১৯৫৯ সালে রূপালী পর্দায় যাত্রা শুরু করার পর থেকে তার অভিনীত মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রের মোট সংখ্যা প্রায় তিন অঙ্কের ঘর ছুঁয়েছে। পদ্মভূষণ, লিজিয়ন অফ অনার কিংবা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার থেকে শুরু করে দেশী-বিদেশী অসংখ্য পদকে সম্মানিত হয়েছেন তিনি। প্রায় ৮৩ বছর বয়সেও সৌমিত্র তখনও দারুণ সুঠাম দেহের অধিকারী সুদর্শন এক পুরুষ। গরম চায়ে ফুঁ দিতে দিতে বাংলা সিনেমা জগতের এই প্রবাদপ্রতীম মানুষটির একটি সাক্ষাৎকার নেয় ফিল্মফেয়ার ডট কম। নিখুঁত ব্রিটিশ ইংরেজিতে কথা বলতে বলতে মাঝেসাঝে বাংলা শব্দ ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়ে নিজের সমস্ত জীবনের গল্পের ঝুলি খুলে দিয়েছিলেন সৌমিত্র চ্যাটার্জী। চলুন তবে ঘুরে আসা যাক তার কর্মমুখর জীবনের টুকরো কিছু স্মৃতিচারণা থেকে।
ফিল্মফেয়ার: আপনার প্রথম সিনেমা সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’। সেই ১৯৫৯ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রায় প্রতি বছরই একটা না একটা ছবি উপহার দিয়ে যাচ্ছেন…
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়: সেটাই তো আমার কাজ। আমি একজন পেশাদার অভিনেতা আর সারাজীবন তা-ই হতে চেয়েছি। বাংলা থিয়েটারের কিংবদন্তী ব্যক্তিত্ব শিশির কুমার ভাদুড়ির সংস্পর্শে আসাটা আমার জন্য অনেক বড় সৌভাগ্যের বিষয় ছিল। তারপর জীবনে প্রথম সিনেমার ডাক পাই স্বয়ং সত্যজিৎ রায়ের কাছ থেকে। পরবর্তীতে এই সম্পর্কগুলো আমার খুব কাজে আসে। ক্যারিয়ারে সত্যজিৎ রায়ের অবদান আজীবন স্বীকার করে যাব।
ফিল্মফেয়ার: কিন্তু শিশির কুমার ভাদুড়ি তো সিনেমা জগতের প্রতি এতটাই বিতৃষ্ণ ছিলেন যে, সত্যজিৎ রায়ের ‘মহানগর’ (১৯৬৩) চলচ্চিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। আপনি কীভাবে এই জগতের প্রতি আকৃষ্ট হলেন?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়: ছোট্টবেলা থেকেই আমি সিনেমার নিয়মিত দর্শক ছিলাম। স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখতে যেতাম। তবে থিয়েটার ছিল আমার প্রথম ভালোবাসা। এখনো সুযোগ পেলে মঞ্চনাটকে কাজ করি। সামনের মাসেও বর্ধমানে গিয়ে মঞ্চে কাজ করব, তারপর আবার ফিরে আসব সিনেমার শ্যুটিংয়ে।
ফিল্মফেয়ার: সবকিছু একসাথে সামলাতে কোনো সমস্যা হয় না?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়: আমি ঠিক জানি না কীভাবে সব সামলাই। শারীরিকভাবে বেশ ক্লান্তি বোধ করি আজকাল। তবে আমার হাতে তো কোনো অপশন নেই। এটাই আমার কাজ, এটাই আমার জীবন, এভাবেই আমি নিজেকে তৈরি করেছি।
