Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

একাত্তরের জোছনা ও জননীর গল্প

২০০৪ সাল। মাঘ মাস প্রায় শেষ হয়ে এলো বলে; বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অন্যপ্রকাশ স্টলের সামনে মানুষের ভয়াবহ রকমের জটলা। জটের ভয়াবহতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেল যখন একপর্যায়ে স্টলের খানিকটা অংশ হুড়হুড় শব্দ করে ধ্বসে পড়ল। তাও মানুষের ভিড় কমছে না। অধীর আগ্রহে সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে ভিড়ের প্রকোপ দেখে সেবার আর ঢুঁ মারা হয়নি সেখানে। তাই জানতেও পারিনি যে সেই বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ নামের এক ইতিহাস! হ্যাঁ, এই লেখাটাকে উপন্যাস না বলে ইতিহাস বলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করব আমি। প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সকল লেখার মধ্যেও এই লেখাটি অনন্য সে কারণেই।

বইটির পূর্ব-কথা অনুচ্ছেদে মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের বর্ণনা দিতে লেখক বলছেন, “সে বড় অদ্ভুত সময় ছিল। স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের মিশ্র এক জগত। সবই বাস্তব, আবার সবই অবাস্তব। আমি সেই ভয়ঙ্কর সুন্দর সুররিয়েলিস্টিক সময় পার করে এসেছি। তার খানিকটাও যদি ধরে থাকতে পারি, তাহলেই আমার মানবজীবন ধন্য।”

হুমায়ুন আহমেদ; Image: Daily Star

কেন এই উপন্যাসকে ইতিহাস বলতে চাই? এতে কাহিনী বিন্যাসের ফাঁকে ফাঁকে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের দলিলের পনেরো খণ্ডের বেশ কিছু অংশ সরাসরি ব্যবহার করেছেন লেখক। সেগুলো মূল কাহিনীর সাথে এতটাই সঙ্গতিপূর্ণ যে মুগ্ধ হতে হয়। উপন্যাসে চরিত্র হিসেবে সেই সময়ের অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু মানুষজনকে আনা হয়েছে। এই চরিত্রগুলো ফুটিয়ে তোলায় লেখক যথেষ্ট মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। বইটির পরিশিষ্ট অংশে মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ বীরত্ব ও সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে পাওয়া খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণ তালিকা সংযোজন রচনাটিকে পরিপূর্ণতা দান করেছে। 

উপন্যাসের দৃশ্যপট মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়। কাহিনী শুরু হয়েছে ১৯৭১ সালের ফাল্গুন মাসের শুরুতে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি এবং শেষ হয়েছে ঠিক ডিসেম্বর মাসের ১৬ তারিখে। এই সময়কালের মধ্যে বেশ কিছু চরিত্রের উত্থান-পতন, আন্তঃসংযোগ, যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি, স্বভাবগত যাত্রা এবং পরিণতি নিয়ে কাহিনী এগিয়েছে আপন গতিতে। যুদ্ধের বীভৎসতা বর্ণনা করা থেকে সরে এসে তৎকালীন সময়ে দেশের সামাজিক ও পারিবারিক পরিবেশ চিত্রণে জোর দিয়েছে। এ কারণে এটি পড়ার সময় সহজেই সম্বন্ধযুক্ত হওয়া যায় চরিত্রগুলোর সঙ্গে। সুপরিকল্পিত ও সুবিন্যস্ত প্লট এতটাই বর্ণনাযোগ্য যে পাঠক পড়তে গিয়ে নিজেদের তৎকালীন পরিবারগুলোর একজন সদস্য মনে করবেন।

