জাদু শিখতে গিয়ে পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে, জাদু জগতে এমন দুষ্ট জাদুকরদের সংখ্যা নেহাতই কম নয়। কৌতূহল হোক বা ক্ষমতার ভয়ংকর লোভ, কালো জাদুর দুনিয়ায় চৌকাঠ মাড়ানোটা জাদু জগতে ভয়ানক সব ধ্বংসলীলা ও যুদ্ধ ডেকে এনেছে। জাদু জগত দাপিয়ে বেড়ানো খলনায়ক গ্রিন্ডেলওয়াল্ড বা ত্রাস ছড়ানো লর্ড ভলডেমর্ট, প্রত্যেকেই খুলে দিয়েছিল অন্তহীন দুর্দশার পথ। তারা কালো যাদুর ছাউনি ঘেরা রাজত্ব তৈরি করতে চেয়েছিল জাদু জগতে। পথভ্রষ্ট সেই জাদুকরদের পাকড়াও করে নরক-তুল্য কারাগার আজকাবানে প্রেরণের দায়িত্ব যারা পালন করত, তাদের হ্যারি পটার ফ্র্যাঞ্চাইজিতে জে.কে. রোলিং অরোর বলে উল্লেখ করেছেন।
ডার্ক আর্টসের বিরুদ্ধে অরোরেরা সর্বদা উঁচিয়ে রেখেছেন তাদের সুরক্ষা ঢাল, জাদু জগতকে বাঁচাতে চেয়েছেন তাদের কালো থাবা থেকে। তাদের নিয়োগ দেওয়া হয় মূলত জাদু মন্ত্রণালয় থেকে। কিন্তু যে কেউ চাইলেই অরোর হতে পারবে না। এজন্য দরকার হবে কঠোর প্রশিক্ষণ, জাদু সম্পর্কে বিশেষ দক্ষতা, এবং প্রখর বুদ্ধিমত্তা ও প্রচণ্ড সাহস। নির্বাচিত অরোরদের মধ্যে অনেকে হয়ে রয়েছেন চিরস্মরণীয়, আবার অনেকে ডুব দিয়েছেন বিস্মৃতির অতল গভীরে। জাদু জগতে কিংবদন্তিতুল্য খ্যাতনামা কিছু বিশেষ অরোরকে নিয়েই আজকে আমাদের এই আয়োজন, যারা তাদের সাহসের পাখা মেলে ধরে হয়ে আছে চির-অমর।
হেসফাসটাস গোর
হেসফাসটাস গোর সম্ভবত একদম প্রথম দিকের একজন অরোর। ১৭৩৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে জন্ম নেওয়া এই জাদুকর অরোর পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন এল্ড্রিচ ডিগরির আমলে। এল্ড্রিচ ডিগরি ১৭৩৩-১৭৪৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত জাদু মন্ত্রণালয়ে কর্মরত ছিলেন। জাদু দুনিয়ায় তার খ্যাতি ছিল আকাশচুম্বী, এবং প্রথম অরোর নিয়োগ পরীক্ষায় তিনি ছিলেন সেই নির্বাচনী পরীক্ষার প্রথম মন্ত্রী।
১৭৫২ সালে অস্থায়ী জাদু-মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন হেসফাসটাস। গবলিন বিদ্রোহের সময় তার পূর্বপুরুষ ব্যাসিল ফ্ল্যাককে চাকরিচ্যুত করার পর তাকে জাদু মন্ত্রণালয়ে স্থায়ী পদ দেয়া হয়। তার সম্পর্কে বেশি কিছু না জানা যায়নি। তবে তিনি গবলিন বিদ্রোহ ও আজকাবানের সুরক্ষা জোরদার ইত্যাদি কাজের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৭৫৪ সালে মন্ত্রী গোর এবং ইতালিয়ান জাদু মন্ত্রী অ্যাবারডিন থেকে রোম পর্যন্ত এক ব্রুমদৌড়ের আয়োজন করেন। এ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল তৎকালীন ইউরোপের খ্যাতনামা দুই ফ্লায়ার, টরকিল ম্যাকট্যাভিশ ও সিলভিও অ্যাস্টলফি। ১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দে ৮০ বছর বয়সে তিনি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