ফিল্মফেয়ার: একইসাথে আপনি একজন কবি, একজন লেখক, ছবি আঁকেন, এক্ষন নামে একটি ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেন… এত কিছু করার অনুপ্রেরণা পান কোত্থেকে?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়: শৈশব থেকেই সৃজনশীল কাজের প্রতি দুর্নিবার এক আকর্ষণ কাজ করত আমার মধ্যে। মোটামুটি সব কাজের কাজী কিন্তু কোনো কিছুতেই ওস্তাদ না- এরকম একটা অবস্থায় ছিলাম। তারপর ভেবে দেখলাম সবদিকে না ছুটে যে কাজগুলো করতে আমি বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি সেদিকেই আরও মনোযোগী হওয়া উচিৎ। কাজেই থিয়েটার আর আবৃত্তি হয়ে দাঁড়াল আমার প্রধান নেশা। বাবা-মা’র কাছ থেকে আমি সর্বাত্মক সহযোগিতা পেয়েছি।
ফিল্মফেয়ার: ‘অপুর সংসারের’ পেছনের গল্পটা কেমন ছিল? শোনা যায় সত্যজিৎ রায় আপনার সাথে চিত্রনাট্য শেয়ার করেছিলেন, যেটা তিনি আর কোনো অভিনেতার সাথে কক্ষনো করেননি…
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়: আসলে তিনি অপুত্রয়ীর দ্বিতীয় সিনেমা ‘অপরাজিত’ (১৯৫৬) এর জন্য কলেজ পড়ুয়া কৈশোর পেরোনো কাউকে খুঁজছিলেন। কিন্তু ঐ চরিত্রটির জন্য আমি একটু বেশি বড় ছিলাম। আমাকে যখন তার সামনে নিয়ে যাওয়া হলো, তিনি চিৎকার করে উঠলেন, “তুমি এত্ত লম্বা আর একটু বেশিই বড়!” ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে ‘গোল্ডেন লায়ন অনারারি অ্যাওয়ার্ড’ জেতার পর এই ত্রয়ীর তৃতীয় সিনেমায় হাত দেয়ার ঘোষণা দিলেন তিনি। তখন তো আমি ভাবতেও পারিনি উনি আমাকেই পছন্দ করবেন! (হেসে) বহু বছর পরে আমায় বলেছিলেন, আমাকে দেখেই নাকি তিনি তৃতীয় ছবিটি বানানোর কথা চিন্তা করেছিলেন। সত্যজিৎ রায়ের সিনেমায় অভিষেক ঘটার চেয়ে ভালো আর কী-ই বা হতে পারে? আরও অনেক অভিনেতাই উনার হাত ধরে সিনেমা জগতে পা রেখেছিলেন, কিন্তু সৌভাগ্যবশত আমি যেভাবে তরতর করে উঠে গেছি অন্য সবার ক্ষেত্রে তেমনটা ঘটেনি। আমরা একসাথে প্রায় ১৪টা সিনেমা আর দুটো ডকুমেন্টারি করেছি। এখনো মনে আছে, তার বাবা সুকুমার রায়কে নিয়ে বানানো একটি ডকুমেন্টারিতে আমি নেপথ্যে কণ্ঠ দিয়েছিলাম। খুব অবাক হয়েছিলাম তখন, কারণ ঐ একটি বাদে বাকি সব জায়গায় তিনি নিজের কণ্ঠই ব্যবহার করতেন।
ফিল্মফেয়ার: চলচ্চিত্রবোদ্ধারা আপনাকে ‘সত্যজিৎ রায়ের সম্পূরক আত্মা’ বলে ডাকতেন। এ ব্যাপারে কী কিছু বলতে চান?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়: তিনি জানতেন আমার কাছ থেকে কী চাইলে কী পাবেন, আর আমি জানতাম উনি আসলে আমার কাছ থেকে কী চান। দারুণ এক আত্মিক যোগাযোগ ছিল আমাদের দুজনের মধ্যে। আমার গুরু তিনি। তিনি কেবল আমার ক্যারিয়ারই গড়ে দেননি বরং আমার মানসিকতায়ও অভাবনীয় পরিবর্তন এনেছেন। আমাদের মধ্যে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত কিছু ব্যাপার-স্যাপারও আছে। তবে নিঃসন্দেহে তিনি ছিলেন অসাধারণ প্রতিভাবান একজন মানুষ। তিনি আমার গুরু, আমার সাথে তার কোনো তুলনা চলে না।
ফিল্মফেয়ার: কোনো এক সাক্ষাৎকারে একবার বলেছিলেন সত্যজিৎ রায় অভিনেতা হিসেবে আপনাকে অনেকটাই স্বাধীনতা দিয়েছিলেন, এমনকি যে সিনেমার মাধ্যমে আপনার অভিষেক ঘটেছিল সেখানেও…
