
বাংলা ভাষার সাহিত্যিকরা বারবার ঘুরেফিরে তাদের লেখনীতে নিয়ে এসেছেন ভূত বা অশরীরী; সেটা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথই হোন বা হালের অনীশ দাশ অপু। প্রখ্যাত লেখকরা যেমন ভূতের গল্প লিখেছেন তাদের বর্ণময় সাহিত্যজীবনে, তেমনি তরুণ, সাহিত্যজগতে নব্য লেখকরা অনেক সময় ভূত বা হরর জাতীয় লেখার মাধ্যমে নিজেকে পরিচয় করিয়েছেন পাঠকদের সামনে। কখনো বিদেশী ভূত আমদানি হয়েছে আমাদের সাহিত্যে, আবার কখনো একেবারে আদি ও অকৃত্রিম দেশি ভূতেই মগ্ন হয়েছেন পাঠকরা।
ড্রাকুলা বা নেকড়েমানবের যেমন অহরহ দেখা মেলে বাংলা সাহিত্যে, তেমনিভাবে ব্রহ্মদৈত্য বা ডাকিনীরও বেশ আনাগোনা রয়েছে এখানে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথও ভূত নিয়ে লিখতে দ্বিধা করেননি, তার বেশকিছু ছোটগল্পে (গল্পগুচ্ছ) রয়েছে ভৌতিক আবহ, কোনোটাতে সরাসরি ভূতের আগমন ঘটেছে, আবার কোনোটাতে ভূত স্বয়ং উপস্থিত না থাকলেও পারিপার্শ্বিকতা ও গল্প বলার ঢংয়ের কারণে ভৌতিক আবহ তৈরি হয়েছে। তবে রবীন্দ্রনাথের ভূতগুলো যে গতানুগতিক ভয়ংকর দর্শন, কিম্ভূতকিমাকার তা কিন্তু মোটেই নয়। তিনি ভয়মাখানো ভাষায় ভূতকে বর্ণনা করেননি, তার চরিত্ররা ভূতের চেহারা দেখে অজ্ঞান হয়ে যায়নি। অনেকক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে অশরীরীকে উপস্থাপন করেছেন রবীন্দ্রনাথ। এদিক দিয়ে রবীন্দ্রনাথ একটু ফাঁক রেখেছেন, তিনি এমনভাবে তার ভৌতিক গল্পগুলো সৃষ্টি করেছেন যাতে করে সেই গল্পগুলোকে মনস্তাত্ত্বিক গল্প হিসেবেও চালিয়ে দেওয়া যায়। মানে পাঠক চেষ্টা করলে গল্পের পেছনে একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে ভূতকে হেসে উড়িয়ে দিতে পারেন। এখানেই রবীন্দ্রনাথের মুন্সিয়ানা।

রবীন্দ্রনাথকে আমরা কীভাবে চিনি? তার অসাধারণ সৃষ্টিকর্মের জন্য। কিন্তু সেই সৃষ্টিতেও তো অনেক ভাগ রয়েছে। পাঠক কি তাকে চেনে তার উপন্যাসের জন্য, গানের জন্য, নাটকের জন্য নাকি চিত্রকর্মের জন্য? নাকি তিনি শুধু আমাদের জাতীয় সংগীত রচয়িতা একজন বিদেশী লেখকমাত্র? এই পরিচয়ের সংজ্ঞা পাঠকভেদে ভিন্ন, যে পাঠক তাকে যেভাবে দেখেছেন, তার কাছে রবীন্দ্রনাথ সেই পরিচয়ে উদ্ভাসিত।
যিনি রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসে মজেছেন, তার কাছে রবীন্দ্রনাথের মূল পরিচয় তিনি একজন শক্তিশালী ঔপন্যাসিক। আবার যিনি রবীন্দ্র সংগীতে মগ্ন, তিনি তাকে দেখেন বাংলা সংগীতজগতের আক্ষরিক অর্থেই একটি রবি হিসেবে। রবীন্দ্রনাথ ছোটগল্প লিখেছেন অনেক, বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্পের ভান্ডার তার হাত ধরেই ভরে উঠতে শুরু করে, তিনিই এই ভান্ডারটি সমৃদ্ধ করেছেন, রেখে গেছেন তার উত্তরসূরি ছোটগল্প লেখকদের জন্য একটি রূপরেখা। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ একজন সার্থক ছোটগল্পকারও বটে। তার ছোটগল্প বৈচিত্র্যে ভরপুর। এখানে যেমন আছে কলকাতার বাবুসমাজের প্রতিনিধি, তেমনি আছে জমিদারের অত্যাচারে বিপর্যস্ত খেটে খাওয়া বাংলাদেশের গ্রামীণ কৃষক।
প্রেমকে নানারূপে তুলে ধরেছেন রবীন্দ্রনাথ। ‘অপরিচিতা’র অনুপমের মতো যেমন ব্যর্থ প্রেমিক আছে, তেমনি আছে ‘সমাপ্তি’র অপূর্বের মতো সফল প্রেমিক। তরুণ-তরুণীর প্রেমের ছবি যেমন এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ, তেমনি বলেছেন প্রৌঢ় পোস্টমাস্টার আর বালিকা রতনের স্নেহময় ভালোবাসার গল্প। যৌতুকের মতো সামাজিক সমস্যা নিয়েও লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ, বাদ দেননি গুপ্তধনের মতো বহুল চর্চিত সাহিত্য উপাদানও। সুতরাং, সমাজের সব স্তরে, মানব মনের অন্দরমহলের প্রতিটি কোনায় বিচরণ করা রবীন্দ্রনাথ কেনই বা বাদ দেবেন ভূত, প্রেত, অলৌকিকতা বা অশরীরীকে?

