সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: দুর্বল চিত্তের অধিকারী এবং যারা হৃদরোগে আক্রান্ত তাদের জন্য কার্গো ২০০ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু এ সিনেমার প্রতিটি ঘটনাই সত্য, আর সত্য যে কত অমানবিক ও কদর্য হতে পারে তার নমুনা এই ক্রাইম থ্রিলার মুভিটি। ১৯৮৪ সালের সোভিয়েত আফগানিস্তান যুদ্ধ সময়ের বীভৎস সত্য দেখে বিষম খেতে হয়। অস্বস্তিকর নির্মাণের সিদ্ধহস্ততার যে খেতাব লার্স ফন ত্রেয়ার আর কোয়েন ব্রাদার্সদের দখলে ছিল তাতে এবার ভাগ বসালেন রুশ নির্মাতা আলেক্সেই বালাবানোভ।
তার খ্যাতির শুরুটিই হয়েছে ‘ব্রাদার’-এর মতো ক্রাইম ড্রামার হাত ধরে। তাই তার কাছ থেকে এমন কাজ তো আর অপ্রত্যাশিত বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা না। ইতিহাসের পাতা থেকে কাহিনী নিয়ে তিনি বরং নিজেই নিজের ক্রাইম জনরার কাজের দক্ষতাকে নতুনভাবে চ্যালেঞ্জ করলেন। চলচ্চিত্রবোদ্ধারা প্রথমে অবাক হলেন, তারপর উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় ভাসালেন। অবশ্য এর মাঝেও অপ্রাপ্তি রয়েছে। পৃথিবীর অন্যতম দুইটি গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র উৎসব বার্লিন এবং কানস থেকে প্রত্যাখ্যাত হয় কার্গো ২০০।
ছবিতে ধর্ম অধর্ম নিয়ে যেমন আলোকপাত হয়েছে, তেমনি কথা এসেছে কম্যুনিজম নিয়ে। সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্রান্তিলগ্নে দেশের মিলিটারি, পুলিশ এবং বিচার বিভাগের বহু অসঙ্গতিতে দৃষ্টিপাত করেছে এই সিনেমা। লেনিনগ্রাদ ষ্টেট ইউনিভার্সিটির (বর্তমান সেইন্ট পিটার্সবার্গ ইউনিভার্সিটি) Scientific Atheism এর প্রফেসর আর্তমের সাথে ফার্মহাউজের মালিক এলেক্সেইর মদ্যপ আলাপচারিতায় প্রশ্ন তোলা হয়েছে“Does God exist or does not?” প্রশ্ন এসেছে ‘soul’ তথা আত্মার অস্তিত্ব নিয়েও। প্রফেসর আর্তম তার মতবাদ জ্ঞান আর প্রজ্ঞা দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন। জানিয়েছেন তার নিজস্ব বিশ্বাসের কথাও। তাতে উত্তেজিত ধার্মিক এলেক্সেই যুক্তি মেনে নেননি। কারণ, তার ধারণা রাশিয়ার কম্যুনিস্টরা লেনিনকেই ঈশ্বর মান্য করে, তথা লেনিনকে ঈশ্বরের স্থানে প্রতিস্থাপন করে। কথার নানা মারপ্যাঁচ, যুক্তি আর থিওরি তাকে সন্তুষ্ট করতে পারে না। উল্টো তিনি প্রত্যুত্তরে বলেন, “Don’t try to scare me with your intelligent words.” সিকুয়েন্সটিতে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের এথিজম চর্চার কিয়দাংশ হলেও ঠাঁই পেয়েছে তাদের মধ্যকার সংলাপে।
তবে চলচ্চিত্রটি মূলসুর বেঁধেছে অপরাধ জগতে, যার উৎপত্তিস্থল কালিয়েভো শহরের একটি ফার্মহাউজ। কম্যুনিস্ট পার্টির উচ্চপদস্থ এক অফিসারের মেয়ে এঞ্জেলিকা উধাও হয়ে যায় ডিস্কো পার্টি থেকে। শেষবার তাকে দেখা গিয়েছিল পার্টিতে SSSR টিশার্ট পরিহিত কোনো এক তরুণের সাথে। এরপর থেকে তার খোঁজ কেউ আর জানে না। একই রাতে কালিয়েভোতে ঐ ফার্মহাউজেই খুন হয় ভিয়েতনামিজ ভৃত্য সোয়ান ভান হেই, এদেশে এসে নাম বদলে সংক্ষেপে যার পরিচয় হয়ে গিয়েছিল সুংকা। এদিকে ফার্মহাউজে মদ বিক্রি হয় বলে রাতে সেখানে যায় SSSR টিশার্ট পরিহিত ভেলেরি আর এঞ্জেলিকা। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস হয়তো ঈশ্বর আগেই টুকে রেখেছিলেন। টানটান উত্তেজনাপূর্ণ থ্রিলার যত এগোয় শিরদাঁড়ার শিরশিরে অনুভূতি ততই বাড়ে। কারণ অজ্ঞাত অপর এক চরিত্র ততক্ষণে গল্পের প্রটাগনিস্ট হিসেবে আবির্ভূত হয়ে থ্রিলারের পুরো দখল নিয়ে নিয়েছে নিজ কব্জায়।
এই চরিত্রের আগমনের হেতুই যেন অস্বস্তি তৈরি। যা আরও অনুভূত হয় ব্যক্তির নাম পরিচয় দীর্ঘসময় অজ্ঞাত থাকার সুবাদে। এঞ্জেলিকার পরিণতি কী হবে তা জানার তীব্র প্রতীক্ষা জাগাতে পারা কার্গো ২০০ এর প্রধান সফলতা। পাশাপাশি আলোক প্রক্ষেপণ এবং মিউজিকের ব্যবহার সাহায্য করেছে ভয়ার্ত অনুভূতি সৃষ্টিতে। এক্ষেত্রে দৃশ্যায়নের কুৎসিত বর্বরতাও কম যায়নি। যোনিপথে কাচের বোতল ঢুকিয়ে যৌন নির্যাতন যেন সেই সাক্ষ্যই বহন করে। এমন পৈশাচিক অত্যাচারে শিকারকে কুঁকড়াতে দেখে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে নপুংসক। তার এই নপুংসকতা নিশ্চিত হওয়া গেছে আরেক সিনে অপর এক ব্যক্তিকে দিয়ে নিজের শিকারকে যৌনসংগম করানোর দৃশ্যে। কিংবা পুরুষ অপরাধীদের ধরে এনে জেলের ভিতর অণ্ডকোষে লাথি মেরে অচেতন করার মতো হিংস্র আচরণে।
পরদিন প্রফেসর আর্তম বুঝতে পারেন অজ্ঞাতসারে অদ্ভুতভাবেই তিনি জড়িয়ে গেছেন পুরো ঘটনার সাথে। তবে ঘটনার জটিল সমীকরণের ধোঁয়াশা বাইরে থাকলেও দর্শক হিসেবে আমরা কাহিনীর সবটা জানি, সবটা দেখতে পাই। কেননা মুভির সব এলিমেন্টই যথাযথভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। শিল্প নির্দেশনাতে মুভিটি এর ভয়ার্ত নান্দনিকতায় সর্বোচ্চ নম্বর দাবি করে। স্কার্টে রক্তের ছোপের দাগ, মদের গুদামঘরের দৃশ্য, জেলের ভিতর এলেক্সের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পূর্বহিন্ট হিসেবে নিভে যাওয়া টিউবলাইটের রূপক ব্যবহার উল্লেখযোগ্য অভূতপূর্ব সংযোজন।
চরিত্র নির্বাচন আর কস্টিউমও দারুণ মানিয়েছে সময়কাল ও কাহিনীর সাথে। জিংক কফিনে থাকা প্যারাট্রুপারের লাশকে ব্যাচ পরিয়ে সম্মাননা জানিয়ে এঞ্জেলিকাকে বেঁধে রাখা খাটে ছুঁড়ে ফেলা, এবং সেই বেডেই নিরপরাধ মেয়েটিকে ধর্ষণ করানো এবং ধর্ষকের কৃতকাণ্ডে অসন্তুষ্ট হওয়াতে ঐ অবস্থাতেই গুলি করে হত্যা। সবমিলিয়ে এক্সপেরিমেন্টালে সম্পূর্ণ হরর অভিজ্ঞতা বলা চলে। এছাড়া মিউজিক ট্র্যাকগুলো দারুণ অর্থপূর্ণ ছবিতে। পাশাপাশি সিনেমাটোগ্রাফিও হয়েছে পরীক্ষণমূলক। টেলিভিশনের আলোর পরিবর্তনে ক্যামেরার এঙ্গেল ধরা কিংবা গোয়ালঘরের দৃশ্যধারণ আর লেনিন্সকে যাবার অভিমুখে গাড়িতে হ্যান্ডকাফ বাঁধা এঞ্জেলিকার প্রতিচ্ছবি দুর্দান্ত চিত্রধারণের নজির। ডিস্কোতে গান শুরু হয়ে যাওয়াতে হঠাৎ গলার স্বর উঁচু করে ফেলার ব্যাপারটিও বেশ বুদ্ধিদীপ্ত লাগে। আরেকটা কথা জানিয়ে রাখি, লেনিনের আলোচনা থেকে পরেরদিন লেনিন্সকের পথে যাত্রাও রাজনৈতিকভাবে ইংগিতপূর্ণ মনে হয়ে।
মনস্তত্ত্ব নিয়ে মুভিতে নান্দনিক পারদর্শিতায় খেলেছেন পরিচালক। ঈশ্বরে অবিশ্বাসী প্রফেসর আর্তমকে যেমন বিশ্বাসের পথে এনেছেন। তেমনি বিশ্বাসী এলেক্সেইকে দিয়ে ক্যাপ্টেন জুরভের প্রতি বিশ্বাসের মাশুল দিয়েছেন। এন্তোনিনা জুরভকে খুন করেছেন ঠিকই কিন্তু এঞ্জেলিকার সাহায্যের জন্য কিচ্ছুটি করেননি। এর কারণ হয়তো হাতে আগ্নেয়াস্ত্র থাকা সত্ত্বেও গুদামঘরে নিজে নিজেকে সাহায্য না করতে পারার খেসারত! জুরভের মা এই ছবির আরেকটি রহস্যময় প্রতীকি চরিত্র। তার আচার-আচরণ কতটা অস্বাভাবিক তা কার্গো ২০০ না দেখলে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। আর যে ভেলেরির জন্য পুরো গোলমাল সেই ভেলেরিই কিনা অধরা থেকে গেছে শেষপর্যন্ত! এমনকি মুভির শেষ দৃশ্যে তাকে দিব্যি অতীতের সব ভুলে গিয়ে নতুন ব্যবসা শুরুর পরিকল্পনা আঁটতে দেখা যায়। মেদহীন ফোকাসড স্ক্রিপ্টের এ ছবি বস্তুত কম্যুনিজমে সোভিয়েত রাষ্ট্রের অকার্যকরতাকে দেখিয়েছে। দেখিয়েছে বিগড়ে যাওয়া এক ক্ষমতাধরের অসংলগ্ন সব কার্যকলাপ।
ছোট ছোট চরিত্রগুলোকে সামগ্রিকভাবে একটি ছকে বেঁধে ফেলে আন্তঃসম্পর্ক তৈরির দারুণ মুন্সিয়ানা রয়েছে এ চলচ্চিত্রে। আর থ্রিলারের রোমহর্ষক উত্তেজনা তো আছেই।
চলচ্চিত্র: Груз 200 (Cargo 200)
সাল: ২০০৭
পরিচালক: আলেক্সেই বালাবানোভ
জনরা: নিও-নোয়া, ক্রাইম থ্রিলার