এতে কোনো মূল চরিত্র নেই। দেশকে যদি চরিত্র হিসেবে গণ্য করা যেত, তাহলে দেশটা হতো মূল চরিত্র। দেশ ও আসন্ন স্বাধীনতাকে ঘিরেই সকল চরিত্র চালিত হয়েছে। প্রতিটি চরিত্রই উপন্যাস শেষে কমবেশি পূর্ণতা লাভ করে। উল্লেখ করা যেতে পারে নীলগঞ্জ হাইস্কুলের আরবি শিক্ষক মাওলানা ইরতাজউদ্দিন কাশেমপুরীর কথা। গল্পের শুরুতে আমরা দেখতে পাই, ইরতাজউদ্দিন চান না যে দেশ স্বাধীন হোক। কারণ, তার মতে দেশ স্বাধীন হলে দেশের মানুষকে হিন্দুর গোলামি করতে হবে। এই ইরতাজউদ্দিনই তার গল্প পরিধির শেষে পৌঁছে চারজন হিন্দুকে জোরপূর্বক খৎনা করানোর প্রস্তুতি দেখে ঘোষণা দিলেন যে, পরাধীন দেশে জুম্মার নামাজ হয় না। তার এই ঘোষণা শুনে নীলগঞ্জে অবস্থানরত মিলিটারি বাহিনীর ক্যাপ্টেনের নির্দেশে সেইদিনই সন্ধ্যায় তাকে সোহাগী নদীর পাড়ে নিয়ে গুলি করা হলো। 

বইয়ের প্রচ্ছদ; Image: Goodreads

বলা যেতে পারে শাহেদ এবং আসমানির কথা। প্রতীকস্বরূপ এই দম্পতির মধ্যে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে প্রায়ই খুনসুটি হয় এবং আসমানী রাগ করে তাদের সন্তান রুনিকে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। একরাতে যথারীতি আসমানী রাগ করে রুনিকে সাথে নিয়ে বাসা ছাড়ল কিন্তু সেই রাতটা অন্য দশটা রাতের মতো ছিল না; রাতটা ছিল ২৫শে মার্চের কালরাত। 

চরিত্র চিত্রণে হুমায়ূন আহমেদ বরাবরই একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে এসেছে। জোছনা ও জননীর গল্প তার ব্যতিক্রম নয়। লেখক বরাবরই গোঁড়ামি-মুক্ত সংলাপ ব্যবহার করে এসেছেন। এই সংলাপগুলোর একটা ছাঁচ আছে যেটা হুমায়ূন-সাহিত্যের স্বভাবগত। তবে দীর্ঘ উপন্যাস হওয়ার কারণে মাঝে মধ্যে সংলাপে নীরসতা আছে। 

উপন্যাসের সিংহভাগ ঘটনা ঢাকা এবং নীলগঞ্জের পরিবেশে রচিত হয়েছে। কৌশলী এবং ফলপ্রসূ বর্ণনা পাঠককে তৎকালীন পরিবেশ সম্পর্কে একটি বিশদ ধারণা পেতে সাহায্য করবে। যেমন ষোলই ডিসেম্বরে জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণ করার পরে কী হলো তার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এভাবে-

“ঢাকা শহরের সব মানুষ ঘর ছেড়ে বের হয়ে পড়েছে। যার যা ইচ্ছা করছে। চিৎকার, হৈ চৈ, লাফালাফি। মাঝে-মধ্যেই আকাশ কাঁপিয়ে সমবেত গর্জন ‘জয় বাংলা’। প্রতিটি বাড়িতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উড়ছে। এই পতাকা সবাই এতদিন কোথায় লুকিয়ে রেখেছিল কে জানে?”

পরিশেষে, জোছনা ও জননীর গল্পে জোছনা হলো স্বাধীনতা এবং জননী হলো প্রাণের বাংলাদেশ। যেই প্রজন্ম নিজ চোখে স্বাধীনতার সংগ্রাম দেখেনি, সেই প্রজন্মের জন্য অবশ্যই পাঠ্য এই মাস্টারপিসটি।

বইয়ের নাম: জোছনা ও জননীর গল্প || লেখক হুমায়ূন আহমেদ 

প্রকাশক: অন্যপ্রকাশ || অনলাইন প্রাপ্তিস্থান: রকমারি.কম

This Bangla article is a review of Jochna O Jononir Golpo by Humayun Ahmed. This novel is based on the liberation war of Bangladesh.

Featured Image: Sadia Rosni Suchana

RB-RF/SM

Related Articles