‘প্রে’ সিনেমাটি প্রিডেটর ইউনিভার্সের সর্বশেষ কিস্তি, যা মুক্তি পেয়েছে ২০২২ সালে। মূল সিনেমার সময়ের আগের প্রেক্ষাপটে বানানো এই সিনেমা, একইসাথে প্রিকুয়েল এবং প্রিডেটর ফ্রাঞ্চাইজির জন্যে রিবুটও।
‘প্রে’র ব্যাপারে যাবার আগে এর শেকড় অর্থাৎ ‘প্রিডেটর’ সিনেমা নিয়ে কিছু কথা বলা উচিত। প্রথমত, ‘প্রিডেটর’ এখন পর্যন্ত আশির দশকের অন্যতম প্রশংসিত অ্যাকশন সিনেমা হিসেবে খ্যাতি ধরে রেখেছে। এর অন্যতম বড় কারণ সিনেমার পরিচালক জন ম্যাকটিয়েরনান এবং অভিনেতা আর্নল্ড শোয়ার্জেনেগার। জন ম্যাকটিয়েরনান অ্যাকশন সিনেমার পরিচালক হিসেবে সিদ্ধহস্ত। ‘প্রিডেটর’, ‘ডাই হার্ড’, ‘দ্য হান্ট ফর দ্য রেড অক্টোবর’ এর মতো ক্লাসিক স্ট্যাটাস পাওয়া সব অ্যাকশন সিনেমা তারই বানানো। তার অ্যাকশন সিনেমার বড় ব্যাপার হলো, অ্যাকশন যতটা টেক্সটে থাকে ঠিক ততটাই ক্যামেরার ভাষায় থাকে। অ্যাকশনে যাবার আগে সময় নিয়ে ভাব আর পরিবেশ তৈরি করেন তিনি। রীতিমতো ড্রামা সিনেমার রীতিতে।
অ্যাকশনের প্রয়োজনে সেট নয়, বরং সেটের নানা অনুষঙ্গ ধরে ধরে অ্যাকশন সিকুয়েন্সের ব্লকিং আর ডিজাইন ঠিক করেন। যেমন- ‘প্রিডেটর’ এর মতো আউটডোর বেইজড সিনেমাতে ইউজুয়াল সেটের প্রপ্স না থাকলেও চারপাশ এবং চারপাশে থাকা ডিটেইলগুলো ধরে ধরে অ্যাকশন সেটপিস বানিয়েই তিনি সামগ্রিক ডিজাইন করেছেন। দুর্দান্ত ভিজ্যুয়াল স্টোরিটেলার তিনি। ট্র্যাকিং শট, ডাচ অ্যাঙ্গেল ধরে সবসময় অবজেক্টিভ জিনিসপত্রকে নজরে রেখে ভিজ্যুয়াল তৈরি করেন। এবং এই ‘প্রে’কে প্রিডেটরের পর এই ফ্র্যাঞ্চাইজির সেরা সিনেমা বলা হচ্ছে, তার পেছনেও আছে ম্যাকটিয়েরনানের পদচিহ্ন আর অরিজিনালের ভাইব। তা নিয়ে দুয়েক কথা বলা যাক।
এই গল্প নারুর, যে কিনা তার গোত্রের সদস্যদের নিয়ে থাকে গ্রেট প্লেইনসে। নারুর চোখ-মুখে ন্যাটিভদের রং মাখা। বোঝাই যায়- তারা শিকারে অভ্যস্ত। নারুকে সকাল সকাল দেখা যায় তীর-ধনুক আর হাতিয়ার নিয়ে শিকারে বের হয়ে যেতে। পিছু পিছু যায় তার পোষা কুকুর, যাকে কিনা সে প্রতিনিয়ত প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এরপর এক হরিণ দেখতে পেয়ে নারু আর তার কুকুর মিলে শিকারের চেষ্টা করে। কিন্তু শিকারী হিসেবে দক্ষ না হওয়ায় হরিণটি পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় আর শিকার করতে গিয়ে কুকুরটি একটি জালে পড়ে আঘাত পায়।
