বাংলা ভাষার চলচ্চিত্রে এযাবৎকালের সর্বোচ্চ বাজেটের চলচ্চিত্র “চাঁদের পাহাড় (Mountain of the moon)”। প্রখ্যাত সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস চাঁদের পাহাড় অবলম্বনে শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মের প্রযোজনায় কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের নির্মিত এই চলচ্চিত্র শঙ্কর রায় চৌধুরী নামে এক বাঙালি অভিযাত্রিকের অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় সাধারণ চাকরিজীবন ছেড়ে আফ্রিকার দুর্গম পথে যাত্রার রোমাঞ্চকর গল্প নিয়ে। সেই গল্পে প্রাসঙ্গিকভাবেই আফ্রিকার অরণ্যবেষ্টিত পাহাড় ও মরুভূমির প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও শ্বাপদসংকুল পরিবেশ স্থান করে নেয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে ফিল্মের চিত্রায়নে আবশ্যকীয় অনুষঙ্গ হিসেবে সিজিআই ও ভিজ্যুয়াল ইফেক্টসকে বিশেষ ভূমিকা রাখতে হয়েছে। গল্পের স্থান আফ্রিকা হওয়ায় ইন্টারন্যাশনাল কাস্টিং সংযোজনের বাধ্যবাধকতাও ছিল ছবিটির ওপর। এতসব ভার সামলে পরিচালক কমলেশ্বর কতটা চিত্তাকর্ষক করে তুলতে পারলেন তার সিনেমা- তা নিয়েই এই লেখার অভিপ্রায়।
চাঁদের পাহাড় দেখার সময় অস্কারজয়ী চলচ্চিত্র লাইফ অফ পাই এবং অস্কার মনোনীত ইন্টু দ্য ওয়াইল্ড-এর মতো রোমাঞ্চ অবচেতনভাবেই অনুভূত হয়। তবে দর্শকের মনে এই অনুভূতি সৃষ্টি করা যে কমলেশ্বরের টিমের জন্য সহজসাধ্য ছিল না, তা ভিজুয়্যাল দেখে অনুমেয়। রোমাঞ্চকর এই ফিল্ম ভীষণ অনুপ্রেরণাদায়ক সাহসী নির্মাণ। চাঁদের পাহাড়ের নায়ক বাংলার এক সাধারণ গ্রাম থেকে উঠে আসা তরুণ শঙ্কর। অ্যাডভেঞ্চারাস এই তরুণ বুদ্ধিমান, আত্মপ্রত্যয়ী, এবং চ্যালেঞ্জ নিতে ভালবাসে। সিনেমায় তরুণের গল্প শুরু হয় ১৯০৯ সাল দেখিয়ে। সেই বছর উগান্ডার মুম্বাসা রেলওয়েতে কাজের উদ্দেশ্যে দেশ ছেড়ে সুদূর আফ্রিকাতে পাড়ি জমায় শঙ্কর। কিন্তু আফ্রিকায় পৌঁছতে না পৌঁছতেই বাজে সব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় তাকে।
সিংহের মুখে পড়তে গিয়েও কোনোভাবে পালিয়ে বেঁচে যাওয়া, এবং ঘুমের মধ্যে ব্ল্যাক মাম্বা সাপ শরীর বেয়ে উঠে আসা যার অন্যতম উদাহরণ। তবে এসবে দমবার পাত্র তো সে নয়। ঘটনাচক্রে একদিন অত্যন্ত প্রতিকূল এক পরিবেশে পরিচয় ঘটে পর্তুগিজ অভিযাত্রিক ডিয়েগো আলভারেজের সঙ্গে। গহীন অরণ্যে আহত আলভারেজের প্রাণরক্ষক সে। আলভারেজ নিজের আফ্রিকা আসার প্রকৃত উদ্দেশ্য বর্ণনা করলে তার রোমাঞ্চকর জীবনে উদ্বুদ্ধ হয়ে শঙ্কর একসময় রেলওয়ের চাকুরি ছেড়ে দিয়ে আলভারেজের সঙ্গী হয়ে হীরার খনির অনুসন্ধানে চাঁদের পাহাড় খুঁজতে বেরিয়ে পরে। অতঃপর তাদের গন্তব্য রিখটারসভেলডের হীরার গুহা। ভয়ঙ্কর জন্তু বুনিপ যে গুহার অতন্দ্র প্রহরী। দুর্গম পথে দুজনের সেই দিনগুলোর অভিজ্ঞতাই চাঁদের পাহাড় চলচ্চিত্রের বুনিয়াদ।
বিগ বাজেটের চাঁদের পাহাড় বাংলা চলচ্চিত্রের প্লট হিসেবে অনন্য ব্যতিক্রম। মেকিং টেকনিকেও সে ব্যতিক্রমী প্রয়াস লক্ষ্যণীয়। দৃশ্যায়ন চিত্রের পাশাপাশি ভয়েস ন্যারেশন কাহিনী বর্ণনাকে আরও সহজবোধ্য করে। কেননা, কমলেশ্বরের ন্যারেশনের বর্ণনা ও শব্দচয়ন খুব গোছালো। ডিওপি সৌমিক হালদার অতি সাহসিকতার সাথে ফিল্মটির দৃশ্যায়ন করেছেন। তার ফ্রেমে খুব কাছ থেকে সিংহ, ব্ল্যাক মাম্বাকে ভয় জাগানিয়া নানা অ্যাঙ্গেল থেকে হাজির করা হয়েছে। ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত এবং দেবজ্যোতি মিশ্রর অসাধারণ সঙ্গীতায়ন অবদমিত রোমাঞ্চকে শ্রুতিমাধুর্য ভাষায় প্রকাশ করেছে। অর্থাৎ ছবির গল্প যে আফ্রিকায় বর্ণিত সেটা অনুভূত হয়েছে মিউজিকের কারিশমায়। বন্য জীবজন্তুর হিংস্রতা চাঁদের পাহাড়ে দেখা দিয়েছে অসংখ্যবার। সেই হিংস্রতা কখনো প্রকাশ পেয়েছে গ্রাফিক্সে, আবার কখনো তা অনুভব করা গেছে শিকারের খণ্ড-বিখণ্ড দেহাবশেষ দেখে।
চমৎকার মেকআপ যে হয়েছে এ কথাও বলতে হবে— একদম ফার্স্ট ক্লাস। গুহায় আটকা পড়া শঙ্করের তৃষ্ণার্ত ঠোঁট, চেতনা হারানোর পর রক্তজমাট ফোলা চোখ, কালাহারি মরুভূমিতে অনেকদিন না খেয়ে থাকায় তার দেহাবরণ, দাঁতের রং, চামড়া ঝলসে যাওয়া পা পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্যতা দিতে পারে। তদুপরি বুনিপের ফাঁদে আটকা পড়ার গ্রাফিক্স অসাধারণ হলেও ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুৎপাতের অ্যানিমেশন দৃশ্যায়ন সম্পূর্ণই মেকি মেকি লাগে। বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব ফুটে ওঠে ঐ সিকুয়েন্সে। আবার অনেকদিন ঠিকমতো খাবার, পানি না পেয়ে কালাহারিতে লম্বা চুলদাঁড়ির শঙ্করের ওজন কমে কিছুটা রোগা হয়ে যাওয়ার ঘটনা নির্মাতা খুব সচেতনভাবে দেখিয়েছেন যা সত্যিই প্রশংসনীয়। অবশ্য বুনিপের গুহায় আটকে পড়ার সিকুয়েন্সে শঙ্করের চুলের দৈর্ঘ্যের পাশাপাশি দাঁড়ি-গোঁফটাও ক্রমশ বাড়লে পরবর্তী সময়ে কালাহারির দৃশ্যে ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পেরেছে বলে বিবেচিত হতো। ছবির চিত্রনাট্য যে অসাধারণ তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কাহিনীর সাথে সামঞ্জস্যতা রেখে আফ্রিকার সোয়াহিলী, সোমালি, মাসাই, মেটাবেলিস ও জুলু সম্প্রদায়য়ের অন্তর্ভুক্তিকরণ তারই প্রমাণ দেয়। পক্ষান্তরে রুগ্ন শঙ্করের বার বার মাটিতে লুটিয়ে পড়ার পুনরাবৃত্তি দেখতে একসময় বেশ বিরক্তিই লাগে।
“The geography varies, but the colonial rules doesn’t.”
কিংবা
“Greed killed humans”
এ ছবির সংলাপগুলো বেশ নাড়া দেয়। “মৃত্যুর আগে কতদিন বাঁচ সেটা বড় কথা নয়। বরং মৃত্যুর পরে কতদিন বাঁচ সেটা ভাবার সময়…” সংলাপে যেমন গভীরতা আছে, তেমনই বহুভাষিক বৈচিত্র্যও রয়েছে। কোনো কোনো দৃশ্যে বাংলা উচ্চারণ পর্তুগিজ কিংবা আফ্রিকানদের মুখে চমৎকার শুনিয়েছে চাঁদের পাহাড়ে। এতকিছুর পরে পর্তুগিজ বন্ধু আলভারেজ, ব্রিটিশ অভিযাত্রিক জিম কার্টার এবং ইতালীয় নাবিক আত্তিলিও গাত্তির উত্তরসূরি শঙ্কর চরিত্রের অভিনয় কেমন হলো তা নিয়ে দুয়েক বাক্যে না বললে হচ্ছে না। দেব ভিন্নধর্মী এই ছবিতে নিজের চেনা-জানা ইমেজের বাইরে চমকে দেবার মতো অভিনয় করেছেন। সরলতা, সাহস, বুদ্ধিদীপ্ততা, বন্ধুবাৎসল্য, আর তেজস্বী মনোভাবের মিশেলে গড়া এই চরিত্রায়ন বেশ চ্যালেঞ্জের ছিল।
শঙ্কর কালাহারি মরুভূমিতে পথ হারিয়েছে। এ অবস্থায় নিজের প্রাণ বাঁচানো দুষ্কর। কারণ, রোডেশিয়ায় ফিরে যাবার পথ তার জানা নেই। আবার কয়েক মাইল ট্রেকিংয়ের জন্য গায়ে এতটুকু শক্তিও অবশিষ্ট নেই। মরুভূমিতে জলের অভাবে যখন সে মৃতপ্রায়, ঠিক তখন মাথার উপর শকুনেরা ঘোরাফেরা করছে তাকে ছিঁড়েফুঁড়ে খুবলে খাবে বলে। এ সময়ে তার অসহায়ত্বের যে অভিব্যক্তি দেখা গেছে, তা অভিবাদনযোগ্য। উপরন্তু, ছবির শেষের যে কাকতালীয় নাটকীয়তা, তা বহুদিন মনে রাখবার মতো। ফলে কমলেশ্বরের চাঁদের পাহাড় যে দর্শকদের অ্যাডভেঞ্চার-প্রেমকে দারুণভাবে তাতিয়ে দিতে সক্ষম সে কথা বলাই বাহুল্য।