কাচে বন্দি দুঃখের সিম্ফনি

মেলোম্যানিয়াকদের শহরে সাড়া পড়ে গেছে। কারণটা একটু অদ্ভুত। নতুন একটা সুরে বাঁধা পড়ছে শহরবাসী। নাগরিক জীবন উঁচুতলার কাঁচঘেরা দেয়ালে মোড়ানো হয়। সেই কাঁচের দেয়ালে আটকে থাকা মানুষগুলোর থাকে একটা করে গল্প। সবার গল্পগুলো মিলেমিশে একটা গান হতে পারতো। আর সেই গানগল্পের যদি নাম দিতে হয়, নামটা হবে ‘কাচবন্দি সিম্ফনি’। কেন? এই প্রশ্নের উত্তরটা দেয়ার একটা ছোট্ট চেষ্টা করছি।

কোএভাল (Coeval) ঘরানার লেখক মাহরীন ফেরদৌসের বই ‘কাচবন্দি সিম্ফনি’। বই হাতে নিলে প্রথমে একটু থমকে যেতে হয় প্রচ্ছদ দেখে। সাদা রঙের দেয়াল ভেদ করে লাল-কমলা জারবেরা আর নীল জারুলের মতো রঙগুলোর পাশে স্তব্ধ কিছু মানুষের মুখাবয়ব দেখা যায়। একটানা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে তাদের আকুতি দেখা যেতে পারে, সেই আকুতি সাথে নিয়েই যেন বইটির সাম্রাজ্যে আমরা প্রবেশ করি।

বইয়ের প্রথমটায় মখমলের মতো সবুজ রং বইটিতে এক রাজসিক সৌন্দর্য নিয়ে এসেছে। শুরুতেই উইলিয়াম বার্কলের বিখ্যাত উক্তিটি পড়ার পর মনে ‘আহারে আহারে’ ডাক ডেকে যায়। আর সেই হাহাকার নিয়ে আমরা গল্পের ক্রমতে চলে যাই। ‘কাচবন্দি সিম্ফনি’ একটি গল্প সংকলন। গল্পগুলোকে লেখক তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন। হারাও, ডুব এবং বিদায়বেলা। 

জীবনের এই বন্ধুর চলার পথে অসংখ্যবার আমাদের মনে হয় যেন হারিয়ে যাই, আর কেউ বিষাদমনে আমাদের খুঁজে ফিরুক, তাই না? ‘কাচবন্দি সিম্ফনি’র ‘হারাও’ অংশটি ঠিক তেমনই মনে হয়েছে। ‘নিঝুম বিদায়বেলা’ গল্পটির প্রজ্ঞা মেয়েটিকে মনে হয় আমাদের পাশের বাসার, যার জীবনের গল্পটি খুব পরিচিত, যার স্বপ্ন আকাশ ছুঁতে চাওয়ার আর তারপর আমরা দেখতে পাই তার ডানা ভাঙ্গার কষ্ট। উচ্চতা ভীতিতে ভোগা গল্পের প্রোটাগনিস্ট ছেলেটির কল্পনা আর বাস্তবতার মিশেলে প্রজ্ঞার পরিণতি আমাদের চোখে ধরা দেয়। প্রজ্ঞার জন্য আমাদের বুকের ভেতর একটা শূন্যতা তৈরি হয়। তার জন্য আমাদের প্রার্থনা করতে ইচ্ছে হয়। এই ইচ্ছে তৈরি করে দেয়ার জন্য লেখককে ধন্যবাদ।

কাচবন্দি সিম্ফনি; Image source: saveig.com

‘চিরকুট’ গল্পটি আমার বেশ হালকা মনে হয়েছে, যেমন গল্প পড়লে যেকোনো মিলেনিয়ালের মনে হতে পারে। আরে! এতো আমার ছেলেবেলার কথা। গল্পটি পড়ার পর ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে মনের অজান্তেই। ‘হয়তো নয়নতারা জানে’ গল্পটি নাড়িয়ে দিয়ে গেছে ক্ষণে ক্ষণে। গল্পে বাবা চরিত্রটি নয়নতারা নামক গৃহকর্মীর শরীর থেকে মাছের গন্ধ পান আর তার বখে যাওয়া ছেলে সেই শরীরে নাক ডুবিয়ে বুঁদ হবার প্রবল আকাঙ্ক্ষায় পুড়তে থাকে। গল্পের প্রতি পাতায় একেকবার রেগে যাচ্ছিলাম। ভাবছিলাম দোষ কাকে দেবো? শরীরী ঘ্রাণে অভিজ্ঞ বাবা নাকি তার বখে যাওয়া ছেলেকে? ছটফট করছিলাম নয়নতারার পরিণতি কী হবে তাই ভেবে। এইটুক বলতে পারি, শেষ পর্যন্ত ধরে রাখার আশ্চর্য এক ক্ষমতা লেখকের আছে। 