ঠিক ওই মুহূর্তেই নারু তখন আকাশে থান্ডারবার্ড নামের এক পাখিকে দেখতে পেয়ে তার দিকে তীর ছুড়ে মারে, যদিও সে বুঝতে পারেনি যে সেটি আসলে ইউএফও ছিল। এরপর দেখা যায়, নারুর ভাই তাবেকে যে এক দক্ষ শিকারী। সে নারুকে বলে কীভাবে তার বাবার কাছ থেকে শিকার করা শিখেছিল, আর বলছিল কাথামিয়ার কথা। ‘কাথামিয়া’ মানে একটি বড় শিকার। নারু তখন বলে, সে কাথামিয়ার জন্য তৈরি, আর সে থান্ডারবার্ডের চিহ্ন দেখতে পেয়েছে।
এরপর নারু নানাভাবে তার ভাই আর মাকে বোঝাতে চায় যে, সে মেয়ে হয়েও দক্ষ শিকারী হতে পারবে। এরপরই তাকে একটা বিশেষ উদ্ভিদ আনতে বনে পাঠান তার মা। ওদিকে, সেই ইউএফও থেকে নেমে আসে এক ভিনগ্রহী প্রিডেটর। ঐ গোত্রের কয়েকজন বনে যায়, যখন তারা খবর পায় যে তাদের একজনকে সিংহ ধরে নিয়ে গেছে। নারুও তাদের পেছনে পেছনে যাওয়ার জন্য এগোয়, কিন্তু ছেলেরা তাকে না যাওয়ার আদেশ দেয়। তখন তাবাহ নাউরুকে নিয়ে যাবার জন্য বলে, কারণ নারু একজন ভালো চিকিৎসক। ছেলেটাকে যদি জীবিত পাওয়া যায়, তবে নারুকে কাজে লাগবে তখন আঘাত সারাতে।
একটু পর দলটি ঐ ছেলের সন্ধান পায় রক্তাক্ত অবস্থায়। কাছে গিয়ে দেখা যায় সে জীবিত। অর্থাৎ সিংহ তাকে হত্যা না করেই ফেলে গিয়েছে। নারু তখন তাকে কিছু ওষুধ দিয়ে ঠিক করার চেষ্টা করে, আর সবাই তাকে নিয়ে ফিরে আসে। এরপর ওরা আবার ঐ সিংহকে মারতে জঙ্গলে ফিরে যায়, কারণ তাদের ধারণা ঐ সিংহ অন্য কারণে ছেলেটিকে না মেরে ফেলে গিয়েছে। তবে নারুর ধারণা, অন্য প্রাণীটা অন্য কিছুও হতে পারে। এরপর তারা মশাল নিভিয়ে অন্ধকারেই ঐ শিকারীর অপেক্ষা করতে থাকে। একটু পর যখন তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল, তখনই একটি বাঘ তাদের উপর আক্রমণ করে। বাঘটি তাদের একজনকে হত্যার পর নারুকে আক্রমণ করে, তবে সে বাঘকে আঘাত করে নিচে পড়ে যায়। পরে সে চোখ খুলে নিজেকে মায়ের কাছে দেখতে পায়, আর জানতে পারে তার ভাই তাকে কাঁধে করে নিয়ে এসেছে বাঘকে হত্যার পর। সম্মান হিসেবে তার ভাই তাবেকে যুদ্ধপ্রধানের পদ দেয়া হয়।
