদের মধ্যে করেছে অনন্য।
১৭৮২ সালে ব্লেক স্থানীয় এক মুদি দোকানীর মেয়ে ক্যাথেরিন বাউচারের সাথে পরিচিত হন। এই পরিচয় পরবর্তীতে প্রণয় ও পরিণয়ে গড়ায়। এই দম্পতির কোনো সন্তান না থাকায় ব্লেক বেশিরভাগ সময় ক্যাথেরিনকে লিখতে, পড়তে ও আঁকতে শেখাতেন। ১৭৮৩ সালে ব্লেক তার প্রথম কবিতার সংকলন ‘পোয়েটিকাল স্কেচেস’ প্রকাশ করেন। কাব্যে খুব একটা কাটতি না হলেও খোদাইকারী হিসেবে ব্লেকের খ্যাতির কারণে তাদের সংসার চলে যাচ্ছিল।
১৭৯৫ সালে ব্লেক ‘লার্জ কালার প্রিন্টস’ নামে একটি সিরিজ শুরু করেন। বাইবেল, মিল্টন ও শেক্সপিয়ার থেকে বিষয়বস্তু নিয়ে তিনি এই সিরিজ চালিয়ে যান। সে বছরই ব্লেক টমাস বাটস নামে একজন পৃষ্ঠপোষক পেয়ে যান। অর্থাৎ বাটসের অর্থায়নে চুক্তিবদ্ধ হয়ে ব্লেক বেশ কয়েক বছর যাবৎ তার জন্য ছবি আঁকেন। এখানে ব্লেক আর্থিক স্বচ্ছলতার সাথে সাথে শিল্পে অবারিত স্বাধীনতাও ভোগ করেন। ব্লেক তার কল্পনায় রঙ লাগিয়ে তুলিতে যা-ই ফুটিয়ে তুলতেন, বাটস তা-ই কিনতেন। ব্লেকের ভাষ্যমতে, তিনি যেকোনো সময়ের চেয়ে এখানে কাজ করার সময় আরও অনেক ভালো কাল্পনিক দৃশ্য দেখতে পেতেন।
১৮০০ সালে কবি উইলিয়াম হেইলি, ব্লেকের পৃষ্ঠপোষক হন। কিন্তু এখানে কিছুদিন কাজ করার পরেই ব্লেক বিষণ্নতায় নিমজ্জিত হন। এখানে চিন্তা ও কল্পনার সেই স্বাধীনতা তিনি পেতেন না। শিল্পী হিসেবে ব্লেক তার বিশুদ্ধতাকে আর্থিক লাভের কাছে বিসর্জন দিতে পারেননি। এই দুই কবির সম্পর্ক তিক্ততার মধ্য দিয়ে শেষ হয়। হেইলি ব্লেককে তার ‘আত্মিক শত্রু’ বা spiritual enemy বলে উল্লেখ করেন।
ব্লেকের অলীক দর্শন বা হ্যালুসিনেশন তাকে সাধারণের কাছে পাগল পরিগণিত করতে থাকে। পরিণত সময়েও তিনি প্রায়ই দাবি করতেন যে তার কাজগুলো দেবদূতদের দ্বারা প্রভাবিত। অনেক সময় কুমারী মেরীর মতো ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের সাথে তার যোগাযোগ হয় বলেও তিনি দাবি করতেন। আসলে ব্যাপারটিকে তার অতীন্দ্রিয়বাদ বা Mysticism বললে বেশি পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে। ঐশ্বরিক শক্তিতে গভীর বিশ্বাস ও প্রতিটি বিষয় ও বস্তুর আধ্যাত্মিক উপলব্ধিই আসলে তার কাজের মূল চালিকা শক্তি ছিল।
উইলিয়াম ব্লেকের নাম তার সমসাময়িক শেলী, কলরিজ, কীটস, ওয়ার্ডসওয়ার্থ প্রমুখের সাথে সমান্তরালে উচ্চারিত হয়নি। খুব স্বল্পসংখ্যক মানুষই সে সময় তার কদর উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। রোমান্টিক যুগের অন্যতম ধারক ও বাহক হিসেবে ব্লেক ব্যক্তিগত কল্পনাশক্তির উপর জোর দিয়েছিলেন। তিনি সমসাময়িক বোধিতত্ত্ব ও নগরায়ণের সংস্কৃতিকে পরিহার করেছিলেন। তার আধ্যাত্মিক ও অলীক দর্শনসমূহ ছিল তার সৃজনশীলতার মূল উৎস। তার নিজ কল্পনার একটা আলাদা আবহ আর আলাদা জগৎ ছিল। একদিকে যেমন Songs of Innocence-এ ব্লেক তার কল্পদৃশ্যগুলো পরম যত্নে ছবির মতো ফুটিয়ে তুলেছেন, আরেকদিকে Songs of Experience-এ তার কল্পনার সপ্তাকাশে অবগাহন করা মনকে মাটিতে এনে নামিয়েছেন; দেখিয়েছেন পার্থিব জীবন-যাপন সম্পর্কেও কি গভীর প্রজ্ঞা ও দর্শনের অধিকারী ছিলেন তিনি। উপর্যুক্ত নাম দু’টি ব্লেকের সেরা দুই কাব্যসংকলনের। Songs of Innocence এ ‘On Another’s Sorrow’ কবিতার শেষ লাইনগুলো এরকম-
“Oh He gives to us his joy,
That our grief He may destroy:
Till our grief is fled and gone
He doth sit by us and moan.”
