“যদি তুমি চোখ মেলো বাঙলা সাহিত্যের দিকে, তাহলে দেখবে জ্বলছে হাজার হাজার প্রদীপ; লাল-নীল-সবুজ, আবার কালোও। হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে রচিত হচ্ছে বাঙলা সাহিত্য। এর একেকটি বই যেনো একেকটি প্রদীপের মতো আলো দিচ্ছে আমাদের। বুক ভরে যায় সে আলোকের ঝরনাধারায়; সে আলোকে ভরে যায় টেবিল, ধূসর সাদা খসখসে পাতা, পৃথিবী ও স্বপ্নলোক।”
বাংলা সাহিত্যের প্রথাবিরোধী লেখক ড. হুমায়ুন আজাদ। বহুমুখী প্রতিভাধর বিশিষ্ট এই ভাষাবিজ্ঞানী ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং সভাপতি। তার লেখার বড় অংশ জুড়ে রয়েছে বাংলা ভাষা, সাহিত্য, এর শব্দভাণ্ডার ও তাদের ইতিহাস। তার রচিত লাল নীল দীপাবলী, কতো নদী সরোবর, বাঙলা ভাষার শত্রুমিত্র প্রভৃতি গ্রন্থ নিশ্চিতভাবেই সুদীর্ঘকাল ধরে আমাদের মাতৃভাষার ইতিবৃত্ত সম্বন্ধে সকল শ্রেণীর সকল বয়সের মানুষের জ্ঞানতৃষ্ণাকে তৃপ্ত করে যাবে এবং সমৃদ্ধ করবে বাংলার সাহিত্যভাণ্ডারকেও।
‘লাল নীল দীপাবলী’র চমৎকারিত্ব তার নামেই রয়েছে। এটি লেখা হয়েছে বাংলা সাহিত্যের হাজার বছরের ইতিহাসকে কেন্দ্র করে। হুমায়ুন আজাদ তার চমৎকার বাক্যশৈলীর মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের হাজার বছরের ইতিহাসকে অত্যন্ত সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষায় উপস্থাপন করেছেন পাঠকের সামনে। তার স্বভাবসুলভ আন্তরিকতার মাধ্যমে তিনি সময়ের গহ্বর থেকে পাঠকের জন্য খুঁজে এনেছেন লুইপা, কাহ্নপা থেকে আধুনিক যুগের কবি-সাহিত্যিকদে
লেখক নিজে বাংলা বিভাগের মেধাবী একজন শিক্ষক হওয়ায় সহস্রাধিক বছরের প্রাচীন বাঙলা সাহিত্যের ক্রমবিবর্তনকে অত্যন্ত সুন্দরভাবে তুলে ধরা সম্ভব হয়েছে তার পক্ষে। সময় থেমে থাকে না কারো জন্য, গোপনে বয়ে চলে সে। সাহিত্যও এগিয়ে চলে সময়ের সাথে সাথে, এভাবেই ঘটে তার বিকাশ, তার রূপান্তর। হুমায়ুন আজাদ এই বিকাশের বিচিত্র বাঁক ও মোড় তাৎপর্যময় করে তুলেছেন, গভীর মমতায় রূপায়িত করেছেন সমৃদ্ধ সেই ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি।
হাজার বছর আগে কেমন ছিল আমাদের মাতৃভাষা? আজকের মতন কি তখনো এভাবে সাহিত্য রচিত হতো? তখনো কি কবিদের মনে পংক্তি ভিড় করে এসে আবদার করে বলতো, “আমাকে ছন্দ দিয়ে, অলংকার দিয়ে সাজাও, পদ্য লেখো আমাকে নিয়ে”? কী নিয়ে কবিতা লিখতেন সেকালের কবিরা? প্রেম? ভালোবাসা? দ্রোহ? নাকি অন্য কিছু নিয়ে?— এমনই হাজারো প্রশ্নের আলো দেখাবে ‘লাল নীল দীপাবলী’।
বাংলা সাহিত্যের পথপরিক্রমায় হাজির হয়েছেন বহু প্রতিভাধর কবি-সাহিত্যিক-লেখক-ঔপন্যাসিক, যাদের মেধায় তরঙ্গিত হয়েছে বাংলা সাহিত্যের পথচলা। প্রাচীন যুগের বিদ্যাপতি, জ্ঞানদাস, মুকুন্দদাস মধ্যযুগের বড়ু চণ্ডীদাস, মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর, আবদুল হাকিম, শাহ মুহম্মদ সগীর বা আধুনিক কালের রবীন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মোহিতলাল মজুমদার, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীম উদ্দীন, বুদ্ধদেব বসু বা জীবনানন্দ দাশ– জানা অজানা বহু সাহিত্যিকের কথা উঠে এসেছে এ বইতে।
এ বইয়ের নির্যাসে জানা যায়, প্রাচীনকালে এ বাংলায় রচিত হয়েছে চর্যাপদ। মধ্যযুগে এসেছে ‘মঙ্গলকাব্য’ নামের দীর্ঘ কাব্য,যেখানে কাব্যের ছন্দে দেবতাদের মর্ত্যলোক প্রতিষ্ঠার কাহিনীগুলো রচিত হয়েছে। প্রাক-আধুনিক যুগের সাহিত্যে সবই রচিত হতো কবিতার ছন্দে, কাব্যভাষায়। এরপর বাংলা সাহিত্যে যুক্ত হয়েছে গদ্য। কখনোই থেমে থাকেনি বাংলা সাহিত্যের অদম্য পথচলা।
সাহিত্যের এ বিরাট ক্রমবিবর্তনের ইতিহাসে লেখক নিজের মতো করে নাম-অলংকৃত করেছেন একেকটি ধাপকে। প্রথম প্রদীপ: চর্যাপদ, প্রদীপ জ্বললো আবার: মঙ্গলকাব্য, মনসামঙ্গলের নীল দুঃখ, গদ্য: নতুন সম্রাট, উপন্যাস: মানুষের মহাকাব্য, রবীন্দ্রনাথ: প্রতিদিনের সূর্য— প্রভৃতি শিরোনাম অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী করে তুলেছে পুরো বইটিকে। চর্যাপদ, মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলীর মজার কিছু চরণ বা গদ্য, উপন্যাস, কবিতা, নাটকসহ সাহিত্যের প্রধান অনুষঙ্গগুলোর অত্যন্ত সহজ-সরল-প্রাঞ্জল বর্ণনা পাঠককে বাধ্য করবে একটানা পুরো বইটা শেষ করতে। চমৎকার গ্রন্থটি লেখকের মহৎ পরিশ্রমে হয়ে উঠেছে সত্যিকার অর্থেই বাংলা সাহিত্যের জীবনী। যেকোনো বয়সের পাঠক এই বইটি পড়ার মাধ্যমে হাজার বছর ধরে প্রজ্বলিত বাংলা সাহিত্যের লাল নীল দীপাবলী দেখার সুযোগ পাবেন।
“সাহিত্য হচ্ছে আলোর পৃথিবী, সেখানে যা আসে আলোকিত হয়ে আসে; কালো এসে এখানে নীল হয়ে যায়, অসুন্দর হয়ে যায় সুন্দর শিল্পকলা। চিরকাল জ্বলবে বাঙলা সাহিত্যের এই সুন্দরের সাধনা, চিরকাল জ্বলবে তার লাল-নীল দীপাবলী। শেষ করবো সুন্দরের এই অনিন্দ্যসুন্দর পথ বাতলে দিয়েই, তোমাদের হাতে আসবে চর্যাপদ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, বা বৈষ্ণব পদাবলী। রবীন্দ্রনাথ তখন তোমার হাতে হাতে ফিরবে; তোমার জন্যে কবিতা গল্প নাটক নিয়ে টেবিলে এসে হাজির হবেন কবি মধুসূদন দত্ত, ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়,ঔপন্যাসিক শরৎ-বিভূতি-মানিক-তারাশঙ্কর, কবি জীবনানন্দ-সুধীন্দ্রনাথ-বুদ্ধদে
ব, এবং আরো অনেকে। এবং আসবেন একালের লেখকেরা। তোমার চতুর্দিকে প্রদীপ, মাঝখানে তুমি বসে আছো। রাজা!”
বইয়ের নাম: লাল নীল দীপাবলী || লেখক: ড. হুমায়ুন আজাদ
প্রকাশক: আগামী প্রকাশনী || অনলাইন প্রাপ্তিস্থান: রকমারি.কম