কেমন ছিল আটশো বছর পূর্বের বাংলা? কেমন ছিল তখনকার সমাজ? গ্রামগুলোই বা কেমন ছিল? আটশো বছর আগে এদেশের মানুষ কীভাবে জীবিকা নির্বাহ করত? কী ছিল তাদের পেশা? কীরূপ ছিল তাদের ধর্মাচরণ? সম্পর্কের স্বরূপগুলো কেমন ছিল? কেমন ছিল এদেশের নদ-নদী, প্রকৃতি?
উত্তরসূরী হিসেবে আপনি যদি আপনার পূর্বপুরুষ, তথা এদেশের আদিজনদের সমাজ, রাষ্ট্র, গ্রাম বা জীবনাচরণ সম্পর্কে জানতে চান বা এদেশের প্রাচীন প্রকৃতি, নদ-নদী, হাট-বাজার, গ্রাম-গঞ্জ বা রাস্তাঘাট কেমন ছিল- তা যদি আপনার দেখতে ইচ্ছে করে, তবে হাতে নিয়ে বসে পড়ুন শওকত আলীর ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ উপন্যাসটি।
উপন্যাসটি ১৯৮১ সালে প্রকাশিত হয়। কিন্তু তা পড়ে পাঠকের খুব কমই মনে হবে, এটি আমাদের এত কাছের সময়ে লেখা। বরং পড়তে পড়তে পাঠক হারিয়ে যাবেন আটশো বছর আগের সময়ে। পিপ্পলীহাট, উজবুট গ্রামের পথে-প্রান্তরে, ঘরে ঘরে, নদ-নদী, বন-জঙ্গলে, ফসলের মাঠে পাঠক ঘুরে বেড়াতে বাধ্য হবেন- তখনকার সাধারণ মানুষের একজন হয়ে। তাদের অনিশ্চিত জীবনের প্রতিটি দুর্ভোগ-দুর্দশাকে পাঠক নিজের করে ভাবতে বাধ্য হবেন। সেই সময়ের সামাজিক নিপীড়নে পীড়িত হবেন, আসন্ন বিপ্লব কিংবা বিপর্যয়ে পাঠক উত্তেজিত অথবা ভীত হবেন।
‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ নামটি একটু দুর্জ্ঞেয়। তাই প্রথমেই নামটি একটু বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে, দিনের একটি বিশেষ তিথি হলো ‘প্রদোষ’। যার দ্বারা মোটামুটি সূর্যাস্তের আগে-পরে দেড় ঘণ্টা সময়কে বোঝানো হয়। অর্থাৎ ‘প্রদোষ’ অর্থ শেষ বিকেল বা সন্ধ্যা। আর, ‘প্রাকৃতজন’ শব্দের অর্থ নিতান্ত সাধারণ মানুষ। শাব্দিকভাবে ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’-এর অর্থ দাঁড়ায় ‘শেষ বিকেলের সাধারণ মানুষ বা আমজনতা’।
উপন্যাসে প্রদোষ দ্বারা লেখক আটশো বছর পূর্বের, অর্থাৎ, ১২০৪ খ্রিস্টাব্দের আগে-পরের সময়কেই নির্দেশ করেছেন। কারণ, উপন্যাসটি মুসলমানদের বাংলা আক্রমণের প্রেক্ষাপটে রচিত। আর ‘প্রাকৃতজন’ দ্বারা লেখক যাদের বুঝিয়েছেন, উপন্যাসটির প্রথম পাতার উৎসর্গপত্রটি পড়লেই পাঠক সেটি বুঝে যাবেন,“রাঢ় বরেন্দ্র বঙ্গ সমতট বাসী প্রাকৃতজনের সংগ্রামী পূর্বপুরুষদের স্মরণে”। রাঢ়-বরেন্দ্র-সমতট নিয়ে বর্তমান যে বাংলা, তার নিতান্ত সাধারণ মানুষ, যারা আমাদের পূর্বপুরুষও বটে, তাদেরকেই লেখক বইটি উৎসর্গ করেছেন।
প্রকৃতপক্ষে মুসলমানদের বাংলা আক্রমণের সময়টি এ অঞ্চলের মানুষের জন্য কি প্রদোষ ছিল? সেটি অবশ্য বিতর্কের বিষয়। লেখকের মতে, সেটি প্রদোষই; অর্থাৎ, সন্ধ্যা, যার পরেই আসে অন্ধকার রাত। ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ নামেই সমগ্র উপন্যাসের সারমর্ম জ্বলজ্বল করছে। শ্যামাঙ্গ-লীলাবতি, বসন্তদাস-মায়াবতী উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। প্রাকৃতজনের প্রতিনিধি হয়ে যারা বিচরণ করেছেন পুরো উপন্যাস জুড়ে। তুর্কিদের বাংলা বিজয়ের পূর্বে বর্ণপ্রথা আর সামন্তবাদের কষাঘাতে জর্জরিত সমাজের দ্বারে দ্বারে তারা ঘুরেছেন অবিরাম।
