হিন্দিতে একটা প্রবাদ আছে, “দের আয়ে, দুরুস্ত আয়ে“, অর্থাৎ দেরিতে হলেও ভালো হওয়া। এই প্রবাদ ঠিক ফলে গিয়েছিল ১৯৯৪ সালে মুক্তি পাওয়া রাজকুমার সন্তোষীর পরিচালিত ‘আন্দাজ আপনা আপনা’ এর ক্ষেত্রেও। সিনেমা হলে যা দর্শকের মনে আশানুরুপ সাড়া জাগাতে পারেনি, স্যাটেলাইট ও টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে তা ঠিকই মন জয় করে নিল দর্শকের। আর ডায়লগ, কে না ভুলতে পারে প্রতিটা চরিত্রের পারফেক্ট কমেডি টাইমিং! আর ডায়লগগুলো, হোক সেটা তেজা ম্যায় হু মার্ক ইধার হ্যায় (তেজা আমি,মার্ক এখানে) কি আঁখে নিকাল কে গোটিয়া খেলুঙ্গা (চোখ তুলে নিয়ে গুটি খেলবো)। কাল্ট ক্লাসিক বলতে বোঝায় এমন যা শুরুতে জনপ্রিয় না হলেও একসময় ঠিকই একটি নির্দিষ্ট কাল্ট বা গোষ্ঠীর কাছে সাফল্য লাভ করে। ১৯৯৪ সালে একগাদা ব্যবসাসফল ছবির পর ‘আন্দাজ আপনা আপনা’ যারা দেখতে চাননি, তারা তো বটেই, সাম্প্রতিক প্রজন্মের কাছেও এটি একটি অসাধারণ ছবি।
বলিউডের অন্যতম সেরা এই কমেডি সিনেমা মুক্তির ২৬ বছর পরও দর্শককে হাসিয়ে চলেছে সমানভাবে। বিশেষত বলিউডে যে সময়ে ওভারঅ্যাক্টিং বা অযথা হাসানোর চেষ্টা করা হয়, সেসময় অনেকে আফসোস করতে পারেন এমন সিনেমা আর হয় না কেন?
অনেকের মনে প্রশ্ন থাকতে পারে, এরকম অসাধারণ প্লটলাইনের ছবি, যার প্রধান চরিত্রে ছিলেন বলিউডের ভাইজান সালমান খান ও মিস্টার পারফেকশনিস্ট আমির খান, অভিনয়ে ছিলেন নব্বইয়ের দশকের দুই সুপারস্টার অভিনেত্রী রাভিনা টেন্ডন ও কারিশমা কাপুর, সেই সিনেমা ঠিক সেরকম সাফল্য তাৎক্ষণিক পায়নি কেন? আসছি সেই কাহিনীতে। তার আগে সিনেমা নির্মাণের নেপথ্যে একটু গল্প শোনা যাক।
যেভাবে তৈরি হলো
রাজকুমার সন্তোষীর লেখা ও পরিচালিত প্রথম ছবি ‘ঘায়েল’ ১৯৯০ সালে ব্লকবাস্টার হিট হয়, যার জন্য ফিল্মফেয়ারে সেরা পরিচালকেরও পুরষ্কার পান তিনি। অ্যাকশন ও সামাজিক থিমের ‘ঘায়েল’ এর পর সন্তোষী চাইছিলেন হালকা থিমের কোনো সিনেমা তৈরি করতে। তার আগের ছবির প্রযোজক প্রয়াত বিনয় কুমার সিনহা প্রস্তাব দিলেন আমির খানকে নিয়ে কমেডি সিনেমা বানাতে।
আমির খান তখনও ‘মিস্টার পারফেকশনিস্ট’ হয়ে ওঠেননি। তিনি তখন বলিউডের উঠতি তারকা। ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তাক’ এর মতো রোমান্টিক সিনেমা দিয়ে শুরু করলেও ‘দিল’, ‘দিল হ্যায় কে মানতা নাহি’-তে তার কমিক টাইমিং ছিল দেখার মতো। পাশাপাশি কাস্ট করা সালমান খানও ছিলেন রোমান্টিক হিরো। ‘ম্যায়নে পেয়ার কিয়া’, ‘সানাম বেওয়াফা’, ‘সাজান’-এর মতো রোমান্টিক ছবি তখন ব্লকবাস্টার হিট তার। তাদের বিপরীতে কাস্ট করা হলো রাভিনা টেন্ডন ও কারিশমা কাপুরকে।
