ইবনে খালদুনের প্রথম পর্বে তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী ও মুকাদ্দিমাহ সম্পর্কে আমরা জেনেছি। এ পর্বে থাকবে আসাবিয়াহ সম্পর্কে কিছু কথা এবং ইতিহাসশাস্ত্রে তাঁর অসামান্য সব অবদানের কথা!
বিষয়বস্তুর বিন্যাস, উপস্থাপনা ও বিভাজন, আলোচ্যসূচির স্পষ্টতা ও যথার্থতা, সরল অথচ উপযুক্ত ব্যতিক্রমী শব্দচয়ন রীতি প্রভৃতি ইবনে খালদুনকে তাঁর পূর্বসূরীদের থেকে এক স্বতন্ত্র মর্যাদা দেয়। এটা সত্য যে, আল মুকাদ্দিমাহর গঠন বিন্যাস এবং এর পাণ্ডিত্যপূর্ণ বিবরণী, গ্রন্থ ও গ্রন্থকারকে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান প্রদান করে। কিন্তু এর সবচেয়ে মৌলিক দিক হলো মানব চিন্তনে অবদান। এটা মূলত ইবনে খালদুনের রাজনৈতিক, সমাজতাত্ত্বিক, অর্থনৈতিক ও দার্শনিক মতাদর্শ সম্বন্ধে বিস্তৃত বিবরণ প্রদান করে। ফ্রাঙ্ক রজেন্থালের মতে,
যদিও সার্বিক বিবেচনায় ইবনে খালদুনকে পর্যাপ্ত মৌলিকত্বের দাবিদার হিসেবে গণ্য করা যায় না, এতদসত্ত্বেও আল-মুকাদ্দিমাহ্ সুস্পষ্টত একটি মৌলিক গ্রন্থ, যা পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষণায় একটি নতুন মাত্রা। এটি কার্যত বৃহত্তর সুপ্রসিদ্ধ সভ্যতার সকল সাধারণ, অথচ স্বতন্ত্র বিষয়ের নজিরবিহীন উপায়ে পুনর্মূল্যায়ন করে। প্রত্যেক বিষয়বস্তুকে মানুষ ও মানবীয় সামাজিক সংগঠনের কার্যকরী উপাদান হিসেবে গণ্য করে মৌলিক ও সুগভীর দৃষ্টিভঙ্গিতে সর্বাত্মক ও সবিস্তর বর্ণনার মাধ্যমে তিনি এ কাজ করেন। এ লেখনীতে তিনি প্রথমবারের মতো ইতিহাস বিকাশের মতবাদ উপস্থাপন করেন। এ মতবাদে জলবায়ু ও ভূ-প্রাকৃতিক নিয়ামক এবং ক্রিয়াশীল নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উপাদানসমূহের সক্রিয় ভূমিকার স্বীকৃতি পেয়েছে। জাতীয় উন্নতি ও অবনতির নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে ইবনে খালদুনকে ইতিহাসের প্রকৃত পরিধি ও প্রকৃতির আবিষ্কর্তা হিসেবে বা অন্তত সামাজিক বিজ্ঞানের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে গণ্য করা যায়।
ইবনে খালদুনের দৃষ্টিতে ইতিহাস হলো মানব সমাজের, বিশ্ব সভ্যতার এবং সমাজের প্রকৃতি ও পরিবর্তনের তথা বন্যজীবন, সামাজিকতা, দলীয় সংঘবদ্ধতা প্রভৃতির অধ্যয়ন। ইতিহাস এক শ্রেণীর লোক দ্বারা সংঘটিত বিপ্লব বা অভ্যুত্থান, যা বিভিন্ন ধরনের রাজ্য বা দেশের জন্ম দিয়েছে, তা-ও আলোচনা করে। এটা মানুষের জীবিকা বা জ্ঞানচর্চার নিমিত্তে অবলম্বনকৃত বিভিন্ন পেশার কার্যাবলি এবং সমাজের সকল শ্রেণির পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের অধ্যয়ন করে। তাঁর মতে, ইতিহাসের আলোচ্য বিষয়সমূহ তথা সভ্যতা, সংস্কৃতি, রাষ্ট্র ও সমাজের উত্থান ও বিবর্তন নিয়ন্ত্রিত হয় ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যাবলি, যেমন- জলবায়ু, খাদ্য, ভূমিরূপ প্রভৃতি দ্বারা এবং দলীয় সংঘবদ্ধ চেতনার (আসাবিয়াহ) মাধ্যমে।
ইবনে খালদুন ব্যক্তি ও জাতির চরিত্র, মেজাজ, রুচি ও সংস্কৃতির উপর কোনো স্থানের জলবায়ু ও পরিবেশের স্পষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করেছেন। ইতিহাস থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি তাঁর মানব জীবনে ভূ-প্রকৃতির প্রভাব বিষয়ক মতবাদকে জোরালো করেছেন। তিনি বলেন,
