ফ্যামিলি ড্রামায় সিদ্ধহস্ত পরিচালক আন্দ্রেই জুভিয়াগিনসেভের অন্যতম সফল চলচ্চিত্র লাভলেস। এর আগে দ্য রিটার্ন , দ্য ব্যানিশমেন্ট, ইলেনা, লেভিয়াথানের মতো ড্রামা ফিকশন বানিয়ে জুভিয়াগিনসেভ হয়ে উঠেছেন বর্তমানে রুশ ফেডারেশনের সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল ডিরেক্টর। তার ফিল্ম অস্কার কিংবা কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে রাশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করাকে রীতিমতো তিনি ডালভাতে পরিণত করেছেন। লাভলেসের ক্ষেত্রে সফল তকমা সাঁটার আগে বলে নেয়া ভাল যে, মুভিটি ৯০ তম অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডে বেস্ট ফরেইন ল্যাংগুয়েজ ক্যাটাগরিতে নমিনেটেড ছিল। সাথে কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের পাম ডি’অরে মনোনয়ন পেয়েছিল, আর সাথে জিতে নিয়েছিল স্পেশাল জুরি অ্যাওয়ার্ড। অপরাপর মুভির মতো এবারও ডিরেক্টরের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ফ্যামিলি ক্রাইসিস। চির ধরা ঠুনকো পারিবারিক সম্পর্কের বলি নিরীহ এক শিশুর গল্প নিয়ে চলচ্চিত্রটির অন্তর্যাত্রা। বাবা-মায়ের পারিবারিক কলহ বিষিয়ে তোলে শিশু আলিশার স্বাভাবিক জীবন। নিজ পরিবারের কাছে সে পরিণত হয় প্রাণহীন অচ্ছুৎ জড় বস্তুতে। মা-বাবার বিচ্ছেদের সিদ্ধান্তে আলিশা গণ্য হয় অন্তরায় হিসেবে। সে হয়ে ওঠে পরিবারের বোঝা। তার জন্ম হওয়াকে বাবা-মা গণ্য করে নিজেদের ভুল সিদ্ধান্ত তথা অনাকাঙ্ক্ষিত আগমন হিসেবে। নিষ্ঠুর দুনিয়ায় আলিশার একজন বন্ধুই রয়েছে শুধু।
আলিশার মা জেনিয়ার সম্পর্ক ৪৭ বছর বয়সী আন্তনের সাথে, যার কিনা নিজেরও ১৯ বছর বয়সী কন্যাসন্তান রয়েছে। পক্ষান্তরে, বাবা বরিসের প্রেম উঠতি বয়সী মাশার সাথে। মাশার গর্ভে বরিসের আরেক সন্তান পৃথিবীতে আলোর মুখ দেখবার প্রতীক্ষায়। বাবা-মায়ের পরকীয়ায় প্রত্যহ নিরাদর অবহেলায় কাটে আলিশার শৈশব। অন্যদিকে, ক্রমেই বিষিয়ে ওঠা পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন করতে মুখিয়ে হয়ে ওঠে জেনিয়া-বরিস দম্পতি। তাদের উচ্চবাচ্য, ঝগড়াবিবাদ আর পারস্পরিক অশ্রদ্ধার নিরব সাক্ষী হয়ে থাকতে হয় শিশুসন্তানকে। কাউকে কিছু বলতে না পেরে অসহায় শিশুটি দরজার আড়ালে লুকিয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদে। এতিমখানা কিংবা বোর্ডিং স্কুলই যে তার ভবিষ্যৎ বাসস্থান সেটি বুঝতে বাকি থাকে না নিষ্পাপ এই শিশুর!
তারপর হঠাৎই একদিন আলিশা বাসা থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলে টের পায় মা। আর তা জানামাত্রই সে জানায় বরিসকে। কিন্তু নিজেদের নতুন জীবন নিয়ে অতি ব্যস্ত বিধায় আলিশার হারিয়ে যাওয়াকে তারা দেখে অনভিপ্রেত ভোগান্তি হিসেবে। তবে সন্তানকে তারা সামান্য হলেও ভালোবাসে- সেই বিষয়টিও দৃষ্টি এড়ায় না। এরপরের ঘটনা কেবলই শিশুকে খুঁজে ফেরার! নির্মাতা এক্ষেত্রে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে জেনিয়া-বরিস দম্পতির ভিন্ন দুটি জীবনকে সমান্তরালে দেখিয়েছেন। সন্তানের জন্য উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ সত্য হিসেবে প্রকাশিত হলেও থেমে থাকেনি পার্টনারদের সাথে তাদের সম্পর্ক। তবে মানবিক দিক এই যে, নিখোঁজ সন্তানের খোঁজে উভয়ের মায়া-মমতা ধীরে ধীরে ফ্রেমে প্রগাঢ়তা ছড়িয়েছে। কিন্তু ওখানেও পরস্পরের অহমিকা আর অশ্রদ্ধা প্রকট হয়েছে। স্বামীকে নতুন প্রেমিকের সাথে তুলনা করে ছোট করতে চাওয়া, কিংবা পথের মাঝে স্ত্রীকে গাড়ি থেকে ধাক্কা মেরে নামিয়ে দেয়ার দৃশ্যে যা স্পষ্ট। এ মুভি নিয়ে হলিউড টাইমস ভূয়সী প্রশংসায় বলেছে —
“Mesmerizing. Rich artistry and slow-burning moral anger.”
