স্টার্টআপ; বর্তমানে বাংলাদেশে বহুল আলোচিত কয়েকটি শব্দের মধ্যে হয়তো শুরুর দিকে থাকবে। কয়েক বছর আগেও এই শব্দটি এতটা আলোচিত ছিল না। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন স্টার্টআপের ক্রমবিকাশ দেশে তরুণ সমাজের মাঝে এই ‘কিছু একটা’ করতে চাওয়ার ধারণা প্রজ্জ্বলিত করে তুলেছে। তাছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে স্টার্টআপগুলোকে বিকশিত হবার জন্য যে অসাধারণ কিছু সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, সেসবের ভূমিকাও নেহাত কম নয়।
আচ্ছা, অনেক তো বোঝা গেল। কিন্তু স্টার্টআপ আসলে কী? সহজ কথায় বলতে গেলে, কোনো একটা সমস্যা সমাধানের জন্য এমন কোনো পণ্য বা সেবা বাজারে নিয়ে আসা, যেটার ‘বিজনেস স্কোপ’ আছে। এখানে বিজনেস স্কোপ কথাটি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এমন অনেক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান আছে, তারাও কোনো সমস্যা সমাধানের জন্যই কাজ করে, কিন্তু স্টার্টআপের সাথে তাদের পার্থক্য এই বিজনেস স্কোপের মধ্যেই। অলাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসা করার উপর অতটা মনোযোগ দেয় না, যতটা স্টার্টআপ দিয়ে থাকে।
এবার আসা যাক ইউনিকর্নে। ইউনিকর্ন মূলত একটি কাল্পনিক ঘোড়া সদৃশ প্রাণী, যার মাথায় একটি খাড়া শিং আছে। তাহলে ইউনিকর্ন আর স্টার্টআপের মধ্যে সম্পর্ক কোথায়? যেসকল স্টার্টআপের ভ্যালুয়েশন ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা তার বেশি, তাদেরকেই ইউনিকর্ন বলা হয়ে থাকে। সংখ্যাটা কত বিশাল, তা বুঝতে টাকায় হিসাব করা যাক। মোটামুটি সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা কোনো কোম্পানির ভ্যালুয়েশন হলেই কেবল তাকে ইউনিকর্ন বলা হয়। ২০১৩ সালে ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট অ্যালিয়েন লি এই ‘ইউনিকর্ন’ শব্দটি ব্যবহার করেন বিলিয়ন ডলারের বেশি ভ্যালুয়েশন আছে, এমন কোম্পানির সংখ্যার অপ্রতুলতার কারণে। যখন এই লেখাটি লেখা হচ্ছে, তখন বিশ্বে মোটামুটি ৬০০ বা তার কিছু বেশি ইউনিকর্ন স্টার্টআপ রয়েছে।
মুনির হাসান তার ‘বিলিয়ন ডলার স্টার্টআপ’ বইয়ে একে একে এমন ১৩টি ইউনিকর্ন কোম্পানির জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা, অতঃপর ইউনিকর্ন তকমা পাওয়া পর্যন্ত বন্ধুর পথগুলোর গল্প বলেছেন। এত এত ইউনিকর্ন কোম্পানির মধ্য থেকে ১৩টি কোম্পানি নির্বাচন করা মোটেও সহজ নয়। তিনি তাই প্রথমে কোম্পানিগুলোর আইডিয়ার ধরনে জোর দিয়েছেন, যাতে একই বা কাছাকাছি আইডিয়ার একাধিক কোনো কোম্পানির গল্প না থাকে। অর্থাৎ, তিনি ১৩টি গল্পে ১৩টি সম্পূর্ণ আলাদা আইডিয়ার গল্প বলার চেষ্টা করেছেন। এর ফলে বইয়ে বেশ বৈচিত্র এসেছে আইডিয়া এবং এর বেড়ে ওঠার গল্পে।
এখানে ফেসবুকের গল্প যেমন আছে, তেমনি আছে ম্যাট্রেস বা জাজিম বিক্রি করে ইউনিকর্ন বনে যাওয়া এক কোম্পানির গল্পও। রয়েছে বাংলাদেশে বিলিয়ন ডলার কোম্পানির পথিকৃৎ গ্রামীনফোনের গল্প। এরপর লেখক গুরুত্ব দিয়েছেন আইডিয়াগুলোর বাস্তবায়নের যাত্রার উপর। কেননা আদতে আইডিয়ার কোনো ব্যবহারিক মূল্য নেই, যতক্ষণ না সেগুলো বাস্তবে রূপান্তরিত হচ্ছে। আর ঠিক প্রতিটি আইডিয়া বাস্তবায়নে কতটা চরাই- উৎরাই পাড়ি দিতে হয়েছে, তার একটা ভালো ধারণা এই গল্পগুলোতে তুলে ধরা হয়েছে।
এয়ারবিএনবি’র রোমাঞ্চকর গল্পটি পড়তে পড়তে পাঠকের বারবার মনে হবে, “জীবন কোনো পুষ্পশয্যা নয়।” পাঠক হয়তো নিজেকেই প্রশ্ন করে বসবেন, ব্রায়ান, জো আর নাথানের জায়গায় থাকলে তিনি কি পারতেন? এত উত্থান-পতনের মাঝেও মাটি কামড়ে তারা নিজেদের সংকল্পে অটুট ছিলেন বলেই হয়তো আজ ৭৫ বিলিয়ন ডলারের কোম্পানি তৈরি করতে পেরেছেন। গোটা বইয়ে সবচেয়ে বড় গল্পও এই এয়ারবিএনবি’র ।
একেক গল্পে একেক ধরনের লড়াই। যেন একদল স্বপ্নবাজ তরুণ যোদ্ধার গল্প বলতেই এই বই লেখা। প্রতিটি গল্পের আছে নানা শিক্ষণীয় বিষয়। যে বিষয়টি বেশি ভালো লাগে, তা হলো, লেখক প্রতিটি গল্পের শেষে তাদের এই স্টার্টআপ যাত্রা থেকে আমরা কী শিখতে পারলাম, তা কয়েকটি পয়েন্ট করে নোট দিয়েছেন। অনেকটা স্কুলের ইংরেজি স্টোরি রাইটিংয়ের মতো, স্টোরির শেষে নীতিবাক্য লেখা। এতে কেবল গল্পই জানা হলো না, এই ইউনিকর্ন কোম্পানিগুলো থেকে আমরা কী শিখতে পারি, আমাদের আর তাদের স্ট্র্যাটেজির মধ্যে কী পার্থক্য আছে, সেগুলো আরো স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়।
একেবারে সহজ-সাবলীল, বাংলা ভাষায় (কোনো টেকনিক্যাল কিংবা ব্যবসায়িক ভাষা বহির্ভূত অর্থে) লেখা ১৩টি স্টার্টআপের গল্প কখন যেন শেষ হয়ে যায়, টেরই পাওয়া যায় না। সিনেমা দেখার মতো এক বসাতেই পুরো বই পড়া হয়ে যায়। দুর্দান্ত সব উদ্যোক্তা-কাহিনী চুম্বকের মতো পাঠককে ধরে রাখে। শেষ হয়ে গেলে যেন মনে হয়, “আহা, আরও ক’টা স্টার্টআপের গল্প থাকলে বেশ হতো!”
বাংলাদেশে এখন উদ্যোক্তা তৈরির হাওয়া চলছে। নতুন নতুন স্টার্টআপ গড়ে উঠছে দেশের আনাচে-কানাচে, সাথে নতুন উদ্যোক্তাও। এই নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য এমন বই কতটা অনুপ্রেরণা যোগাবে, উদ্যম বাড়িয়ে দেবে এবং কিছু বাস্তবধর্মী জ্ঞানার্জনে সহায়তা করবে, তা কেবল তারাই বুঝতে পারবেন। হয়তো একদিন আমাদের দেশের ইউনিকর্নের গল্প লেখা হবে, সেই প্রত্যাশা রইল।