মার্চের ১২ তারিখ লস এঞ্জেলেসের ডলবি থিয়েটারে অনুষ্ঠিত হবে ৯৫ তম অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডস। অনুষ্ঠানের একেবারে শেষ পর্যায়ে ঘোষণা করা হয় বহুল প্রতীক্ষিত ক্যাটাগরি ‘বেস্ট পিকচার’ জয়ীর নাম। প্রতি বছর ১০টি সিনেমা মনোনয়ন পায় ‘বেস্ট পিকচার’ ক্যাটাগরিতে। কোনো নির্দিষ্ট দাঁড়িপাল্লায় নয়, বরং ইন্ডাস্ট্রিতে, দর্শকদের কাছে, বা ফিল্মমেকিংয়ে বিশেষ প্রভাব ফেলেছে এরকম ১০টি মুভিকেই প্রতিবছর মনোনয়ন দেয়া হয় বেস্ট পিকচার ক্যাটাগরিতে। আজকে চলুন এবারের অস্কারের ১০ বেস্ট পিকচার মনোনীত সিনেমা নিয়ে কিছু জানা যাক।
১) All Quiet on the Western Front
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ব্যাকড্রপে যুদ্ধের ভয়াবহতার নির্মম এক চিত্র দেখা যায় নেটফ্লিক্স প্রযোজিত জার্মান ফিল্ম ‘All Quiet on the Western Front’ এ। জার্মান লেখক এরিখ মারিয়া রিমার্কের যুদ্ধক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা একই নামের বই থেকে অ্যাডাপ্ট করা হয়েছে মুভিটি। এরিখ মারিয়ার বইয়ের উপজীব্য ছিল যুদ্ধের ভয়াবহতাকে নিরেট সত্যতার সাথে তুলে ধরা। এই উপজীব্য মুভির প্রতিটি দৃশ্যে, পরিচালকের প্রতিটি চয়েসে উঠে এসেছে। মুভির প্রোটাগনিস্ট পল যুদ্ধে যাওয়ার বাস্তবতা না বুঝেই জড়িয়ে পড়ে এই মরণ খেলায়। এককালে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত পলের মুখোমুখি হতে হয় যুদ্ধের এই কঠোর, নৃশংস বাস্তবতার। যুদ্ধের কারণে সৈন্যদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ভীতিকর অবনতি মুভির স্ক্রিনপ্লে, বার্গারের পরিচালনা ও ফিলিক্স ক্যামারারের বিস্ময়কর অভিনয়ে যথাযথভাবে ফুটে উঠেছে।
২) Avatar: The Way of Water
১৩ বছর পরে জেমস ক্যামেরন হাজির হলেন অ্যাভাটারের সিক্যুয়েল নিয়ে। এই মধ্যবর্তী সময়ে অনেক প্রশ্নই উঠেছিল সিক্যুয়েলটি নিয়ে। এতদিন পরেও কি অ্যাভাটার ফ্র্যাঞ্চাইজ পারবে দর্শক ধরে রাখতে? অ্যাভাটার কতটাই বা প্রাসঙ্গিক আছে ১৩ বছর পরে? ক্যামেরন নিজেই কি পারবেন প্রথম মুভির ম্যাজিক আবার তৈরি করতে? সকল প্রশ্নের উত্তর দিয়ে Avatar: The Way of Water ২.২৪ বিলিয়ন ডলার আয় করে সর্বকালের বিশ্বব্যাপী বক্স অফিসে তিন নাম্বার পজিশনে বসে আছে। দেখা গেল ১৩ বছর পরেও দর্শকরা উৎসুক হয়ে বার বার ঘুরতে গিয়েছে প্যান্ডোরাতে। প্রযুক্তির সাহায্যে ফিল্মমেকিং কোন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায়, জেমস ক্যামেরন আরেকবার দেখিয়ে দিলেন হলিউডকে।
৩) The Banshees of Inisherin