১৯৯২ সালে শ্যুটিং শুরুর পর পরই শুরু হলো শিডিউল নিয়ে ঝামেলা। প্রত্যেক অভিনেতাই তখন নিজেদের অন্য সিনেমা নিয়ে ব্যস্ত। সিনেমা শ্যুটিংয়ে দেরি হওয়ায় সন্তোষীও তার পরবর্তী আরেকটি সামাজিক ছবি ‘দামিনী’-র কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, যা ১৯৯৩ সালে মুক্তি পায় ও ব্যবসাসফল হয়। আমির খান এক সাক্ষাৎকারে বলেন, সিনেমার কলাকুশলীরা পোস্টার প্রিন্টও করেননি, কারণ তারা ভয়ে ছিলেন সিনেমা যদি ঠিক সময়ে মুক্তি দিতে না পারেন। সালমান ও আমির দুজনেই একে অপরের চেয়ে বেশি স্ক্রিন টাইম দাবি করেছিলেন। যদিও পরে সন্তোষী দুজনকে একসাথে কাজ করতে মানিয়ে নেন। সিনেমা তৈরির বিলম্বটাও পড়ে চোখে, যেখানে এক দৃশ্যে সালমানের চুল বড়, ঠিক আরেক দৃশ্যে ছোট।
সালমান ও আমিরকে নিয়ে একত্রে সিনেমা বানানোর ঘোষণা দেবার দুই বছর পর, ১৯৯৪ সালের ৪ নভেম্বর মুক্তি পেল ‘আন্দাজ আপনা আপনা’। এরই মধ্যে সেই বছর বক্স অফিস কাঁপিয়ে নিয়েছে সালমান ও মাধুরী দীক্ষিতের ‘হাম আপকে হ্যায় কৌন’, অক্ষয় কুমার ও রাভিনার ‘মোহরা’, গোবিন্দা ও কারিশমার ‘রাজা বাবু’। সিনেমা ব্যবসাসফল না হওয়ার পেছনে কারণ ধরা হয় যে, বছরে এতগুলো ব্যবসাসফল ব্লকবাস্টার হিট ছবি মুক্তির পর শেষে এসে সিনেমাটি দেখতে দর্শকেরা তেমন আগ্রহী ছিলেন না।
এছাড়া সন্তোষী খুব বেশি প্রচার চালাননি সিনেমার। আর বলিউডের সিনেমা হিট হওয়ার অন্যতম উপাদান ছিল গান। যেমন- মোহরা ছবির সাফল্যের মূলে ছিল রাভিনা ও অক্ষয়ের ‘তু চিজ বাড়ি হ্যায় মাস্ত মাস্ত’ গানটি। তুষার ভাটিয়ার সংগীত পরিচালনায় ‘আন্দাজ আপনা আপনা’-র মিউজিক স্কোর চমৎকার হলেও হিট হবার মতো কোন গান ছিলো না, গানগুলো ছিল কিছুটা প্যারোডি টাইপের।
প্রায় তিন কোটি রুপি বাজেটের ‘আন্দাজ আপনা আপনা’ দেশ-বিদেশ মিলে বক্স অফিসে আয় করে আট কোটি রুপি। বড় শহরগুলোতে ভালো ব্যবসা করলেও সারা দেশে মুখ থুবড়ে পড়ে।
পরবর্তীতে স্যাটেলাইটে ও ভিসিআরের মাধ্যমে মুক্তি দেওয়া হয় সিনেমাটি। এবং তারপরই দর্শকরা এর মাহাত্ম্য বুঝতে পারে। পারফেক্ট কমিক টাইমিং, অসাধারণ সব ডায়লগ ক্রমেই আমজনতার মন জয় করে নেয় সিনেমাটি। সন্তোষী, যিনি সিনেমার ব্যর্থতায় আশাহত হন, তিনিও পরবর্তীতে আশা করেননি যে একসময় ঠিকই আমজনতা আপন করে নেবে সিনেমাটি।
‘আন্দাজ আপনা আপনা’-র আন্দাজের গল্প
একটি সিনেমার প্রাণ তার চরিত্রগুলো,এই সিনেমাও সেদিক দিয়ে ব্যতিক্রম নয়।
দুজনেই দুই ছোট শহরের দুই বাপের বেকার বাউন্ডুলে ছেলে, যাদের কাজ বাপের কষ্টের কামাই উড়িয়ে বসে বসে রাজা-উজির মারা। অমরের ইচ্ছা শর্টকাট উপায়ে বড়লোক হবার, আর প্রেমের স্বপ্ন অভিনেতা হবার। ঠিক একই সময় চিত্রপটে আগমন ঘটে আমেরিকা ফেরত কোটিপতি বাপের মেয়ে রাভিনা বাজাজ ও তার সেক্রেটারি কারিশমার। রাভিনা বিয়ের জন্য বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে যে সে এক ভারতীয় ছেলেকে বিয়ে করবে। রাভিনাকে পটাতে বাপের সব বেচে বের হয়ে যায় দুজন। অপরদিকে রাভিনার চাচা গ্যাংস্টার তেজা পরিকল্পনা করে তাকে ও তার বাবাকে মেরে সম্পত্তি দখলের। সেজন্য সে রবার্ট ও ভাল্লা নামের দুই সহযোগীকে পাঠায়। কে পটাতে পেরেছিল রাভিনাকে বা তেজা তার কুপরিকল্পনায় সফল হয় কিনা এ নিয়ে চলে কাহিনী।
