‘মেগান’ (২০২৩) বানানোর আগে পরিচালক জেরার্ড জনস্টোন, হররে তার স্বকীয় ছাপ প্রথম সিনেমা ‘হাউজবাউন্ড’ (২০১৪) দিয়েই রেখেছিলেন। হরর আর কমেডির বিপরীত এবং কঠিন সংযুক্তিটা এত চনমনেভাবে ক্র্যাক করেছেন তিনি, তাতে বোঝাই গিয়েছিল এই জনরায় আরো অনেক কিছু পাবার আছে তার কাছ থেকে। তার দ্বিতীয় সিনেমা ‘মেগান’ মুক্তি পেয়েছে সম্প্রতিই। তবে সবদিক থেকে এখনও এগিয়ে আছে প্রথম সিনেমা ‘হাউজবাউন্ড,’ যেটা একশব্দে ‘দুর্দান্ত’। নিউজিল্যান্ডীয় এই হরর-কমেডির গল্প অস্থিরচিত্ত তরুণী কাইলি বাকনেলকে ঘিরে। এটিএম বুথে চুরি করতে গিয়ে হাতে হাতকড়া পড়ে তার।
তবে তার মানসিক স্থিতি আর অতীত রেকর্ড পুনর্বিবেচনা করে কোর্ট তাকে ৮ মাস ঘরে বন্দী থাকার নির্দেশ দেয়; তার মায়ের সাথে, সৎবাবার সাথে, যাদের সাথে তার বনিবনাই হয় না। তার পক্ষে সেটাই সবচেয়ে বড় শাস্তি। ওদিকে, মায়ের বাড়ির সীমানা ছেড়েও যেতে পারবে না। রাখা হচ্ছে নজরদারী। এর মাঝে তার মা বলেন, তাদের ঘরটা ভুতুড়ে। প্রথমে মায়ের কথায় তেঁতে ওঠে কাইলি। তবে হাতে অফুরন্ত সময় পেয়ে বিরক্তি কাটাতেই হোক আর সত্যিই কৌতূহলী হয়ে হোক, কাইলি ব্যাপারটায় ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়তে থাকে। এবং তখনই আবিষ্কার ভয়ংকর কিছু বিষয়।
‘হাউজবাউন্ড’ হরর-কমেডির কোডটা বেশ মসৃণভাবে ক্র্যাক করতে পেরেছে, কারণ এই সিনেমা নিজের প্রকৃতি সম্বন্ধে পুরোপুরি সচেতন। এই সিনেমা জানে কী হতে যাচ্ছে। তাই তো একই সিনে ভয় জাগিয়ে, পরক্ষণেই আবার কোনো হাস্যরসের উপাদান রেখে নৈপুণ্যের সাথে আসল নির্যাস ধরে রেখেছে। অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত আর নুয়্যান্সে ভরা তার লেখনী। প্রত্যেকটা ভিজ্যুয়াল ডিটেইল আলাদাভাবে দৃষ্টিগোচর হয়। ভিজ্যুয়াল ভাষায় হয়তো অভিনবত্ব পাবেন না; সেটা সবসময় প্রয়োজনীয় না, যদি ইফেক্টিভনেস আর দক্ষতা দুটোই থাকে। এবং ওটাই এই সিনেমার ক্ষেত্রে খুব সহজাতভাবে ঘটেছে! সেট হিসেবে এই সিনেমা, বাড়িটাই পেয়েছে। কিন্তু কী তীক্ষ্ণ ভিশন আর নৈপুণ্যের সাথেই না প্রোডাকশন ডিজাইন করেছে। বাড়িটার সিমেট্রি, বেইজমেন্ট, প্রতিটি কর্ণারকেই হরর আর কমেডির জন্য একেকটা ভিজ্যুয়াল উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেছেন জনস্টোন। ওতেই তার উদ্ভাবনী টেকনিকগুলো লুকিয়ে।
প্রতিটি ফ্রেমের ব্লকিং আর কম্পোজিশন সুচিন্তিত আর নিখুঁত। একটি দৃশ্য আছে, যেখানে বেইজমেন্টে কাইলি, কাইলির মা আর কাইলির বন্ধু অপেক্ষায় ছিল ভূতের উপস্থিতি টের পেতে। সেখানে একেকজনের মুখের ড্রামাটিক ক্লোজ আপ দিয়ে সাসপেন্সকে একদম সর্বোচ্চ পারদে উঠতে দিয়ে পরক্ষণেই যেভাবে কমেডিক পাঞ্চ দিয়েছেন, সেটাই জনস্টোনের চতুর লেখনী আর তীক্ষ্ণ ফিল্মমেকিংয়ের দারুণ উদাহারণ হয়ে ওঠে। এবং আবহসঙ্গীত তো আছেই দৃশ্যগুলোর সাসপেন্সকে আরো উঁচুতে পৌঁছাতে।