পারসিভিয়াল গ্রেইভস
গেলার্ট গ্রিন্ডেলওয়াল্ড কর্তৃক অপহৃত হবার আগপর্যন্ত পারসিভিয়াল গ্রেইভস ছিলেন ‘ম্যাজিক্যাল কংগ্রেস অভ দ্য ইউনাইটেড স্টেটস অভ আমেরিকার একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। ১৮৮৬ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেন এই জাদুকর। স্কুল জীবনের দুর্দান্ত ফলাফল ও অর্জন তাকে ওই সংস্থার জাদু প্রয়োগ আইন বিভাগের (ডিপার্টমেন্ট অভ ম্যাজিক্যাল ল এনফোর্সমেন্ট) প্রধান, জাদু প্রতিরক্ষা পরিষদের মহাপরিচালক পদে আসীন হতে সহায়তা করেছে।
১৯২৬ সালের ডিসেম্বর মাসে হিউম্যান ট্রান্সফিগারেশন নামক জাদু ক্ষমতা ব্যবহার করে গেলার্ট গ্রিন্ডেলওয়াল্ড গ্রেইভসের রূপ ধারণ করেন। গ্রিন্ডেলওয়াল্ডের নাশকতার সময় তিনি কোথায় বন্দি ছিলেন, বা তার কী হাল হয়েছিল- তা এখনো অজানা। জাদুবিদ্যার বিশেষ কতগুলো শাখায় পারসিভিয়ালের ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য। একজন অরোর হবার দরুন ডুয়েলিং, মার্শাল ম্যাজিক, কালো জাদুর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা, হার্বোলজি, পোশন, চার্ম ইত্যাদি বিষয়ে ছিল তার বিশেষ দক্ষতা।
থিসেয়াস স্ক্যামান্ডার
হাউজ হাফলপাফ থেকে যে কয়জন খ্যাতনামা জাদুকর জগদ্বিখ্যাত হয়েছেন, তন্মধ্যে থিসেয়াস স্ক্যামান্ডার অন্যতম। ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে স্ক্যামান্ডার পরিবারে জন্ম নেন বিখ্যাত এই জাদুকর। উল্লেখ্য যে, থিসেয়াস স্ক্যামান্ডার হচ্ছেন নিউট স্ক্যামান্ডারের বড় ভাই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মাগলদের বিশেষ সাহায্য করায় তিনি ‘ওয়ার হিরো’ খেতাব পান। জাদুমন্ত্রী আর্চার এভারমন্ড মাগলদের এই বিশ্বযুদ্ধ থেকে সকল জাদুকরদের দূরে থাকতে বলেছিলেন। কিন্তু বাধা সত্ত্বেও সাহসী থিসেয়াস সে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।
অরোর অফিসের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হবার পর তিনি গেলার্ট গ্রিন্ডেলওয়াল্ড পাকড়াও অভিযানে শামিল হন। গ্রিন্ডেলওয়াল্ডের হাতে হাতকড়া না পরাতে পারলেও, তিনি প্যারিসে গ্রিন্ডেলওয়াল্ডের জনসভায় জাদুকরদের রক্ষা করতে পেরেছিলেন। জাদুবিদ্যায় তিনি অসাধারণ দক্ষতা হাসিল করেছিলেন। হগওয়ার্টস থেকে গ্রাজুয়েশনের পর জাদু মন্ত্রণালয়ে অরোর হিসেবে যোগ দিলে, নিজ মেধা ও দক্ষতার বলে অল্পসময়েই অরোর বিভাগের প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হন। অরোর প্রশিক্ষণে তিনি কনসিলমেন্ট অ্যান্ড ডিজগাস, স্থিলথ অ্যান্ড ট্র্যাকিং কোর্সগুলোতে সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।
