ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব আর্থার জেমস বেলফোরের একটি ঘোষণার মাধ্যমে স্বাধীন ফিলিস্তিনের ভাগ্যাকাশে নেমে আসে দুর্যোগের ছায়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরেই ফিলিস্তিনিরা বুঝতে পারেন যে, স্বাধীন দেশেই তারা পরবাসী হয়ে পড়েছেন। দলে দলে ইউরোপ থেকে ফিলিস্তিনে আসতে থাকে ইহুদীরা। দখল করে নিতে থাকে তাদের বসতবাড়ি, গ্রাম, শহর, এমনকি ফসলি জমিও। উচ্ছেদ করতে থাকে আরব মুসলিমদের। বাস্তবায়িত হতে থাকে বেলফোর ঘোষণা।
এদিকে আরব ফিলিস্তিনিরাও এর প্রতিবাদ জানাতে থাকে। স্বাধীন ভূখণ্ডে পরাধীন হয়ে কে-ই বা থাকতে চায়! ফিলিস্তিনিদের রুখতে এবার ইহুদীরা সশস্ত্র হয়ে উঠল। গড়ে তুলল একাধিক গুপ্তঘাতক সংঘ এবং সশস্ত্র সংগঠন। প্রতিবাদরত ফিলিস্তিনিদের উপর শুরু হলো রক্তাক্ত নির্যাতন। কিন্তু নিজ দেশে পরবাসীদের হাতে নির্যাতন কেন মেনে নেবে ফিলিস্তিনিরা? তারাও রুখে দাঁড়ালো দখলদার ইহুদীদের বিরুদ্ধে।
‘গল্প বলি ফিলিস্তিনের’ বইটি মূলত দীর্ঘ সাত দশক ধরে চলা ফিলিস্তিনিদের মুক্তি আন্দোলন সম্পর্কে রচিত। তবে এখানে বিস্তৃতভাবে ইতিহাস বর্ণনা করা হয়নি। বইয়ে স্থান পেয়েছে স্বদেশ রক্ষায় ফিলিস্তিনিদের বীরত্বপূর্ণ কিছু গল্প। যে গল্প বিভিন্ন সময় তাক লাগিয়েছে বিশ্ববাসীকে। বিশ্ববাসী দেখেছে দেশমাতৃকাকে রক্ষায় জ্বলে ওঠা সাহসী মানুষগুলোকে।
বইটির লেখক হামমাদ রাগিবের জন্ম মৌলভীবাজারে। পড়াশোনা করেছেন ঢাকার জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলুম ফরিদাবাদ মাদ্রাসায়। মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক অনলাইন সংবাদ মাধ্যম গলফ বাংলায় কাজ করার সুবাদে মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে জ্ঞানার্জনের সুযোগ পান লেখক। আর সেখান থেকেই আগ্রহ জন্মে ফিলিস্তিন সম্পর্কে। ফিলিস্তিনিদের উত্থান-পতনের ইতিহাস গল্পে গল্পে সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করেছেন। সেই সঙ্গে ফিলিস্তিনি কয়েকজন বীরের আত্মদানের গল্পও সংযুক্ত হয়েছে। পাঠক এক বসায় পুরো ফিলিস্তিনকে সংক্ষেপে পাঠ করে নিতে পারবেন। কবি ও কথাসাহিত্যিক সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর বইটির সম্পাদনা করেছেন। ‘গল্প বলি ফিলিস্তিনের’ বইটি লেখকের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ।
বইটি মোট ১৩টি অধ্যায়ে বিভক্ত। লেখক প্রথম পাঁচটি অধ্যায় ফিলিস্তিনের ইতিহাস সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছেন। বাকি আটটি অধ্যায়ের তুলে এনেছেন ফিলিস্তিনি মুক্তি আন্দোলনের অকুতোভয় সাতজন বীরের বীরত্বগাঁথা। অত্যন্ত চমৎকারভাবে গল্পের ভাষায় উপস্থাপন করা হয়েছে ঘটনাগুলো। পড়তে গিয়ে লেখক হারিয়ে যাবেন আল-কুদস-এর অলিতে-গলিতে।
বইটি শুরু হয়েছে হযরত উমর (রা.) এর জেরুজালেম বিজয় দিয়ে। হযরত উমর (রা.) ফিলিস্তিন সফর ও রাজা সেফ্রোনিয়াসের পরাজয় বর্ণনা করা হয়েছে। পাশাপাশি পরিচয় দেওয়া হয়েছে আল-আকসা কমপ্লেক্সের বিভিন্ন স্থাপনা এবং আব্রাহামীয় ধর্মগুলোর কাছে এই স্থান কেন গুরুত্বপূর্ণ, সেই সম্পর্কে। উমারের (রা.) জেরুজালেম সফরের মহানুভবতার গল্প এবং সেফ্রোনিয়াসের আতিথেয়তার পূর্ণ স্বাদ পাওয়া যাবে এখান থেকে।
এরপর ১০৯৯ সালে ক্রুসেডারদের হাতে ফিলিস্তিনের নির্মম পরাজয় বর্ণনা করা হয়েছে। ফুটিয়ে তোলা হয়েছে জেরুজালেমে ক্রুসেডারদের বর্বরোচিত গণহত্যা ও ভয়াবহতার চিত্র। এরপর দীর্ঘ সময় ধরে জেরুজালেমে চলল খ্রিস্টানদের শাসন। লেখকের চমৎকার বর্ণনাশৈলী এবং প্রাঞ্জল ভাষায় এই ঘটনাগুলো জীবন্ত হয়ে ধরা দেবে পাঠকের কাছে। ফলে সহজেই পাঠকের পঠন আকাঙ্খা পূরণ করবে বইটি।
১১৮৭ সালে জেরুজালেম অবরোধ করলেন ইতিহাসের এক কালজয়ী বীর সালাউদ্দীন আইয়ুবী। অবরোধের দ্বাদশ দিনে সৈন্য-সামন্ত নিয়ে ঢুকে পড়লেন শহরে। ফলে প্রায় এক শতক পর পুনরায় জেরুজালেম মুসলমানদের অধিকারে আসলো। সালাউদ্দীন আইয়ুবীর শৈশব স্বপ্ন থেকে জেরুজালেম বিজয় পর্যন্ত ঘটনাগুলো অতি সংক্ষেপে বইয়ে স্থান পেয়েছে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের সংক্ষিপ্ত বর্ণনাতে সর্বশেষ স্থান পেয়েছে বেলফোর ঘোষণা থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহগুলো। কেন ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার আশ্বাস দিল এবং ইসরায়েল রাষ্ট্র হিসেবে কীভাবে গড়ে উঠল? জাতিসংঘ কেন নিরব ভূমিকা রাখল ফিলিস্তিনের বুকে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠায় এবং বিশ্ব মোড়লরাই বা কেন দখলদার রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিল? এমন সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে বইয়ের এই অংশ থেকে।
মাত্র ৮০ পৃষ্ঠার এই ছোট্ট বইইয়ে ফিলিস্তিনের বীরত্বগাঁথা ঘটনাগুলো বর্ণনা করা হয়েছে অত্যন্ত সাবলীল এবং গল্পের ভাষায়। মুক্তির জন্য সশস্ত্র ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিরা যেভাবে দাঁড়িয়েছে তা সারা বিশ্বের কাছে বিস্ময়। ফিলিস্তিনের শিশু, কিশোর, বৃদ্ধ, নারী, এমনকি শারীরিকভাবে অক্ষমরা পর্যন্ত অপরাজেয় সংগ্রাম করে যাচ্ছে দখলদার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে। বিশ্ববাসী প্রতিনিয়ত দেখছে বীরত্বপূর্ণ প্রতিবাদের এই নতুন ভাষা।
কখনো ইসরায়েলের বিমান ছিনতাই করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন, কখনো বা নিরস্ত্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন দখলদার বাহিনীর উপর। দীর্ঘ সত্তর দশক ধরে ইসরায়েলের নির্যাতন আর নিষ্পেষণের শিকার ফিলিস্তিনিরা আজ কোণঠাসা। কিন্তু তারপরেও তাদের প্রতিবাদ ও মুক্তি আন্দোলন থেমে নেই। বইটির চমকপ্রদ এই বীরত্বগাঁথা গল্পগুলো যেকোনো পাঠককে নতুন করে ভাবতে শেখাবে।
দশকের পর দশক ধরে শান্তি আলোচনা, জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ এবং তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে ফিলিস্তিনের সমস্যা সমাধানের অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সমাধান আসেনি। শান্তিও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বরং অশান্তির দাবানল ক্রমেই বাড়ছে। তারপরও বিশ্ববাসী আশায় বুক বেঁধেছে- কোনো একদিন নিশ্চয়ই ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। ফিলিস্তিনিরাও স্বপ্ন দেখছে, কোনো একদিন প্রতিষ্ঠা হবে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র। যেখানে তারা নির্ভয় বসবাস করতে পারবে, চলতে পারবে বুক ফুলিয়ে। সেই দিনের প্রতীক্ষায় ফিলিস্তিনিরা প্রতিদিন সইছে ব্যথার দহন। বইটি সেই ব্যথাদীর্ণ ফিলিস্তিনের ইতিহাস ও বর্তমান তুলে এনেছে হৃদয়গ্রাহী বর্ণনায়, যা পাঠককে পূর্ণ পঠনতৃপ্তি দিতে সক্ষম।
বইটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর সাবলীল বর্ণনাভঙ্গি। প্রত্যেকটি ঘটনা গল্পের ভাষায় তুলে আনা হয়েছে। শব্দচয়নের ক্ষেত্রেও দুর্বোধ্য শব্দ পরিহার করে সহজ শব্দ বেছে নেয়া হয়েছে। কাজেই পড়তে গিয়ে পাঠককে কোথাও আটকে যেতে হবে না। তাছাড়া সংক্ষিপ্ত বর্ণনাও একে অনবদ্য করে তুলেছে।
এতসব চমৎকার অনুভূতির পরেও পাঠক হিসেবে কিছু অতৃপ্তি থেকে গেছে। প্রথমত, বইটির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটগুলো অতি সংক্ষিপ্ত। পূর্ব থেকে ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা নেই এমন পাঠকরা বইটি পড়ে বিস্তারিত জানতে পারবে না। অনেক জায়গায় খেই হারিয়ে ফেলতে পারেন। অর্থাৎ, বইটির পূর্ণ স্বাদ পেতে হলে বর্ণনাকৃত ইতিহাস সম্পর্কে পূর্ব থেকেই ধারণা থাকতে হবে। সংক্ষিপ্ত এবং অপূর্ণাঙ্গ বর্ণনার কারণে কিছু কিছু জায়গায় পাঠক হিসেবে অতৃপ্ততা রয়ে গেছে।
বইয়ে কোনো ভূমিকা নেই, নেই প্রকাশকের কথাও। এছাড়া বইয়ের কোনো অংশেই লেখক সম্পর্কে দু’কথা লেখা নেই, যা বইটির অপূর্ণতা বলেই বিবেচনা হতে পারে।
তরুণ এবং উদীয়মান লেখক হিসেবে হামমাদ রাগিব এ বইয়ে তার দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। বর্ণনাশৈলী, বাক্যবিন্যাস এবং সাবলীল ভাষা প্রয়োগ তার প্রতিভার পরিচয় দিয়েছে।
সামগ্রিকভাবে ‘গল্প বলি ফিলিস্তিনের’ বইটি ফিলিস্তিন সম্পর্কে জানার নতুন সুযোগ সৃষ্টি করবে। এছাড়া যারা গল্প ও থ্রিলার পড়তে পছন্দ করেন, বইটি তাদের জন্যও চমৎকার অনুভূতি দিতে সক্ষম। কেননা পুরো বইটিই রচিত হয়েছে গল্পের ছলে।
বইটি সংগ্রহ করতে
বই: গল্প বলি ফিলিস্তিনের
লেখক: হামমাদ রাগিব
প্রকাশনা সংস্থা: নবপ্রকাশ
প্রথম প্রকাশ: জুন, ২০১৮
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৮০ পৃষ্ঠা
মুদ্রিত মূল্য: ১২০/-