তৃতীয় অংকে গিয়ে, ‘হাউজবাউন্ড’ যেভাবে তার রহস্যের পরত খুলেছে, ওই টুইস্টের মধ্যেই এর স্বীয়-সচেতন প্রকৃতি, জনরা উপাদানকে উল্টে দেবার ক্ষমতা আর হাস্যরসটাকে চমৎকারভাবে ব্যাল্যান্স করবার দক্ষতা প্রমাণিত। সাথে ভায়োলেন্স আর গোর-কে যতটা কমিক্যালি আনতে পেরেছে, সেটা সত্তরের আউটরেইজেস হরর আর আশির দশকের স্ল্যাশারের যথাযথ ‘অ্যামালগ্যামেশন’ হয়েছে। বলা যায়, জেরার্ড জনস্টোন একটি খাঁটি আর রেয়ার হরর-কমেডি উপহার দিয়েছেন।
এবং হরর-কমেডির এই মিশ্রণটা আমরা তার দ্বিতীয় সিনেমা ‘মেগান’ (২০২৩)-এও দেখতে পাই। তবে এবার হররটাও অনেক বেশি, আর কমেডিটা এসেছে পরিহাসমূলক বক্তব্যের মধ্য দিয়ে। ব্যঙ্গ আর সতর্কতার মধ্য দিয়ে। কথা বলা যাক, ‘মেগান’ নিয়ে।
আশির দশকের ‘চাইল্ড’স প্লে’ সিনেমায় খেলনা পুতুলের হন্তারক হবার (বাংলার- পুতুলের প্রতিশোধ) যে গল্প আমরা দেখেছি, সেটাই এই সময়ে এসে এ.আই-তে পরিবর্তিত হয়েছে আর কী। ‘মেগান’ সিনেমায়, আমরা একটা আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্ট পুতুলকে হন্তারক হয়ে উঠতে দেখি। রোবোটিস্ট গেমা তৈরি করে এই জীবন্ত পুতুল। দেখতে শুনতে যাকে প্রায় মানুষই মনে হয়! তার বোন আর বোনজামাই মারা যাবার পর, বোনের মেয়ের দায়িত্ব পড়ে তার উপর। যেটার জন্য সে পুরোপুরি অপ্রস্তুত। বাচ্চা লালনপালনের ধাঁচটাই তার মাঝে নেই। সে মনোযোগী ক্যারিয়ার নিয়ে। তাই বাচ্চা সামলানোর এই উঁটকো ঝামেলা থেকে বাঁচতে, যেটা সে মুখে স্বীকারও করে না, সে তৈরি করে এই পুতুল। তার ভাগ্নি ক্যাডির সঙ্গী হিসেবে।
পুতুলকে সে ক্যাডির বয়সের মানুষ সঙ্গী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য পুতুলের মধ্যে রেখেছে নিজেকে ডেভেলপ করার প্রক্রিয়া। অর্থাৎ, ক্যাডির সঙ্গে থেকে সে-ও শিখবে। ওভাবেই সে হয়ে উঠবে ক্যাডির আদর্শ সাথী। কিন্তু সেই শেখার আওতায় আসে ভায়োলেন্স। আর পুতুল মেগান সেটাকে আলাদাভাবে ভাগ করতে পারে না। ফলে ধীরে ধীরে সে হয়ে ওঠে হন্তারক। ক্যাডির প্রতি হয়ে ওঠে তুমুল রক্ষণাত্মক। আর সেই সাহচর্য প্রভাব ফেলে ক্যাডির উপর। এবং পরিস্থিতি হয়ে ওঠে প্রত্যাশিতভাবেই ভয়ংকর।
এই গল্প নতুন না। শুনতে খেলো লাগে। সেটাই এই সিনেমার মূল ব্যাপার। এই সিনেমা সেল্ফ-অ্যাওয়্যারনেস/সচেতনতামূলক। হাস্যরসের যোগান সম্বন্ধে সিনেমার এই সচেতনতা এবং সেটাকেই আলিঙ্গন করে কমিক ও কমিক্যালি সিরিয়াস হবার জায়গাটা; এই সিনেমা ভালোভাবে ব্যালান্স করেছে (ঠিক, জনস্টোনের প্রথম সিনেমা ‘হাউজবাউন্ড’-এর মতো। এটাই হয়ে উঠেছে তার স্টাইল।) গল্পটাও কিন্তু খুব সুন্দরভাবে বলে যাওয়া; প্রয়োজনীয় বিবরণ এবং চরিত্রদের দিকে নজর রেখে। আমি আগ্রহী ছিলাম, মেগানের সাথে ক্যাডির যে মিথস্ক্রিয়া গড়ে উঠছে, সেটার হিংস্র বহিঃপ্রকাশ কীভাবে ঘটছে তা দেখতে। এবং সেটা খুব মসৃণ আর যৌক্তিকভাবেই হয়েছে। সেখানে আধুনিক সময়ের প্যারেন্টিং এবং দায়িত্ব থেকে বাঁচবার তাড়নায় বাচ্চাদের প্রযুক্তির সাথে অবিচ্ছেদ্য যোগাযোগ ঘটিয়ে দেবার কু-প্রভাব সম্পর্কে সুন্দর বক্তব্য রাখা হয়েছে। আলগোছেই হয়েছে সেটা, জোরপূর্বক কিছু মনে হয়নি।
একটা এ.আই. পুতুল যেভাবে মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলছে, মানুষের পরিস্থিতিভিত্তিক প্রতিক্রিয়া আর আচরণের গ্যামাট যেভাবে অনুসরণ করে নিজেকে ডেভেলপ করছে (যেটাতে আসল হরর ভাইব পাওয়া যায়, বক্তব্যের জায়গা থেকে, ভবিষ্যৎ শংকার জায়গা থেকে); সেটা একদম একটা মানুষের বাচ্চার ছোট থেকে নিজেকে পারিপার্শ্বিক অবস্থার আলোকে গড়ে তুলবার মতো। ওই গ্যামাটটাই ধরেছে। এর ভেতর দিয়ে, মানুষ আসলে কীভাবে মানুষের মতো আচরণ করে/করতে শেখে ও কীভাবে সে স্বকীয় হয়ে ওঠে- তারই নিগূঢ় দার্শনিক কোণ আছে। সিনেমার পরিচালক জেরার্ড জনস্টোন এসকল কোণকে যেভাবে ভিজ্যুয়াল গল্পবয়ান আর সামগ্রিক ন্যারেটিভে প্রতিষ্ঠা করেছেন, এমন পাল্পি উপাদানের মাঝেও চিন্তা উদ্রেককারী বিষয়াদি টেনেছেন, মূল টেক্সটের উপর চড়াও হতে না দিয়েই- সেটাই তার ফিল্মমেকিং দক্ষতাকে প্রমাণ করে।
চিত্রনাট্যকার আকিলা কুপারেরও প্রশংসা করতে হয় এই নুয়্যান্স জায়গাগুলো মসৃণভাবে চিত্রনাট্যে স্তরীকরণ করার জন্য। মেগান যখন ভায়োলেন্সকে আস্তে আস্তে নিজের ভেতর প্রতিষ্ঠিত করছে আর ক্যাডিকেও প্রভাবিত করছে, সরাসরি প্রভাবিত না করেই; সেই অংশটা ‘অরফান’ (২০০৯) সিনেমার ভাইব দেয়। মেগান যেন তখন অরফান সিনেমারই এস্থার হয়ে ওঠে। এই সামঞ্জস্য কেমন যেন একটা হিমশীতল ভাইব দেয়। তবে সেই হোমাজ বা শ্রদ্ধাঞ্জলী সচেতনভাবেই দেওয়া। কারণ, সিনেমার সাথে যে জেমস ওয়ানও যুক্ত। তাই এই ডিজাইনিং কেন আসলো, সেটা বুঝতে বেগ পেতে হয় না।
‘মেগান’ কিন্তু তার নিজের রসিক প্রকৃতি থেকে বের হয়নি। জনস্টোন ড্রামাটিক মুডে গল্পটা বলে যেভাবে ক্যাম্পি হররে ঢুকলেন, পুরোটাই কিন্তু টোনের জায়গা থেকে বিচ্ছিন্ন ভাইব দেয়নি। সিনেমার গতিময়তা ক্যাম্পি হররের স্বাভাবিকের চেয়ে একটু ধীর টেম্পোতে রেখেও ড্রামাটিক এবং স্ট্রেইটফরোয়ার্ড দু’ভাবেই ঠিকঠাক সমতাতেই তিনি গল্পকে নামাতে পেরেছেন। এটা কোথায় যাচ্ছে, তা বুঝতে সমস্যা হবে না।
তবে ওই সচেতন প্রকৃতি, উপভোগ্যভাবে রাখা বিদ্রুপাত্মক কোণ, শ্রদ্ধাঞ্জলি, ছোটখাট কিন্তু শক্তিশালী নুয়্যান্স জায়গাগুলো যেভাবে বুদ্ধিদীপ্ত ফিল্মমেকিংয়ে মিশেছে, তাতে ‘মেগান’ উপভোগ করতে কোনো ঝামেলাই হয়নি, যেগুলো তার প্রথম সিনেমায়ও ছিল। এবং কিছু ক্ষেত্রে আরো দুর্দান্তভাবে ছিল। তা যাক, ‘মেগান’ ২০২৩ সালে মুক্তি পাওয়া প্রথম জনরা সিনেমা এবং সেটিও ভালো। হরর দিন দিন আরো প্রাসঙ্গিক হবে, কারণ ওর মধ্য দিয়েই আমরা সবাই যাচ্ছি। আর জেরার্ড জনস্টোনও এই জনরায় ইতোমধ্যেই হয়ে উঠেছেন নির্ভরযোগ্য নাম!