সত্য গল্পের গভীরতার জায়গা থেকে লাভলেস দারুণ শক্তিশালী বার্তা দেয়। চিত্রনাট্যের চমকপ্রদতায় সময়ের সাথে সাথে হারানো সন্তান নিয়ে দম্পতির মানসিক বিষাদ ও ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের সহাবস্থানকে দর্শকদের অনুভব করিয়েছেন জুভিয়াগিনসেভ। একই সময়ে সাবপ্লটে জেনিয়ার ভালোবাসাহীন জগতে তার মায়ের সাথে সম্পর্কও ভাবনার রসদ যোগায়। নিশ্চিতভাবে বলা যায়- চলচ্চিত্রের মাঝের সময়ের চলমান উত্তেজনা, আলিশার খোঁজ পাবার সামান্যতম আশা দর্শক অনুভূতিকে প্রবলভাবে ঝাঁকুনি দিতে সমর্থ হবে। বরিসের সাথে মাশার মিলনদৃশ্যে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের স্থায়িত্ব এবং একে অন্যের পাশে থাকার প্রসঙ্গ আসলে তাদের যে কথোপকথন উঠে আসে তা যথেষ্ট অর্থবহ এবং বাস্তবিক হয়ে দাঁড়ায়।
-মাশা আমি আজীবনই তোমার পাশে এভাবে থাকতে চাই।
-তুমি নিশ্চিতভাবে একই কথা কোনো একসময় তোমার সাবেক স্ত্রীকেও বলেছিলে।
লাভলেসের কারিগরি দিক যথেষ্ট সমৃদ্ধ। চলচ্চিত্রটির সিনেমাটোগ্রাফি করেছেন রাশিয়ান বিখ্যাত চিত্রগ্রাহক মিখাইল ক্রিচম্যান, যিনি আগেও অনেকগুলো চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন জুভিয়াগিনসেভের নির্দেশনায়। এ ছবিতে তার অনবদ্যতার পরিচয় পাওয়া যায় প্যানারোমা ধরায়। ওপেনিং সিনের টেপস্ট্রিপ ঝুলিয়ে দিয়ে যে স্মারক দর্শকমনে গেথে দিয়েছেন, সেটি আবার শেষ দৃশ্যে নিয়ে এসে আলিশার স্মৃতিচারণার চমৎকার এক ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছেন প্রথিতযশা সিনেমাটোগ্রাফার। এছাড়া লো-লাইটে বেডসিনে ক্যামেরা চরিত্রকে অনুসরণ করে শৈল্পিকভাবে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। গল্পের শক্ত গাঁথুনিতে মিউজিকনির্ভরতা ছিল না বললেই চলে। আর যেখানে ছিল তা প্রয়োজন সাপেক্ষে সিকুয়েন্স বিচারে পরিমিত প্রয়োগ মনে হয়েছে। তাছাড়া ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরেও মৃদুমন্দ শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা গিয়েছে।
মুভিতে দেখানো আলিশার নিখোঁজ হবার সময় তথা ঘটনাপ্রবাহ ২০১২ সালের। অথচ তখন ‘Sleepwalking’ নামক যে ট্র্যাকটি গাড়িতে প্লে করা হয়, তা রিলিজই হয় ২০১৩ সালে। তদ্রুপ, আরেক দৃশ্যে বরিসকে উইন্ডোজ ১০ অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করতে দেখা যায়, প্রকৃতপক্ষে যা রিলিজ হয় ২০১৫ সালে। তবে শিল্পসত্য বিবেচনায় ভুলগুলো বড় কোনো ভুল বলে বিবেচ্য হবে না। বরং, নৈরাশ্যবাদ এবং ব্যাড প্যারেন্টিংয়ের সুদৃঢ় গল্প হিসেবেই প্রতীয়মান হয় লাভলেস। বাবা-মায়ের টক্সিক রিলেশনশিপকে ১২ বছর বয়সী শিশুর অসহায় অবস্থান থেকে বর্ণনার দারুণ প্রয়াস লাভলেস। পাশাপাশি, একে আধুনিক সমাজ ব্যবস্থার ভালোবাসা ও অনুভূতিহীনতার মোক্ষম সমালোচনাও বলা যেতে পারে।
নির্মাতা আত্মস্বার্থকে অসামান্য দক্ষতায় ফ্রেমবন্দি করেছেন ছবিতে, যাতে সময়ের স্রোতে ভালোবাসা ফিকে হয়ে যাবার পুনরাবৃত্তি দেখা যায়। মুভির শেষাংশে আমরা দেখতে পাই নবজীবনে ভালোবাসার নতুন সঙ্গী পেয়েও তারা অসুখী। তাদের চেহারায় নির্লিপ্ততা, নিঃস্পৃহ ভাব আর বিরক্তিভরা অভিব্যক্তি জানান দেয়- তারা যা চেয়েছিল, তা পেয়েও আজ ভালো নেই। শেষ সিকুয়েন্সে সময় বদলে গেলে আলিশার হারানো বিজ্ঞপ্তির পোস্টারও বিবর্ণ অবস্থায় স্ক্রিনে ভেসে আসে। তাতে বোঝানো হয় যে, অজান্তে নিজেদের ফেলে আসা অবহেলার শিশুটি মাঝে মাঝে জেনিয়া ও বরিসকে এখনও, সামান্য হলেও, ভাবায়! বস্তুত ফিল্মটি দৃঢ়কণ্ঠেই বলতে চায়, “ভালোবাসা ছাড়া তুমি এই পৃথিবীতে বাঁচতে পারবে না।“
চলচ্চিত্র: Нелюбовь (Loveless)
পরিচালক: আন্দ্রেই জুভিয়াগিনসেভ
জনরা: ড্রামা ফিকশন
সাল: ২০১৭