সাইবেরিয়ার মতো শীতল অঞ্চলের অধিবাসীরা বা ইকুয়েডরের নিকটবর্তী উষ্ণ অঞ্চলে বসবাসকারী লোকেরা জীবনে তেমন সাফল্য অর্জন করতে বা মানব চিন্তনে অবদান রাখতে পারে না।
তাঁর মতে, নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের বাসিন্দারা, যেমন- রোমান, গ্রিক, পারসিক, আরব প্রভৃতি সভ্যতা-সংস্কৃতিতে অন্যান্যদের তুলনায় অধিকতর অবদান রেখেছে। তাই চরম জলবায়ুর অঞ্চল সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে তুলনামূলক অনুন্নত। তিনি এটাও মন্তব্য করেন যে, মানুষের সাধারণ জ্ঞান ও প্রজ্ঞা এবং অভ্যাস ও আচরণ কোনো স্থানের অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ দ্বারা প্রভাবিত হয়।
রাজনৈতিক জীবনের বিকাশ অর্থাৎ এর উৎপত্তি, বৃদ্ধি, পরিপূর্ণতা, অবক্ষয় ও পতন দুটো নিয়ামকের মাধ্যমে ইবনে খালদুন ব্যাখ্যা করেছেন- প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞান।
জীববিজ্ঞানের গতিশীলতা বা বিকাশের ক্ষেত্রে কার্যকরী নিয়ামক আত্মা ও এর মেজাজ বা অবস্থা। প্রাকৃতিক বিজ্ঞান বা সংস্কৃতির গতিশীলতার কার্যকরী শক্তি হলো সামাজিক একাত্মতা (আসাবিয়াহ) নামক মানবাত্মার এক বিশেষ গুণ বা বৈশিষ্ট্য, যা মানুষের সাধারণ প্রতিরক্ষা ও অস্তিত্বের জন্য মানুষের পারস্পরিক আত্মীয়তা বা বন্ধুত্বের প্রতি স্বাভাবিক সহানুভূতি যোগায়। ইবনে খালদুনের মতে, রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনের অন্যতম উপাদান হলো ধর্মীয় ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ সংঘবদ্ধ দলীয় চেতনা। একেই মূলত তিনি আসাবিয়াহ বলে অভিহিত করেছেন । উল্লেখ্য, তিনি অবশ্য ধর্মকে সভ্যতার প্রাথমিক উপাদান হিসেবে গণ্য করতেন না। এক্ষেত্রে তিনি ধর্মের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার প্রথম প্রতিনিধিত্বকারী, কেননা এ আদর্শিক ধারা পাশ্চাত্যে তাঁর পাঁচশত বছর পর আবির্ভূত হয়।
এটা সত্য যে, ধর্মীয় চেতনা ও নবীগণের আবির্ভাব রাজনৈতিক আন্দোলনকে বেগবান ও ত্বরান্বিত করতে পারে, কিন্তু কোনো সুস্পষ্ট রাজনৈতিক সমর্থন ছাড়া সেগুলো (অর্থাৎ ধর্ম-দর্শন) এ বিশ্বে সফলতা পায় না। এ মতবাদের পক্ষে অসংখ্য উদাহরণ ইতিহাসে পাওয়া যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হলো ইসলামের অতিপ্রাকৃত ঘটনাবহুল সাফল্য। অবশ্য আধুনিক বিশ্বে দলীয় চেতনা বা সমগোত্রীয় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অন্য যেকোনো উপাদানের চেয়ে সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে অধিকতর কার্যকর। সুইজারল্যান্ড, বেলজিয়াম, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতির ন্যায় সমাজে এটা স্পষ্টত লক্ষণীয়।
ইবনে খালদুন মানব সভ্যতার বিবর্তন সম্বন্ধেও কথা বলেন। তাঁর মতে, মানব সভ্যতা গ্রামীণ ও যাযাবর স্তর থেকে ক্রমান্বয়ে শহর ও নগর জীবনে উন্নীত হয়। অবশ্য এর চূড়ান্ত পর্যায় হলো সাম্রাজ্যে উপনীত হওয়া। মরুভূমির যাযাবর জীবনের সরল ও প্রাকৃতিক জীবনধারা ক্রমান্বয়ে বিত্ত-বৈভব ও আয়েশী সংস্কৃতি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। জীবনমানের এই পরিবর্তন পূর্ববর্তী কর্মচঞ্চল জীবনকে স্থবির করে দিয়েছে। ক্রমান্বয়ে এটি মানুষের বীর পৌরুষত্বকে নমনীয় নারীত্বের পর্যায়ে নিয়ে আসে। এমতাবস্থায় ঐ সকল লোকরা বা শাসকরা তাদের দেশ ও সমাজকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারে না । তখন তারা রাষ্ট্র রক্ষার জন্য ভাড়াটে বাহিনী নিয়োগ করে।