আয়ারল্যান্ডের প্রশান্ত এক দ্বীপে দুই বন্ধুর সম্পর্কের টানাপোড়েনের গল্প ‘The Banshees of Inisherin’। দীর্ঘ সময় ধরে একসাথে কাজ করা দুই সঙ্গী কলিন ফ্যারেল ও ব্রেন্ডন গ্লিসনের সাথে মুভিটি বানিয়েছেন লেখক-পরিচালক মার্টিন ম্যাকডনাহ। ব্যানশিজ একান্তই আন্তরিক, মানবিক একটি উপাখ্যান। এখানে আছে অন্তরের গভীর সম্পর্কের গল্প, বন্ধুত্বের গল্প, পরিবারের মমতার গল্প, আয়ারল্যান্ডের ছোট্ট এক দ্বীপের মানুষগুলোর গল্প। কলিন ফ্যারেল ও ব্রেন্ডন গ্লিসনের পারফরমেন্সে বন্ধুত্বে ফাটল ধরার ব্যথা, কেরি কন্ডনের এক্সপ্রেশনে হাজারো গোপন অনুভূতি, ব্যারি কিওগানের পাগলাটে চরিত্র- সবকিছু মিলিয়ে ব্যানশিজ অব ইনিশেরিন এক মর্মস্পর্শী অভিজ্ঞতা।
৪) Elvis
বাজ লারম্যানের ‘Elvis’ অত্যন্ত ইউনিক এক বায়োপিক, কারণ এটা বাজ লারম্যানের এলভিস! নির্মাতা হিসেবে লারম্যান অনন্য। তার সেই অনন্য গল্প বলার স্টাইল বজায় থাকে এই মুভির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। লারম্যানের এই ইউনিক স্টাইলের কারণেই এলভিসের সাথে বাকি কোনো বায়োপিকের তুলনা দেয়া অসম্ভব। ৮৫ মিলিয়নের বাজেটে ২৮৭ মিলিয়ন ডলার তুলে নেয়া বক্স অফিস দর্শকপ্রীতিরই প্রমাণ। এলভিস প্রেসলি চরিত্রে অস্টিন বাটলারের বিস্ময়কর পারফরমেন্সের কল্যাণে ‘Elvis’ অনুরাগের বস্তু হয়ে উঠেছে অনেক দর্শকের কাছে।
৫) Everything Everywhere All At Once
ড্যানিয়েল কুয়ান আর ড্যানিয়েল শাইনার্ট (ড্যানিয়েলস) পরিচালিত ‘Everything Everywhere All At Once’ এক অদ্বিতীয়, অভাবনীয়, পাগলাটে, আবেগময় রোলারকোস্টার। মাল্টিভার্স নিয়ে সায়েন্স ফিকশন মুভির মধ্যে পরিচালক জুটি এশিয়ান ইমিগ্রেন্ট এক পরিবারের আশা-আকাঙ্ক্ষা, ব্যর্থতা, হতাশা, ভালোবাসা, আবেগের গল্প বলেছেন। মিশেল ইয়োহ মুভির মূল চরিত্র, এভেলিনের মধ্যে ধারণ করেছেন অসংখ্য মহাবিশ্বের সকল আবেগ, অনুভূতি। এভেলিনের স্বামী ওয়েমন্ডের চরিত্রে কী হুই কোয়ানের উদারতা ও ভালোবাসার বাণীতে অশ্রুসিক্ত হয়নি এমন কোনো দর্শক নেই। স্টেফানি স্যু দ্বৈত চরিত্রে দেখিয়েছেন গভীর বিষণ্নতা ও ধ্বংসবাদের এক মর্মন্তুদ পারফর্মেন্স। Everything Everywhere এক ইউনিভার্সাল গল্প যার মূল বস্তু পরিবার, মানবিক সম্পর্ক, ভালোবাসা।
৬) The Fabelmans