গ্লোবাল উইজার্ডিং ওয়ারে ব্রিটিশ জাদু মন্ত্রণালয় তাকে গ্রিন্ডেলওয়াল্ড পাকড়াও অভিযানে পাঠানোর পর, ফরাসি জাদু মন্ত্রণালয় তাকে মেঘ-পিশাচ ক্রিডেন্স ব্যারবোনের খোঁজে পাঠায়। কালো জাদুর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা, চার্ম, দ্বন্দ্বযুদ্ধ, নেতৃত্ব দানের ক্ষমতা, প্রায় সবকিছুতেই ছিল থিসেয়াসের জুড়ি মেলা ভার। জাদু জগতের ইতিহাসে তিনি ছিলেন অন্যতম সফল একজন অরোর।
রাফাস স্ক্রিমগেয়র
জাদু-মন্ত্রণালয়ে অরোর হিসেবে যোগ দেয়ার পর তার জীবনের বেশিরভাগ সময় ব্যয় হয়েছে কালো জাদুকরদের পেছনেই। অরোর বিভাগে তার সহকর্মী ছিল জন ডলিশ, প্রাউডফুট, নিমফ্যাডোরা টঙ্কস, কিংসলি শ্যাকলবোল্টের মতো জাদুকরেরা। তিনি অরোর অফিসের প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হবার পর পরই আজকাবান থেকে পালিয়ে যান সিরিয়াস ব্ল্যাক। সেজন্য তিনি প্রায়শই টঙ্কস ও শ্যাকলবোল্টকে সিরিয়াসের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেন। ১৯৯৬ সালের জুন মাসে রহস্য বিভাগে লড়াইয়ের পর ভলডেমর্টের প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে জাদু জগত নিশ্চিত হয়।
এর আগে কর্নেলিয়াস ফাজের অধীনে থাকা মন্ত্রণালয় ভলডেমর্টের অস্তিত্বকে নাকচ করার পাশাপাশি ডাম্বলডোর এবং হ্যারিকে মিথ্যাবাদী হিসেবে ঘোষণা করে। পরবর্তী সময়ে ভলডেমর্ট ব্রিটেনের জাদু সমাজ ও মাগল সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করলে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন কর্নেলিয়াস ফাজ। তার স্থলাভিষিক্ত করা হয় স্ক্রিমগেয়রকে। অ্যালবাস ডাম্বলডোরের ভাষায় রাফাস ছিলেন, ‘ম্যান অভ অ্যাকশন’। অপরাধ করলে তিনি সাথে সাথে শাস্তি দিয়েছেন।
রন উইজলি
ব্যাটেল অভ হগওয়ার্টসের পর পড়ালেখা সমাপ্ত করার উদ্দেশ্যে আর কখনো হগওয়ার্টসের চৌকাঠ মাড়ায়নি রন উইজলি। হরক্রাক্স ধ্বংস করা, হ্যারি এবং হারমায়নিকে বাকি হরক্রাক্সগুলো খুঁজতে সহযোগিতা করা, এবং ডেথ ইটার ধরপাকড়ে হ্যারি পটারকে পরিপূর্ণ সাহায্য করায়, রনকে সরাসরি অরোর হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। সেখানে দু’ বছর কাজ করার পর সে মন্ত্রণালয় ত্যাগ করে জর্জ উইজলির সাথে উইজলি’স উইজার্ড হুইজেস নামক দোকানটা আবার চালানো শুরু করে দেয়।
নেভিল লংবটম
হগওয়ার্টসের হার্বোলজি বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে নির্বাচিত হবার আগে কিছুদিন অরোর হিসেবে কাজ করেছিল নেভিল লংবটম। জাদুমন্ত্রী কিংসলি শ্যাকলবোল্টের ইচ্ছা ছিল, হ্যারি, রন এবং নেভিল কিছুদিন অরোরের দায়িত্ব পালন করে ডেথ ইটারদের বন্দী করতে সাহায্য করুক। সপ্তম বর্ষে এসে ডাম্বলডোর’স আর্মিকে পরিচালনা ও ভলডেমর্টের সর্বশেষ হরক্রাক্স নাগিনী বধের মাধ্যমেই নেভিল বুঝিয়ে দিয়েছিল, তার মধ্যে অরোর হবার সকল যোগ্যতা মিটমিট করে জ্বলছে। সিনেমা ও বইয়ের বিভিন্ন জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে, হার্বোলজিতে ছিল লংবটমের বিশেষ দখল। বাকি ডেথ ইটারদের পাকড়াওয়ের পর সে স্থায়ীভাবে প্রফেসর স্প্রাউটের অধীনে হগওয়ার্টসের হার্বোলজি বিভাগে যোগদান করে।
টিনা গোল্ডস্টেইন
গ্রিন্ডেলওয়াল্ড, নিউট স্ক্যামান্ডারদের আমলে টিনা গোল্ডস্টেইন ছিল এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম। ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করেন হাফ-ব্লাড এই নারী জাদুকর। ব্রিটিশ জাদুকর নিউট স্ক্যামান্ডার বিচিত্র প্রাণীর সন্ধানে সুদূর আমেরিকায় পাড়ি জমালে, নো-ম্যাজদের (জাদু না জানা সাধারণ মানুষ ) সামনে থেকেই কৌশলে তাকে পাকড়াও করতে সক্ষম হন টিনা।
বিখ্যাত জাদুকর গ্রিন্ডেলওয়াল্ডের মুখোমুখি হবার পর, দ্বন্দ্বযুদ্ধে গ্রিন্ডেলওয়াল্ডের হাত থেকে ছড়ি ছিনিয়ে নেন টিনা। থিসেয়াস স্ক্যামান্ডারের মতো পটু জাদুকর ক্রিডেন্স বারবোনের সন্ধান বের করে ফেলার আগেই, টিনা ক্রিডেন্সের অবস্থান শনাক্ত করতে পেরেছিলেন। এমনকি টিনা গ্রিন্ডেলওয়াল্ডের ছড়িয়ে দেয়া নীল আগুনকেও নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছিলেন, যাতে সেটা পুরো প্যারিসকে ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত করতে না পারে।
মন্ত্রবিদ্যায় টিনা গোল্ডস্টেইন ছিলেন অন্যদের চেয়ে এককাঠি সরেস। লোকোমোশন চার্ম দিয়ে তিনি নৈশভোজের আয়োজন করে ফেলতে পারতেন, ফ্রেঞ্চ মিনিস্ট্রি অভ ম্যাজিক আর্কাইভে সাধারণ একটা মন্ত্রের মাধ্যমেই লেস্ট্রেঞ্জ পরিবারের সেকশন খুঁজে বের করা, গ্রিন্ডেলওয়াল্ডের ব্ল্যাক ফায়ার প্রতিরোধে শিল্ড চার্ম ব্যবহার করা সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্র তিনি খুব সুনিপুণ ভাবে প্রয়োগ করতে পারতেন।
অ্যালিস এবং ফ্র্যাংক লংবটম
হ্যারি পটার মুভিতে হাবাগোবা, সহজ-সরল গোছের নেভিল লংবটমকে দেখে থাকলেও, অনেকেই তার মা-বাবা অ্যালিস ও ফ্র্যাঙ্ক লংবটম সম্পর্কে তেমন কিছু জানে না। অর্ডার অভ দ্য ফিনিক্সের সক্রিয় সদস্য এবং অরোর হিসেবে গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন এই দম্পতি। তারা ভলডেমর্টের মতো দুর্ধর্ষ জাদুকরের মুখোমুখিও হয়েছে তিন-তিনবার। নিজের প্রথম উত্থানের পর অর্ডার অভ দ্য ফিনিক্সের সামনে দাঁড়াতে পারেনি ভলডেমর্ট।
কিন্তু যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে, নেভিল লংবটম যখন সবেমাত্র শিশু, তখন বেল্লাট্রিক্স লেস্ট্রেঞ্জ, তার স্বামী, এবং বার্টি ক্রাউচ জুনিয়র মিলে অ্যালিস ও ফ্র্যাঙ্কের উপর অমানবিক জুলুম চালিয়েছে। নির্যাতনের এক পর্যায়ে তারা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। পরবর্তী সময়ে তাদেরকে সেন্ট মাঙ্গোস হাসপাতালে পাঠানো হয়। অরোর থাকাকালীন, অ্যালিস্টার মুডিদের সাথে কাঁধ মিলিয়ে ভলডেমর্টের অনুসারীদের গ্রেফতারে সাহায্য করেছেন এই লংবটম দম্পতি।