আরেকটি কথা হলো, রবীন্দ্রনাথ তার জীবনে অনেকবার প্ল্যানচেট করে ভূত নামিয়েছেন বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে প্রেতচর্চার বিরুদ্ধে কোনো বাঁধা ছিল না। কিশোর রবীন্দ্রনাথ প্ল্যানচেট করে মাইকেল মধুসূদন দত্তের সাথেও কথা বলেছেন। সুতরাং, ভূত, প্রেত, অশরীরী এসব নিয়ে রবীন্দ্রনাথের বেশ আগ্রহ আর অভিজ্ঞতা দুটোই ছিল বলা যায়। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের সংকলন ‘গল্পগুচ্ছ’-এর প্রায় পাঁচটি গল্প ভৌতিক আবহে রচিত। সেগুলো নিয়েই কথা বলা হবে আজ।
কঙ্কাল: ফাল্গুন, ১২৯৮
পঞ্চম শ্রেণীর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার কেন্দ্র পড়েছিল একটা হাই স্কুলে। আমাদের সময় একদিনে দুটো করে পরীক্ষা হতো: সকালে একটা, বিকেলে একটা; দুপুরে খাওয়ার জন্য কিছুক্ষণ বিরতি। খাওয়ার পর হাতে অনেক সময় রয়ে যেত, কিছু করার থাকত না। কারণ, পরীক্ষার ঠিক আগ মুহূর্তে বইয়ে চোখমুখ, নাক-কান গুঁজে একটু ভালো রেজাল্টের জন্য শেষবারের মতো প্রাণান্ত চেষ্টা করার প্রবণতা তখনো আমাদের মাঝে শুরু হয়নি। আমরা তখন এতটাই ভালো ও মনোযোগী স্টুডেন্ট ছিলাম যে পরীক্ষার আগের রাতেই আমাদের পুরো সিলেবাস শেষ হয়ে যেত। তো দুপুরের ওই ফাঁকা সময়টাতে আমরা দলবেঁধে পুরো স্কুলটা ঘুরে বেড়াতাম।
একদিন এরকম সারা স্কুলে পাক খাওয়ার সময় কেউ একজন আবিষ্কার করল, তেতলার একটা ঘরে একটা সাক্ষাৎ নরকঙ্কাল পাওয়া গেছে। ব্যাস, আমাদের আর পায় কে। সবাই হুড়মুড়িয়ে উঠল সেই কঙ্কালটা দেখার জন্য। কিন্তু তার জন্যেও একটু পরিশ্রম করা আবশ্যক, আর একটু সাহসও লাগবে। কারণ, কংকালটা দেখার একমাত্র উপায় হলো তেতলার কার্নিশ বেয়ে ভবনের পেছন দিকের জানালা দিয়ে দেখা। অনেকবার যাব কী যাব না ভাবতে ভাবতে অবশেষে বহুকষ্টে সাহস সঞ্চয় করে কার্নিশে চড়ে বসলাম। দেয়ালে মুখ, বুক ঠেকিয়ে অনেক কষ্টসাধ্য করার পর অবশেষে সেই ‘গিরি লঙ্ঘন’ সম্ভব হলো। জানালার গ্রিল ধরে দেখলাম, বিপরীত দেয়ালে দরজার কাছে একটা এক মানুষ সমান কঙ্কাল দাঁড়িয়ে আছে। সেই প্রথম আমার কঙ্কাল দেখা। আরও অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম, কঙ্কালটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে! ভালোমতো চেয়ে দেখি, কঙ্কালের মুখের গর্তে একটা চক ঢোকানো, নিশ্চয় কোনো বিচ্ছু ছোকরার কাজ। দূর থেকে দেখে সিগারেটের মতো মনে হয়েছিল। তখন হঠাৎ আমার মনে একটা প্রশ্ন জাগল, আচ্ছা এটা যার কঙ্কাল সেই ব্যাক্তি কি জীবিতকালে ধূমপান করতেন!

