অর্ধচন্দ্রাকৃতির কাস্তে হাতে ক্রোধে ফুঁসলাচ্ছেন ক্রোনোস! নিজ পিতা ইউরেনাস, অর্থাৎ আকাশকে একটু আগেই করেছেন ফালি ফালি। আকাশ ও ভূমি একইসাথে ক্রোনোসকে রূঢ় অভিশাপ দিয়ে বললেন,
“আমাদের সাথে যেমনটা করছ, একদিন তোমাকেও সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে, ফল ভোগ করতে হবে তিলে তিলে। তোমার সন্তানেরাও তোমার সাথে ঠিক এরকমই ব্যবহার করবে।”
হুংকারে ফেটে পড়া ক্রোনোস তখন বললেন, “দেখি কী করে ওরা আমার জায়গা দখল করে?” ক্রোনাসের স্ত্রী রিয়ার ঘরে সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার সাথে সাথেই তাদেরকে পেটে চালান করতেন অত্যাচারী ক্রোনোস। এদের মধ্যে ছিলেন গ্রিক উপকথার জনপ্রিয় দেব-দেবী; হেস্টিয়া, ডিমিটার, ও হেরা। কিন্তু সর্বশেষ পুত্র জিউসকে জন্মদানের পরই তার মা রিয়া তাকে লুকিয়ে রাখলেন ক্রিট দ্বীপের এক নির্জন গুহায়, ক্রোনোসের চোখের আড়ালে। ধরিত্রীমাতার সন্তান পার্বত্যদেবীদের লালন-পালনে দ্বীপে নিরাপদে শৌর্য-বীর্য নিয়ে বেড়ে উঠতে লাগলেন জিউস।
দীর্ঘ দশ বছর পর ভাইবোনদের নিয়ে একজোট হয়ে, ক্রোনোস আর টাইটানদের বিরুদ্ধে লড়লেন তিনি। পুরো দলকে নেতৃত্ব দিলেন একেবারে সামনে থেকে। এই যুদ্ধে ধনাত্মক প্রভাবকের ন্যায় জিউস বাহিনীকে সাহায্য করেছিল এক চোখওলা দানব সাইক্লপরা। তারা একদিকে যেমন জিউসকে তৈরি করে দিত মারণসম বজ্র, তেমনি পসেইডনের হাতে তুলে দিয়েছিল শক্তিশালী ত্রিশূল।
এভাবে একসময় পরাজিত হলো ক্রোনাস ও তার সহযোগী টাইটান বাহিনী। যুদ্ধে ইতি টানার পর, ক্রোনোস আর টাইটানদের টার্টারাস নামক মৃত্যুসম ভয়ানক এক কারাগারে বন্দি করে রাখলেন জিউস। এরপর স্বর্গের অধিপতি নির্বাচিত হলেন তিনি, রূপান্তরিত হলেন দেবরাজ জিউস হিসেবে। একে একে বাকিদেরকেও বিভিন্ন জিনিস ভাগ করে দেয়া হলো। এর মধ্যে সমুদ্রের দায়িত্ব দেয়া হলো পসেইডনকে, আর পাতালপুরীর শাসক হিসেবে নির্বাচিত হলেন হেডিস।
ঠিক এভাবেই টান টান উত্তেজনাপূর্ণ গ্রিক উপকথার একদম গোড়া থেকে শুরু হয়েছিল প্রখ্যাত লেখক রজার ল্যান্সেলিন গ্রিনের লেখা বই ‘টেইলস অভ দ্য গ্রিক হিরোজ’ বা ‘গ্রিক বীরদের আখ্যান’-এর।
গ্রিক পুরাণ সম্পর্কে খুঁটিনাটি জানতে যারা বিশেষভাবে আগ্রহী, তারা এই বই নির্দ্বিধায় পড়া শুরু করতে পারেন। মোট ১৯টি আলাদা আলাদা অধ্যায়ে ভাগ করা বইটি গ্রিক পুরাণের একেবারে উৎস থেকে আলোচনা শুরু করেছে, যা গিয়ে ঠেকেছে গ্রিস-ট্রয়ের নাটকীয় উপাখ্যানে। বইয়ে আপনার মোলাকাত হবে নিঃশ্বাসে আগুনের হলকা বের হওয়া ক্রোধান্মত্ত ষাঁড়ের সাথে। দেখা মিলবে বহু মাথাওলা ড্রাগনের। আরও পাবেন সেয়ানা জাদুকর, বিশ্বাস ভঙ্গ করা সেন্টর, ঈর্ষাপরায়ণ দেবতা আর বিকৃত রুচির রাজা-মহারাজাদের।
অজানা এক সমুদ্রে পাঠক জাহাজ নিয়ে এগিয়ে চলবেন বিশাল জলরাশির বুক চিরে, আরোহণ করবেন স্বর্গখ্যাত অলিম্পাস পর্বতের চূড়ায়, কখনোবা নরকতুল্য পাতালে অনুভব করবেন হেডিসের ক্রোধাগ্নিসম প্রখর তাপ। হয়তো দেখবেন, দেবরাজ জিউস ছুঁড়ে মারছেন বিশাল আকারের বজ্রপাত বা ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন বহুমস্তক হাইড্রার সামনে।
গল্পের শেষে সুন্দর পরিসমাপ্তি থাকবে, সেটা ভাবারও কোনো কারণ নেই। কারণ, তেজস্বী বীরদের জীবনে বেছানো পুরো পথটাই কণ্টকাকীর্ণ। ঝুঁকিপূর্ণ সকল অভিযানে মৃত্যুর সঙ্গে প্রতিনিয়ত টেক্কা দিতে হয় তাদের। তাতেই তাদের বীরগাথা অমলিন হয়ে থাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, হাজার বছর ইতিহাসে বেঁচে থাকেন তারা। ‘গ্রিক বীরদের আখ্যান’ নামক বইয়ে আলোচনা করা হয়েছে গ্রিক বীরদের নিয়ে, যারা বীরদর্পে আরোহণ করেছেন খ্যাতির শীর্ষে। এদের মধ্যে প্রমিথিউস, ডাইওনিসাস, হার্মিস, পার্সিয়াস, হেরাক্লিস (হারকিউলিস), অ্যাডামিটাস, থিসিয়াস প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন অধ্যায়ে বর্ণিত তাদের দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ড গায়ে জাগায় শিহরণ, রক্ত হয়ে ওঠে টগবগে। দীর্ঘ যাত্রায় দেখা হয় অসংখ্য বিশ্বস্ত বন্ধু ও সাহসী মিত্রের।
লেখকের কথা
প্রখ্যাত লেখক এবং জীবনীকার রজার ল্যান্সেলিন গ্রিন ১৯১৮ সালের ২ নভেম্বর, ইংল্যান্ডের নরউইচের এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই প্রাচীন ইতিহাসের প্রতি প্রবল ঝোঁক ছিল তার। মাটন কলেজে অধ্যয়নের পর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.লিট. ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। সৃজনশীল এই মানুষটি নিজ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন প্রাচীন পুরাণের প্রায় সকল শাখাতেই। এর মধ্যে মিশরীয় পুরাণ, নর্স পুরাণ, গ্রিক পুরাণ, ইজরায়েলি পুরাণ, ট্রয় ট্র্যাজেডি ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইতিহাস সৃষ্টি করা ফ্যান্টাসি উপন্যাস ‘দ্য লর্ড অভ দ্য রিংস’ এর রচয়িতা জে. আর. আর. টোলকিনের সাথে অক্সফোর্ডে একই সাহিত্যসভার অংশ ছিলেন গ্রিন। ১৯৮৭ সালে ইংল্যান্ডের শেশারে অবস্থিত পারিবারিক প্রাসাদে মৃত্যুবরণ করেন স্বনামধন্য এই ইতিহাসবেত্তা।
অনুবাদ নিয়ে কিছু কথা
বইটির অনুবাদকর্মের সাথে জড়িত ছিলেন বর্তমান সময়ের অন্যতম দুই অনুবাদক, মারুফ হোসেন, ও মোঃ ফুয়াদ আল ফিদাহ। ঝরঝরে ও প্রাঞ্জল ভাবানুবাদ বইয়ের কাহিনীগুলোর ভিতরে ডুব দেয়াটা আরও সহজ করে দিয়েছে। ‘টেইলস অভ দ্য গ্রিক হিরোজ’ নাম রূপান্তর করে ‘গ্রিক বীরদের আখ্যান’ নামটি পুরো কাহিনীর ধারাবাহিকতাকেই যেন প্রতিফলিত করে। শব্দচয়নের ধাঁচও ছিল যথাযথ এবং মানানসই। ফলে পুরো বইটিই পাঠককে আকর্ষণের জালে আটকে রাখবে।
ধর্মানুভূতি সর্বদাই মানুষের চিন্তা-চেতনার উপর বিরাট একটা প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে। প্রাচীন গ্রিকদের মধ্যে যখন দেবদেবীদের নিয়ে তৈরি মুখরোচক কাহিনীগুলো জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে, গ্রিকরা তখনও তেমন সভ্য নয়। কালের পরিক্রমায় অন্ধকার ঠেলে, গ্রিকরা যখন নিজেদেরকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করল, তখন তারা হয়ে উঠল অধিকতর সভ্য। তারা দেবরাজের মসনদে বসাল জিউসকে। তারা জিউসকে যতটা না পরাক্রমশালী হিসেবে উপস্থাপন করেছিল, তার চেয়ে বেশি রাঙিয়েছিল ‘দয়াশীলতা’র রঙ দিয়ে।
জিউসের আগে যেসব দেবতাদের গল্প প্রচলিত ছিল, তাদের আচরণ যতটা না ছিল দেবতাসুলভ, তার চেয়ে বেশি ছিল ভয়ানক, নির্দয়, নিষ্ঠুর ও নিষ্করুণ। যেমন- ঝড়, ভূমিকম্প, জলোচ্ছ্বাস, জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলোকেই একেকজন দেবতা হিসেবে মানা হতো। এরা সবাই ছিলেন পৃথিবী ও আকাশের সন্তান। তারপর গল্পকথকেরা একসময় বুঝতে পারলেন, অন্যান্য প্রাচীন গল্পের চেয়ে জিউসের গল্পগুলো লোকসমাগমে প্রচার করাটাই বেশি যুক্তিযুক্ত। তখন তারা দেবতাদেরকে দেও-দানব হিসেবে না দেখিয়ে দেখাল মিত্র হিসেবে। মরণশীল মানুষের সকল দুর্বলতা মিশিয়ে দিল অমর দেবতাদের মাঝে। ফলে স্বর্গের উচ্চাসনে কুর্সি গরম করা দেবতারা হয়ে গেলেন মনুষ্যজাতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
লেখক এই বিষয়টিই মূলত পুরো বইয়ের পাতায় পাতায় অসাধারণ সব গল্পের সমান্তরাল বর্ণনায় বয়ান করে গেছেন। কখনো হার্মিস, অ্যাপোলো বা জিউসের একে অপরের প্রতি হিংসা-দ্বেষের মতো মানবীয় অনুভূতিগুলো গল্পের মতো করে উপস্থাপন করা হয়েছে। কখনোবা সামনে এসেছে শৃঙ্খলিত দেবতা প্রমিথিউসের নাটকীয় উপাখ্যান। ডায়োনিসাস, থিসিয়াস এবং পার্সিয়াসের দুঃসাহসী অভিযানের আদ্যোপান্ত, হারকিউলিসের বিখ্যাত বারো অভিযানের আকর্ষণীয় বর্ণনাও জায়গা পেয়েছে বইয়ের পাতায়।
এ বইয়ের গল্পে হারিয়ে যেতে পারলে, সঙ্গ দেবেন দেবরাজ জিউস, সমুদ্র-দেবতা পসেইডন, পাতালপুরীর সম্রাট হেডিস, শিকারী আর্টেমিস, প্রেমের দেবী আফ্রোদিতিসহ গ্রিক পুরাণের আরও অনেক নায়ক-নায়িকা। সাথে ঘুরে আসা যাবে তিন হাজার বছর আগের পৌরাণিক গ্রিস থেকে।
বইটি সংগ্রহ করতে
বই: গ্রিক বীরদের আখ্যান
লেখক: রজার ল্যান্সলিন গ্রিন
অনুবাদক: মোঃ ফুয়াদ আল ফিদাহ, মারুফ হোসেন
প্রকাশনা সংস্থা: আদী প্রকাশন
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ১৫৯ পৃষ্ঠা
নির্ধারিত মূল্য: ২৭০ টাকা