নিমফ্যাডোরা টঙ্কস
অর্ডার অভ দ্য ফিনিক্সের অন্যতম অনুগত জাদুকর, অরোর হিসেবে নিমফ্যাডোরা টঙ্কস তার দায়িত্ব পালন করেছেন বহুবার।
জাদু মন্ত্রণালয় ভলডেমর্টের প্রত্যাখ্যান পুরোপুরিভাবে অস্বীকার করলেও নিমফ্যাডোরা টঙ্কস ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন, অর্ডার অভ দ্য ফিনিক্সের সদস্য ও অরোর, দু’দিকেই কাজ চালিয়ে যেতে হবে। জাদু জগতের দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তাকে এক বৈঠা দিয়ে দুই নৌকা চালানোর মতো কাজ করতে হয়েছে। রহস্য বিভাগের ভবিষ্যদ্বাণীর সুরক্ষা দেওয়া, অর্ডার অভ দ্য ফিনিক্সকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করার পাশাপাশি, মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী রাফাস স্ক্রিমগেউরের চোখ ফাঁকি দিয়েও সুকৌশলে অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে হয়েছে।
দ্বন্দ্বযুদ্ধে দোর্দণ্ড ক্ষমতা অর্জন করা এই অরোর রহস্য বিভাগ, অ্যাস্ট্রোনমি টাওয়ার, সেভেন পটারের যুদ্ধ, এবং ব্যাটেল অভ হগওয়ার্টসে বহু ডেথ ইটারকে ধরাশায়ী করেছেন। তিনি ছিলেন একজন ম্যাটামরফম্যাগাস, যিনি পলিজুস পোশান বা মন্ত্র ছাড়াই তৎক্ষণাৎ ইচ্ছানুযায়ী নিজের রূপ বদল করতে পারতেন। এটি করতে জাদুবিদ্যায় গভীর জ্ঞান ও নিয়ন্ত্রণ থাকা লাগে। ব্রিটিশ এ হাফ-ব্লাড জাদুকর ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে হগওয়ার্টসে ভর্তি হলে সর্টিং হ্যাট তাকে হাউজ হাফলপাফের জন্য নির্বাচিত করে।
তিনি ছিলেন গ্রিফিন্ডরের চার্লি উইজলির ব্যাচমেট। ১৯৯১ সালে হগওয়ার্টসের পাট চুকিয়ে জাদু মন্ত্রণালয়ে যোগ দেয়ার পর ম্যাড-আই মুডির অধীনে থেকে, সকল গুরুত্বপূর্ণ জাদু কৌশল আয়ত্তের মাধ্যমে নিজেকে পরিণত করেন অন্যতম সেরা এক অরোরে। ১৯৯৫ সালে সেকেন্ড অর্ডার অভ দ্য ফিনিক্সে যোগ দেবার পর তিনি মন্ত্রণালয়ে গোয়েন্দার মতো গুরুদায়িত্ব পালন করেন।
এসব দক্ষতার পাশাপাশি মন্ত্রবিদ্যা, কালো জাদুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, হার্বোলজি, পোশন, ব্রুমস্টিক ফ্লাইং ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও টঙ্কসের ছিল পরিপূর্ণ দখল। স্কোরিং চার্ম, স্টানিং স্পেল, শিল্ড চার্মের ব্যবহার তার কাছে ছেলেখেলা ছিল মাত্র। এছাড়াও হগওয়ার্টসে চতুর্থ বর্ষে থাকাকালীনই তিনি প্যাট্রোনাস কাস্টের ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। ডেথ ইটারদের মধ্যে শুধুমাত্র বেল্লাট্রিক্স লেস্ট্রেঞ্জই তাকে টেক্কা দেবার মতো ক্ষমতা রাখত।
কিংসলি শ্যাকলবোল্ট