রবীন্দ্রনাথের ‘কঙ্কাল’ ছোটগল্পটি একটি কঙ্কালের জীবিতকালের গল্প। প্রত্যেকটা কঙ্কালই একসময় আমাদের মতো মানুষ ছিল, তার একটি জীবনপ্রবাহ ছিল, আর সেই প্রবাহে সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা সব মিলেমিশে একাকার হয়ে ছিল। একজন চিকিৎসক বা চিকিৎসাবিদ্যার একজন শিক্ষার্থী যখন একটি নরকঙ্কাল নিয়ে কাজ করেন, তিনি কি কখনো সেই কঙ্কালের অতীত নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন, জীবিতকালের চিত্ররূপ কল্পনা করার প্রয়াস করেন? রবীন্দ্রনাথ সেটা করেছেন, আর তা ফুটিয়ে তুলেছেন এক আত্মরতিতে (নার্সিসিজম) ভোগা তরুণীর ব্যর্থ প্রেমের গল্প দিয়ে।
‘কঙ্কাল’ গল্পে আত্মমুগ্ধতায় বিহ্বল এক রূপবতী যুবতীর জীবনের আক্ষেপ বর্ণিত হয়েছে। গল্পটি উত্তম পুরুষে লেখা। গল্পকথকের বাড়িতে একসময় একটি নরকঙ্কাল ছিল এবং তিনি সেই কঙ্কালের সাহায্যে অস্থিবিদ্যা শিখতেন। কালের আবর্তনে কঙ্কালটি বাড়ি থেকে হারিয়ে যায় আর স্বাভাবিকভাবে কথকও কঙ্কালের অস্তিত্বের কথা ধীরে ধীরে ভুলে যান। কিন্তু একদিন কোনো কারণে কথককে বাধ্য হয়ে একসময়ে কঙ্কালের আবাসস্থল সেই ঘরে রাতের বেলা ঘুমাতে হয়। অন্ধকার ঘরে শুয়ে কথক ঘরের ভেতর দ্বিতীয় কারো উপস্থিতি অনুভব করেন। ভীতসন্ত্রস্ত কথক যখন সেই আগন্তকের উদ্দেশ্যে ‘কে’ বলে প্রশ্ন করেন তখন উত্তর ভেসে আসে, ‘আমি। আমার সেই কঙ্কালটা কোথায় গেছে তাই খুঁজিতে আসিয়াছি’।
গল্পের পরের অংশে দেখা যায় সেই আগন্তুক প্রেত রমণী নিজের জীবিতকালের ব্যর্থ প্রেমের আক্ষেপ ভরা কাহিনী জানাচ্ছেন কথককে। অসামান্য সুন্দরী হওয়ায় তার নিজের রূপের জন্য অহংকার ছিল, নিজেকে নিজেই ভালোবেসে ছিলেন তিনি। সমস্ত পুরুষজাতি তার রূপে মুগ্ধ হয়ে তার প্রেমে মাতাল হয়ে আছে এই ধারণা যখন সেই সুন্দরীর মনে বদ্ধমূল হলো তখনই তিনি প্রেমে পড়লেন এক ডাক্তারের। কিন্তু সেই ডাক্তারই যখন এই নারীর নীরব প্রেমের নাড়ীনক্ষত্র ধরতে না পেরে অন্যত্র বিয়ে করার আয়োজন করলেন, তখন ব্যর্থ প্রেমিকা নিজের হাতে প্রেমিককে বিষপানে খুন করেন এবং সাথে সাথে নিজেও আত্মহত্যা করেন।
গল্পটিতে ভয়ের চেয়ে বেদনাবোধই বেশি ফুটে উঠেছে।
জীবিত ও মৃত: শ্রাবণ, ১২৯৯
কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল, সে মরে নাই।
এই বিখ্যাত লাইনটি রবীন্দ্রনাথের ‘জীবিত ও মৃত’ গল্পের অংশ। এই গল্পটিকে একেবারে চিরায়ত ভূতের গল্প বলা চলে না। কারণ এখানে সরাসরি কোনো ভৌতিক চরিত্র নয়, বরং মানুষের মনের অবচেতনে লুকিয়ে থাকা ভূতটিকে তুলে এনেছেন রবীন্দ্রনাথ। গল্পের মূল চরিত্র কাদম্বিনীকে মৃত ভেবে সবাই তার উপস্থিতিকে ভৌতিক হিসেবে ধরে নেয়, আর তা সহ্য করতে না পেরে অবশেষে কাদম্বিনীকে পুনরায় মরে গিয়ে প্রমাণ করতে হয় যে সে আসলে মরেনি।
