উপন্যাসের শেষে আহমদ ছফা একটি প্রশ্ন রেখে যান। তিনি যেখান থেকে শেষ করেছেন, এ লেখার শুরুটা সেখান থেকে। ওঙ্কার এমন এক উপন্যাস, যা প্রথা ভাঙতে শুরু করে প্রথম বাক্য থেকে। এবং প্রথা ভাঙার এ নিয়ম অব্যাহত থেকেছে পুরো সময়। বইয়ে লেখক গল্প শোনাতে চাননি। যখন যেখানে যেভাবে মন চেয়েছেন, কাহিনীর মোড় ঘুরিয়ে পাঠককে চমকে দিয়েছেন।
ওঙ্কার সম্পর্কে জানার আগে জেনে নিই, ওঙ্কার অর্থ কী? কেনইবা ছফা উপন্যাসের এ নাম রেখেছেন? হিন্দু-পুরাণ মতে, ‘ওঙ্কার’ শব্দের মানে হলো ‘আদি ধ্বনি’ বা সকল ধ্বনির মূল। ওঙ্কার আপাদমস্তক ভাবগাম্ভীর্যে পূর্ণ একটি উপন্যাস, ভারি নামকরণে একটা চমৎকার আবহ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন লেখক। এরপর পুরো লেখায় ফুটিয়েছেন সৌন্দর্য্যের ফুল। শব্দের পোক্ততায় থরে থরে সাজিয়েছেন গল্পের স্তর। মানুষের দৃষ্টি দু’ রকম। একটি বাহ্যিক দৃষ্টি, অপরটি অন্তর্দৃষ্টি। বাইরের দৃষ্টিতে আমরা গোটা দুনিয়া দেখি, অন্তর্দৃষ্টি দেখায় অদেখা চিত্রের সামগ্রিকতাকে।
আমাদের মাঝে যারা কথা বলতে পারেন না, অর্থাৎ বোবা, তাদেরও ভাষা আছে। ভাষার স্বকীয়তা আছে। সেসব আমরা শুনতে পাই না। শুনতে না পাওয়ার চেয়ে বলা ভালো, শুনতে চাই না। তাই বুঝতেও পারি না। বাইরের কান জোড়া দিয়ে যা শুনতে পাই না, সেসব অন্তরে প্রতিধ্বনির সুর তোলে। হৃদয়ের গহীন অবধি সে ধ্বনি অনায়াসে পৌঁছায়। ওঙ্কারে আহমদ ছফা এ বিষয়টি বোঝাতে চেয়েছেন। তার বর্ণনা কৌশল, ভাষার সাবলীলতা ও সংবেদনশীলতা পাঠককে উপলব্ধি করাবে তীক্ষ্ণতা ও তিক্ততা। সে রেশ গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিরাজমান।
“লেখকদের কিছু জমিজমা ছিল। যা তার পূর্বপুরুষদের কাছ হতে পাওয়া। লেখকের বাবা সেসব বাড়ানোর বদলে বসে বসে ভোগ করেছেন। সম্পত্তির পাশাপাশি লেখকের বাবা তার বাবার কাছ আরেকটি জিনিস পেয়েছিলেন। একখানা মেজাজও তাকে পূর্ব-পুরুষরা দিয়ে গিয়েছিল। মেজাজের তেজ বিশেষ ছিল না, তবে ঝাঁঝ ছিল বেশ কড়া রকমের।”
এভাবে পিতার বর্ণনা দিয়ে গল্প বলা শুরু করেন ছফা। মজার ব্যাপার হচ্ছে, উপন্যাসে পিতার কোনো নাম নেই। নাম না থাকাটা খুব বেশি প্রভাব ফেলেনি। কারণ নামহীন হলেও মোটেই অস্তিত্বহীন নন পিতামশাই। বরং ধরতে গেলে, উপন্যাসের রচয়িতা যতখানি লেখক, তারচেয়ে কোনো অংশে পিতা কম নন।
সময় পরিবর্তনশীল। যুগের চাহিদা মাথায় রেখে নিত্য খোলস বদলায়। সমাজ ব্যতিক্রম নয়। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলার প্রত্যয়ে সমাজ বদলায়। কিন্তু আমাদের যারা বয়োজ্যেষ্ঠ, কিংবা যারা এক দশকের মধ্যে গত হয়েছেন, তাদের দিকে মনোনিবেশ করলে খেয়াল করা যায়, তারা সময় আর সমাজের পরিবর্তন কখনও মেনে নেননি। প্রাচীনকালের আভিজাত্য, অহংবোধ আর কুসংস্কারের বলয়ে আবদ্ধ ছিলেন। বংশের গরিমা ছিল তাদের শরীরে। কেউ কেউ ছোটবেলায় বিশাল জমিদারি দেখে বড় হয়েছেন। যুবক বয়সে যখন হাল ধরার প্রয়োজন আসে, জমিদারির সঠিক ব্যবহার করে সম্পত্তি বাড়ানোর সময় আসে; তখন তারা আমোদ-ফূর্তিতে দিন কাটিয়ে সমস্ত জমিদারি হারিয়ে বসেন। হারালেও রক্তে জমিদারি। সেটি রক্তের সঙ্গে মগজেও ঝালাই করা হয়ে গেছে।
ফলে, একসময় যারা তাদের অধীনস্থ ছিল, সেই তাদের পরিবার জ্ঞান-সম্পদে এগিয়ে গেলেও কথিত জমিদারের বংশধররা পুরনো গল্পের জাবর কেটে দিন পার করে। সেটির ভয়ানক ভয়াবহতা তারা বুঝতে পারে না। যতদিনে জ্ঞানচক্ষু খোলে, ততদিনে সব হারিয়ে নিঃস্ব হতে হয়।
ওঙ্কারে একটিমাত্র চরিত্রের নাম প্রয়োগ করেন লেখক। চরিত্রের নাম ‘আবু নসর মোক্তার’। আবু নসর আমাদের চারপাশের সুবিধাবাজ সেইসব মানুষের অন্তর্গত, যারা সারাক্ষণ সুযোগ খোঁজায় মত্ত। মোক্তার সুযোগসন্ধানী, চতুর এবং চূড়ান্ত লোভী। এক পুকুরের পানি আরেক পুকুরে ঢালার দলে তিনি। রাজনৈতিক ক্ষমতাধরদের কাছাকাছি যেতে যা করা প্রয়োজন, কমতি রাখেন না। এই করতে করতে একদিন সুযোগ মেলে। বাগে পেয়ে যান এ উপন্যাসের নায়কের বাবাকে। সর্বস্ব লুটে নেন তাদের। এর পেছনে যথারীতি স্বার্থ লুকিয়ে থাকে। বলা বাহুল্য, যাতে বলি হয় স্বয়ং নায়ক।
“নায়ক কীভাবে বলি হলো? কেন হলো?”
স্পয়লারের ভয়ে এখানে থেমে যাবার চিন্তা করলে আপনাকে নিশ্চিন্ত করছি। এটুকু জানলেও স্পয়লার হবে না। তবে এ নিয়ে চর্চার প্রয়োজন আছে। ওঙ্কারে আদতে স্পয়লারের কিছু নেই। উপন্যাসে ছফা গল্প ফাঁদতে বসেননি। জীবন যেভাবে আপন গতিতে চলে, ওঙ্কারকে লেখক ওভাবে টেনেছেন। কোনো সীমারেখায় বাঁধেননি। তাই নির্ভার থাকুন।
আবু নসর মোক্তার ছিলেন নায়কের বাবার খুব বিশ্বস্ত এবং কাছের লোক। ডান হাত-বাম হাত বলা চলে। জমিদারি রক্তের দাপটে কারণে অকারণে এর-ওর বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার বাতিক ছিল নায়কের বাবার। মোক্তার সাহেব সেসব দেখভাল করতেন। কোনো এক কারণে মোক্তারের বিরুদ্ধে মামলা ঠোকেন বাবা। তাতে চটে যান মোক্তার। কূটবুদ্ধির প্রয়োগে ধরাশায়ী করেন নায়কের বাবাকে। জমিজমা বাগিয়ে নেয়। এতে অসুস্থ হয়ে পড়েন বাবা। চিকিৎসার পয়সা নেই। এদিকে প্রাণ সংকটাপন্ন। এমন অবস্থায় মোক্তার ত্রাণকর্তা সেজে আসে। মোক্তারের একটি বোবা মেয়ে আছে। নায়কের মাকে প্রস্তাব দেয়, তার ছেলে যদি মোক্তারের মেয়েকে বিয়ে করে, তাহলে বাবার চিকিৎসার সম্পূর্ণ ভার তিনি নেবেন। এমনকি ফিরিয়ে দেবেন যাবতীয় সম্পদ। বিএ পাশ করে বসে থাকা নায়কের পরিবার রাজি না থাকলেও বাবা মার কথা ভেবে উভয়ের ইচ্ছার বিপক্ষে গিয়ে বিয়ে করেন মোক্তারের মেয়েকে।
বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীকী একটা রূপ উঠে এসেছে ওঙ্কারে। ‘সূর্য তুমি সাথী’-র পর আহমদ ছফার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘ওঙ্কার’। মূলত ‘৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থানের সামগ্রিক যে চিত্র, ওঙ্কার তার সাহিত্য আকারে প্রকাশিত রূপ। ষাটের দশকের শিক্ষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ছয় দফা আন্দোলনে গড়ে উঠা স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিত্তি চূড়ান্তভাবে প্রস্ফুটিত হয় ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের হাত ধরে। সাধারণ মানুষ রাজপথে নেমেছিল। রক্তের বহমান স্রোতধারা তাদের বিচলিত করতে পারেনি। নতুন ভোরের আশায় অনবরত গর্জন তুলেছে। স্বপ্ন বাস্তবে রূপান্তর করা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। সমগ্র বাধা ঠেলে এগিয়ে যায় স্বপ্নবাজ বাঙালি।
উপন্যাসে না বলা গল্পের ভিড়ে লেখক শোনাতে চেয়েছেন সেইসব গল্প। চেয়েছেন বাঙালির ত্যাগ, ভয়হীন পথচলা মেলে ধরতে। বহু ত্যাগ, তপস্যা, একনিষ্ঠতার মিশেলে স্বাধীনতা ধরা দিয়েছে। অনুরূপভাবে, আপাতদৃষ্টিতে ভিত্তিহীন মনে হওয়া কোনো ইচ্ছের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে গেলে প্রয়োজন অন্তরের শক্তি। গল্পে নায়কের বোবা স্ত্রীর চেষ্টাও তেমন। গল্পে পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশকে যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে, এর গভীরে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত পাঠকের মনস্তত্ত্বে বড়সড় ধাক্কা লাগবে।
আমাদের স্বাভাবিক ভাবনায় উপন্যাস মানে ইয়া মোটা বই। পাতার পর পাতা ওল্টালেও যেন শেষ হবে না কাহিনী। এসবের বাইরে গিয়ে ওঙ্কার প্রমাণ করেছে, উপন্যাস মানেই অতিকায় নয়। মাত্র তিন ফর্মার, যেখানে ১ ফর্মা- ১৬ পৃষ্ঠা; একটি বইও হতে পারে সার্থক উপন্যাস। বাংলা সাহিত্যে এত ছোট উপন্যাস দ্বিতীয়টি নেই। শুরুতে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ধারাবাহিক আকারে প্রকাশিত হওয়া ওঙ্কার উপন্যাসরূপে আসলে হৈচৈ পড়ে যায়। তৎকালীন পত্রিকায় আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। তবে পড়ার পর এর স্বকীয়তাকে স্বীকার করেছেন সবাই। ওঙ্কার আকৃতিতে উপন্যাস না হলেও প্রকৃতিতে উপন্যাসের কাতারবদ্ধ। স্মৃতিচারণের ভঙ্গিমায় সময় ও সমাজের বিবর্তন, রাজনৈতিক অবস্থা ও গণ জাগরণের খসড়া ফুটে ওঠে এতে।
কোনো উপন্যাস তখন সার্থক হয়, যখন তা পাঠকের হৃদয়ের গহীনে প্রবেশ করতে পারে। ওঙ্কার পড়তে পড়তে পাঠক হারিয়ে যাবে অজানা মায়ায়। নিজেকে নিয়ে ভাববে। ভাবার সবধরনের উপাদান এতে বিদ্যমান। পারিবারিক গল্প আছে। আছে দাম্পত্য কলহ, ভাঙা-গড়া। আছে অফিসের অশান্তি, রাজনৈতিক অস্থিরতা। ওঙ্কার আরেকটি জিনিসও শেখাবে। মানুষ নিজের কাছে কিছু লুকোতে পারে না। মানুষ যা পারে, তা হলো সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে, নিদেনপক্ষে চেষ্টা করে কৃত্রিম হাসি দিতে।