স্টিভেন স্পিলবার্গের অটোবায়োগ্রাফিকাল সিনেমা ‘The Fabelmans’। মুভির প্রোটাগনিস্ট স্যাম ফ্যাবেলম্যান মূলত স্পিলবার্গেরই স্ট্যান্ড-ইন। প্রখ্যাত এই নির্মাতার ফিল্মমেকিং এর প্রতি ভালোবাসা তৈরি হওয়ার শুরুর দিকের গল্প বলে দ্য ফ্যাবেলম্যান্স। ফিল্মমেকিংয়ের যাত্রা শুরুর পাশাপাশি মুভিতে রয়েছে স্পিলবার্গের পরিবারের গল্প। তার বাবা-মায়ের ডিভোর্স স্পিলবার্গের কৈশোরকালের গঠনমূলক অধ্যায় ছিল, যা পরবর্তীকালে তার বেশ কিছু সিনেমায় প্রভাব বিস্তার করেছে। স্পিলবার্গের মতে, ফ্যাবেলম্যান্সের গল্প তার ফিল্মোগ্রাফির এখানে-ওখানে লুকিয়ে ছিল সবসময়ই। জীবন ও ক্যারিয়ারের এই পর্যায়ে এসেই তিনি অবশেষে জীবনের অত্যন্ত ব্যক্তিগত এই অধ্যায়ের গল্পকে রূপালী পর্দায় তুলে ধরলেন।
৭) Tár
‘Tár’ এর রাইটার-ডিরেক্টর টড ফিল্ড বলেছেন, তিনি মুভিটি লিখেছিলেন কেইট ব্ল্যানচেটকে মাথায় রেখে। অন্য কোনো অভিনেতাকে নিয়ে তিনি মুভিটি চিন্তাই করতে পারতেন না। মুভি দেখার পরে কারো সন্দেহ থাকার কথা না ফিল্ডের বক্তব্য নিয়ে। কেইট ব্ল্যানচেটই টার! মুভির প্রায় সবগুলো সিনে রয়েছেন তিনি আর ডেলিভার করেছেন একের পর এক দুর্দান্ত দৃশ্য। বিশ্বখ্যাত মিউজিক কন্ডাক্টর লিডিয়া টারের ক্ষমতার অপব্যবহারের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে গভীর থেকে গভীরতম স্থানে অবরোহণের গল্প বলে ‘টার’। বর্তমানে হট টপিক বনে যাওয়া ‘ক্যান্সেল কালচার’ সম্পর্কিত বিরল ন্যুয়ান্সড বিশ্লেষণ পাওয়া যায় টড ফিল্ডের এই স্ক্রিপ্টে। লিডিয়া টারের মতো অতি জটিল এক চরিত্রে কেইট ব্ল্যানচেট এতটাই সাবলীল যা শুধুমাত্র তার মতো দক্ষ একজন অভিনেত্রীর পক্ষেই সম্ভব।
৮) Top Gun: Maverick
অ্যাভাটার ২ এর পরে দ্বিতীয় ব্লকবাস্টার ও সিক্যুয়েল হিসেবে বেস্ট পিকচারে জায়গা করে নিয়েছে টম ক্রুজের বিশ্বব্যাপী সমাদৃত Top Gun: Maverick। প্রথম টপ গান মুক্তি পেয়েছিল ১৯৮৬ সালে। প্রথম মুভির ৩৬ বছর পরে টম ক্রুজকে আবার দেখা গেল হটশট পাইলট ম্যাভেরিকের চরিত্রে। কীভাবে ৩৬ বছর পরে এসে একটি সিক্যুয়েল বিলিয়ন ডলার আয় করল? প্রথম মুভির কাহিনীর ৩০ বছর পরে ম্যাভেরিক কোথায়, কেমন আছে এমন সব প্রশ্নকেই মুভির গল্পের কেন্দ্রবিন্দু করা হয়েছে। টম ক্রুজের ক্যারিয়ার, লেগ্যাসি ইত্যাদির সাথে এত চমৎকারভাবে ম্যাভেরিকের গল্প মিলে গেছে যে এখানে নিয়তির হাত আছে বলে কল্পনা করলেও খুব ভুল হবে না। দ্বিতীয়ত, মুভির ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট থেকে শুরু করে সাউন্ড, সিনেম্যাটোগ্রাফি, এডিটিং এত নজরকাড়া যে দর্শকরা বাধ্য হয়েছে থিয়েটারে একাধিকবার যেতে। এই মুভির থার্ড অ্যাক্টে রয়েছে সিনেমার ইতিহাসের সবচেয়ে অবাক করা, মুগ্ধকর কিছু ভিজ্যুয়াল! দীর্ঘ দু’বছর মহামারিতে আক্রান্ত মুমুর্ষু হলিউডকে চাঙ্গা করে নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছে যে মুভি তাকে বেস্ট পিকচারে জায়গা না দিয়ে উপায় আছে!