কোনো অজানা কারণে জমিদার বাড়ির বিধবা বউ কাদম্বিনীর হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গেলে তাকে মৃত ভেবে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয় দাহ করানোর জন্য। অন্ধকার শ্মশানে যখন সৎকার কার্য শুরু করার জন্য মৃতদেহের সাথের লোকেরা অপেক্ষা করছিল এমন সময় কাদম্বিনী পুনরায় জেগে ওঠে। শ্মশানের অন্ধকার ঘরে ঘটা এরকম অবিশ্বাস্য ঘটনায় ভয় পেয়ে মৃতদেহে ফেলে রেখে শ্মশান ত্যাগ করে লোকজন চলে যায় আর প্রচার করে কাদম্বিনীর সৎকার কাজ যথোচিতভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
এদিকে অভাগী কাদম্বিনী রাতের অন্ধকারে শ্মশানঘাট ত্যাগ করে সারারাত হেঁটে তার এক বাল্যকালের সখীর বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হয়। সেখানে আপাত নির্বিঘ্ন জীবনযাপন করলেও একসময় যখন বান্ধবীর স্বামী খোঁজ নিয়ে জানতে পারে কাদম্বিনী সমাজের চোখে অনেক আগেই মৃত, তখন স্বভাবতই তারা ধরে নেয় মৃত কাদম্বিনী দুনিয়ার মায়া এখনো ত্যাগ করতে না পেরে প্রেতাত্মা হয়ে তাদের সাথে বাস করছে।
বাল্যকালের প্রিয় বান্ধবীর কাছেও যখন কাদম্বিনী ভূত হিসেবে পরিগণিত হলো তখন তার আর কোথাও যাওয়ার স্থান রইল না। কারণ সমাজ ততদিনে জেনে গেছে কাদম্বিনী মৃত্যু হয়েছে, সুতরাং এই সমাজের যে অংশেই কাদম্বিনী যাক না কেন তার আর কোথাও ঠাঁই হবে না। ‘মানুষ ভূতকে ভয় করে, ভূতও মানুষকে ভয় করে, মৃত্যুনদীর দুই পারে দুইজনের বাস’, আর এই দুইয়ের মাঝে কাদম্বিনীর অবস্থান। সুতরাং না পারছে সে নিজেকে প্রেতলোকে সমর্পণ করতে, না পারছে সমাজে নিজের জীবিত সত্তাকে প্রমাণ করতে।
অবশেষে অনেক দ্বিধাগ্রস্ত, নিজের অস্তিত্ব নিয়ে বিভ্রান্ত কাদম্বিনী পুনরায় সবার চোখ এড়িয়ে নিজের বাড়িতে পৌঁছলো, হয়তো ভেবেছিল নিজের আত্মীয় পরিজন তাকে বিশ্বাস করবে, তার অস্তিত্বকে মনে নেবে। কিন্তু বিধি বাম! মানুষ সামাজিক জীব, তাই সমাজের প্রতিষ্ঠিত সত্যকেই সে-ই সর্বাগ্রে মান্য করে, অনেক সময় সেই সত্যের ভেতরে সত্যকে খোঁজার প্রয়োজনীয়তা মোটেই বোধ করে না। অবশেষে, নিজের শয়নঘরে গিয়েও যখন কাদম্বিনী নিতান্ত আশ্রয়টুকু পেল না, তখন মৃত্যুর মতো অমোঘ সত্যকে অবলম্বন করেই তাকে নতুন একটা সত্য প্রতিষ্ঠা করতে হলো। কাদম্বিনী নিজেকে মেরে প্রমাণ করে ছাড়ল যে সে আসলে মরেনি।
ক্ষুধিত পাষাণ: শ্রাবণ, ১৩০২
পাহাড়ের গা ঘেঁষে বিরাজমান, আপাত পরিত্যক্ত কোনো রাজপ্রাসাদ যদি গল্পের মূল উপজীব্য হয় তবে সেই প্রাসাদে ভূত থাকবে, সেটা একেবারে অস্বাভাবিক কিছু নয়। আর যখন রবীন্দ্রনাথ এরকম ভৌতিক প্রাসাদ নিয়ে কিছু লিখবেন, সেখানে অতি অবশ্যই পাঠক ভিন্ন স্বাদের ভূতের গন্ধ পাবেন।
‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পে একটি প্রাচীন রাজপ্রাসাদের অশরীরী আচরণকে রবীন্দ্রনাথ উত্তম পুরুষের বয়ানে বর্ণনা করেছেন। রাজপ্রাসাদের ভূতগুলোর সাধারণত একটা রূপ থাকে। মোদ্দা কথা, যেকোনো বাস্তুভূতেরই একটা না একটা রূপ থাকবে, আর সেই রূপ ধরে মাঝে মাঝে বাড়ির সদস্যদের জ্বালিয়ে মারবে, এটাই নিয়ম। হলিউডের হরর সিনেমাগুলোর কল্যাণে আমরা এই জাতীয় ভূতের সাথে আজকাল বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছি। কিন্তু আজ থেকে প্রায় একশ কুড়ি বছর আগে রবীন্দ্রনাথ ব্যাপারটাকে একটু ভিন্নভাবে, রবীন্দ্রসদৃশভাবেই ভেবেছেন। তিনি আলাদা কোনো ভূত বা প্রেতাত্মাকে পুরো প্রাসাদে একটি স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে জাঁকিয়ে বসাননি, বরং সেই অশরীরীকে প্রাসাদের সাথেই একসাথে করে দিয়েছেন। মানে সমগ্র প্রাসাদটিই আগাগোড়া একটি প্রেতাত্মা হয়ে উঠেছে।

গল্পটিতে ভারতবর্ষের বরীচ নামক স্থানে দ্বিতীয় শা-মামুদের তৈরি নদীর ধারের একটি শ্বেতপ্রাসাদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যে ‘প্রাসাদের প্রত্যেক প্রস্তরখন্ড ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত হইয়া আছে, সজীব মানুষ পাইলে তাকে লালায়িত পিশাচীর মতো খাইয়া ফেলিতে চায়’। প্রাসাদের পুরনো পাপের ফলে জমা অভিশাপই পুরো প্রাসাদটিকে একটি জীবন্ত অতৃপ্ত প্রেতে পরিণত করেছে, আর এই অশরীরীর হাত থেকে বেঁচে ফেরার দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা উত্তম পুরুষে বর্ণনা করেছেন গল্পকথক।
মণিহারা: অগ্রহায়ণ, ১৩০৫
রবীন্দ্রনাথের বেশ কয়েকটি ভূতের গল্পের কাহিনী গল্পের ভেতর আরেকজন গল্পকথক নিজের মুখ দিয়ে উত্তম পুরুষে পাঠকদের শুনিয়েছেন। ‘মণিহারা’ গল্পটিও সেরকমই একজন তৃতীয় পুরুষের জবানিতে উত্তম পুরুষে বর্ণিত। এই গল্পটির একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি গল্পের ভেতর আরেকটি গল্প। তার উপর শেষের দিকে এসে পাঠক একটি ছোটোখাট ধাক্কাও খেতে পারেন। এসব কথায় না যাই, পাঠক বরং গল্পটি পড়ে নিজেই যাচাই করে দেখবেন।
গল্পটি ফণিভূষণ সাহা নামক এক শিক্ষিত ধনী ও তার সুন্দরী স্ত্রী মণিমালিকাকে নিয়ে। ফণিভূষণ পৈতৃক সূত্রে ধনী, ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত আধুনিক বাঙালি, গল্পের ভাষায় ‘নব্যবঙ্গ’। কিন্তু নিজের বিবাহিত জীবনে তিনি কখনো পুরুষতান্ত্রিকতা ফলাতে পারেননি। তাকে সবসময় বিনাতর্কে স্ত্রীর আবদার মেটাতে হয়েছিল। ফণিভূষণ স্ত্রীকে প্রচন্ড ভালোবাসতেন। ফলে কালে কালে স্ত্রী তার মাথায় উঠে বসল। অবস্থা এমন হলো যে, নিজের ব্যবসা রক্ষার জন্য যখন স্ত্রীর গয়না বন্ধক দেওয়া নিতান্ত প্রয়োজন হয়ে উঠলো, তখনও ফণিভূষণ জোর গলায় তা স্ত্রীর কাছে দাবি করতে পারলেন না। ফলে ব্যবসা বাঁচানোর জন্য হতভাগা স্বামীকে কলকাতায় গিয়ে টাকা সংগ্রহের চেষ্টা করতে হলো।
এদিকে নারী মাত্রই গয়না নিয়ে বিশেষ সতর্ক। এই তত্ত্বের অনুসারী স্ত্রী মণিমালিকার মনে হলো, তার গয়না বুঝি এবার গেলো। স্বামীর নজর থেকে নিজের জীবনের চেয়েও প্রিয় বাহুমূল্য গয়নাগুলো বাঁচানোর জন্য মণিমালিকা নিজের বাপের বাড়িতে রওনা দিল। কিন্তু নদীপথে যাওয়ার সময় সেই যে গহনাসহ মণিমালিকা কোথায় হারিয়ে গেলো তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না।
আবারও সেই চিরাচরিত অতৃপ্ত আত্মার গল্প, যে কি না ইহজগতের মায়া ত্যাগ না করতে পেরে বারবার ফিরে আসে। মণিমালিকা যে অতৃপ্তি নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছিল তাতে হয়তো তার মুক্তি মেলেনি। আবারও রবীন্দ্রনাথ কঙ্কাল নিয়ে এলেন তার গল্পে। স্ত্রী বিয়োগের দুঃখভারাক্রান্ত ফণিভূষণ একদিন ঘুমের মধ্যে অলংকার পরিহিত কঙ্কালের হাঁটার শব্দ শুনতে পেয়ে ঘুম থেকে জেগে ওঠেন। ব্যাস, এরপরই নিয়মিত ঘরের আশপাশে তিনি এই বিদঘুটে শব্দ শুনতে পেলেন। কঙ্কালের হাড়ের খটখট শব্দের সাথে সোনার অলংকারের নিক্কণ; এই সংমিশ্রিত শিঞ্জিত শব্দমালা ফণিভূষণকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিল। ঘুমন্ত অবস্থায় একদিন ফণিভূষণ নিজেকে আবিষ্কার করলেন নদীর ঘাটে, যে নদীতে মণিমালিকা তার প্রাণপ্রিয় অলংকারসমেত ডুবে মরেছিলেন। ফণিভূষণও আর নদী থেকে কোনোদিন উঠে আসেননি।
মূল ভূতের গল্প এখানেই শেষ। কিন্তু এরপরে সমাপ্তিতে গিয়ে পুরো ব্যাপারটি পাঠকের কাছে গোলমেলে ঠেকতে পারে। গল্পটির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, পাঠক ইচ্ছে করলে এর একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারেন। কারণ ঘুমের মধ্যে হাঁটা ব্যাপারটি যেমন বিজ্ঞান ব্যাখ্যা করতে পারে, তেমনিভাবে প্রিয়জনের মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে নিরবচ্ছিন্ন চিন্তা করলে তার একটি প্রভাব মনের ভেতর তৈরি হতেই পারে। এটিও নিতান্ত অবৈজ্ঞানিক, আজগুবি কিছু নয়।
মাস্টারমশায়: আষাঢ়-শ্রাবণ, ১৩১৪
‘মাস্টারমশায়’ একটি থ্রিলারধর্মী ভৌতিক গল্প। কলকাতার বাবুসমাজের প্রতিনিধি বনাম মধ্যবিত্ত কেরানী- এই দুয়ের সম্পর্কের ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে গল্পটি এগিয়েছে। দারিদ্র্যের কষাঘাতে জীর্ণ হরলাল কলকাতায় নিজের পড়ালেখার খরচ চালানোর জন্য টিউশন খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে ধনী অধর মজুমদারের একমাত্র ছেলে বেণুগোপালকে পড়ানোর কাজ পায়। এখান থেকেই গল্পের শুরু। হরলালের সাথে ধীরে ধীরে বেণুর দারুণ খাতির জমে ওঠে, শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কের চেয়েও তাদের দুজনের সম্পর্ক বন্ধুর মতো হয়ে যায়। কিন্তু এই সুখ বেশিদিন সয় না। অধরবাবুর বাড়িতে হঠাৎ চুরি হয় আর গৃহস্বামী পরোক্ষভাবে হরলালকেও সন্দেহ করেন। ক্ষুব্ধ, অপমানিত হরলাল কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে যায়, মাস্টার-ছাত্রের অসাধারণ স্নেহময় সম্পর্কের সমাপ্তি ঘটে এখানেই।
এরপর বেশ কয়েক বছর কেটে যায়। বেণুগোপাল ধীরে ধীরে যুবক হয়ে ওঠে, এদিকে হরলালও এক ইংরেজ ব্যাবসায়ীর দপ্তরে নতুন কাজ জুটিয়ে নেয়। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে হর আর বেণুর সম্পর্ক এখানেই চিরতরে শেষ। কিন্তু হরলালের মায়ের অনুরোধে একদিন নিমন্ত্রণ রক্ষার জন্য বেণুগোপালকে আবার হরলালের ঘরে আসতে হয়। আবারও গুরু-শিষ্যের মিলন ঘটে।
এদিকে বেণুর বাবা অধরবাবু তার প্রথমপক্ষের স্ত্রী বিয়োগের পর পুনরায় বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন। মনঃক্ষুন্ন বেণু বিলেত চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। মৃত মায়ের গয়নাগুলো হরলালের কাছে জমা রেখে হরলালের অগোচরে তার ঘর থেকে অফিসের তিন হাজার টাকা নিয়ে সকলের অজ্ঞাতসারে বেণু একদিন বিলেতের জাহাজে চেপে বসে। এবার নিজের ছাত্রের কাছ থেকে প্রতারণার শিকার হয় হরলাল। তার সাজানো-গোছানো সুন্দর ছিমছাম কেরানী জীবন এক ধাক্কায় ধ্বংস হয়ে যায়। পরাজিত, বিপর্যস্ত, হতাশ হরলাল কলকাতার রাস্তায় একটি ঘোড়ার গাড়িতে চড়া অবস্থায় গাড়ির ভেতর মৃত্যুবরণ করে।
এরপর থেকে সেই গাড়িটিতে রাতের বেলা কোনো যাত্রী একা আরোহন করলে অশরীরী কিছুর অস্তিত্ব অনুভব করে।

এই গল্পটিতে আগাগোড়া ভূতের অস্তিত্ব নেই। পুরো গল্পটিই মূলত সমাজের রাস্তায় চলতে গিয়ে বারবার হোঁচট খাওয়া মধ্যবিত্ত হরলালের ব্যর্থতার গল্প, এখানে চিরায়ত ভূতের কোনো স্থান নেই৷ কিন্তু গল্পের সূচনাতেই রবিবাবু ভৌতিক আবহ সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং পাঠক সূচনা পড়েই বাকি গল্প পড়ার আগ্রহ পাবে। মূলত, ‘মাস্টারমশায়’ গল্পে ভূতের কান্ডকীর্তি নেই, বরং ভূত সৃষ্টি হওয়ার পেছনের ঘটনাই এখানে মূখ্য হয়ে উঠেছে। এক অতৃপ্ত মানব আত্মার অতৃপ্তির পেছনের গল্পই ‘মাস্টারমশায়’ গল্পের মূল উপজীব্য।
গল্পের পেছনের গল্প
রবীন্দ্রনাথ আড্ডা দেওয়ার সময়ও গল্প তৈরি করে ফেলতে পারতেন, এতটাই শক্তিশালী কল্পনাশক্তি ছিল তার। তার অনেকগুলো ভূতের গল্প নিজের জীবনের কিছু অভিজ্ঞতার ফলে সৃষ্টি হয়েছে, আবার কিছু গল্প নিজে বানিয়েছেন বন্ধুমহলে আড্ডা দেওয়ার সময় বন্ধুদের আবদার রক্ষার্থে। ‘কংকাল’ গল্পটির সূচনা অংশের সাথে এর সৃষ্টির পেছনের কারণের বেশ মিল আছে। রবীন্দ্রনাথের ছোটবেলার শোবারঘরে একটি কঙ্কাল ঝুলানো ছিল। ছোট হলেও সেরকম ভয় কখনো পাননি তিনি। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে বড় হয়ে। একদিন ঠাকুরবাড়িতে অতিথি এলে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় বাধ্য হয়েই বিবাহিত রবীন্দ্রনাথকে ছোটবেলার সেই কঙ্কালের ঘরে ঘুমাতে হয়। আর সেই রাতেই কবিগুরু নতুন এক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন। তাঁর ভাষায়, “শুয়ে চেয়ে দেখলুম, সেজের আলোটা ক্রমে কাঁপতে কাঁপতে নিবে গেল। আমার মাথায় বোধ হয় তখন রক্ত বোঁ বোঁ করে ঘুরছিল, আমার মনে হতে লাগল কে যেন মশারির চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে, বলছে ‘আমার কঙ্কালটা কোথায় গেল? আমার কঙ্কালটা কোথায় গেল?’ ক্রমে মনে হতে লাগল সে দেয়াল হাতড়ে হাতড়ে বন্ বন্ করে ঘুরতে আরম্ভ করছে। এই আমার মাথায় গল্প এসে গেল আর-কি।“
পাঠকের কাছে জীবনের কোনো মূহুর্তে এসে নিজেকে জীবিত থাকতেও মৃত বলে মনে হয়েছে? মানে যাকে বলে জীবন্মৃত আর কি? রবীন্দ্রনাথ কিন্তু একবার নিজেকে সতসত্যই মৃত বলে মনে করেছিলেন। একসময় কবির একটা অভ্যাস ছিল, ভোররাত্রে ঘুম থেকে উঠে অন্ধকার ছাদে ঘুরে বেড়ানো। তো একদিন ঘুম থেকে উঠে ছাদে যাওয়ার প্রয়াস করতেই টের পেলেন, ভোর তো দূরের কথা, তখন মাত্র গভীর রাত। রবীন্দ্রনাথ পুনরায় না ঘুমিয়ে সারা বাড়ি অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। মানে ঐ রাতদুপুরে নিকষ অন্ধকারের মধ্যে রবিবাবু পুরো জোড়াসাঁকোর বাড়িতে প্রেতাত্মার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন; “হঠাৎ মনে হলো আমি যেন প্রেতাত্মা, এ বাড়ি haunt করে বেড়াচ্ছি। আমি যেন মোটেই আমি নয়, আমির রূপ ধরে বেড়াচ্ছি মাত্র।” নিজের আমিত্ব নিয়ে এইরূপ সন্দেহের পরই রবীন্দ্রনাথের মাথায় ‘জীবিত ও মৃত’ গল্পের আইডিয়া এলো। ঠাকুরের উক্তিতে, “…সেই রাত্রে এই গল্পটা আমার মাথায় এল, যেন একজন কেউ দিশাহারা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেও মনে করছে অন্য সকলেও মনে করছে যে, সে সে নয়।“
আরেকটি সূত্রমতে, রবীন্দ্রনাথ বাল্যকালে তার আত্মীয় তারকনাথ অধিকারীর নিকট একটি সত্য ঘটনার বিবরণ শুনেছিলেন, যার অনেক অংশ ‘জীবিত ও মৃত’ গল্পের প্রথমাংশের সাথে মিলে যায়।
‘ক্ষুধিত পাষাণ’ এর গল্প কল্পলোক থেকে আমদানি হলেও রবির জীবনের সাথে এর কিছুটা যোগসূত্র আছে। বিলেতে যাওয়ার আগে রবীন্দ্রনাথকে কিছুকাল তার মেজদার সাথে আমেদাবাদে কাটাতে হয়েছিল। সেখানে তাকে থাকতে হয়েছিল শাহিবাগের এক বাদশাহি আমলের রাজবাড়িতে। সেই রাজবাড়িতে থাকাকালীনই প্রথমবারের মতো রবীন্দ্রনাথের মনের মধ্যে আভাস দিয়েছিল ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এর গল্প।
ব্রাহ্মসমাজের সুবাদে রবীন্দ্রনাথ ও কুচবিহারের মহারানী সুনীতি দেবীর বেশ সুসম্পর্ক ছিল। নানা আড্ডা, নিমন্ত্রণে তাদের প্রায়ই দেখাসাক্ষাৎ হতো। সুনীতি দেবী ভূতের গল্প শুনতে পছন্দ করতেন আর রবীন্দ্রনাথের কাছে গল্প শোনানোর আবদার করে বসতেন। একবার নাছোড়বান্দা রানীর এরকম ভূতের গল্প শোনার ইচ্ছাপূরণে রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করলেন ‘মণিমালিকা’ গল্পটি।
‘মাস্টারমশায়’ গল্পটিও কুচবিহারের মহারানীর মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথের কাল্পনিক সৃষ্টি। হরলাল ভাড়াটে ঘোড়ার গাড়িতে মৃত্যুবরণ করার পর থেকে পরবর্তী সময়ে সেই গাড়িটির রাত্রিকালীন যাত্রীরা প্রায়শই গাড়ির ভেতর একটি অশরীরী কিছুর অস্তিত্ব অনুভব করত, যাত্রীর কাছে মনে হতো গাড়ি সঠিক রাস্তায় না চলে ভুল পথে চলছে, গাড়োয়ান ঘোড়া থামাতে চাইলেও ঘোড়া থামছে না। রবীন্দ্রনাথ একটু বিস্তারিতভাবে, নিজের বাস্তব জীবনের সাথে মিলিয়ে, রংচং মেখে শুধু এই অংশটুকু বানিয়ে রানীকে শোনান। রানী অবশ্য এটুকু শুনেই গল্পটিকে সত্য বলে ঠাউরে নিয়ে রবীন্দ্রনাথকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘অ্যাঁ, সত্য নাকি?’। যাহোক, রবীন্দ্রনাথ পরে নতুন করে গল্পটি আবার লেখেন।