লক্ষ্মণাবতী তখনো বাংলার রাজধানী। সেন বংশের অশীতিপর রাজা লক্ষ্মণ সেন ক্ষমতায়। বৃদ্ধ রাজা। রাজ্যের কলকাঠি সামন্তরাজাদের হাতে। নিজেদের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ রাখতে সামন্তরা বর্ণনাতীত নির্যাতন চালায় সাধারণ মানুষের উপর। এই সামন্তদের অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে নিম্নবর্গের মানুষেরা মাঝে মাঝে নিজেদের অজান্তেই বিদ্রোহী হয়ে ওঠত। বিদ্রোহের প্রতিক্রিয়া হতো ভয়ঙ্কর। সামন্তপতিরা বিদ্রোহী জনগণের উপর চালাত অকথ্য নির্যাতন। উপন্যাসের হরিসেন চরিত্রটি জীবন্ত থেকেছে সেসব সামন্তরাজার প্রতিনিধি হয়ে।
সামাজিক শৃংখলা তখন ভেঙে পড়েছিল। সেনদের দ্বারা বিতাড়িত বৌদ্ধ সাধুদের আনাগোনা বেড়ে যায় সমাজে, তাদের ভেতর দেখা দেয় অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ডের প্রবণতা। এদিকে সামন্তদের উপর রাজার ছিল না কোনো নিয়ন্ত্রণ। সাধারণ প্রজারা করের বোঝায় জর্জরিত। বর্ণপ্রথার বিষে পুরো সমাজ নীল।
এমন একটি সময়ে এখানে শুরু হয় যবন তথা মুসলমানদের আনাগোনা। সমগ্র উত্তর ভারত পেরিয়ে মুসলমানদের লক্ষ্য তখন বাংলার দিকে। সম্পূর্ণ নতুন ধর্ম, নতুন জাতি, নতুন একটি জীবনধারার আগমন ঘটতে যাচ্ছে এ অঞ্চলে। প্রাকৃতজন, তথা সাধারণের মাঝে কেমন হয় এর প্রতিক্রিয়া? আসন্ন একটি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিপ্লবকে কীভাবে গ্রহণ করবে এ অঞ্চলের মানুষ? সেনদের দ্বারা বিতাড়িত বৌদ্ধদের সামাজিক অবস্থানই বা কেমন হবে? লেখক সেরকম কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেছেন উপন্যাসটিতে।
উপন্যাসের কাহিনীধারায় সোমজিতের মতো কিছু চরিত্র ছিল, যারা তৎকালীন সমাজিক সংহতি রক্ষায় তৎপর হয়ে উঠেছিলেন। সামন্তদের অত্যাচারের পীড়ন থেকে মুক্তির পথনির্দেশনা নিয়ে যারা ছুটে যেতেন লক্ষণ সেনদের দরবারে। কিন্তু সামন্তবেষ্টিত রাজদরবারে রাজার কাছে ঘেঁষার সুযোগ সোমজিতদের হয়ে উঠত না। লেখক সোমজিতকে নিয়ে যান হলায়ুধ মিশ্রের মতো ঐতিহাসিক চরিত্রের কাছেও। হলায়ুধ মিশ্র তখন লক্ষ্মণ সেনের প্রভাবশালী মন্ত্রী। কিন্তু তার মতো পণ্ডিতাম্মন্য ব্যক্তিরও আসন্ন বিপ্লব নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। সামাজিক বিপর্যয় রুখতে তার যেন কোনো তাড়না নেই। আছে একধরনের অবসন্ন শীতলতা। আসন্ন বিপ্লবটির জন্যই যেন হলায়ুধরা অপেক্ষা করে আছেন। যা ঘটার, তাকে ঘটতে দাও। মুসলামানদের আগমন নিয়ে সোমজিতের উদ্বেগের জবাবে হলায়ুধ যেমন বলে উঠেন,
“যবনদের আগমনে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়েই বা কী হবে- যা ভবিতব্য তাই হবে। এও কর্মফল বলতে পারো। আমার বিশ্বাস, যবনদের আগমনে ধর্ম বলো, জাতি বলো, কোনোকিছু ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। তারা যদি এ দেশ জয় করে নেয়, তাহলে নিশ্চয় তাদের এদেশ শাসন করতে হবে।”
এভাবে এ অঞ্চলে একসময় মুসলমানদের আগমন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। একসময় সত্যি সত্যি মুসলমানরা রাজধানী লক্ষ্মণাবতী আক্রমণ করে। যে আসন্ন বিপ্লবের ছায়া পুরো উপন্যাসের উপজীব্যকে এক সুতোয় বেঁধে রেখেছিল, সেটি অবশেষে ঘটেই গেল। তুর্কি মুসলিমরা একটি রাজশক্তি হিসেবে সত্যি সত্যি বাংলায় এসে গেছে। রাজা লক্ষণ সেন কোনো প্রতিরোধ সৃষ্টি না করেই পালিয়ে যান।
