♪ Can’t touch it, see it
But you can always feel it
The greatest things you’ll ever know
Are invisible ♪
অনুভূতি ধরা যায় না, ছোঁয়াও যায় না। অনুভূতি কেবল অনুভব করার জন্য। আর ভালো লাগার অনুভূতিগুলো ভাগাভাগি করে নেওয়ার জন্য। আনন্দের অনুভূতিগুলো সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারলেই তা অনুভব করা যায় প্রকৃত অর্থে।
গল্পটা এক পোস্টঅফিসের প্রধান কর্মকর্তার ছেলে জেসপারকে নিয়ে। প্রচণ্ড আরামপ্রিয় আর বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত অলস জেসপার কাজে ফাঁকি দিতেই বেশি ভালবাসে। কিন্তু ছেলের এহেন জীবনযাপন ভাবিয়ে তুলে বাবাকে। সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেন ছেলেকে উচিত উপায়ে শিক্ষা দেবার। জেসপারকে পাঠিয়ে দেন উত্তর মেরুর বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপ ‘স্মিরেন্সবার্গ’ এ। শর্ত হলো, এক বছরের মধ্যে ছয় হাজার চিঠি পোস্ট করতে হবে তাকে, আর না পারলে শাস্তি হিসেবে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হবে সে। অলস হলেও নিজের ব্যাপারে বেশ আত্মবিশ্বাসী জেসপার। আর কোনো উপায় না থাকায় স্মিরেন্সবার্গের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায় সে।
কিন্তু এ-কী! এ কোথায় এসে পড়ল সে! কুয়াশাচ্ছন্ন-বিষণ্ণমাখা স্মিরেন্সবার্গকে যেন মৃত্যুপুরী বললেই বেশি মানায়। দ্বীপে নামতেই রহস্যময় দ্বীপের ঘটনা একে একে জানতে পারে সে। এই দ্বীপের বসবাসকারীরা দুইদলে বিভক্ত – ক্রাম এবং এলিংবো। পূর্বপুরুষের নিয়ম রক্ষায় দুই দলের মধ্যে বিবাদ এই দ্বীপের মামুলি ঘটনা। কেউ কারো জন্য নয় এখানে, দুই জাতির কেউ একে অন্যের সাথে মেলামেশা করে না। সুখ-দুঃখ কিংবা প্রয়োজনীয় কোনো কিছুই তারা ভাগাভাগি করে না। কেউ কাউকে চিঠি লেখে না। নতুন এই পোস্টম্যানকেও তারা ভালোভাবে গ্রহণ করে না। কীভাবে এই দ্বীপে থেকে ছয় হাজার চিঠি পোস্ট করবে সে? এ কি আদৌ সম্ভব?
বিলাসী জীবন ছেড়ে নিজের জরাজীর্ণ পোস্ট অফিসের কেবিনে বাস করা যেন জেসপারের কাছে এক রীতিমতো দুঃস্বপ্ন। যেভাবেই হোক এখান থেকে মুক্তি পেতে হবে। ঘটনাচক্রে জেসপার খোঁজ পায় বসতি থেকে দূরে বনের মধ্যে বাস করা এক বৃদ্ধের – নাম ক্লাউস। রাগী এবং কঠোর মনোভাবের ক্লাউসের সাহায্য পেতেও বেশ বেগ পেতে হয় তার। বৃদ্ধকে ব্যবহার করে জেসপার উপায় বাতলে ফেলে চিঠি পোস্ট করার। ক্লাউস আর এক তরুণী স্কুল শিক্ষিকার সাহায্যে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করতে গিয়ে পুরো দ্বীপের চেহারা যেন একদম পাল্টে দেয় জেসপার। আনন্দের জোয়ার আর আলো ফিরে কুয়াশা কাটতে থাকে দ্বীপের। লক্ষ্য পূরণের খুব নিকটে জেসপার। গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারত কিন্তু বাধ সেধে বসে দুই দলের দলপতি। স্মিরেন্সবার্গের এমন চেহারা আর পূর্বপুরুষদের আদর্শ ভুলে ক্রাম আর এলিংবোর সখ্যতা তো তারা চায় না। তারপর?
সম্প্রতি নভেম্বরের ১৫ তারিখে মুক্তি পায় নেটফ্লিক্স অরিজিনালস-এর কমেডি-এডভেঞ্চার ধারার প্রথম ফিচার অ্যানিমেশন ক্লাউস। মুক্তির পর থেকেই বেশ সাড়া ফেলেছে মুভিটি। আইএমডিবি রেটিং ৮.৪। মূলত সান্টাক্লস-এর আবির্ভাব নিয়ে এই অ্যানিমেশন মুভিটি নির্মাণ করা হলেও এর প্রধান চরিত্র কিন্তু সান্টা নয়। ডিরেক্টর সার্জিও পাবলোস সান্টাক্লস মিথলোজিকে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছেন। কেমন হতো যদি সান্টার আবির্ভাব হতো স্বার্থপর এক যুবকের স্বার্থ উদ্ধার করতে গিয়ে? সান্টাক্লসের কথা উল্লেখ না করেও খুব সূক্ষ্মভাবেই এর রীতিনীতিগুলোকে গল্পাকারে সাজিয়েছেন তিনি। আপনি যদি অ্যানিমেশন মুভির ভক্ত হয়ে থাকেন, তবে পাবলোসের নাম না শুনলেও ডেসপিকেবল মি ফ্র্যাঞ্চাইজির নাম শুনেছেন নিশ্চয়। ডেসপিকেবল মি-এর ক্রিয়েটর পাবলোস জনপ্রিয় টার্জান, রিও, মিনিয়ন্স এবং দ্য হাঞ্চব্যাক অফ নটরডেম এর ক্যারেক্টার ডিজাইনার হিসেবে কাজ করেছেন। এই স্প্যানিশ প্রাক্তন অ্যানিমেটর ডিজনি স্টুডিওসের সাথেও যুক্ত ছিলেন বহুদিন। তাই ক্লাউসের স্টোরিলাইনে ডিজনির স্বাদ পাওয়া যাবে অনেকটা। তবে সেটা ডিরেক্টর ইচ্ছা করেই করেছেন। এছাড়াও ক্লাউসের অ্যানিমেটরদের অনেকেই ৯০ এর দশকের ডিজনি অ্যানিমেশনগুলোর সাথে যুক্ত ছিল। তাই ক্লাউসে ডিজনি ক্লাসিকের ছোঁয়া থাকাই অবাক হবেন না।
ভিন্ন স্বাদের কাহিনী নিয়ে নির্মিত অ্যানিমেশনটিতে হাস্যরসেরও অভাব নেই। জেসপার চরিত্রটিকে এমনভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, যা পুরো ৯৭ মিনিট আপনার ঠোঁটে হাসি ধরে রাখবে। পাশাপাশি অন্যান্য চরিত্রগুলোও সমান তালে হাসির খোরাক জোগাবে। সচরাচর অ্যানিমেশন মুভিগুলোতে কিছু না কিছু শিক্ষণীয় বার্তা থাকে, সেটা হতে পারে সামাজিক বা ব্যক্তিগত জীবন ও আবেগকে কেন্দ্র করে। ক্লাউসেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। সাথে আবেগের সংমিশ্রণ মুভিটিকে পূর্ণতা দিয়েছে। অ্যানিমেশন ভক্তরা হয়তো মুভির কোনো এক পর্যায়ে নিজেকে আবিষ্কার করতে পারেন চোখের কোণায় পানি আর ঠোঁটে এক ফালি হাসি নিয়ে। তবে মুভিটির সব থেকে আকর্ষণীয় দিকটি হলো এর অ্যানিমেশনের ধরন আর গ্রাফিক্স।