বইয়ের দ্বিতীয়ার্ধের নাম ‘ডুব’। মোট চারটি গল্প আছে এই অংশে। প্রথম গল্পের নাম ‘হেমন্ত’। হেমন্ত ঋতুটি বছরের প্রায় সায়াহ্নে আসে। বিদায় বেলার আগে শেষ ঝলক আলোর মতো। কোমল কিন্তু উজ্জ্বল। মোমেনা আখতার অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষিকা। তার প্রবাসী কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার ছেলে একটা রোবটের প্রোটোটাইপকে পরীক্ষামূলকভাবে মায়ের একাকীত্বের সঙ্গী হিসেবে বাসায় পাঠিয়ে দেয়। সাহিত্যমনা মোমেনা নিজের পড়ন্ত সময়ের কথা ভেবেই হয়তো মিলিয়ে রোবটের নাম রাখেন ‘হেমন্ত’। এ পর্যায়ে গল্পটিকে সায়েন্স ফিকশন মনে হতে পারে কিন্তু গল্প শেষে একজন মাঝবয়সী নারীর বোধ, একাকীত্ব, কষ্টের সাথে মিলিয়ে গল্পটি অনেক বেশি মানবিক হয়ে ওঠে।

‘মেরিনার মেঘমালা’ মূলত একটি দুঃস্বপ্নের গল্প। কেমন লাগবে যদি অন্য কারোও দুঃস্বপ্নে আমরা আটকে পড়ি? গল্পটি পড়তে পড়তে তাই ভাবনা জাগে, আহা জীবন! ‘মহুয়ার গুঞ্জরনে’ গল্পটি পড়ার পর কিছুক্ষণ স্তব্ধতায় চারপাশ থেমে থাকে। জীবন সুন্দর আর তা মনে না রেখে পারিপার্শ্বিক জটিলতায় হারিয়ে যাওয়ার যে কদর্য রূপ তা আমাদের ভাবায়। গল্পটিতে চমৎকার কিছু উক্তি ব্যবহার করা হয়েছে আর লেখকের কাব্যিক অলংকরণে হয়েছি মুগ্ধ।

লেখক মাহরিন ফেরদৌস; Facebook

বলতে বলতে গল্পের শেষার্ধে চলে এসেছি। শেষ ব্যাপারটার সাথে মিল রেখেই যেন এর নামকরণ করা হয়েছে ‘বিদায়বেলা’। ‘চৈতালি সন্ধ্যায় সামরিন ও আমি’ গল্পটির সাথে একজন খুব জনপ্রিয় লেখকের ‘দ্বিতীয়জন’ গল্পটির কিছুটা মিল রয়েছে। তবে আশার কথা হলো, এই মিলটুকু ছাপিয়ে অচিরেই গল্পটি নিজস্ব ভঙ্গিতে চলে গিয়েছে বহুদূর। গল্পের গাঁথুনি ছিল খুবই সুন্দর। এই ফাঁকে বলে রাখি, কল্পনা থেকে সত্ত্বার সৃষ্টি নিয়ে ‘রুবি স্পার্কস’ নামের চমৎকার একটি ইংরেজি চলচ্চিত্রও আছে। চাইলে প্রিয় পাঠক দেখে নিতে পারেন।

‘ফেলে আসা সুগন্ধি’ আরেকটি কনটেম্পোরারি ঘরানার গল্প। ব্যস্ত নাগরিক জীবন, স্মৃতির টানা-পোড়েন, দায়িত্ববোধ আর মনের গলি-ঘুপচিতে আটকে পড়া এই নিয়েই কাহিনী এগোয়। এমন গল্পগুলো আমাদের কাতর করে। মনে হতে থাকে জীবন আরেকটু সহজ, সরলরেখার মতো হলে খুব কি ক্ষতি হতো? গল্পের একদম শেষ সংযোজনের নাম ‘উপহার’। উপহারে কী আছে তা পাঠককুলের জন্য বরং ভিন্ন রকমের উপহার বা চমক হিসেবে থাকুক! তবে তা পড়ে শেষ করার পর পাঠক যে অকস্মাৎ ঝটকার শিকার হতে পারে তার দায়ভার সম্পূর্ণই লেখকের। 

নির্ঝর নৈঃশব্দ্যের ঝকঝকে প্রচ্ছদ বরাবরের মতোই নান্দনিক হয়েছে। তবে অসম্ভব ভালোলাগা কাজ করেছে প্রতি গল্পের আগে থাকা ফাইজা ইসলামের করা চমৎকার অলংকরণ দেখে। যা বইটিকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। বইটির পাতাগুলো সুন্দর, বাইন্ডিং দারুণ! জানা মতে ‘পেন্সিল পাবলিকেশনস’ এবারের মেলা দিয়েই তাদের প্রকাশনা যাত্রা শুরু করেছে। তবে বইয়ের মান, উপস্থাপন দেখলে তা কেউ বলবে না। বরং প্রথম শ্রেণির প্রকাশনীর কাজের মতো মান সম্মত হয়েছে। 

বইয়ের নাম: কাচবন্দি সিম্ফনি || লেখক : মাহরীন ফেরদৌস

প্রকাশনা: পেন্সিল পাবলিকেশন্স || অনলাইন প্রাপ্তিস্থান: রকমারি.কম

This Bangla article is a review of 'Kachbondi Symphony' by Mahrin Ferdous.

Featured Image: Instagram/mahrin.ferdous

RB-RF/SM

Related Articles

Exit mobile version