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়: তিনি জীবনে কখনো এই শব্দগুলো উচ্চারণও করেননি যে আমার যা ইচ্ছে তাই করতে পারব। তবে তিনি বসে বসে আমাকে তার চিত্রনাট্যগুলো পড়ে শোনাতেন, যেগুলোতে আমি অভিনয় করিনি সেগুলো পর্যন্ত শোনাতেন। বেশ কয়েকবার আমি নিজে থেকে কিছু চরিত্র চেয়ে বসেছিলাম, তিনি ভুলেও রাজি হননি। (হেসে) ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ (১৯৬৮) সিনেমার গুপী চরিত্রটি করার জন্য আমি উঠেপড়ে লেগে গেছিলাম। চিত্রনাট্য শুনেই একেবারে লাফিয়ে উঠেছিলাম, অনেক অনুনয়-বিনয় করি আমাকে নেয়ার জন্য। সত্যজিৎ রায় আমার মুখের উপর বলে দিলেন, “তোমাকে দেখে কোনো দিক থেকেই কৃষকের ছেলে বলে মনে হয় না”। মজার ব্যাপার হচ্ছে, শেষপর্যন্ত তপেন চ্যাটার্জী যখন চরিত্রটিতে অভিনয় করলেন, আমার মনে হলো গুপী চরিত্রের জন্যই তার জন্ম হয়েছে। তিনি এতটাই অনবদ্য ছিলেন যে আমি মানিকদাকে (সত্যজিৎ রায়) গিয়ে বলতেও পারিনি আমি অভিনয় করলে আরও ভালো হতো! তবে পরবর্তীতে এই সিরিজের ‘হীরক রাজার দেশে’ (১৯৮০) সিনেমায় উদয়ন পণ্ডিত চরিত্রে ঠিকই নিজের জায়গা করে নিয়েছিলাম। শুরু থেকে আমাদের একসাথে করা শেষ সিনেমা ‘শাখা-প্রশাখা’ (১৯৯০) পর্যন্ত সব ছবিতে তিনি আমাকে অভিনয়ের স্বাধীনতাটুকু দিয়েছিলেন। আমাকে ডেকে বললেন ছোট্ট একটা রোল আছে, সব মিলিয়ে ২৫টা ডায়লগও হবে না, আমি সেখানে কাজ করতে চাই কিনা। হেসে ফেললাম আমি। মানিকদা যদি বলতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছাতার মতো ঘরের এক কোণায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, আমি নিঃসঙ্কোচে সেই চরিত্রে কাজ করতেও রাজি হয়ে যেতাম।
ফিল্মফেয়ার: ‘শাখা-প্রশাখা’ ছিল সত্যজিতের একদম শেষদিকের একটি সিনেমা, আপনার সাথে করা শেষ সিনেমা। এটাকে কীভাবে আলাদা করবেন?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়: মানিকদা আমাকে বললেন, “শোন সৌমিত্র, সারাজীবন তোমাকে তোমার মতো কাজ করার সুযোগ দিয়েছি আমি। তবে এই সিনেমায় আমরা দুজন একসাথে চিন্তা করব”। মানসিক বিকারগ্রস্ত এক লোকের চরিত্র ছিল সেটি। তিনি বলেন, “এমন অনেক লোককে আমি দেখেছি, তুমিও দেখেছ। তাদের ব্যবহার বাকিদের থেকে একদম আলাদা, চিত্রনাট্য লেখার সময় সেই আলাদা ব্যাপারগুলো আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই”।
ফিল্মফেয়ার: এই সুদীর্ঘ পথচলায় কোনো একটি ঘটনার কথা বলবেন যা আপনার মন ছুঁয়ে গিয়েছিল?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়: ক্যারিয়ারের পাঁচ দশকে হাজার হাজার দিন-রাত শ্যুটিং করেছি আমি। তবে প্রথমদিন ‘অপুর সংসারের’ সেটে হাজির হওয়ার কথাটা আমি কোনোদিন ভুলব না। দৃশ্যটা ছিল এমন- অপু চাকরির খোঁজে একটা লেবেলিং ফ্যাক্টরির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে ভেতরে সবাই রোবটের মতো কাজ করেই চলেছে। এই কাজ তার দ্বারা হবে না ভেবেই সে নার্ভাস হয়ে পড়ে।
ফিল্মফেয়ার: আপনার সহকর্মীদের কথায় আসা যাক। উত্তম কুমার আর আপনার মধ্যে যদি তুলনা করা হয় তবে আপনাকে বলা হয় ‘মেধাবী অভিনেতা’ আর উত্তম কুমারকে বলা হয় ‘পপ আইকন’…
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়: (থামিয়ে দিয়ে) এইসব উপাধি… একদম পছন্দ করি না আমি। একজন ভালো অভিনেতা অবশ্যই মেধাবী হবেন, তার পা মাটিতেই থাকবে। আর মেধাবী না হলে কেউ এত সহজে জনপ্রিয়তা পায় না। ফিল্মে আসার বহু বছর আগে থেকেই উত্তম কুমারকে চিনি আমি।
ফিল্মফেয়ার: উত্তম কুমারের সাথে আপনার সম্পর্কের সমীকরণটা কেমন ছিল?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়: তিনি আমার ভগ্নীপতির খুব কাছের বন্ধু ছিলেন। প্রথমবার তার সাথে আমার দেখা হয় আমাদের বাড়িতে, আমার বোনের বিয়েতে। প্রথমবার আমরা দুজন একসাথে কাজ করি তপন সিনহার ‘ঝিন্দের বন্দী’ (১৯৬১) সিনেমায়। সেটের বাইরে কাজ করতে গিয়ে দুজন দুজনার প্রেমে পড়ে যাই। (হেসে) তারপর যার যার ক্যারিয়ারের নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত আমাদের বন্ধুত্ব অটুট ছিল।
ফিল্মফেয়ার: আপনার তো বিশাল একটি নারী ফ্যানচক্র রয়েছে। কীভাবে সামলাতেন সেসব?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়: আহ, এই ব্যাপারটি খুবই মজার ছিল। নারীদের আকর্ষণ পেতে ভালো লাগত না বললে মিথ্যা বলা হবে। প্রথম ফ্যানের কাছ থেকে পাওয়া প্রেমপত্রটি আমার স্ত্রী দীপা বহু বছর সযত্নে তুলে রেখেছিল। তারপর বেশ কয়েকবার আমরা বাড়ি বদলাই আর কালে কালে সেটা হারিয়ে যায়। (হেসে) চিঠিটার সারমর্ম ছিল এরকম- ‘আমার দুর্ভাগ্য যে তুমি বিবাহিত’। এরপর আরও কয়েক হাজার চিঠি পেয়েছিলাম, কিন্তু এটা প্রথম হওয়ায় আলাদা একটা অনুভূতি জড়িয়ে ছিল এর সাথে।
ফিল্মফেয়ার: লোকে এখনো আপনাকে সত্যজিৎ রায়ের ‘সোনার কেল্লা’ (১৯৭৪) আর ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ (১৯৭৯) সিনেমার তরুণ গোয়েন্দা ফেলুদা হিসেবে চেনে। সত্যজিৎ তো আপনার কথা চিন্তা করেই উপন্যাসে ফেলুদার ছবি আঁকতেন বলে শোনা যায়।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়: শুরুর দিককার স্কেচগুলো ঠিক আমার মতো না। আমার মনে আছে, মানিকদা বলতেন তিনি এই উপন্যাসে নিজেকেই তুলে ধরতে চাইতেন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ফেলুদা দেখে দেখে বড় হয়েছে, আর তাদের চোখে আমি আজও ফেলুদাই রয়ে গেছি। সত্যি বলতে, প্রথমদিকে লোকে আমাকে ফেলুদা বলে ডাকলে ভালো লাগত না আমার। আমি ভাবতাম, “জীবনে কম তো ভালো সিনেমা করিনি। তাহলে কেন শুধু ফেলুদার নামেই আমাকে মনে রাখা হবে? অপুর সংসার বা অশনি সংকেতের জন্য নয় কেন?” পরে অবশ্য সে ভুল ভেঙেছে। আমার কাজ লোককে আনন্দ দেয়া। যদি একজন ভক্তও আমাকে ফেলুদা হিসেবে মনে রাখে, তাতে আমার খুশি হওয়া উচিৎ, রাগ না। তাছাড়া সে সময়ে বাচ্চাদের সিনেমা খুব একটা বানানোও হতো না। আমি ঘরে ফিরে নিজের দু’বাচ্চার মুখের দিকে তাকিয়ে ছবিটি করিনি, সারা বাংলার বাচ্চাদের জন্য করেছি।
ফিল্মফেয়ার: ফেলুদার আচার-আচরণ ছিল একেবারেই স্বতন্ত্র। আপনার কী কখনো মনে হয়েছিল সৌমিত্র চ্যাটার্জীও ফেলুদা হতে পারে?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়: (মৃদু হেসে) ফেলুদা ছিল কিছুটা আমার মতো, কিছুটা সত্যজিৎ রায়ের মতো। ফেলুদা, আমি আর সত্যজিৎ রায় ছিলাম একটি সুখী ত্রিভুজীয় প্রেমকাহিনীর তিনটি চরিত্র।
ফিল্মফেয়ার: ঋষিকেশ মুখার্জী, দিলীপ কুমার, রাজ কাপুর… সবাই হিন্দি সিনেমায় অভিনয় করার জন্য মুখিয়ে ছিলেন, কিন্তু আপনি তা সবসময় এড়িয়ে গেছেন। কেন?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়: আমি জানি না কেন। আজকের দিনে হলে আমি হয়তো ঐ ছবিগুলোতে কাজ করতে মানা করতাম না। তখন বয়স কম ছিল, বুদ্ধি-সুদ্ধি কম ছিল, টাকার দরকারটাও সেভাবে বুঝিনি। সত্যি বলতে, হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে বাকিদের কাজ করতে দেখে নিজে কখনো উৎসাহ পাইনি। ওখানে গিয়ে কাজ করলে আমি কবিতা লিখতে পারতাম? মঞ্চে কাজ করতে পারতাম? হ্যাঁ, হিন্দি সিনেমায় কাজ করলে আমার নাম-যশ-খ্যাতি অনেকটাই বেড়ে যেত। কিন্তু আমি তো সত্যজিৎ রায়ের সাথে অসংখ্য কাজ করেছি, আন্তর্জাতিকভাবে সেগুলো স্বীকৃতি পেয়েছে। আমাকে লোভ দেখানোর আর কী-ই বা থাকতে পারে? পরবর্তীতে আমি টিভি ফিল্মে অভিনয় করেছিলাম, সবাইকে জানানোর জন্য যে আমিও হিন্দি বলতে পারি।
ফিল্মফেয়ার: নাসিরুদ্দিন শাহ নাকি আপনার অনেক বড় ভক্ত। দেখা হয়েছে তার সাথে?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়: হ্যাঁ, বেশ কয়েকবার। একসাথে বার্লিনে গিয়েছিলাম আমরা। তার কাছ থেকে চমৎকার একটি প্রশংসাবাণী শোনার আগ পর্যন্ত জানতামই না যে উনি আমার ভক্ত। বার্লিনে আকিরা কুরোসাওয়ার একটি ফিল্ম দেখতে যাই আমরা। সিনেমা চলার সময় তিনি আসেননি। পরদিন সকালে জিজ্ঞেস করলাম আসোনি কেন। উত্তর দিল, “দাদা, অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছিলাম জুতোর ফিতাগুলো ঠিকমতো বাঁধার। কিন্তু তখনই শুনতে পেলাম টেলিভিশনে নাকি অশনি সংকেত দেখাবে। সত্যজিৎ রায়ের এই একটি সিনেমা আমি দেখিনি। কুরোসাওয়ার সিনেমা নাহয় ভারতে গিয়ে দেখে নেয়া যাবে, কিন্তু ভিনদেশে বসে সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা দেখার মজা আমি কোথায় পাব?” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “নাসির, সিনেমাটি তোমার কেমন লেগেছে? আমার কাজ ভালো লেগেছে?” সে বলল, “দাদা, অভিনেতা হিসেবে নিজেকে তখনই সার্থক মনে করব যখন আপনি যেভাবে আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন, আমিও কাউকে সেভাবে অনুপ্রাণিত করতে পারব”। সে আমার কাজের অনেক প্রশংসা করেছে, আমিও তার কাজ পছন্দ করি।
ফিল্মফেয়ার: তপন সিনহা, মৃণাল সেন, তরুণ মজুমদার… বড় বড় সব চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সাথে কাজ করেছেন। বাদ পড়েছেন কেবল ঋত্বিক ঘটক। তিনি ‘কোমল গান্ধার’ (১৯৬১) সিনেমায় আপনাকে প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। অনুশোচনা হয়নি কখনো?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়: না, এই ব্যাপারগুলো কখনো মাথায় আসে না। আমার মনে হয়েছে আমাদের দুজনের জুটি মোটেও জমবে না। ব্যক্তিগতভাবে তাকে আমি একদমই পছন্দ করি না, সোজা হিসেব। পরিচালক হিসেবে, তিনি অসাধারণ।
