কল্পনার রাজ্যে মানুষ সর্বদাই নিজেকে চিন্তা করে আরও সুখি হিসেবে কিংবা বলা যায় আরও উন্নত হিসেবে। এই কাল্পনিক চিন্তাভাবনাই যখন আমরা বিজ্ঞানভিত্তিক উপায়ে করি সেটা তখন হয়ে যায় বিজ্ঞান কল্পকাহিনী। বিজ্ঞান কল্পকাহিনী সত্যিকারের বিজ্ঞান না হলেও এর মধ্যেই বোনা হয়ে যায় ভবিষ্যতের বীজ। আজ থেকে ৫০ বছর আগেও যে কাজটা ছিল সবার জন্য অসম্ভব সেটাই হয়তো হয়ে যায় আজকের দিনে নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার। পৃথিবীতে এই কল্পকাহিনী নিয়ে লেখা হয় শত শত বই কিংবা তৈরি হয় শত শত সিনেমা। এমনই একটা এডভেঞ্চারের কাহিনী নিয়ে ১৯৫৪ সালে রিচার্ড ফ্লেশার তৈরি করেন 20,000 Leagues Under the Sea নামের সিনেমা। যেখানে দেখানো হয় সমুদ্রের গভীরে মানুষের এক কাল্পনিক জগতকে।
“সমুদ্রই সবকিছু। এটি ভূপৃষ্ঠের সাত-দশমাংশ জুড়ে ছড়িয়ে আছে। এর রয়েছে বিশুদ্ধ নিঃশ্বাস ও জীবন দানকারী শক্তি।” এমনই কিছু উক্তি থেকে বোঝা যায় সিনেমাটি জুড়েই রয়েছে সমুদ্র জগতকে নিয়ে অসাধারণ কিছু গল্পের সমন্বয়। সিনেমার শুরু থেকেই সমুদ্র নিয়ে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া একটা জনশ্রুতি নিয়ে গল্প শুরু হয়। বলে রাখা ভালো সিনেমাটি বিংশ শতকের মাঝামাঝি নির্মিত হলেও এর গল্পটি বেশ পুরোনো। সিনেমটি তৈরি হয়েছে জুল ভার্নের একই নামের বিজ্ঞান কল্পকাহিনী থেকে, যেটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৭২ সালে।ক্লাসিক্যাল গল্প নিয়ে যাদের আগ্রহ তাদের জন্য সিনেমাটা দেখা দরকার।
সমুদ্রের মাঝে একের পর এক ধ্বংস হতে থাকা জাহাজ নিয়ে ছড়িয়ে পরতে থাকে একটা গল্প, যাতে বলা হয় এক ভয়ংকর সামুদ্রিক জীব কিংবা দৈত্য একে একে ধ্বংস করে ফেলছে সমুদ্রে গমন করা বিভিন্ন জাহাজ। তখনই প্রফেসর পিয়েরে এরোনাক্স জাহাজে করে বেরিয়ে পড়েন সমুদ্রে রহস্য অনুসন্ধানে।
অসীম সমুদ্রের মাঝে জাহাজ নিয়ে বেরিয়ে পড়া একদল সাহসী মানুষের কাহিনীই দেখা যাবে এরপর থেকে। সবাই খুঁজে ফিরবে সেই দৈত্যের, আসলেই কী ঘটবে এরপর?