৯) Triangle of Sadness
বেস্ট পিকচারে দ্বিতীয় বিদেশী ফিল্ম হিসেবে আছে সুইডিশ পরিচালক রুবেন অসল্যান্ডের সোশ্যাল স্যাটায়ার ‘Triangle of Sadness‘। অ্যান্টি-ক্যাপিটালিস্ট এই স্যাটায়ারে আছে বিলাসবহুল এক প্রমোদতরীতে যাত্রা করা একদল বিবেকশূন্য ধনী যাত্রী। পদে পদে অতি নিপুণতার সাথে অসল্যান্ড সমাজের অত্যধিক ধনীশ্রেণীর চিন্তাহীন, বেপরোয়া প্রকৃতি তুলে ধরেছেন উপভোগ্য ও বিনোদনমূলক উপায়ে। মুভিটি সম্পূর্ণ নতুন বেগ খুঁজে পায় থার্ড অ্যাক্টে পৌঁছে, যেখানে ডলি ডি লিওন অভিনীত এবিগেইলের দেখা মেলে। প্রচন্ড মজাদার এই চরিত্রের মধ্য দিয়ে অসল্যান্ড ডেলিভার করেন সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রির উপর তীক্ষ্ম কিছু কমেন্টারি। ট্রায়াঙ্গল অব স্যাডনেসের মতো বক্সের বাইরের বা ফর্মুলায় না পড়া স্যাটায়ারের বেস্ট পিকচারে মনোনয়ন পাওয়া বেশ প্রশংসার বিষয়।
১০) Women Talking
সম্ভবত এই লিস্টের সবচেয়ে ভারী এবং গুরুত্বপূর্ণ সিনেমা পরিচালক স্যারাহ পলির ‘Women Talking‘। খুবই সেন্সিটিভ একটি বিষয়কে স্যারাহ পলি যথেষ্ট যত্নের সাথে উপস্থাপন করেছেন। ২০১০ সালে এক নিভৃত ধার্মিক (মেনোনাইট) কলোনির নারীরা আবিষ্কার করেন অচেতন অবস্থায় কলোনির পুরুষদের দ্বারা তারা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন নিয়মিত। এই ভয়াবহ আবিষ্কারের পরে কলোনির একদল নারী আলোচনা শুরু করেন পরবর্তী করণীয় নিয়ে। সেই আলোচনাই এই মুভির বিষয়বস্তু। পুরো মুভিতে শুধুমাত্র এই কয়েকজন নারী নিজেদের সাথে ঘটে যাওয়া জঘন্য এই অবিচার আর তার প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেন। কিন্তু এই আলোচনাকে স্যারাহ পলি এতটা চিত্তাকর্ষক, বাস্তবিক রূপে উপস্থাপন করেন যে একমুহুর্তের জন্যও মনোযোগ ভঙ্গ হয় না। মুভির সম্পূর্ণ রানটাইমে রুনি মারা, ক্লেয়ার ফয়, জেসি বাকলিদের কথায় মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে কাটিয়ে দেয়া যায়। মুভিটি বেস্ট পিকচার জিততে না পারলেও আরেকটি ক্যাটাগরি, Adapted Screenplay, জিতবে সে আশা করছি মনপ্রাণ দিয়ে।