নিপীড়ন আর জাত-পাতে আকণ্ঠ ডুবে থাকা বাংলার সাধারণ মানুষের করণীয় এবার কী হবে? কোথায় যাবে তারা? উপন্যাসের চরিত্রগুলোর শেষ পরিণতিই যেন সে আভাস দিয়ে যায়। লেখকের ভাষায়,
“প্রদোষে প্রাকৃতজনের কাহিনী এখানেই সমাপ্ত। পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, লীলাবতী, বসন্তদাস, ছায়াবতী, মিত্রানন্দ, নিরঞ্জন প্রমুখ চরিত্রগুলির শেষ পর্যন্ত কী হলাে? কেন তাদের পরিণতি লিপিবদ্ধ হলো না? এ প্রশ্নের উত্তরে সবিনয় নিবেদন এই যে, সীমাবদ্ধ ক্ষমতাই লেখককে অধিক বিস্তারে যেতে সাহসী করেনি। উপরন্তু ঐসব চরিত্রের পরিণতি ইতিহাসে মােটামুটি স্পষ্টভাবেই লিপিবদ্ধ।”
উপন্যাসটির চরিত্রগুলোর চিত্রায়ন আর গল্পের প্রবহমানতায় লেখক অনন্য মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। ভাষা, উপমা আর কাহিনী বিন্যাসে সুদূর অতীতের সমাজকে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন সুনিপুণ দক্ষতায়। বিংশ শতাব্দীতে বেড়ে উঠে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মানুষের সমাজালেখ্য রচনা তার জন্য খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। কেননা, সে সময়ের সমাজ ব্যাবস্থার পরিপূর্ণ চিত্র পাওয়ার মতো ঐতিহাসিক সূত্র খুবই অপ্রতুল। আর তাই, উপন্যাসটি লিখতে গিয়ে লেখককে সাহায্য নিতে হয় সমসাময়িক হলায়ুধ মিশ্রের ‘শেখ সোভদয়া’র মতো গূঢ় বইয়ের। সে কারণেই হয়তো ইতিহাসাশ্রয়ী উপন্যাস হিসেবে ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ এতটা সার্থক হয়ে উঠেছে।
তবে উপন্যাসের নামকরণের সার্থকতা নিয়ে সরল পাঠকের মনে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হতে পারে। মুসলমানদের আগমনের পূর্বে বাংলার সমাজ ছিল বর্ণপ্রথা, জাত-পাত ও মানবিক অসাম্যে জর্জরিত। সাম্যের পতাকাবাহী ধর্ম হিসেবে ইসলামের আগমন এ অঞ্চলে একটি ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। বিধিবদ্ধ ‘সামাজিক-সাম্য’ ধারণার সাথে এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষ প্রথম পরিচিত হয় ইসলাম ও মুসলমানদের সংস্পর্শে আসার কারণেই। আবার এটাও ঠিক, একটি বহিঃশক্তি হিসেবেই মুসলমানদের এ অঞ্চলে আগমন ঘটেছিল।
তবুও মুসলমানদের আগমনে এ অঞ্চলে যে সামাজিক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল, তা নিছক বিজয়ী শক্তির চিরাচরিত প্রভাবে হয়নি। এর পেছনে ছিল ইসলামের সাম্যের বাণীর প্রত্যক্ষ প্রভাব। কিন্তু লেখক এ পরিবর্তনকে বিজয়ী বহিঃশক্তির চিরাচরিত প্রভাব হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন। ইসলামের সাম্য-বাণীর প্রভাবের বিষয়টি সেখানে গৌণ হয়ে থেকেছে। আর সে কারণেই সম্ভবত উপন্যাসের নাম ‘প্রত্যুষে প্রাকৃতজন’ না হয়ে, ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ হয়েছে। ধোঁয়াশাটাও এখানেই।
বই: প্রদোষে প্রাকৃতজন || লেখক: শওকত আলী
প্রথম প্রকাশ: ১৯৮৪ || প্রকাশক: ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড