একজন অসচ্চরিত্র প্রাক্তন গোয়েন্দা, তার টুকরো টুকরো হওয়া লাশের রহস্যভেদের প্রচেষ্টা, এক রহস্যময়ী বিধবা নারী চরিত্র- এসব নিয়েই নিরানন্দ, কিন্তু প্রবল শক্তিশালী চাইনিজ নিও নোয়ার ফিল্ম ‘ব্ল্যাক কোল, থিন আইস’-এর (২০১৪) প্লট। রেমন্ড চ্যান্ডলার, জেমস এম কেইন বা ড্যাশিয়েল হ্যামেট রচিত উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ফিল্ম নোয়ারসমূহ যারা দেখেছেন, দিয়াও ইনান এসব লেখকের দ্বারা যে প্রবলভাবে প্রভাবিত; তা তারা সহজেই অনুধাবন করতে পারবেন। এবং ক্লাসিক ফিল্ম নোয়ারগুলোর মতোই এখানেও কোনো নায়ক বা খলনায়ক নেই; আছে কেবল বিভিন্ন ধরনের আপোস করা বা মানিয়ে নেওয়া।
বর্তমানে নিও-নোয়ার সিনেমার পরিচালকদের মধ্যে আমরা একটা প্রবণতা দেখি। সেটা হলো, তারা তাদের প্রজেক্টকে সমসাময়িক বিভিন্ন অলঙ্করণে সজ্জিত করে দেন। যেন ওল্ড স্কুল চোর-গোয়েন্দার গল্পকে কেবল আধুনিক প্রসাধনে সজ্জিত করেই নব্য দর্শকদের জন্য হৃদয়গ্রাহী করে তোলা সম্ভব৷ এ পন্থা অবলম্বন করে সাম্প্রতিক সময়ে সফলতা অর্জন করা সিনেমাগুলোর মধ্যে ‘সিন সিটি’ (২০০৫), ‘কিস কিস ব্যাং ব্যাং’ (২০০৫), ‘ব্রিক’ (২০০৬), ‘ড্রাইভ’ (২০১১) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। চীনা পরিচালক দিয়াও ইনান তার ‘ব্ল্যাক কোল, থিন আইস’ হুডানিট পরিচালনার ক্ষেত্রে এ প্রথাকে অগ্রাহ্য করে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী পদক্ষেপ নিয়েছেন। এটির সাথে বরং আপনি ক্যারল রিড পরিচালিত এবং অরসন ওয়েলস অভিনীত ‘দ্য থার্ড ম্যান’-এর (১৯৪৯) মিল খুঁজে পাবেন অনেকটা।
এ সিনেমায় আর্ট ফিল্ম আর নিও নোয়ারের সমন্বয়ে উদ্ভূত হয়েছে একটি দোঁআশলা জনরার; যেখানে উভয় জনরার মূল বৈশিষ্ট্যগুলো সমভাবে উপস্থিত। সাথে যুক্ত হয়েছে নিয়ন আলো আর শীতপ্রধান ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকার নিরানন্দ পরিবেশ; যা গল্পের প্রেক্ষাপটকে পৌঁছে দেয় দর্শকের মনে। এটি ইনান পরিচালিত তৃতীয় সিনেমা। স্কেল এবং কারিগরি দক্ষতার দিক থেকে এটি ছাড়িয়ে গিয়েছে তার আগের দুই প্রজেক্ট ‘ইউনিফর্ম’ (২০০৩) এবং ‘নাইট ট্রেইন’কে (২০০৭); সুগম করেছে বাণিজ্যিকভাবে সফল হওয়ার পথও।
আবার এটি নির্মাণ করতে গিয়ে ইনান চলচ্চিত্র উৎসবের কথা একেবারে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছেন, এমনও নয়। ৬৪তম বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ডেন বেয়ার জিতে নিয়েছে ‘ব্ল্যাক কোল, থিন আইস’।
সিনেমা জগতে দিয়াও প্রথম কাজ করতে শুরু করেন স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে। পরিচালক ঝ্যাং ইয়াংয়ের দু’টি সিনেমার স্ক্রিপ্ট লিখেছিলেন তিনি; ‘শাওয়ার’ (১৯৯৯) এবং ‘স্পাইসি লাভ স্যুপ’ (১৯৯৭)। তার নোয়ার অনুরাগের পরিচয় পাওয়া যায় ইনান পরিচালিত প্রথম সিনেমা ‘ইউনিফর্ম’-এ (২০০৩)৷ এখানে আমরা একজন উদ্দেশ্যহীন যুবককে দেখি, যে পারিবারিক লন্ড্রির দোকানে একটি পুলিশের পোশাক খুঁজে পায়। কেউ পোশাকটি নিতে না এলে সে এই পোশাক পরে নিজেকে পুলিশ বলে পরিচয় দেয় লোকজনের কাছে।
ব্ল্যাক কোলেও এ ধরনের বিষয়-আশয় দেখা যায়। কারণ এখানকার প্লটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে একটি লন্ড্রি দোকান এবং কেউ ফেরত নিতে আসেনি- এমন একটি কোট। এবার পুলিশরা আসল, কিন্তু অনেককিছুই প্রথমদিকে যেরকম মনে হয়; আসলে সেরকম নয়। দিয়াওয়ের ভীতিপ্রদ এই গল্পে আগের নৃশংস এক ঘটনা অর্ধদশক পর এখানকার চরিত্রদের জীবনকে আবার তছনছ করে দিতে আসে।
গল্পের প্রেক্ষাপট উত্তর চীনের একটি ফ্যাক্টরি অঞ্চল। সময় ১৯৯৯। শুরুর দিকেই সিনেমার নামে কেন কয়লার কথাটি এসেছে, তা বুঝতে পারি আমরা। বিভিন্ন স্থানের অনেকগুলো কয়লাক্ষেত্রে একটি মৃতদেহের বিভিন্ন অংশ পাওয়া যায়। মৃত ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা হয়। তার নাম লিয়াং ঝিজুন (ওয়াং জুয়েবিং); সে এখানকার একটি কয়লাক্ষেত্রেই কর্মরত ছিল। তার স্ত্রীর নাম উ ঝিঝেন (গুয়েই লুন-মেই) এবং সে একটি লন্ড্রি দোকানে কাজ করে৷ প্রেক্ষাপটে আসে ডিটেকটিভ ঝ্যাং জিলি (লিয়াও ফ্যান)। মানুষ হিসেবে সে কেমন, তা আগেই জানতে পারবেন দর্শকেরা।
করিৎকর্মা এই গোয়েন্দা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এবং একজন সন্দেহভাজনকেও চিহ্নিত করে ফেলে। এই সন্দেহভাজনকে ধরতে গেলে ঘটনা মোড় নেয় ভিন্নদিকে। যেখানে কেবল একটি সাধারণ গ্রেফতারের ঘটনা ঘটার কথা, সেখানেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। শুরু হয় গোলাগুলি। এই শ্যুটআউটের দৃশ্য বহুক্ষণ দর্শকের মনে থেকে যাবে। সাম্প্রতিক সময়ে সিনেমায় দৃশ্যায়িত সেরা শ্যুটআউটের দৃশ্যেও থাকার যোগ্য এটি। কেননা, একাধারে এটি হাস্যরসাত্মক, অসার- কিন্তু তা যেন নির্মমভাবে দক্ষ। টারেন্টিনোর ভক্তরা এই শ্যুটআউট দেখে পুলকিত হবেন নিঃসন্দেহে।
এরপর কেটে যায় পাঁচ বছর৷ আমরা দেখতে পাই পানাসক্ত এবং উচ্ছৃঙ্খল ঝ্যাংকে, যে এখনো সেই গোলাগুলির ঘটনায় ভীত-সন্ত্রস্ত। পুলিশের চাকরি ছেড়ে দিয়ে এখন কাজ করছে সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে। ঘটনাক্রমে তার সাথে দেখা হয়ে যায় প্রাক্তন পার্টনার ক্যাপ্টেন ওয়াংয়ের (ইউ আইলেই)। তার কাছ থেকে সে জানতে পারে, আগের মতো একই পদ্ধতি নতুন করে হত্যাকাণ্ড শুরু হয়েছে। আবারও মানুষজনকে মেরে টুকরো টুকরো করে বিভিন্ন জায়গায় শরীরের বিভিন্ন অংশ ফেলে রাখা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই তারা দু’জন কারখানা শ্রমিকের লাশ শনাক্ত করেছে। গাড়িতে বসে যখন ওয়াং আর ঝ্যাং এই হত্যাকাণ্ডগুলো নিয়ে বলছিল, তখন একপর্যায়ে ওয়াং বলে উঠে,
“এই মহিলার (উ ঝিঝেন) সাথে এই রহস্যের কোনো একটা যোগসাজশ রয়েছে। কারণ তার সাথে যারই সখ্যতা হয়, সে-ই মারা যায়।”
ঝ্যাং ব্যক্তিগতভাবে এ ব্যাপারে অনুসন্ধান চালাতে শুরু করে। এখনো ঝ্যাং আগের মতোই চমৎকার গোয়েন্দা। প্রাণঘাতী ‘ব্ল্যাক উইডো’ হোক বা না হোক, উ ঝিঝেন একজন রহস্যময়ী নারী। আর অভিনেত্রী গুয়েই লুন-মেই এই ধরণের ফেম ফেটাল চরিত্রের জন্য একদম মানানসই। এর আগে তাকে দেখা গেছে তাইওয়ানের চলচ্চিত্র ‘বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড’-এ (২০১২)। তার কালো, কাঁচের মত, সুন্দর চোখজোড়া আশাহীন পরিস্থিতিতে আটকে পড়া উ ঝিঝেন চরিত্রের রহস্যময়তা বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ।
চল্লিশের দশকের হলিউডে এই সিনেমা নির্মিত হলে হয়তো উ এর চরিত্রে আমরা দেখতাম লানা টার্নার বা আইডা লুপিনোকে। অন্যদিকে ডিটেকটিভ চরিত্রে হামফ্রে বোগার্ট বা রবার্ট মিচুমের বাইরে অন্য কাউকে কল্পনা করা কঠিন। কেন এবং কিভাবে উকে ঘিরে এত রহস্যময়তা সৃষ্টি হয়েছে, সেটি আমরা জানতে পারব সিনেমার দ্বিতীয় ভাগে। রহস্যের পাজলগুলো একত্র হয়ে যতই পূর্ণাঙ্গ রূপ নিতে থাকে; ততই ঝ্যাং এবং উ একে অপরের কাছে আসতে থাকে। আর সিনেমার প্লট যত গরীয়ান হয়, ততই এর নিয়তি পাল্প রোমান্টিসিজমের দিকে এগুতে থাকে।
সিনেমার পুরোটা জুড়ে ইনান অস্বস্তি এবং আসন্ন বিপদের আবহ ধরে রেখেছেন সুনিপুণভাবে। এবং এই ভাব তখনও বজায় ছিল, যখন সিনেমার প্লট প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত জটিল হয়ে যায়। তবে এই জটিলতা এমন কিছু নয় যে সিনেমাপ্রেমীরা কয়েক মিনিট ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে সমাধান করতে পারবেন না। পাশাপাশি, এই অস্পষ্টতা হয়তো পরিচালকের বৃহৎ পরিকল্পনারই অংশবিশেষ।
যদিও এটি আরেক চীনা পরিচালক জিয়া ঝ্যাংকের ‘আ টাচ অভ সিন’-এর (২০১৩) মতও সরাসরি রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করে না, তথাপি ‘ব্ল্যাক কোল, থিন আইস’ সমরূপ নিদারুণ এবং রক্তচোষা এক সমাজের চিত্র উপস্থাপন করে। যেখানে মনুষ্য জীবন প্রাকৃতিক গ্যাসের মতোই ব্যয়যোগ্য। কেউই নিরাপদ না, কার উপর কখন খড়গ নেমে আসবে- তা কেউ বলতে পারে না৷ তাই কখন কেউ আমাদের অভাগা নায়ককে বলে উঠবে, “বাদ দাও ঝ্যাং; এটা চীন! এখানে এমনই হয়!” অথবা কখন ঝ্যাং নিজেই এই সত্য উপলব্ধি করবে, সে অপেক্ষাতেই যেন আমাদের সময় কেটে যায়।
টান টান উত্তেজনায় পরিপূর্ণ কোনো থ্রিলার নয় এই সিনেমা। কারণ এখানে নিও নোয়ার বা থ্রিলার জনরার কাঠামো ভেঙে চীনের শিল্প এলাকার বর্ণহীন পরিবেশ এবং অবসাদগ্রস্ত বাসিন্দাদের স্বরূপ তুলে ধরেছেন পরিচালক দিয়াও ইনান। চীনের সর্বব্যাপী বিদ্যমান সেন্সরশিপের থাবা এর উপরও পড়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্করণের চেয়ে চীনে মুক্তিপ্রাপ্ত সংস্করণের দৈর্ঘ্য কিছুটা কম। এটা অনেকটা ডার্ক কমেডিক ব্যাপার। কেননা, যে সমাজের চেহারা পরিচালক পর্দায় তুলে ধরতে চেয়েছেন; সেই সমাজই তার শিল্পকে কাটাছেঁড়া করছে। সাধারণ দর্শককে আকৃষ্ট করার মতো পর্যাপ্ত উপকরণ থাকলেও এটি শেষপর্যন্ত যারা সিনেমাপ্রেমীদের জন্যই নির্মিত।
সিনেম্যাটোগ্রাফার ডং জিনসংয়ের সাথে মিলে ইনান বিভিন্ন দৃশ্যের উপস্থাপনে সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। বিশেষ করে ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৪ সালে যাওয়ার ব্যাপারটিকে যেভাবে ট্রেকিং শটের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে, সেটি অনবদ্য। এই সিনেমায় ক্ষণে ক্ষণে অ্যাবসার্ডিটি বা অসারতাও উঁকি দিয়েছে৷ যেমন, সদ্য বিচ্ছেদপ্রাপ্ত দম্পতির তাস খেলা, সুসজ্জিত অ্যাপার্টমেন্টের করিডোরে ঘোড়ার উপস্থিতি বা শেষ দৃশ্যে দিনের আলোয় আতসবাজির ঝলকানি। সিনেমার নামকরণের ক্ষেত্রেও হেঁয়ালি রয়েছে।
মূল ম্যান্ডারিন নাম ‘বাই রি ইয়ান হো’ এর ইংরেজি অর্থ হলো ‘ডেলাইট ফায়ারওয়ার্কস’। কিন্তু দিনের বেলায় কি আমরা সচরাচর আতশবাজি ফুটতে দেখি? চীনের বাইরের বাসিন্দা হিসেবে আমরা হয়তো এই সিনেমার সবগুলো রূপক বুঝবে না৷ তবে গুরুত্বপূর্ণ হলো সিনেমার মূলভাব এবং এখানকার চরিত্রদেরকে বোঝা। তারা কোন পরিস্থিতিতে থাকে, তাদের কোন কাজের পেছনে অনুপ্রেরণা কী, এসব বোঝার চেষ্টা করা।
প্রোডাকশন ডিজাইনে মনমরা সবুজ আর অস্বাভাবিক হলুদ আলোর ব্যবহার পুরো সিনেমার অবসাদগ্রস্ত প্রেক্ষাপটকে দর্শকমনে প্রতিফলিত হয়। যেটি এই সিনেমার মূলভাবকে করে তুলেছে আরো প্রগাঢ়। আর আর্ট ডিরেক্টর লিউ কিয়াং শ্রমিক শ্রেণির মানুষের নিরাশাকে তুলে ধরেছেন বিভিন্ন জীর্ণ বার, পুলিশ স্টেশন, স্যালুন ইত্যাদির মাধ্যমে। যা আবার ফুটে উঠেছে এখানকার চরিত্রদের বিভিন্ন আচরণেও।
‘ব্ল্যাক কোল, থিন আইস’ সম্পর্কে বলতে গিয়ে পরিচালক দিয়াও বলেন,
“আমি কোনো ভাবালু বা ‘স্লাইস অভ লাইফ’ ধরনের গল্পে সমাজকে তুলে ধরতে চাই না৷ জনরাভিত্তিক সিনেমাগুলোকে আরো ভালোভাবে, আরো গুরুগম্ভীরভাবে তৈরি করা সম্ভব।”
অর্থাৎ, তিনি কোনো স্যোশাল ড্রামার মাধ্যমে সমাজ সম্পর্কে বলার চেয়ে তিনি অপরাধ বা অন্য কোনো জনরার মাধ্যমে সমাজ সম্পর্কে নিজের মতামত ব্যক্ত করতে চান৷ তিনি আরো বলেন,
“এধরনের সিনেমাগুলো হয়তো একটু নিরাশাবাদী; কিন্তু বক্তব্যের প্রকাশে এগুলো নিঃসঙ্কোচ এবং অকৃত্রিম।”
তাই, সময় করে দেখে নিতে পারেন দিয়াও ইনানের এই স্যোশাল কমেন্ট্রি। বুঝে নিতে পারেন, নিজের আশপাশের সমাজ সম্পর্কে কী বলতে চান চীনের অন্যতম মেধাবী এই পরিচালক। তবে একথা নিঃসন্দেহে বলা চলে, সিনেমা চলাকালীন যত প্রশ্ন দর্শকের মনে ছিল, তার চেয়েও বেশি প্রশ্ন নিয়ে এই সিনেমা দেখা শেষ করবেন দর্শক।