এখানে ‘He’ বলতে ব্লেককে স্রষ্টাকে বুঝিয়েছেন। যখন সৃষ্টি কষ্টে কাঁদে, তখন স্রষ্টাও আমাদের পাশে বসে কাঁদতে থাকেন। তিনি তার আনন্দ আমাদের মাঝে বিলিয়ে দেন, যাতে আমাদের কষ্ট দূর হয়ে যায়। এভাবেই ব্লেক দৈবকে উপস্থাপন করেছেন, পরম মমতায়, পরম আদরে। Songs of Experience এ ‘A Divine Image’ কবিতায় ব্লেক লিখেছেন-
“Cruelty has a human heart,
And jealousy a human face;
Terror the human form divine
And secrecy the human dress.”
এখানে কবি বুঝিয়েছেন, নির্দয়তা, ঈর্ষা, সন্ত্রাস ও গোপনীয়তা- এ সবকিছু নেহায়েৎ বিমূর্ত ধারণাই নয়। বরং এদেরও আছে মানবীয় চেহারা, মানবীয় হৃদয়, মানবীয় আবরণ। অর্থাৎ এসব বিশেষ্যকে আলাদা করে দেখার কিছু নেই। এরা মানুষের অন্তরে, মুখে ও মুখোশে বাস করে। মানুষই এদের পরিচায়ক। কী স্বল্প কথায় কী সুগভীর প্রজ্ঞা! এটি ব্লেকের সবচেয়ে লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। তার বেশিরভাগ কবিতাই চার লাইন বা আট লাইনের। কিন্তু এই সংক্ষিপ্ততাই তার কাব্যগুলোকে করেছে আরও মাধুর্যমণ্ডিত ও মহিমান্বিত। ঠিক যেমনটা শেক্সপিয়ার ‘হ্যামলেট’-এ বলেছেন, “Brevity is the soul of wit.”– ব্লেক এর স্টাইলটিও একদম তা-ই।
১৮২৭ সালে ব্লেক জন লিনেল নামে এক তরুণ শিল্পীর পৃষ্ঠপোষকতায় দান্তের ‘ডিভাইন কমেডি’ সিরিজের খোদাইয়ের কাজ করছিলেন। এই কাজ অসমাপ্ত রেখেই সে বছর ১২ আগস্ট ব্লেক পরলোকগমন করেন। মৃত্যুবরণের দিনও নিরন্তর কাজ করে গেছেন। কাজ করতে করতে এক সময় তিনি ক্ষান্ত দেন, তারপর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলেন, “থাকো কেট, এভাবেই থাকো। আমি তোমার ছবি আঁকবো। কারণ তুমিও আমার জীবনে দেবদূতের কম ছিলে না।” মৃত্যুর আগে জীবনভরের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে ভোলেননি ব্লেক। স্ত্রীর ছবিটি এঁকে তিনি তার যন্ত্রপাতি নামিয়ে রাখেন ও শুয়ে ভজন গাইতে থাকেন। সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ স্ত্রীর কাছে তিনি অঙ্গীকার করেন যে তিনি সবসময় তার সাথে থাকবেন। তারপরেই তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
কিছু শিল্পী তাদের শিল্পকর্ম দ্বারা নিজ জীবনের চাইতেও বৃহত্তর মাত্রা অর্জন করেন। উইলিয়াম ব্লেকও তেমনি একজন শিল্পী, যিনি ক্যানভাসেও রঙ দিয়ে যেমন এঁকেছেন, তেমনি কবিতার খাতায় কালি দিয়েও এঁকেছেন। নিজ চিত্রকল্প আর শব্দজালের অসাধারণ মূর্চ্ছনায় ব্লেক মহাকালে করে নিয়েছেন স্থান।