ফিল্মফেয়ার: সুজয় ঘোষের শর্টফিল্ম ‘অহল্য’তে একেবারে নতুন একটি মাধ্যমে কাজ করেছেন আপনি। কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়: মাধ্যমের বিচার আমি বুঝি না। এইসব বিষয়ে আমাকে মূর্খ বলা যেতে পারে। কম্পিউটার কীভাবে কাজ করে সেটাও আমি জানি না। আমার সামনে যদি একটি ক্যামেরা নিয়ে কেউ দাঁড়িয়ে বলে অভিনয় করতে হবে, আমি করব। সুজয়ের ‘কাহানী’ ছবিটা আমার দারুণ লেগেছিল। বুঝেছিলাম ছেলেটা কাজ জানে। কাজেই ও যখন সিনেমা করার অনুরোধ করল আমি খুশিমনেই হ্যা বলে দিলাম। অভিজ্ঞতা ভালোই ছিল। রাধিকা আপ্তে অসাধারণ কাজ দেখিয়েছে।
ফিল্মফেয়ার: তরুণদের সাথে কাজ করতে কেমন লাগছে?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়: যদি তারা ভালো কাজ করে, আমি খুব উপভোগ করি। আর কাজ ভালো না হলে বিরক্ত লাগে।
ফিল্মফেয়ার: আপনি তাদের কাজ দেখেন?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়: বেশিরভাগ ভালোরাই তো কাজ করছে হিন্দি সিনেমায়। বাংলা সিনেমা দেখারই সময় পাই না, আর তো হিন্দি। আসলে আজকাল বাংলা সিনেমা দেখতে ভালো লাগে না, মান খুব খারাপ হয়ে গেছে সিনেমার।
ফিল্মফেয়ার: তখনকার আর এখনকার মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়: দুই দশকের মধ্যে দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমা নকল করে মূলধারার সব বাংলা সিনেমা বানানোর প্রথা চালু হয়ে গেছে। সৌভাগ্যবশত সে দিনগুলো আমরা অনেকটাই পার হয়ে এসেছি, তরুণ নির্মাতারা সুন্দর সিনেমা বানাচ্ছে এখন। কিন্তু বিষয়বস্তুর দুর্বলতার কথা এখানে না বললেই নয়। ছবির ভেতরে এখন আর কোনো প্রাণ নেই, কেমন যেন সব চালবাজি মনে হয়।
ফিল্মফেয়ার: পুরো ইন্ডাস্ট্রিরই কি একই অবস্থা বলে আপনি মনে করেন?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়: কেউ কেউ তো অবশ্যই ভালো করছে, নাহলে সুজয়ের ‘কাহানী’র মতো সিনেমা এলো কী করে? হিন্দি হলেও এটি মূলত একটি বাংলা সিনেমা। খালি কলকাতায় শ্যুটিং হয়েছে বলেই বলছি না, এর মধ্যে কলকাতার প্রাণ রয়েছে, লোকজন রয়েছে, আবহ রয়েছে।
ফিল্মফেয়ার: ক্যারিয়ারের পাঁচ দশকে আপনার সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা কী?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়: বিশ্বস্ত হওয়া, সৎ হওয়া।
ফিল্মফেয়ার: আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তিগুলো কী কী?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়: নাটক-সিনেমার প্রতি ছোটবেলা থেকেই আমার এক ধরনের টান ছিল। অভিনেতা হিসেবে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি অপুর সংসারে কাজ করার সুযোগ পাওয়া, আমার জীবনই বদলে দিয়েছে ঐ একটি ঘটনা। আর ব্যক্তিগত জীবনের কথা বললে বাচ্চারাই আমার সব।