নীল আলখাল্লা ও টুপি পরিহিত কৃষ্ণাঙ্গ জাদুকর কিংসলি শ্যাকলবোল্টের সাথে হ্যারি পটার ভক্তরা সুপরিচিত। জাদু মন্ত্রণালয়ের দক্ষ এই পিওর ব্লাড অরোরের হগওয়ার্টস জীবন সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। কিংসলি জাদু মন্ত্রণালয়ে উঁচু মাপের একজন অরোর হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। আজকাবান থেকে পালিয়ে যাওয়া সিরিয়াস ব্ল্যাককে পাকড়াওয়ের জন্য যে অনুসন্ধানী দল গঠন করা হয়েছিল, কিংসলি ছিলেন সেই দলের প্রধান। জাদু মন্ত্রণালয় থেকে ভলডেমর্টের প্রত্যাবর্তনের খবর প্রত্যাখ্যান করা হলেও, কিংসলি সেটা বিশ্বাস করেননি। আসন্ন বিপদের তাপ তিনি আঁচ করতে পেরেছিলেন ঠিকই।
সেজন্য তিনি পুনরায় অর্ডার অভ দ্য ফিনিক্সে যোগদান করেন। নিমফ্যাডোরা টঙ্কসের পাশাপাশি তিনিও জাদু মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি অর্ডার অভ দ্য ফিনিক্সে গোপনে কাজ করতে থাকেন। কিন্তু চতুর কিংসলি এত সুচতুরতার সাথে সবকিছু চালিয়ে গেছেন, কেউ তা বুঝতেই পারেনি। তিনি জানতেন, সিরিয়াস ব্ল্যাক পুরোপুরি নির্দোষ। ‘সিরিয়াস ব্ল্যাক তিব্বতে গা ঢাকা দিয়ে আছে’- এমন তথ্য দিয়ে তিনি মন্ত্রণালয়কে বিভ্রান্তির পথে নিয়ে যান।
জাদু মন্ত্রণালয় কিংসলির প্রতি পরিপূর্ণ বিশ্বাস ও ভরসা রাখত। সেজন্য মন্ত্রণালয় থেকে মাগল প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষার দায়িত্বটা তার ঘাড়েই ন্যস্ত করা হয়। ‘রহস্য বিভাগ’ ও ‘ব্যাটেল অভ সেভেন পটারস’ দুটো লড়াই-ই তিনি সাহসের সাথে লড়েছেন। দুঃসাহসী পদক্ষেপে ব্যাটেল অভ হগওয়ার্টসে নেতৃত্ব দিয়েছেন একেবারে সামনে থেকে। নির্ভরতার প্রতীক, অকুতোভয় এই বীরযোদ্ধাকে পরবর্তী সময়ে জাদুমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।
অ্যালেস্টর ‘ম্যাড-আই’ মুডি
ম্যাড-আই মুডি নামটার সাথে জড়িয়ে আছে একগুচ্ছ আবেগ ও একরাশ উষ্ণ ভালোবাসা। লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটা, একচোখো এই জাদুকর হ্যারিকে পরিপূর্ণ সুরক্ষা দেবার চেষ্টা করেছেন সর্বদাই। জাদু জগতের প্রথম মহাযুদ্ধের পর সর্বদিক থেকে খ্যাতি কুড়িয়ে নেন ম্যাড-আই মুডি। বলা হয়ে থাকে, আজকাবানে যে-সকল ডেথ ইটার বন্দী, তাদের অর্ধেককেই সেখানে পুড়েছেন ম্যাড-আই মুডি নিজে। তিনি যাদের পেছনে লেগেছিলেন, তাদের প্রায় সবাইকেই ধরতে সক্ষম হয়েছেন, কিন্তু স্লিদারিন হাউজের ইভান রোজিয়ারদের মতো জাদুকরেরা বোকামি করে তার সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধ লাগতে গিয়ে ফলস্বরূপ প্রাণ হারিয়েছে।
জাদু জগতের প্রথম মহাযুদ্ধে শক্তিশালী লর্ড ভলডেমর্ট ও ডেথ ইটারদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে একটা চোখ, পা, ও নাকের একটা অংশ হারান। অরোর হিসেবে নিযুক্ত হবার জন্য মন্ত্রণালয় তার যে পরীক্ষা নিয়েছিল, তিনি সেটাতে কোনো বাধা ছাড়াই উতরে যান। জাদুবিদ্যার খুঁটিনাটি বিষয় ছিল তার নখদর্পণে। তিনি এমন কিছু বিষয়ে দক্ষ ছিলেন, যেগুলো অনেক জাদুকরদের কাছে ছিল স্বপ্নের মতো। যেমন, কালো জাদুর অস্তিত্ব টের পাওয়া। সেজন্য তিনি ফো-গ্লাস, সিক্রেসি সেন্সর, স্নিকোস্কোপের মতো দুর্লভ কিছু যন্ত্র ব্যবহার করতেন।