কালক্রমে রাষ্ট্র আর টিকতে পারে না এবং এর অপমৃত্যু তথা পতন ঘটে। আরব জাতির জাগরণ, বিকাশ, অবক্ষয় ও পতন ইবনে খালদুনের উপরোক্ত মতবাদকে সমর্থন করে। অবশ্য এর বিপরীত ধারাটিও ঘটতে পারে। জনগণের কর্মবিমুখতা শাসককে স্বেচ্ছাচারী করে তুললে জনগণ আন্দোলন করে। আর এ আন্দোলন রাষ্ট্র ও সমাজকে পুনরায় ক্ষিপ্র ও গতিশীল করে তোলে। সমাজের আঙ্গিক ধারণা ও ইতিহাসের জৈবিক ব্যাখ্যা ইবনে খালদুনকে আধুনিক যুগের সমাজতাত্ত্বিক ধারার প্রবক্তাদের অন্তর্ভুক্ত করে। তিনি বলেন, রাষ্ট্রের একটি জৈবিক গঠন রয়েছে। মানব জীবনের ন্যায় এর জন্ম, যৌবন, বৃদ্ধ-বয়স, অবক্ষয় ও মৃত্যু রয়েছে।
ইবনে খালদুনের ইতিহাসচর্চার পরিধি অত্যন্ত সুপ্রশস্ত। তিনি বর্ষানুক্রমিক রীতির ঐতিহাসিক সাহিত্য, আইন বিজ্ঞানের বিকাশ, বিভিন্ন ধর্মীয় রাজনৈতিক সম্প্রদায় প্রভৃতি সংক্রান্ত মূল্যবান তথ্য সরবরাহ করেছেন। এটা সত্য যে, তাঁর বিশ্ব ইতিহাস স্পেনের উত্তর বা পারস্যের পূর্বের ইতিহাস আলোচনা করে না, তবে ঐ সীমিত ভৌগোলিক পরিধির মধ্যেই তিনি মুসলিম ও অমুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের বিস্তৃত ইতিহাস তুলে ধরেছেন। অমুসলিম ইতিহাস রচনার জন্য তিনি তখনকার সময়ে প্রাপ্ত রোমান ইতিহাস বিশেষজ্ঞ ওরোসিয়াস , ইহুদি ইতিহাসবিদ জোসিফন প্রমুখ ইউরোপীয় লেখকদের রচনা সবিস্তর ব্যবহার করেছেন।
কোনো কোনো গবেষকের দৃষ্টিতে, ইবনে খালদুনের মৌলিক চিন্তা ও মতবাদের কোনো পূর্বসূরী ছিল না এবং ইসলামি বিশ্বে তাঁর কোনো উত্তরসূরীরও আবির্ভাব ঘটেনি। তবে মিশরীয় পণ্ডিত ও ঐতিহাসিক আল মাকরিজি (১৩৬৪-১৪৪২ খ্রি.), যিনি কায়রোতে ইবনে খালদুনের বক্তৃতামালায় যোগদান করেছিলেন, তিনি তাঁর মতাদর্শে অনেকটা প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। অন্যদিকে, মধ্যযুগীয় আধুনিক ইউরোপীয় ঐতিহাসিক ম্যাকিয়াভেলি, ভিকো, গিবন প্রমুখ স্পষ্টত ইবনে খালদুনের বুদ্ধিবৃত্তিক উত্তরাধিকারী।
বস্তুত বিশ্ব-অভিজ্ঞতার অধিকারী, অগাধ মেধাশক্তি সম্পন্ন ইবনে খালদুন তাঁর আবিষ্কারের দূরদর্শিতা ও বিশ্লেষণী ক্ষমতার মাধ্যমে পরবর্তী ইউরোপীয় লেখকদের গভীরভাবে প্রভাবিত করেছেন। এটা সত্য যে, মুসলিম জগতে তাকে গ্রহণ করার মতো প্রয়োজনীয় মেধা ও পরিবেশের বিকাশ ঘটেনি। এক্ষেত্রে চার্লস ইসাবি যথার্থই বলেন যে,
ইবনে খালদুনের মৌলিকত্ব প্রাচ্যের চেয়ে পাশ্চাত্যে অধিক মাত্রায় প্রশংসিত ও স্বীকৃত হয়েছে।
ডি.এস. মার্গোলিয়থের ভাষ্য স্মর্তব্য,
অধিকাংশ আরব ঐতিহাসিকদের ক্ষেত্রে একথা প্রযোজ্য যে, তাদের লেখনী হয় তাঁদের পূর্বসূরীদের লেখনীর পুনঃপ্রচার, না হয় ওগুলোর সংক্ষিপ্তরূপ বা কখনও ভাষান্তররূপ মাত্র। কিন্তু আবদুর রহমান খালদুন বা ইবনে খালদুনের লেখনী এক্ষেত্রে লক্ষণীয় মাত্রায় ব্যতিক্রম।
সকল আলোচনা শেষে এ কথা কোনো দ্বিধা ব্যতিরেকেই বলা যায় যে, ইবনে খালদুন ইসলামের ইতিহাসে আবির্ভূত অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক-দার্শনিক এবং সর্বযুগের অন্যতম সেরা লেখক।