“সবার সব ক্ষমতা থাকে না। আবার প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু ক্ষমতা থাকে। গুণ থাকে। সেই গুণটার বিকাশ ঘটতে না দেওয়ার মানে হলো নিজের জীবনকে নিজেই অপমান করা। এ একধরনের আত্মহত্যা।”
নিজের গুণ, নিজের ভালো লাগা, কিংবা নিজের প্রতিভার বিকাশ ও বহিঃপ্রকাশ ঘটতে না দেয়া যদি আত্মহত্যার শামিল হয়, তাহলে প্রতিদিন জগৎজুড়ে কী পরিমাণ নীরব আত্মহত্যার ঘটনাই যে ঘটে চলেছে, তার তল পাওয়া মুশকিল হয়ে যাবে।
কিন্তু মজার, কিংবা গভীর আক্ষেপের বিষয় হলো, এ জাতীয় স্বপ্নের অপমৃত্যুর শিকার কারা তা চিন্তা করতে গেলে প্রথমেই আমাদের কল্পনায় ফুটে ওঠে কোনো কমবয়েসী যুবক-যুবতির মুখ, সমাজ-সংসারের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে যাকে নিজের স্বপ্নের জলাঞ্জলী দিতে হয়েছে, প্রিয় নেশাকে বিদায় বলে অন্য কোনো পেশাকে আলিঙ্গন করে নিতে হয়েছে।
খুব কমক্ষেত্রেই আমরা ভাবি, একই ধরনের স্বপ্নের অপমৃত্যুর অভিজ্ঞতা হতে পারে মধ্যবয়স্ক কোনো মানুষেরও, তা-ও আবার কোনো পুরুষের নয়, নারীর, যে কি না তার যৌবনের প্রায় পুরোটাই ব্যয় করেছে স্বামী-সন্তান নিয়ে সংসার ধর্ম পালন করতে গিয়ে। এমন নারীদের মননেও যে কোনো অবদমিত স্বপ্ন, অনাস্বাদিত আকাঙ্ক্ষার ঢেউ খেলে যায়, সে ব্যাপারেও কে-ই বা ভাবে! সারাটা জীবন হেঁশেল ঠেলে, ঘর সামলে ক্লান্ত, ভীষণ রকমের একাকিত্বে ভোগা নারীর মাঝেও যে প্রথম যৌবনের স্বপ্ন ও ভালো লাগা নতুন করে উঁকি দিয়ে যেতে পারে, তারও যে মধ্যবয়সে এসে জীবনটাকে নতুন করে শুরু করার ইচ্ছা জাগতে পারে, এ-ও তো আমাদের অনেকেরই কল্পনার বাইরে।
ঠিক এমনই এক নারীর স্বপ্ন, এবং সেই স্বপ্নের বিপরীতে ঘাপটি মেরে থাকা নিষ্ঠুর বাস্তবতার চিত্র ফুটে উঠেছে সুচিত্রা ভট্টাচার্যের ‘হেমন্তের পাখি’ উপন্যাসে।
উপন্যাসের শুরুতে আমরা দেখতে পাই মধ্য-চল্লিশের (৪৬ বছর) গৃহিণী অদিতি দুপুর বেলার নির্জন সময়ে খাঁচার টিয়াকে বুলি শেখানোর চেষ্টা চালায়। বারবার ব্যর্থ হয়। তারপরও হাল ছাড়ে না সে। কিন্তু কেন? কারণ সময় কাটাতে কিংবা একাকিত্ব দূর করতে আর কিছু যে করার নেই তার। দুই ছেলেকে মানুষ করতে, কিংবা তারও আগে যৌথ পরিবারে শ্বশুর-শ্বাশুড়ি, দেওর-ননদদের সকল চাহিদা মেটাতে সারাটা দিনই ব্যয় হতো তার। সেই সাথে স্বামীকে প্রতিটা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জিনিস এগিয়ে দিয়ে সাহায্য করা তো ছিলই। এখন ছেলেরা বড় হয়ে গেছে, স্বামীও আগের চেয়ে কম বৈ বেশি থাকে না বাসায়। তাই সকাল আর রাতেই কেবল স্বামী-ছেলেকে নিয়ে তাড়া থাকে তার। দুপুর কিংবা সন্ধ্যেটা এক অর্থে অখণ্ড অবসরই যেন তার জন্য।
অদিতির এমনই নিস্তরঙ্গ জীবনে একদিন হুট করে হাজির হন হেমেন্দ্র নারায়ণ মল্লিক নামের এক লেখক। সম্পর্কে অদিতির দুঃসম্পর্কের মামা হন তিনি। একসময় নিজেই অনেক লেখালেখির চেষ্টা করতেন। এখন সেসব ছেড়েছুড়ে পত্রিকা বের করার শখ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তার। আর সেই সূত্রেই হঠাৎ একদিন মনে পড়েছে তার অদিতির কথা; যে অদিতি একসময় বেশ গল্পটল্প লিখত। আবার যাতে অদিতি গল্প লিখতে শুরু করে, তার পত্রিকায় গল্প দেয়, সেই আবদার নিয়েই অদিতির কাছে ধর্না দেন তিনি।
শুরুতে অদিতির কাছে পুরো ব্যাপারটাই অবাস্তব মনে হয়। এতদিন পর আবার লেখালেখি শুরু করা যায় নাকি! পুরনো সেই প্রতিভায় যে মরচে পড়ে গেছে। কিংবা কালের প্রবাহে পলি পড়ে গেছে অদিতির লেখার হাতে। তাই সে লেখার বিন্দুমাত্র চেষ্টাটুকুও করে না। আর তার এই নিশ্চেষ্ট থাকা দেখেই শুরুর উক্তিটি করেন হেমেনমামা।
হেমেনমামার কথা জোর নাড়া দেয় অদিতিকে। একটু একটু করে সে আবিষ্কার করে, মনের অনুভূতি কাগজে-কলমে ফুটিয়ে তোলার যে সহজাত গুণ তার ছিল, সেটি এখনো হারিয়ে যায়নি। এখনো গল্পের ছলে জীবনের কাহিনী বলা তার পক্ষে খুবই সম্ভব। এই আত্মোপলব্ধির ফলে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করতে শুরু করে অদিতি। সে বুঝতে পারে, প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়সেও একেবারে ফুরিয়ে যায়নি সে, নিজের হৃদয়াবেগ নিংড়ে দিয়ে সৃজনশীলতার ডালি এখনো সাজাতে পারে।
শুরুতে স্বামী ও ছেলেরা অদিতির গল্প লিখতে শুরু করাকে নিছকই শখ কিংবা খেয়াল মনে করেছিল। তাই বিভিন্ন টীকা-টিপ্পনির পাশাপাশি খানিকটা ‘প্রশ্রয়’ও বুঝি তারা দিয়েছিল। ফলে প্রবল উৎসাহ নিয়ে একটি গল্প লিখে ছাপিয়েও ফেলে অদিতি, এবং সেই গল্প প্রচুর প্রশংসিতও হয়। সেই গল্পের ধারাবাহিকতায় আরো আরো লিখতে থাকে সে, নানাজনের থেকে লেখার আবদারও পেতে থাকে। ক্রমান্বয়ে ফ্ল্যাটবন্দি জীবন থেকে বের হয়ে এসে সে নিজের বৃত্ত বড় করতে থাকে, কারো মা কিংবা কারো স্ত্রীর পরিচয়ের বাইরেও একটি স্বতন্ত্র পরিচিতি গড়ে তুলতে থাকে।
আর এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য গড়ে তুলতে গিয়েই সূচনা ঘটে পরিবারের সদস্যদের সাথে দ্বন্দ্বের। সারাজীবন যাকে নিজেদের সম্পত্তি, নিজেদের ‘বাঁদি’ ব্যতীত আর কিছু বলে ভাবার অবকাশ পায়নি, সেই মানুষটির নবপরিচয়ে উত্থান কি এত সহজে মেনে নেয়া সম্ভব! তাই তো খুব সূক্ষ্মভাবে সৃষ্ট দ্বন্দ্বটা একপর্যায়ে স্থূল থেকে স্থূলতর হয়ে ওঠে, এবং অদিতিকে নতুন করে সম্মুখীন হতে হয় অস্তিত্ব সঙ্কটের। ২৩ বছরের বিবাহিত জীবনের শুরু থেকেই এই সঙ্কট তার সাথে হাত ধরাধরি করেই চলেছে বটে, তবে এতটা প্রকট কখনো হয়নি, কেননা এতদিন সে এগুলোকে দেখেও না দেখার ভান করে এসেছে। কিন্তু এখন যে তার জীবনের ক্রান্তিকাল। এই ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে কোন রাস্তা বেছে নেবে অদিতি? সে কি নিস্তরঙ্গ জলে ছুঁড়ে মারা ঢিলের মতো খানিকক্ষণ ঢেউ তুলেই থিতিয়ে যাবে, নাকি জন্ম দেবে প্রবল জলোচ্ছ্বাসের?
সুচিত্রা ভট্টাচার্যের লেখনীর সাথে যারা পূর্ব পরিচিত, তারা অবশ্যই জানেন, সমসাময়িক শহুরে প্রেক্ষাপটে জীবনের গল্প বলতে ঠিক কতটা সিদ্ধহস্ত ছিলেন তিনি। বাঙালি মধ্যবিত্ত, আটপৌরে নারীর জীবনকে যেভাবে আতস কাঁচের নিচে রেখে তিনি দেখতেন এবং সেই দেখার প্রতিফলন তিনি ঘটাতেন নিজের লেখনীতে, তার কোনো তুলনা হয় না। আবার এমনটিও ভেবে নিতে অসুবিধা হয় না যে, অনেক গল্পের রসদ তিনি জোগাড় করতেন নিজের জীবন থেকেই।
সুচিত্রা ভট্টাচার্য তার লেখনীর মাধ্যমে অকপটে তুলে ধরতেন নারীর জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষা-কামনা-বাসনার কথা, তাদের জীবনবোধের এপিঠ-ওপিঠ। সংসারের টানাপড়েন, দাম্পত্য সংকট ও সম্ভাবনা, নারীর সামাজিক অবস্থান, নারীর সঙ্গে নারীর শত্রুতা-মিত্রতা ও সামগ্রিক সম্পর্ক ইত্যাদি দারুণভাবে ফুটে উঠতো তার রচনায়। বাংলা সাহিত্যে নারীকেন্দ্রিক উপন্যাসের হয়তো অভাব নেই, কিন্তু সেসবের অধিকাংশই সৃষ্টি হয়েছে পুরুষ লেখকদের কলমে। তাই সেগুলো নারীমনের উপরিতলকেই কেবল ছুঁয়ে যেতে পেরেছে, পারেনি নারীমনের অতল গহীনে অবগাহন করতে। এই জায়গাটিতে সবচেয়ে বেশি সফল সুচিত্রা ভট্টাচার্য। তার মতো করে শহুরে, মধ্যবিত্ত নারীর মনের সব না-বলা কথা আর কে-ই বা বলতে পেরেছে!
যে কয়টি উপন্যাসে এই কাজটি সবচেয়ে বেশি সফলতার সাথে করতে পেরেছেন সুচিত্রা ভট্টাচার্য, তার মধ্যে তালিকার একদম উপরের দিকেই থাকবে ‘হেমন্তের পাখি’। সরাসরি নারীবাদ কিংবা পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার কথা উল্লেখ না করেও, যে প্রামাণ্য চিত্রকল্প তিনি এ উপন্যাসে এঁকেছেন তাতে ঐ দুটি পরিভাষার প্রসঙ্গ বুঝে নিতে বেগ পেতে হয় না।
তিনি দেখিয়েছেন, অদিতির স্বামী সুপ্রতিম কীভাবে কথায় কথায় অদিতিকে খোঁচা দেয় যে, সে নাকি অলস, সারাদিন বাড়িতে শুয়ে-বসেই কাটায়। অর্থাৎ সংসার চালানোতে অদিতির যে অশেষ অবদান, সেটি সুপ্রতিমের চোখে পড়ে না। আবার সেই সুপ্রতিমেরই চেহারা বদলে যায়, যখন অদিতি গল্প লেখাকে নিজের ধ্যান-জ্ঞানে পরিণত করে ফেলে। তখন আবার তার কাছে মনে হয় অদিতি বাড়াবাড়ি করছে, বিবাহিত নারীর যে মাত্রাজ্ঞান থাকা দরকার সেটি সে লঙ্ঘন করছে। আবার এই সুপ্রতিমই গোটা ২৩টি বছর ভালোমানুষির মুখোশ পরে থাকার পর মুখোশের অন্তরালের বীভৎস চিত্রটা উন্মোচিত করে ফেলে, যখন সে নিজের অহমিকা প্রতিষ্ঠিত করতে অদিতিকে টাকার খোঁটা দিতেও ছাড়ে না। তাই তো গভীর অভিমান নিয়ে অদিতি লিখতে বাধ্য হয়,
“সুপ্রতিম একশো ভাগ পুরুষ।”
এখানে যে পুরুষ বলতে কেবল লৈঙ্গিক পুরুষের কথা নয়, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ঝাণ্ডাধারী এক প্রতিনিধিকে বোঝানো হচ্ছে, সেটি বুঝে নেয়া যায় সহজেই।
অদিতির আরেক বোধোদয় আমরা দেখতে পাই পুরনো বন্ধু সুজাতার সাথে ক্ষণিকের আলাপচারিতা শেষে। স্বামীর মুখে বারবার নিজের অলসতা, অকর্মণ্যতা নিয়ে খোঁটা শুনে যাওয়া অদিতি মনে করত, কর্মজীবী নারীরা হয়তো ভালো আছে, নিজেদের ব্যক্তিস্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদা বজায় রাখতে পারছে। কিন্তু তার সেই ধারণা ভেঙে খানখান হয়ে যায়, যখন সে জানতে পারে ওকালতি প্রাকটিস করে বলে সুজাতাকে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের কাছে কীভাবে অপদস্থ হতে হয়েছে, এবং একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে সেই পেশায় ইস্তফাও দিতে হয়েছে।
এই উপন্যাসের আরো একটি বড় জায়গা জুড়ে রয়েছে পৈতৃক সম্পত্তির প্রশ্নে অদিতির আপন ভাইয়ের কাছে ঠকে যাওয়া, কিংবা দুই ছেলেকে নিজ আদর্শ ও মূল্যবোধে মানুষ করতে পারার ব্যর্থতাও। বন্ধু ও বন্ধুপত্নীর বিবাহবিচ্ছেদের প্রাক্কালে সুপ্রতিমের যে ভূমিকা ছিল, কিংবা অফিসে দুর্নীতিবাজ উচ্চপদস্থদের দেখেও তার মুখ বুজে থাকা, এই বিষয়গুলোও যেন বিশাল বড় ধাক্কা হয়ে আসে অদিতির কাছে। সব মিলিয়ে নিজের লেখক সত্তাকে পুনঃআবিষ্কারের পাশাপাশি নিজের পারিপার্শ্বিক জগতটাকেও অদিতি নতুন রূপে আবিষ্কার করতে থাকে, যা তার মনোজগতেও ব্যাপক প্রভাব ফেলে যায়।
তবে অবশ্যই, অন্য সবকিছুকে ছাপিয়ে এই উপন্যাসে মুখ্য হয়ে দাঁড়ায় একজন মধ্য-চল্লিশের নারীর আত্মানুসন্ধান এবং নিজের অবদমিত স্বপ্নের বাস্তবায়ন। প্রথম যৌবনে যে স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটেছে, সংসারের জাঁতাকলে পিষ্ট বিবাহিতা নারীর পক্ষে কি এতদিন পর আবারো নতুন করে সেই স্বপ্ন দেখা ও তা পূরণের লক্ষ্যে পা বাড়ানো সম্ভব? যে পাখিকে খাঁচায় আটকে রেখে তার কথন-প্রবৃত্তিকে গলা টিপে মারা হয়েছে, অতর্কিত আঘাতে তার ডানা মেলে উড়বার সাধও কেড়ে নেয়া হয়েছে, হঠাৎ করে কি আদৌ তার মুখে বুলি ফোটানো সম্ভব? কিংবা খাঁচার বন্দিদশা থেকে মুক্ত করলেই কি আর সে ডানা মেলে আকাশে উড়তে পারবে?
এসব প্রশ্নের উত্তরের এক শৈল্পিক উপস্থাপনই যেন ঘটেছে ‘হেমন্তের পাখি’ উপন্যাসে। তবে সেই উত্তরগুলো ঠিক ঠিক পাওয়ার জন্য কেবল দৃশ্যমান দুটি চোখ দিয়েই উপন্যাসটি পড়লে হবে না, খুলে দিতে হবে আপনার মনের চোখকেও। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অনুভব করতে হবে উপন্যাসের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি অনুচ্ছেদ। বুঝতে হবে প্রতিটি উপমা, প্রতিটি রূপকালঙ্কার। তবেই কেবল অদিতির পাশাপাশি আপনারও সম্পন্ন হবে আত্মানুসন্ধানের এক অপূর্ব যাত্রা।
বইটি অনলাইনে কিনতে চাইলে ক্লিক করতে পারেন নিচের লিংকে-