পুরো মুভিটি জুড়ে হয়তো নজরকাড়া ক্লাসিক অ্যানিমেশনের দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকবেন আপনি, আর বোঝার চেষ্টা করবেন আসলে কী ধরনের অ্যানিমেশন ব্যবহার করা হয়েছে এতে। টুডি(2D) নাকি থ্রিডি(3D)? আধুনিক অ্যানিমেশন ইন্ডাস্ট্রি যখন ঝুঁকছে থ্রিডি সিজিআই সহ অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তির পিছে সেখানে নেটফ্লিক্স নিয়ে এলো পুরানো সময়ের ট্র্যাডিশনাল অ্যানিমেশনে। পাবলোস ২০১০ সালে তার স্টুডিওতে কাজ শুরু করেন ক্লাউসের জন্য। প্রায় ২৫০ জন আর্টিস্ট এবং অ্যানিমেটর হাতে এঁকে তৈরি করেছেন এই অ্যানিমেশন ফিল্ম, এঁকেছেন ৩১৬০টি দৃশ্য। ২০১৫ তে এর একটি টেস্ট এনিমেশন প্রকাশ পেলে ডিস্ট্রিবিউটর কোম্পানিগুলো ঝুঁকি নিতে চায়নি। এর দুই বছর পর নেটফ্লিক্স ক্লাউসের গ্লোবাল রাইটস কিনে নেয়। হাতে আঁকা টুডি ট্র্যাডিশনাল ধাঁচের অ্যানিমেশন দেখে অনেকেই হয়তো নস্টালজিক হয়ে পড়তে পারেন। ক্লাউসের মাধ্যমে নতুন এক অ্যানিমেশন পদ্ধতি সামনে নিয়ে এসেছেন পাবলোস। টুডি পদ্ধতিতে হাতে আঁকা হলেও পুরানো ট্র্যাডিশনাল অ্যানিমেশনের সাথে এর পার্থক্য হলো লাইটিং টেকনিকের মাধ্যমে ক্যারেকটার আর ব্যাকগ্রাউন্ড-এর লাইট ডেপথ, যা টুডি মুভিটিতে ত্রিমাত্রিকভাব ফুটিয়ে তুলেছে এবং নতুনত্ব দান করেছে। যদিও বেশ কিছু জিনিস এবং স্থানের ডিজাইন থ্রিডি সিজিআই এর মাধ্যমে করা হয়েছে আর্টিস্টদের খাটনি কমাতে, তবে তা তুলনামূলক কম। কিছু যানবাহন, রেইনডিয়ারগুলো এবং প্রয়োজন সাপেক্ষে অল্পকিছু স্থানের দৃশ্য সিজিআই করা হয়েছে। পাবলোসের মতে, থ্রিডি সিজিআই এর ভিড়ে ট্র্যাডিশনাল অ্যানিমেশন দিয়েও এই প্রজন্মকে নতুন কিছু উপহার দেয়া সম্ভব তা তুলে ধরতে চেয়েছেন তিনি।
মজার বিষয় হলো পাবলোসের সান্টার এই সংস্করণটি ক্রিস্টোফার নোলানের ব্যাটম্যান বিগিনস থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বানানো। গথাম থেকে স্মিরেন্সবার্গকে কিছুটা হালকাভাবে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন এর ডিরেক্টর। আর সান্টাকে বিশাল মনের কিন্তু গাম্ভীর্যপূর্ণভাবে, যে খুব কম কথা বলে আর বড় রকমের ক্ষতির মোকাবেলা করতেও প্রস্তুত।
সব মিলিয়ে বলা যায়, কমেডি অ্যাডভেঞ্চারটি দেখা শেষ করবেন বেশ তৃপ্তির সাথেই। সান্টার গিফট, লাল পোশাক আর চিমনি দিয়ে আগমন, সান্টার বাহন আর রেইনডিয়ার সব ছোটখাটো মিথগুলো গল্পাকারে ফুটে উঠতে দেখে আপনার মুখেও হাসি ফুটবে। এছাড়া ক্লাউসের অন্ধকারাচ্ছন্ন অতীত গল্পপ্লটে নতুন ফ্লেভারও এনে দিয়েছে। কোনো এক ছুটির দিনে বসে পড়তে পারেন পরিবারের সবাই মিলে ক্লাউস দেখতে।
বই ও সিনেমা সম্পর্কিত চমৎকার সব রিভিউ আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/