কয়েকদিন আগে দূর্গেশগড়ের গুপ্তধন নামে একটি মুভি নিয়ে আমরা কথা বলেছিলাম। এরই ধারাবাহিকতায় আজ বলা হবে সেই মুভির প্রিক্যুয়াল বা সোনা দা সিরিজের প্রথম মুভিটির কথা; নাম ‘গুপ্তধনের সন্ধানে’। মূল প্রসঙ্গে আসা যাক তবে।
শাহ সুজা ছিলেন বাংলায়। তার সময় বাংলা ছিল বেশ সমৃদ্ধ। ৬ সেপ্টেম্বর ১৬৫৭; গুজব শোনা গেল সম্রাট শাহজাহান মারা গেছেন। সিংহাসনের লোভে ভাইয়ে ভাইয়ে লড়াই শুরু হলো। হেরে ফিরে গেলেন সুজা। একসময় তিনি আবার শক্তি সঞ্চয় করে ফিরলেন। আবার যুদ্ধ হলো। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম খেলা। এবারও ভাইয়ের কাছে হেরে গেলেন। ভাবলেন, আরাকান অর্থাৎ মায়ানমারে গিয়ে আবার শক্তি সঞ্চয় করে ফিরে আসবেন নিজের অধিকার বুঝে নিতে। যাবার আগে তার ভান্ডারের বিপুল সম্পত্তি লুকিয়ে রেখে যান কাছের কিছু মানুষের কাছে। ভেবেছিলেন, তিনি ফিরে আসবেন। কিন্তু ভাগ্য যে নিষ্ঠুর! তার আর বাংলায় ফেরা হলো না। সময়ের ফেরে হারিয়ে গেল তার সেই রত্নভান্ডার।
সোনা দা অর্থাৎ সুবর্ণ সেন, ৭ বছর পরে ফিরে এলেন নিজের দেশে। তার ভাই আর প্রায় সমবয়সী ভাতিজা আবির গেল তাকে আনার জন্য। বাড়ি ফিরে শুনলেন বৌদির দাদা অর্থাৎ আবিরের বড় মামা মারা গেছেন। পেশায় উকিল আবির কিন্তু সোনাদার ভাইপো। নিজের কাকাকে সে দাদা বলে ডাকে, কারণ বয়সের পার্থক্য কম।
বড্ড রহস্যময় মানুষ ছিলেন তিনি। হেঁয়ালি ভালোবাসতেন। ভাগ্নেকে বড্ড ভালবাসতেন। ভাগ্নের নাম নিয়েও হেঁয়ালি করতে ভোলেননি। এমনকি পুরোহিত থেকে শুরু করে সবাই তার হেঁয়ালির মুখোমুখি হত। এই মামার নাম হরিনারায়ণ সিংহ রায়। সুপন্ডিত এই মানুষটির মৃত্যু হয় বড্ড রহস্যময়ভাবে। মারা যাবার ঠিক কিছুক্ষণ আগে ভাগ্নের জন্য একটা চিঠি লিখে রেখে যান। বাড়ি ভেঙে ফেলা বা বিক্রির প্রস্তাব তিনি পেয়েছিলেন, কিন্তু ফিরিয়ে দিয়েছেন, পৈতৃক বাড়ি বলে কথা।
সেই মনিকান্তপুর নামের সুন্দর গ্রামে রয়েছে হরির বন্ধু আর তাঁর মেয়ে ঝিনুক। ছোট থেকেই আবির ঝিনুক একে অন্যকে বেশ পছন্দ করে। আবির-সোনাদা যখন মনিকান্তপুরে যাচ্ছিল, তখন থেকে আবিরের উত্তেজনা ছিল অনেক বেশি, কারণ ঝিনুক পরীক্ষার ছুটিতে বাড়িতে। এক তথ্যবহুল সেমিনার শেষে আবির আর সোনাদা যাত্রা শুরু করে মনিকান্তপুরের পথে। খাদ্যরসিক আবির মামাকে শেষবারের মতো দেখতে পারেনি, কারণ সে তখন হাইকিংয়ে ছিল। মামাবাড়ি এসে সে কিছুটা মুষড়ে পড়ে। এদিকে মামার রেখে যাওয়া চিঠি পোস্ট করতে ভুলে যাওয়া গৃহকর্মী আবিরের হাতে তুলে দেয় সেই চিঠি। সাথে দেয় অদ্ভুত দর্শন এক আংটি। সেই আংটি সবসময় থাকত হরির হাতে।
যা-ই হোক, ইতিহাসবিদ সুবর্ণ সেনের কথায় আর নানা ঘটনার মাধ্যমে জানা যায়, সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজার প্রায় তিনশত বছরের বেশি পুরোনো ধন-রত্ন লুকানো আছে এই মণিকান্তপুরেই।
নিজের মৃত্যুর আগে হরিনারায়ণ বুঝতে পেরেছিলেন কিছু ঘটবে। আর তাই ডায়েরিতে সেই গুপ্তধনের সন্ধান একটি হেয়ালির মাধ্যমে দিয়ে গিয়েছিলেন। মামার বিশ্বাস ছিল- পেশায় উকিল আবির ঠিক খুঁজে বের করবে সেই রত্ন।
একদিকে ভূতের আনাগোনা, অপরদিকে এই বাড়ির উপর নজর রয়েছে দশানন নামে এক ব্যক্তির। নামে রাবণ, কিন্তু কাজে কি তা-ই? এদিকে প্রথম রাতেই কালো বেড়াল রাতের অন্ধকারে দেখে বেশ ভড়কে যায় আবির।
এদিকে পরদিন ঝিনুক আর তার বাবা দেখা করতে আসেন। পুরো বাড়িতে ঝিনুকের রাজত্ব। অকৃতদার হরির প্রাণ ছিল ঝিনুক। বাড়ির এখানে সেখানে অবাধ যাতায়াত, মনিমাণিক্য খুঁজে বেড়িয়েছে ছোটবেলা থেকেই।
বাড়ি ঘুরতে ঘুরতে বাড়ির এমন এক স্থানে এসে এরা হাজির হলো, যেখানে এই পরিবারের মৃত সবার জন্য রয়েছে স্মৃতিফলক।
খুব অদ্ভুতভাবে ঝিনুক আর তার বাবাসহ আবির-সুবর্ণ জুটি জানতে পারেন নিজের স্মৃতি ফলক নিজেই বানিয়ে রেখে গিয়েছেন। সেই ফলকে লেখা অদ্ভুত কিছু ছন্দ। সেই ছন্দের মানে কেউ ধরতে পারল না। কেন তিনি এই ছন্দ লিখে গিয়েছেন তা-ও বোঝা সম্ভব হচ্ছিল না।
হঠাৎ একসময় মামার রেখে যাওয়া চিঠি আর ডায়েরির পাতার সেই হেঁয়ালি উদ্ধার করে যাত্রা শুরু হলো গুপ্তধন খোঁজার। কখনও বিষধর সাপ, কখনও ভয়ঙ্কর ভূতের মুখোমুখি হতে হয় এই ত্রিরত্নকে। কিন্তু শেষমেশ কি তারা পারবে সুজার সেই রহস্য উদ্ধার করতে? আসলেই কি তা মণিমানিক্য? নাকি অন্য কিছু?
এদিকে আবির এই বাড়ি কখনও ভেঙে ফেলতে চায়, পালাতে চায় এখান থেকে; অন্যদিকে ঝিনুক চাইছে এই বাড়ি, এই ঐতিহ্য সংরক্ষণ করতে। এ নিয়ে আবির-ঝিনুকের বেশ মনোমালিন্য শুরু হয়। অন্যদিকে এই বাড়ির কেউ নজর রাখছে এই তিন রত্নের উপর। অদৃশ্য শত্রুর সাথে মোকাবেলা কি করতে পারবে তারা? যখের ধন হয়ে যায়নি তো সুজার সেই অমূল্য ধন। তবে কি আসলেই কোনো রত্ন লুকোনো আছে? নাকি কেবল মিথ? অনেক প্রশ্নের অনেক উত্তর। মুভি দেখা শেষ না করে আপনারা চোখ সরাতে পারবেন না। এরপরে কী হবে? এরপর কি সমাধান আছে? এই প্রশ্ন বারবার ঘুরপাক খাবে মাথায়। লেখক-প্রযোজক-পরিচালক শুরু থেকে শেষ অবধি রহস্য ধরে রেখেছেন। এখানেই তাদের স্বার্থকতা। রহস্যের শুরু কোথায় হয়েছে, সেটা ধরতে গেলেও আপনাদের বুদ্ধি খাটাতে হবে। আপনারাও মাথা খাটাতে পারবেন তাদের সাথে।
২০১৮ সালে প্রকাশিত এই মুভির মাধ্যমে সোনাদা সিরিজের যাত্রা শুরু। ইতিমধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে এই সিরিজ। মুভির নানা ভূমিকাতে অভিনয় করেছেন আবীর চট্টোপাধ্যায় (সুবর্ণ সেন ওরফে সোনাদা), অর্জুন চক্রবর্তী (আবীর), ঈশা সাহা (ঝিনুক), দশানন (রজতাভ দত্ত), অরিন্দম সিল (সুবীর রায়), গৌতম ঘোষ (হরিনারায়ণ সিংহ রায়) প্রমুখ।
শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের ব্যানারে আসা এই লোমহর্ষক গল্পের রচয়িতা ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শুভেন্দু দাশমুন্সি। প্রযোজক হিসেবে ছিলেন মহেন্দ্র সোনি আর শ্রীকান্ত মেহতা। সোনাদা সিরিজের প্রথম মুভি এটি। নতুন এই রহস্যভেদী বাংলার সিনেমা জগৎকে বেশ বদলে দিয়েছে। এই সিরিজেরই দ্বিতীয় ছবি ‘দুর্গেশগড়ের গুপ্তধন’।
[গুপ্তধনের সন্ধানে মূল বইটি কিনুন রকমারি থেকে]