কালো জাদুর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষাতে তিনি ছিলেন একাই একশো। সেজন্য অনেকেই তাকে সবর্কালের সর্বশ্রেষ্ঠ অরোর হিসেবেও দাবি করেন। এছাড়াও সাহসিকতা, নেতৃত্বদানের ক্ষমতা, ছড়িবিহীন নন-ভার্বাল ম্যাজিক, ওড়ার ক্ষমতা, হার্বোলজি, পোশন, চার্ম, ট্রান্সফিগারেশন, শিক্ষাদান, প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন অনন্য ও অসাধারণ। ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে অ্যালবাস ডাম্বলডোরের অনুরোধে সাড়া দিয়ে তিনি হগওয়ার্টসে ‘কালো জাদুর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা’ নামক বিষয়ের প্রফেসর হিসেবে যোগদান করেন। নিমফ্যাডোরা টঙ্কসের মতো জগদ্বিখ্যাত অরোর-ও ম্যাড-আই মুডির থেকেই প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ম্যাড-আই মুডি একেবারে নিজের মতো গড়ে তুলেছিলেন তাকে।
অরোর পদ থেকে অবসর নেবার পরেও জাদু জগতের দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন অর্ডার অভ দ্য ফিনিক্সের এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। ব্যাটেল অভ সেভেন পটারসের সময় দুর্ঘটনাবশত মারা যান পিওর-ব্লাড এই অরোর। নিভে যায়, অর্ডার অভ দ্য ফিনিক্সের এক প্রজ্জ্বলিত বাতি।
হ্যারি পটার
পুরো ফ্র্যাঞ্চাইজি মূলত তাকে আলোচিত করেই উৎসর্গীকৃত। হগওয়ার্টসে থাকাকালীন নানা প্রতিকূল বাঁক পেরিয়ে শেষ বর্ষে এসে ‘ব্যাটেল অভ হগওয়ার্টস’-এর কারণে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করতে পারেনি সে। হারমায়নি পড়ালেখার পাট চুকালেও গ্র্যাজুয়েট হবার উদ্দেশ্যে আর কখনো হগওয়ার্টসে যাওয়া হয়নি হ্যারির। তবে সে ফাঁকে ফাঁকে হগওয়ার্টসে গিয়ে অনুজদের কালো জাদুর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার অনুশীলন দিয়ে আসত। মূলত কিংসলি শ্যাকলবোল্টের ইচ্ছাতেই জাদু মন্ত্রণালয়ে সে রন উইজলি ও নেভিল লংবটমের সাথে অরোর হিসেবে যোগ দেয়।
এরপর সে ডেথ ইটার পাকড়াও করতে জাদু মন্ত্রণালয়কে অনেক সাহায্য করে। রন ও নেভিল কিছু-বছর পর সে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিলেও, হ্যারি পটার জাদু মন্ত্রণালয়েই অরোর হিসেবে থেকে যায়। তার ইচ্ছা ছিল, জাদু জগতকে কালো জাদু নামক অশুভ শক্তির হাত থেকে মুক্ত করে, নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেওয়া। ২৬-২৭ বছর বয়সের দিকে অরোর বিভাগের প্রধান ও ২০২০ সালের দিকে জাদু নিয়ন্ত্রণ বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পেয়ে যায় হ্যারি।