এভাবে কিছুদিন যায়। নারু তখনও তার দক্ষতা পুরোপুরি দেখাতে পারছে না কাউকে। অন্য একদিন দেখা যায়, নারু আবার তার শিকারের জন্য চর্চা করছে। একই দৃশ্যে পর্যায়ক্রমে দেখা যায়, পাশেই তার কিছু দূরত্বে ঐ প্রিডেটর শিকার করছে। নাউরু যখন প্রিডেটরের হত্যা করা শিকারগুলোর মুখোমুখি হয়, তখন সে প্রিডেটরকে অনুসরণ শুরু করে। একপর্যায়ে সে এক ডোবায় পড়ে যায় যেখান থেকে সে দক্ষতার সাথে নিজেকে বাঁচায়।
এরপর সে একটি ভালুক দেখতে পায়। তীরের সাহায্য নারু ভালুকটিকে শিকারের চেষ্টা করে। কিন্তু হঠাৎ করে ধনুকের তার ছিড়ে যায়, আর ভালুকটি তাকে দেখে আক্রমণ করে। তখন ঐ প্রিডেটর ভালুককে আক্রমণ করে হত্যা করে। পানিতে ঝাপ দিয়ে নারু কোনোভাবে পালিয়ে নিজের গোত্রের লোকদের সাথে সাক্ষাৎ করে যারা তাকে জোরপূর্বক গোত্রে ফেরত নিয়ে যেতে চায়। তাদের ঝগড়ার একপর্যায়ে প্রিডেটর তাদের উপর আক্রমণ করে!
শেষমেষ সেখান থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও নারু অন্য এক গোত্রের এলাকায় গিয়ে পড়ে, যারা তাকে ও তার ভাইকে বন্দী করে। এরপর তারা নারুর কাছে সাহায্য চায় ঐ প্রিডেটরকে ধরার জন্য। যখন নারু রাজি হয় না, তখন তারা তার ভাইকে তারই সামনে আঘাত করে আর পুনরায় সাহায্য করতে বলে। একপর্যায়ে তারা নারু ও তার ভাইকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে ওই প্রিডেটরকে মারার জন্য। এরপর নারু ও তার ভাইকে লাঠির সাথে বাইরে বেঁধে রাখে, এবং অপেক্ষা করে প্রিডেটরের আক্রমণের। একপর্যায়ে প্রিডেটর ওখানে হাজির হয়। কিন্তু সেখানে আগে থেকেই ফেলে রাখা ফাঁদে পড়ে তার পা আটকে যায় এবং সবাই একযোগে প্রিডেটরকে গুলি করতে শুরু করে। কিন্তু তাতে প্রিডেটরের কোনো ক্ষতি হয় না, বরং নারকীয় এক হত্যাযজ্ঞ চালায় প্রিডেটর।
সৌভাগ্যবশত নারু ও তার ভাই সেখান থেকে পালিয়ে আসে, আর কীভাবে প্রিডেটরকে হত্যা করা যায় সেই পরিকল্পনা করে। নারু তখন একাই ঐ গোত্রের আস্তানা থেকে নিজের কুকুরকে আনতে যায়, আর তাবে যায় ঘোড়া আনতে। নারু তার কুকুরকে যে-ই না উদ্ধার করে, তখনই প্রিডেটর সেখানে হামলা করে। সে একাই প্রিডেটরের মুখোমুখি হয়। কিন্তু একপর্যায়ে প্রিডেটর অদৃশ্য হয়ে নারু ও তার ভাইয়ের উপর আরও চড়াও হয়। ফলে এক অপ্রত্যাশিত করুণ ঘটনার সম্মুখীন হয় নারু।
এরপর নারুকে দেখা যায় অন্য গোত্রের আঘাতপ্রাপ্ত প্রধানের সামনে। সে তাকে প্রিডেটরের শিকার হিসেবে ব্যবহারের পরিকল্পনা করে। সে প্রিডেটরকে বিভিন্ন দিক থেকে আর বিভিন্ন ফাঁদের সাহায্যে আক্রমণ শুরু করে। মানুষ এবং ভিনগ্রহী প্রিডেটরের এক অনন্য সংঘর্ষের মুখোমুখি হয় দর্শক। হিমশীতল আবহের বনে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয় দুজনের মাঝে। এবং দর্শক রুদ্ধশ্বাসে বসে থাকে শেষ বিজয় কার হয় তা দেখতে।
তো… এই হচ্ছে ‘প্রে’ সিনেমার কাহিনি। বলা যায়, এক বেসিক স্টোরিলাইন ধরেই সিনেমাটি সাজানো। কিন্তু তারপরও অবাক করে এর ফিল্মমেকিং! প্রে প্রথমত যেভাবে ১৯১৭ এর প্রেক্ষাপট ধরেও বর্তমানকে, অর্থাৎ পোস্ট মি-টু এরাকে ধরে তা হলো মূল চরিত্রে নারু নামক নারীচরিত্র দিয়ে। শুধু জেন্ডার সোয়াইপ নয়, বরং নারুর গোত্রের পুরুষেরা যেভাবে তাকে শিকারে নিয়ে যেতে অনীহা দেখায় এবং অবদমিত রাখতে চায়, তা সবসময়ের পুরুষতান্ত্রিকতা এবং দুই লিঙ্গের দ্বৈরথকেই সামনে আনে।
এছাড়া, এই সিনেমার পরিচালক আরেকটি দারুণ কাজ করেছেন- মূল প্রিডেটরের মতো স্ট্রেইটফরোয়ার্ড অ্যাকশন ফিল্মমেকিংয়ের পাশাপাশি এর মাঝে ড্রামাটিক অংশও রেখেছেন। এই সিনেমা নারু আর প্রিডেটরের রুদ্ধশ্বাস অ্যাকশনে যাবার আগে পুরুষতান্ত্রিক গোত্রে নারুর নিজেকে প্রমাণ করার মরিয়া স্বভাব এবং সমতার জন্য লড়াইয়ের পাশাপাশি একদম সমান্তরালে প্রিডেটরের তার যোগ্য শিকার খুঁজে বেড়ানোর জার্নিও সামনে আনে। তাই যে মুহূর্তে প্রিডেটর আর নারু মুখোমুখি হয়, ঐ মুহূর্তই সবচেয়ে বড় ক্লাইম্যাক্টিক মুহূর্ত হয়ে ওঠে ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছানোর আগেই। এর আগে দ্বিতীয় অংকে সবাই যখন একে একে প্রিডেটরের হাতে মারা পড়ছিল, তখন বাঘের মতো নারুর দু’কদম পিছিয়ে প্রিডেটরের প্রত্যেকটি মুভমেন্ট পর্যবেক্ষণ করা এবং তার দুর্বলতা খুঁজে বের করা ভিন্ন মাত্রা যোগ করে।
সিনেমার ফাইনাল অ্যাক্ট পুরোটাই নারু আর প্রিডেটরের সংঘর্ষ। পরিচালক শুধুমাত্র চারপাশের পরিবেশ আর ছোটখাট সব উপাদান কাজে লাগিয়ে অ্যাকশন ডিজাইন করেছেন জন ম্যাকটিয়েরনানের মতো। আর মিউটেড কালার প্যালেট এবং সফট লাইটিং এই সিনেমাকে পূর্ণ ন্যাচারালিটি দিয়েছে। ন্যাচারের মধ্যেই দুটো ভিন্ন গোত্রের বিনাশী লড়াই গোটা বিষয়কে আরো অমোঘ করে তোলে। এবং শেষপর্যন্ত, দর্শককে একটি রুদ্ধশ্বাস অ্যাকশন সিনেমা দেখার তৃপ্তি দেবার সাথে সাথে ‘প্রে’ জায়গা করে দিয়ে যায় ফ্র্যাঞ্চাইজিতে ভবিষ্যতে আরো কিছু প্রিডেটর এবং নারুকে যোগ হতে।