পরিচালক সন্তোষী চেয়েছিলেন, টম এন্ড জেরির মানবরূপ অমর আর প্রেমের মাঝে দেখাতে। এমনিতে দুজন বন্ধু, এমনই যে দুজনে এক পেয়ালায় চা পান করে, কারণ অমরের ভাষায়, তাতে বন্ধুত্ব বাড়ে। কিন্তু সুযোগ যখন আসে রাভিনাকে পটানোর, একে অপরকে ডিঙিয়ে, মারামারি করে সেই সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না কেউই, চায় কেউ জেল খাটুক কী গণধোলাই খাক। কিন্তু তেজার ভাষায় এই দুই “পাপলু” সিনেমার শেষ পর্যন্ত ভালো বন্ধু হয়েই থাকে। তাদের চরিত্রে সালমান ও আমিরের অভিনয় ছিল একদম খাপে খাপ। বর্তমানে উদ্ভট সব সিনেমার জন্য সমালোচিত ‘ভাইজান’ সালমান খানের সাথে এই কমেডি অভিনেতা সালমানের কোনো মিল পাওয়া যাবে না। আর আমির প্রমাণ করে দেন তিনি আসলেই একজন পারফেকশনিস্ট, কোনো চরিত্রই তার কাছে অসাধ্য নয়, তা সে দমফাটানো হাসিরই হোক না কেন।
তবে ‘আন্দাজ আপনা আপনার’ মূল আকর্ষণ তার পার্শ্বচরিত্রগুলো। পরেশ রাওয়াল, যিনি রাভিনার বাবা ও তার যমজ ভাই দুজনের চরিত্রে অভিনয় করেন, তা ছিল অসাধারণ। বলিউডে ভিলেন বলতে বোঝানো হয় শক্তিশালী গুন্ডা ও সুন্দরী সঙ্গিনীকে নিয়ে ঘোরা খবিশ এক লোক, যেখানে তেজাকে দেখে ভয় তো দূরের কথা উল্টো হাসতে হাসতে পেট ফেটে যাবার জোগাড় হবে। রাভিনার টাইম টেবিল মেনে চলা কড়া বাপ থেকে খুনের প্ল্যান করে প্রতিবার ধরা খেয়ে যাওয়া তেজা, পরেশ রাওয়ালই সেরা ছিলেন এ চরিত্রের জন্য।
যার কথা না বললেই নয়, তিনি ক্রাইম মাস্টার গোগো, যার চেহারা দেখলেই সবাই হাসতে বাধ্য। ‘মি. ইন্ডিয়া’-র ভয়ঙ্কর ভিলেন মোগাম্বোর ভাইপো গোগোও ত্রাস, যার ডায়লগগুলো এখনও ফেরে ভক্তদের মুখে। তেরি আঁখে নিকাল কে গোটিয়া খেলুঙ্গা (চোখ তুলে নিয়ে গুটি খেলবো), আয়া হু কুছ তো লুটকার যাউঙ্গা (এসেছি যখন, কিছু তো লুট করে নিয়ে যাবো), ইয়ে তেজা তেজা কেয়া হ্যায় (এই তেজা তেজা কি)। গোগোর চরিত্রে শক্তি কাপুরও দেখিয়েছেন তার সেরাটি।
দমফাটানো সব হাসির ডায়লগ, অসাধারণ কমিক টাইমিং, অন্য সিনেমার রেফারেন্স- সব মিলিয়ে ‘আন্দাজ আপনা আপনা’ ছিল তার সময় অনুযায়ী এগিয়ে। এটা তখনকার দর্শকরা না বুঝলেও এখনকার দর্শকরা ঠিকই বোঝেন। তাই তো ক্রাইম মাস্টার গোগোর ডায়লগগুলো ঘোরে মুখে মুখে।
সিনেমাটি নিয়ে কমেডিয়ান অদিতি মিত্তাল বলেন, “আন্দাজ আপনা আপনা নিয়ে লিখতে গিয়ে, আমি যা বুঝেছি, তা হলো এটা মায়ের ভালোবাসা নিয়ে লেখার মতো ব্যাপার। প্রত্যেকের এটা কেমন লাগে বলার মতো আলাদা গল্প আছে।” চিত্র সমালোচক রাজা সেন এই সিনেমা সর্বকালের সেরা কমেডি সিনেমাগুলোর একটি নামকরণ করেন।
কোনো এক অলস ছুটির দিনে যদি বিনোদনের কিছু না পান, দেখতে বসুন সিনেমাটি। হোক তা অমর আর প্রেমের “বন্ধু তুমি, শত্রু তুমি” ভাব, কী তেজার মহা মহা সব প্ল্যান, হাসিয়ে রাখবে আপনাকে, যেমন করে হাসাচ্ছে বাকিদের, দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে।