ডার্সলি পরিবারের অত্যাচারের রোষানলে অতিষ্ঠ হয়ে গেছে হ্যারি পটার। বৈরি প্রকৃতির নির্মমতার হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য নিশ্চুপ বুকফাটা আহাজারি করে যাচ্ছে সে। করুণার পাত্র হয়ে বেঁচে থাকার কোনো ইচ্ছা নেই তার। তাই, নিষ্প্রাণ হ্যারি বেরিয়ে যেতে চাচ্ছে সেই পরাধীনতার বিমূর্ত খোলস ভেঙে। সে সময় গ্রীষ্মের তপ্ত প্রখরতা কাটিয়ে দেওয়া শীতল বৃষ্টির মতো হ্যারির জীবনে আশীর্বাদ হয়ে আগমন ঘটল রুবিয়াস হ্যাগ্রিডের।
দেখতে দানব সদৃশ, মাথা ভর্তি চুল- যা ঘাড় ছুঁয়েছে অনায়াসে, মুখ-ভর্তি দাঁড়ির কোনে লুকানো মুখমণ্ডলটাকে অতিকায় শরীরের তুলনায় নিতান্তই ছোট মনে হয়। সে যেন দুর্গম এক দ্বীপ থেকে উদ্ধার করে নিয়ে এল হ্যারিকে, দিল নতুনভাবে বাঁচার উদ্যম। পুরোটা সময় ধরেই হ্যারি-রন-হারমায়োনি ত্রয়ীর খুব ভালো বন্ধু ছিল হ্যাগ্রিড, যার কাছে তারা নির্দ্বিধায় মনে চেপে রাখা সকল কথা খুলে বলতে পারত। অর্ডার অভ দ্য ফিনিক্সের সক্রিয়, বিশ্বস্ত, কর্তব্যনিষ্ঠ, ও অনুরত এই হগওয়ার্টস যোদ্ধাকে নিয়েই আজকের এই আয়োজন।
মাতৃশূন্যতা
‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য গবলেট অব ফায়ার’ বইয়ে, হ্যাগ্রিড হ্যারি, রন আর হারমায়োনির কাছে বাবা-মা সম্পর্কে মুখ খুলেছিল। পুরো ফ্র্যাঞ্চাইজিতে হ্যাগ্রিডের বাবার নাম উল্লেখ না করা হলেও, হ্যাগ্রিডের মায়ের সম্পর্কে কিছু তথ্য উঠে এসেছে। হ্যাগ্রিডের বাবা সাধারণ এক জাদুকর হলেও বিয়ে করেছিলেন ফ্রিডওলফা নামক অতি-দীর্ঘাকৃতির এক দানবীকে। জন্মের পরই হ্যাগ্রিডকে তার বাবার কাছে রেখে চলে যান ফ্রিডওলফা। হ্যাগ্রিডের মতে, তার মায়ের ভেতর মমত্ববোধ ও জননী-সুলভ আচরণের ছিটেফোঁটাও ছিল না। এরপর তিনি গ্রাওপ নামক এক দৈত্যের জন্ম দেন, যে ছিল হ্যাগ্রিডের সৎ ভাই। অর্ডার অভ দ্য ফিনিক্স সিনেমার কল্যাণে দর্শকরা সে গ্রাওপের দেখা পেয়েছিল।
ডাম্বলডোরের লাশ বহন
হ্যারি পটার মুভি সিরিজের ষষ্ঠ কিস্তিতে সেভেরাস স্নেইপের হাতে প্রয়াণ ঘটে মহামতি অ্যালবাস ডাম্বলডোরের। তবে দুঃখের বিষয়, প্রত্যক্ষ মর্মপীড়ার অনুভূতি জাগানো এ দৃশ্যের পরবর্তী অংশটুকু সেলুলয়েডের ফিতায় ধারণ করা হয়নি বিধায় মুভি ভক্তরা হৃদয়বিদারক এক উপাখ্যানের সমাপ্তি দেখতে পারেনি। সর্বকালের অন্যতম সেরা এ যশস্বী জাদুকরকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য শেষকৃত্যে অংশ নিয়েছিল অর্ডার অভ দ্য ফিনিক্স, হগওয়ার্টস, জাদু মন্ত্রণালয়ের সকল কলাকুশলী।
ডাম্বলডোরের লাশ বহনের সৌভাগ্য হয়েছিল রুবিয়াস হ্যাগ্রিডের। হ্যাগ্রিড ও ডাম্বলডোর পরস্পরকে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। হগওয়ার্টসে অনেকবার হ্যাগ্রিডকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন ডাম্বলডোর, এমনকি তার জন্য অনেক কঠোর আইনও শিথিল করেছিলেন তিনি। তাই, শেষ বিদায়ে প্রচণ্ড কান্নায় ভেঙে পড়েছিল হ্যাগ্রিড। বলা যায়, এক অব্যক্ত কান্না বুকে চেপে, অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিদায় দিতে হয়েছিল এই মহান জাদুকরকে।
স্কুল থেকে বহিষ্কার
লর্ড ভলডেমর্ট ওরফে টম মারভেলো রিডল তখন হগওয়ার্টসের ছাত্র। কৌতূহলবশত সালাজার স্লিদারিনকে নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে হঠাৎ সে একদিন ‘চেম্বার অভ সিক্রেটস’ সম্পর্কে জানতে পারে। সালাজার স্লিদারিনের উত্তরসূরী হওয়ায় হগওয়ার্টসের ‘চেম্বার অভ সিক্রেটস’ খুলে ফেলতে সক্ষম হয় টম রিডল। এর ফলে বেরিয়ে আসে ব্যাসিলিস্ক নামের দানবীয় এক সরীসৃপ এবং আঘাত করে বসে অনেক মাগলবর্ন শিক্ষার্থীকে। সরীসৃপটি মার্টেল ওয়ারেন নামক এক মেয়েকে মেরে ফেললে, হগওয়ার্টসের সভাসদেরা স্কুল বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
নিজেকে বাঁচানোর জন্য রিডল তখন সব দোষ চাপায় হগওয়ার্টসের ছাত্র রুবিয়াস হ্যাগ্রিড এবং তার পোষা প্রাণী অ্যাক্রুম্যান্টুলা ও অ্যারগগের উপর। রিডল যেভাবেই হোক, তৎকালীন প্রধান শিক্ষক আরমান্ডো ডিপেটকে বোঝাতে সক্ষম হয়, হ্যাগ্রিডের পোষা অ্যারগগই স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ত্রাস ছড়িয়ে যাচ্ছে। শাস্তিস্বরূপ হ্যাগ্রিডকে তখন হগওয়ার্টস থেকে বের করে দেওয়া হয় আর রিডলকে করা হয় পুরস্কৃত। কিন্তু অ্যালবাস ডাম্বলডোর বিশ্বাস করতেন, হ্যাগ্রিড এ খুনের জন্য দায়ী নয়। তাই তিনি হ্যাগ্রিডকে হগওয়ার্টসের মাঠরক্ষক হিসাবে রেখে দিলেন।
অতিকায় হ্যাগ্রিড
সিনেমায় ফুটিয়ে তোলা হ্যাগ্রিডের বিশাল বড় শরীর দেখে তাকে দানব ভেবে ভুল করেছিলেন? তাহলে বলে রাখি, বইয়ে তার শারীরিক উচ্চতা ছিল এর থেকে আরও বিশাল। ফিল্মের ভিজ্যুয়াল কম্প্যারিজনের ভিত্তিতে তার উচ্চতা ছিল ৮ ফুট ৬ ইঞ্চি, যেখানে বইয়ের বর্ণনায় তার আসল উচ্চতা হলো ১১ ফুট ৬ ইঞ্চি! এগারো ফুটের দানবতুল্য এই হ্যাগ্রিডকে সেলুলয়েডের পর্দায় আটাতে হলে প্রোডাকশন হাউজকে বেশ বেগ পেতে হতো, কারণ সিরিজের প্রথম থেকে শেষপর্যন্ত সবগুলো সিনেমাতেই তার উপস্থিতি ছিল প্রবল।
চলচ্চিত্রে রূপায়ন
স্কটল্যান্ডের অভিনেতা রোবি কোলট্রেন হ্যারি পটার ফ্র্যাঞ্চাইজির প্রতিটি চলচ্চিত্রে হ্যাগ্রিড চরিত্রের সুনিপুণ প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। মূলত, হ্যাগ্রিড চরিত্রটার জন্য রোলিং অনেক আগ থেকেই মনে মনে রোবি কোলট্রেনকে বেছে রেখেছিলেন। রোলিং তাকে হ্যাগ্রিড চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাবনা দেয়ার সাথে সাথেই গ্রিন সিগন্যাল দিয়ে দেন তিনি। তাই, হ্যারি পটার সিনেমার জন্য সর্বপ্রথম নির্বাচিত হওয়া অভিনেতা হলেন রোবি কোলট্রেন। প্রখ্যাত আমেরিকান অভিনেতা রবিন উইলিয়ামস এ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। তবে রোলিং শুরু থেকেই সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, হ্যারি পটারের সকল স্টার-কাস্ট হতে হবে যুক্তরাজ্যের বাসিন্দা।
রোবি কিন্তু সবসময় হ্যাগ্রিডের চরিত্রে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াননি। কারণ, সিনেমায় হ্যাগ্রিডকে যতটা দানবীয় দেখায়, রোবি গতরে অতোটা গাট্টাগোট্টা ছিলেন না। তাই, সেখানে গিয়ে হাজিরা দিতে হয়েছে ৬ ফুট ১০ ইঞ্চি উচ্চতার সাবেক রাগবি খেলোয়াড় মার্টিন বেফিল্ডকে। হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য চেম্বার অভ সিক্রেটসে রিডল ডায়েরির সাহায্যে হ্যারি পটার যখন ৫০ বছর আগের হগওয়ার্টসে ফিরে গিয়েছিল, ফ্ল্যাশব্যাক দৃশ্যে তখন শিক্ষার্থী হ্যাগ্রিডের দেখা মিলেছিল এক ঝলক। সে সময় অল্পবয়স্ক হ্যাগ্রিডের ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছিলেন অভিনেতা মার্টিন বেফিল্ড।
বাস্তব দুনিয়ার ছোঁয়া
লেখকদের কল্পনাপ্রসূত গাদা গাদা কাল্পনিক চরিত্রের শেকড় অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, বেশিরভাগই বাস্তব দুনিয়ার বিভিন্ন ব্যক্তিজীবন থেকে অনুপ্রাণিত। জে. কে. রোলিংও এর ব্যতিক্রম নন। রুবিয়াস হ্যাগ্রিডের চরিত্রটা নেওয়া হয়েছে দক্ষিণ ইংল্যান্ডের দ্য ওয়েস্ট কান্ট্রিতে বসবাসরত এক বিশালদেহী বাইকার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে।
‘হ্যারি পটার পেজ টু স্ক্রিন: দ্য কমপ্লিট ফিল্ম মেকিং জার্নি’ বইয়ে রোবি কোলট্রেন উল্লেখ করেছেন, ওই লোকের সাথে মোলাকাত হয়েছে তার। রবি জানিয়েছেন, বাইকারটি হ্যাগ্রিডের মতোই বিশালাকায়, এবং কুসুম-কোমল হৃদয়ের অধিকারী।
হ্যাগ্রিডের পিতা
‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য গবলেট অভ ফায়ার’ সিনেমায়, মাদাম ম্যাক্সিমের সাথে কাটানো সময়টাতে হ্যাগ্রিড তার পুরনো দিনের দুঃখের ঝাঁপি খুলে বসে। তার বাবা তাকে কত কষ্ট করে মানুষ করেছিল, তা সে মর্মান্তিক কষ্ট মিশিয়ে সেই আবেগঘন পরিস্থিতিতে বর্ণনা করে যায়। দুঃখের বিষয় হলো, জে. কে. রোলিং এত এত চরিত্রের নামকরণ করলেও, হ্যাগ্রিডের বাবার কোনো নামের অস্তিত্ব আজ অবধি মেলেনি। হয়তো, রোলিং পাঠকদের কোনো চমক দেবার জন্য তা গোপন রেখেছেন।
হ্যাগ্রিডের মতে, তার বাবা ছিল আকারে ছোট্ট একজন মানুষ, যাকে হ্যাগ্রিড ছয় বছর বয়সেই এক হাত দিয়ে তুলে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যেতে পারত। ১৯৪০ সালের দিকে, মাত্র বারো বছর বয়সে পিতাকে হারিয়ে হ্যারি পটারের মতো এতিম হয়ে যায় হ্যাগ্রিড, কারণ তার মা তাকে আগেই ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। হ্যাগ্রিডের মতে, ওই সময়টা ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বাজে সময়গুলোর মধ্যে অন্যতম।
চারিত্রিক বিকাশ
রোলিংয়ের মতে, সিরিজের যেসব চরিত্র তিনি একেবারে প্রথম দিকেই সৃষ্টি করেছিলেন, এদের মধ্যে হ্যাগ্রিড অন্যতম। রোজমারি গোরিং তার ‘হ্যারি’স ফেম’-এ উল্লেখ করেছেন, রোলিং সৃষ্ট চরিত্রগুলোর মধ্যে হ্যাগ্রিডই একমাত্র চরিত্র, যাকে সরাসরি ফরেস্ট অভ ডিন থেকে উদ্ভূত বলে মনে করা হয়। এই ফরেস্ট অভ ডিন ইংল্যান্ডের পশ্চিম অংশে অবস্থিত।
লুকানো জাদুর কৌশল
হগওয়ার্টস স্কুল থেকে বহিষ্কার হবার আগে, হ্যাগ্রিড ১৬ ইঞ্চি লম্বা ওক কাঠের তৈরি জাদুর ছড়ি ব্যবহার করত। তৃতীয় বর্ষে দুর্ঘটনাবশত সেটা ভেঙে গেলেও, ছড়িটা আবার মেরামত করা গিয়েছিল। তারপর সে সেটা লুকিয়ে রেখেছিল গোলাপি রঙের এক ছাতার আড়ালে, যা প্রয়োজনের সময় গোপনে ব্যবহার করত। ‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য ফিলোসফারস স্টোন’ সিনেমায় ডাডলি ডার্সলির পেছনে শূকরের লেজ গজানোর কথা মনে আছে তো? বা প্রবল ঝড় বৃষ্টির রাতে দুর্গম দ্বীপে আশ্রয় নিতে আসা ডার্সলি পরিবারের ঘরে দেশলাই ছাড়া কোঁৎ কোঁৎ শব্দে আগুন জ্বালানোর কথা? প্রতিটি জাদু সম্পাদনা কিন্তু হ্যাগ্রিড ওই ছাতা দিয়েই করেছিল।
হ্যাগ্রিডের পারদর্শিতা
যদিও চার্ম, স্পেল ও অ্যাডভান্স ম্যাজিক প্রয়োগে হ্যাগ্রিড ততটা পারদর্শী ছিল না, কিন্তু তার জাদু ঠেকানোর ক্ষমতা ছিল অভাবনীয় পর্যায়ের। আড় ধনুক চালানোর দক্ষতায় তার ছিল জুড়ি মেলা ভার। এছাড়াও দানবাকৃতির শরীরের অধিকারী হওয়ায় সে ছিল প্রচণ্ড শক্তিশালী, তাকে এত সহজে দমানো যেত না। আর স্বভাবেও সে এত সহজে হাল ছাড়ার পাত্র ছিল না।
শখের পেশা
রাঁধুনি হিসেবে হ্যাগ্রিডের হাত ততটা চালু না হলেও, সে রান্না করতে খুব ভালবাসত। পটারমোর ওয়েবসাইটে তার মোট তিনটি শখের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল; বাগান করা, জাদুকরী জন্তু পোষা আর রান্না করা। বাকি দুটোতে মুন্সিয়ানা দেখাতে পারলেও, তার রান্না তেমন সুস্বাদু হতো না। তবুও প্রিয় জিনিস বলে কথা!
নামকরণ
রোলিং তার চরিত্রগুলোর নামকরণের জন্য প্রচুর সাহিত্য, জীবজন্তু, বিখ্যাত জায়গা ইত্যাদি নিয়ে বিশদ গবেষণা করেছেন। তেমনি, রুবিয়াস হ্যাগ্রিডের নামের প্রথম অংশ ‘রুবিয়াস’ এসেছে লাতিন শব্দ ‘রুবিনিয়াস’ থেকে, যার অর্থ হলো ‘লাল বর্ণ’। আর হ্যাগ্রিড অংশ এসেছে ‘হ্যাগ্রিডেন’ থেকে, যার অর্থ হলো ‘চিন্তিত’। হ্যাগ্রিড সবসময় হ্যারির সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত থাকত। তাই, রোলিং তার নাম ঠিক করেছিলেন ‘রুবিয়াস হ্যাগ্রিড’ হিসেবে।
এছাড়াও তার নাম আলকেমির সাথে সম্পৃক্ত। হ্যাগ্রিড আর ডাম্বলডোরের নাম প্রাচীন ইংরেজি ভাষার সাথে সম্পৃক্ত থাকলেও, এই নাম দুটো দিয়ে আরেকটা মজাদার জিনিস জুড়ে আছে। আগেই বলা হয়েছে, রুবিয়াস এসেছে লাতিন শব্দ ‘রুবিনাস’ থেকে, যার অর্থ হচ্ছে লাল। আর অ্যালবাস এসেছে ‘অ্যালবা’ থেকে, যার অর্থ হচ্ছে সাদা। লাল আর সাদা হচ্ছে আলকেমির এক নিগূঢ় উপাংশ, যা মানবিক চরিত্রের দুটো দিককে প্রতিফলিত করে। হ্যাগ্রিড ও ডাম্বলডোর দু’জনেই ছিলেন হ্যারির পিতার মতো।
অর্থাৎ, লাল আর সাদা দুটো জিনিসই হ্যারি পটারের সাথে সম্পর্কযুক্ত। আরও ভেঙে বললে, হ্যারি পটারের সাথে প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল রুবিয়াস হ্যাগ্রিডের। লাল রং মূলত চরিত্রের প্রাণবন্ত, উদ্যম ও প্রায়োগিক দিকগুলোকে উল্লেখ করে, যা ছিল রুবিয়াস হ্যাগ্রিডের স্বভাবসিদ্ধ বৈশিষ্ট্য। অপরদিকে সাদা রং চরিত্রের হৃদয়গ্রাহী, শান্ত-শিষ্ট-ধীর ও বুদ্ধিগত বৈশিষ্ট্যকে প্রতিবিম্বিত করে। যে বৈশিষ্ট্যগুলো অ্যালবাস ডাম্বলডোরের মধ্যে নিহিত। জে. কে. রোলিং যে তার সৃষ্ট সাহিত্যে কত নিখুঁত দূরদর্শী ছিলেন, এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ হতে পারে এই রূপকের উদাহরণ।
হ্যাগ্রিডের ফ্যাশন
বাদামি লোমশ এককেতা পোশাক, হলুদ ছোপযুক্ত গলা-বন্ধনি, বৃহৎ বাদামি ওভারকোট; নিশ্চিত করে বলা যায়, অদ্ভুত গোছের দানবীয় এই পোশাক নিয়ে হ্যাগ্রিড কোনো ফ্যাশন শো’তে পুরস্কার জিততে পারবে না। তবে এগুলো তাকে বানিয়েছে অন্য সবার থেকে আলাদা। উদ্ভট এ পোশাক অন্যরকম আকৃতি দান করেছিল। আর নিজের উদ্ভাবিত পোশাকের দ্বারা যদি নিজের ব্যক্তিত্বকে একটু আলাদা করে উপস্থাপন করা যায়, তবে তা-ই সই!
বিড়াল বিরূপতা
জাদুকরী প্রাণীসমূহের ক্ষেত্রে হ্যাগ্রিডের বিশেষ দুর্বলতা থাকলেও, সে বিড়ালকে একদম সহ্য করতে পারত না। কারণ, ‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য ফিলোসফারস স্টোন’ বইয়ে হ্যাগ্রিডকে বলতে দেখা গিয়েছিল, বিড়ালের প্রতি তার প্রচুর অ্যালার্জি আছে। সেজন্যই হগওয়ার্টসের তত্ত্বাবধায়ক অ্যারগাস ফিলচের বিড়াল মিসেস নরিসের সাথে ছিল তার দা-কুমড়া সম্পর্ক।
একজন প্রকৃত গ্রিফিন্ডর
১৯৪০ সালে হগওয়ার্টসে ভর্তি হবার পর, সর্টিং হ্যাট তার ডানপিটে স্বভাবের তারিফ করে তাকে হাউজ গ্রিফিন্ডরে পাঠায়। তৃতীয় বর্ষে হগওয়ার্টস থেকে বহিষ্কৃত হয়ে গেলে, গ্রাজুয়েশনের পাট চুকানোর সৌভাগ্য হয়নি হ্যাগ্রিডের। সেজন্য এখনো নিজেকে গ্রিফিন্ডরের একজন গর্বিত ছাত্র হিসেবে মনে করে সে। তার মতো অনুগত গ্রিফিন্ডরের সংখ্যা খুব কমই পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, হ্যারির স্লিদারিন ঘৃণা জন্মানোর পেছনে হ্যাগ্রিডও অনেকটা দায়ী। হ্যাগ্রিডই সর্বপ্রথম হ্যারিকে হগওয়ার্টসের সকল নিয়মকানুন ও ইতিহাস সম্পর্কে অবগত করেছিল। কথার ফাঁকে সে বলে দিতেই পারে,
“স্লিদারিন থেকে সবসময় খারাপ জাদুকর বের হয়!”
অর্ডার অভ দ্য ফিনিক্সের প্রতি পাঁড় আনুগত্য
১৯৭০ সালে অ্যালবাস ডাম্বলডোরের নিজ হাতে গড়া সংগঠন ‘অর্ডার অভ দ্য ফিনিক্স’ এর একদম গোড়ার দিকের সদস্য রুবিয়াস হ্যাগ্রিড। অন্য সবার মতো তার জাদুচর্চার বৈধতা না থাকলেও, সে বিভিন্ন সময় অর্ডারের সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সবসময় নিজের আনুগত্য, বিশ্বস্ততার পরিচয় দিয়ে এসেছে সে। হ্যারি পটারের মা-বাবা ভলডেমর্ট কর্তৃক হত্যার পর, হ্যাগ্রিডই পিচ্চি হ্যারিকে প্রিভেট ড্রাইভের কাছে নিয়ে গিয়েছিল।
হ্যাগ্রিডের যমজ?
হ্যাগ্রিডের সৎভাই গ্রাওপের কথা মোটামুটি সবারই জানা। কিন্তু গুজব আছে, ডিগ্রাহ নামে হ্যাগ্রিডের এক পাজি ও শয়তান ভাই আছে, যে নিষিদ্ধ করিডোরে লুকিয়ে থাকে সবসময়। সেজন্যই, শিক্ষার্থীদের সেখানে যাওয়া নিষিদ্ধ। ‘ডিগ্রাহ’ নামটা কেমন একটু অদ্ভুত ঠেকছে না? তাহলে মজার একটা জিনিস বলি। এই ‘Digrah’ শব্দটি এসেছে মূলত ‘Hagrid’ থেকে। লক্ষ করে দেখুন, ‘Hagrid’ কে ওল্টালে কিন্তু ‘Digrah’ পাওয়া যায়।
স্মৃতিরক্ষার জন্য ধন্যবাদ
এতিম হ্যারির জন্য রুবিয়াস হ্যাগ্রিড ছিল পিতৃতুল্য, যে তাকে নিজ সন্তানের মতো বাচ্চাকাল থেকে শুরু থেকে হগওয়ার্টসের শেষ দিনটি পর্যন্ত সচেতন অভিভাবকের মতো আগলে রেখেছে সযত্নে। জেমস ও লিলির সাথে দারুণ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকায়, একবার দু’জনের ছবি তুলে রেখেছিল হ্যাগ্রিড। জ্ঞান হবার পর, হ্যাগ্রিডের কাছে নিজের হারানো মা-বাবার ছবি দেখার পর হ্যারি কতটা আবেগাপ্লুত হয়েছিল, তা বলাই বাহুল্য।
হ্যাগ্রিডের মোটরবাইক
অতিকায় বিশাল দেহের অধিকারী হওয়ায়, ব্রুমস্টিক বা জাদুর ঝাড়ুতে উড়তে পারত না হ্যাগ্রিড। এর পরিবর্তে সবসময় তাকে একটা মোটরবাইক নিয়ে উড়তে দেখা গেছে। তার পূর্ব মালিক অবশ্য হ্যাগ্রিড ছিল না। তাকে এই উড়ন্ত মোটরবাইক উপহার দিয়েছিলেন সিরিয়াস ব্ল্যাক।
কারও যদি হ্যাগ্রিডকে ব্রুমস্টিকে উড়তে দেখার শখ হয়, তবে সে ‘লেগো হ্যারি পটার; ইয়ারস ১-৪’ গেমে তার ক্যারেক্টারটা আনলক করে দেখতে পারে। একমাত্র ওখানেই বায়ু ফুঁড়ে হ্যাগ্রিডকে উড়তে দেখা গেছে।
বয়োজ্যেষ্ঠ হ্যাগ্রিড
জাদুকরদের বয়সের বাড় মাগলদের তুলনায় একটু ধীরেই হয়। সাধারণ জাদুকরেরা মাগলদের থেকে বেশি বছর বেঁচে থাকে। অ্যালবাস ডাম্বলডোর ১১৫ বছর, আরমান্ডো ডিপেট ৩৫৫ বছর, মিনেরভা ম্যাকগোনাগল ১২৭ বছর (এখনো জীবিত), নিউট স্ক্যামান্ডার ১১৯ বছর পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। ১৯২৮ সালে জন্মগ্রহণ করেছিল রুবিয়াস হ্যাগ্রিড। সে হিসেবে জাদু জগতের দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল, প্রায় ৭০-এর কাছাকাছি। ২০২১ সাল অনুযায়ী তার বয়স বর্তমানে ৯৩ বছর!
সকল সিনেমায় উপস্থিতি
হ্যারি পটার লাইভ অ্যাকশন সিরিজে (ফ্যান্টাস্টিক বিস্টস সাগা বাদে) সিনেমা এসেছে মোট আটটি, যার মধ্যে মোট ১৪ জন অভিনেতাকে প্রথম থেকে শেষ সিনেমা পর্যন্ত রূপালি পর্দায় দেখা গিয়েছে। রোবি কোলট্রেন এই ১৪ জনের একজন। এর মধ্যে কোনো কোনো অভিনেতা আবার ভিন্ন সমস্যার পর্যবসিত হয়ে ছিটকে গিয়েছেন সিনেমা থেকে। যেমন, প্রথম দুই সিনেমায় অ্যালবাস ডাম্বলডোর চরিত্রে অভিনয় করার পর মারা যান অভিনেতা রিচার্ড হ্যারিস, ক্রিমিনাল চার্জের কারণে প্রোডাকশন হাউজ সরিয়ে দেয় ভিনসেন্ট ক্র্যাব চরিত্রে অভিনয় করা জেমি ওয়েলেটকে।
প্যাট্রোনাসের অপারগতা
দুঃখজনক হলেও সত্যি, হ্যাগ্রিড কখনো তার প্যাট্রোনাস কাস্ট করতে পারত না। এ বিষয়ে রোলিং এক টুইটে জানিয়েছেন,
“হ্যাগ্রিড কখনো নিজের প্যাট্রোনাস সৃষ্টি করতে পারেনি। এটা করা খুবই দুঃসাধ্য কাজ, এবং এর জন্য দুরূহ মন্ত্র উচ্চারণ করতে হয়।”
কিন্তু তাতে কী? এর ফলে তো হ্যাগ্রিডের প্রতি ভালোবাসায় কারও বিন্দুমাত্র ঘাটতি পড়েনি।
হাউজ গ্রিফিন্ডরের এই শিক্ষার্থী আনুগত্য, অনুবর্তন, একনিষ্ঠতার যে উদাহরণ দেখিয়ে গেছে, তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। হ্যারি পটারের পিতৃ-মাতৃহীন জীবনে হ্যাগ্রিডের আগমন ছিল নব সূর্যোদয়ের এক চিলতে আলোর মতো, যার মধ্য দিয়ে হ্যারির জীবনে সঞ্চার ঘটেছিল নতুন এক প্রাণের।