প্রফেসরদের জাহাজ কিন্তু একসময় দুর্ঘটনায় পড়ে এবং ঘটনাক্রমে প্রফেসর সন্ধান পান গভীর সমুদ্রের একদল মানুষের, যারা সারা জীবনের মতো সমুদ্রকে বেছে নিয়েছে নিজেদের আবাসস্থল হিসেবে। প্রফেসরের সাথে তার সহযোগী এবং জাহাজের একজন বন্ধুও সেই অদ্ভুদ সাবমেরিনে বসবাসকারী মানুষদের সন্ধান পেয়ে যায়। এরপরের গল্পটি নিরেট কল্পকাহিনী যেখানে বিজ্ঞানের আশ্রয় রয়েছে স্থানে স্থানে।
প্রফেসর যে সাবমেরিনে পৌঁছান তার নিয়ন্ত্রক ক্যাপ্টেন নিমো প্রথমে এই তিনজন আগন্তুককে শাস্তি দিতে চাইলেও একসময় তাদের উপর প্রসন্ন হয়ে তাদেরকে সাথে নিয়ে নেন। নিমো প্রফেসরের খ্যাতি সম্পর্কে জানতেন এবং গুণিজনদের কদর করতে জানতেন। প্রফেসরও তখনকার পৃথিবীর সাপেক্ষে এতো আধুনিক একটি জলজান সম্পর্কে জানতে আরো আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ক্যাপ্টেন নিমো তাদেরকে তার পানির নিচের অসাধারণ জগৎ সম্পর্কে পরিচয় করিয়ে দেন।
আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে পৃথিবীর স্থলভাগের সাহায্য ছাড়াই বিচিত্র সব পুষ্টিকর খাবার কিংবা সমুদের নিচে কৃষিকাজ ইত্যাদি অনেক অদ্ভুত বিষয় দিয়ে ভরপুর সিনেমাটি দর্শকের জন্য অনবদ্য অনুভুতি এনে দেবে নিশ্চিত। প্রফেসর একসময় ভাবতে থাকেন কেন ক্যাপ্টেন নিমো তার এমন সুন্দর প্রযুক্তি সারা বিশ্বের সামনে তুলে ধরছে না? নিমোর আবিষ্কার করা শক্তি উৎপাদনের প্রযুক্তিটি পৃথিবীর জন্য কল্যাণই বয়ে আনবে। তখন প্রফেসর জানতে পারেন নিমোর সাথে ঘটে যাওয়া করুণ এক ইতিহাসের কথা, যেখানে পৃথিবীর মানুষের একে অন্যের প্রতি হিংসা বিদ্বেষ কিংবা নির্যাতনেরই বর্ণনা শুধু মেলে।
নিমোর জীবনের ইতিহাস এবং তার পানির নিচের অদ্ভুত রাজ্যকে অনবদ্যভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সিনেমায়। পুরোনো হলেও সিনেমাটি সে সময়ের প্রযুক্তির যথার্থ ব্যবহার করেই তৈরি করা করা হয়েছে।
সিনেমাটিতে প্রফেসর কিংবা ক্যাপ্টেন নিমো ছাড়াও প্রফেসরের দুই বন্ধুর চরিত্রগুলোও অনেক গুরুত্ব বহন করে। নেড ল্যান্ড চরিত্রে অভিনয় করা কার্ক ডগলাস তার অনবদ্য অভিনয়ের মাধ্যমে সারাক্ষণ পর্দায় তার অবস্থার শক্ত করে গেছেন। ক্যাপ্টেন নিমো চরিত্রটির জন্য জেমস ম্যাসন আরেকটু ব্যক্তিত্বশালী অভিনয় করলে আরেকটু ভালো হতো অবশ্য। প্রফেসরের চরিত্রে পল লুকাস ছিলেন মানানসই।
ওয়াল্ট ডিজনির প্রযোজনার ধারাবাহিকতায় তারা সবসময়ই আউট অব দ্য বক্স ধাঁচের সিনেমা নিয়ে আসে। এটিও তেমনই একটি সিনেমা। এতে একাধারে এডভেঞ্চার, সায়েন্স ফিকশন আর অজানাকে জানার মানুষের চিরদিনের টানকে সুন্দরভাবেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। যারা একটু নতুন ধরনের স্বাদ পেতে চান আর ক্লাসিক্যাল সিনেমার প্রতি আগ্রহী তারা অবসরে দেখতে পারেন এটি।
দিনশেষে আরও উন্নত এবং আরও আধুনিক জীবনযাপনের জন্য মানুষের মধ্যে হানহানি ত্যাগ করে একত্রে কাজ করে যাওয়াটা যে জরুরি, সেটা তুলে ধরা হয়েছে এখানে। সিনেমার শেষে ক্যাপ্টেন নিমোর উক্তিটি এ দিকটাই নির্দেশ করে- “There is hope for the future & when the world is ready for a new & better life, all these things will someday come to pass, in God’s good time.”
এডভেঞ্চার বা সাইফাই ঘরোনার সিনেমাটির আইএমডিবি রেটিং ৭.২ এবং ৫ মিলিয়ন ইউএস ডলারে তৈরি করা মুভিটি বক্স অফিসে আয় করে নেয় ২৮.২ মিলিয়ন ইউএস ডলার। এছাড়াও একাধিক একাডেমি এওয়ার্ড পাওয়া সিনেমাটিকে সায়েন্স ফিকশন ঘরোনার মুভি নির্মাণের পথিকৃৎ সিনামগুলোর একটি হিসেবে মনে করা হয়। জুল ভার্নের এই গল্পটি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে পরবর্তিতে তৈরি হয় Captain Nemo & Underwater City। আগ্রহী হলে দেখে ফেলতে পারেন এ সিনেমাটিও।