Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

‘পুষ্পা: দ্য রাইজ’ সিনেমা ও রক্তচন্দন কাঠের বাস্তবতা

এই সময়ে, যখন করোনাভাইরাসের নতুন ঢেউয়ের আগ্রাসনে জনজীবন পুনরায় বিপর্যস্ত হওয়ার আশঙ্কা বিরাজমান, তখন বলিউডের চলচ্চিত্র প্রযোজক-পরিচালকেরা সিনেমা নির্মাণ কিংবা নির্মিত সিনেমা মুক্তির আগে দশবার সার্বিক পরিস্থিতির কথা ভেবেছেন। একটা সিনেমা মুক্তির পর সেটা দর্শক, চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে কিনা, সেটার উপর আর্থিক সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করে। করোনার এই সময়ে বিভিন্ন বিধিনিষেধের গ্যাঁড়াকলে পড়ে সিনেমা হলগুলোতে দর্শকের প্রবেশ বন্ধ হয়ে গিয়েছে, যেটি একটি সিনেমার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কপালে চিন্তার ভাঁজ আরও বাড়িয়েছে। সিনেমা মুক্তি ও দর্শকদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার জন্য বর্তমানে পরিচালকদের কাছে এখন একমাত্র উপায় ‘ওটিটি প্লাটফর্ম’।

হতজতপবকব
করোনার এই সময়ে তৈরি করা মুভির মুক্তি নিয়ে শঙ্কায় ছিলেন পরিচালক-প্রযোজক-অভিনয়শিল্পী সবাই;
image source: timesofindia.indiatimes.com

‘পুষ্পা: দ্য রাইজ’ সিনেমাটি বর্তমানে ভারত তো বটেই, পুরো বিশ্বে বেশ আলোড়ন তৈরিতে সক্ষম হয়েছে। সিনেমার মূল দুই চরিত্রে অভিনয় করেছেন দক্ষিণী জুটি আল্লু অর্জুন ও রাশমিকা মন্দানা, যাদের দুর্দান্ত অভিনয়ের জন্য ভারত তো বটেই, এর বাইরেও অসংখ্য ভক্ত রয়েছে। সিনেমাটি মুক্তির পর ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী এর আয় দাঁড়িয়েছে সাড়ে তিনশো কোটি রূপির অধিক। করোনার এই পরিস্থিতিতে এই বিশাল অংকের আয় যেকোনো সিনেমার পরিচালক-প্রযোজকের জন্যই স্বপ্নের ব্যাপার। সিনেমায় দেখানো হয়েছে কীভাবে রক্তচন্দন কাঠ পাচারের সাথে জড়িত পুষ্পা রাজ (যে চরিত্রে আল্লু অর্জুন অভিনয় করেছেন) নিজের সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। শুধু তা-ই নয়, এর পাশাপাশি আরও অনেক ঘটনা নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সিনেমায়। আল্লু অর্জুন, ফাহাদ ফাসিলসহ সিনেমার বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করা শিল্পীদের নিখুঁত অভিনয়, আকর্ষণীয় প্লটের পাশাপাশি অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফির জন্য বাড়তি মনোযোগ কাড়তে সক্ষম হয়েছে সিনেমাটি।

জতওতপেব
দক্ষিণী সুপারস্টার আল্লু অর্জুন অভিনীত এই মুভি আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা লাভ করেছে; image source: proiqra.com

আমাদের মূল আলোচনার বিষয় কিন্তু ‘পুষ্পা: দ্য রাইজ’ নয়, কিংবা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির উপর করোনাভাইরাসের প্রভাবও নয়। করোনাভাইরাসের এই সময়ে মুক্তি পাওয়া ও ব্যবসাসফল হওয়া ‘পুষ্পা: দ্য রাইজ’ সিনেমায় যে বহুমূল্য রক্তচন্দন কাঠের অবৈধ ব্যবসার প্রসঙ্গ উঠে এসেছে, সেই কাঠ হচ্ছে মূল বিষয়। সিনেমায় হয়তো এই কাঠ সম্পর্কে মৌলিক ধারণা পাওয়া যাবে, কিন্তু এর বাস্তবতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেতে হলে আরও অনেক বিষয় সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। এই কাঠকে কেন্দ্র করে কীভাবে বিশাল পাচার নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠেছে, কীভাবে বিশ্ববাজারে এর বিরাট চাহিদা তৈরি হয়েছে, কেন এই কাঠের কদর এত বেশি, ঠিক কী কারণে এর এতো চাহিদা থাকা সত্ত্বেও ভারতসহ পৃথিবীর অনেক দেশে এই কাঠের ব্যবসা নিষিদ্ধ– এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হবে এই লেখাতে।

যদি জিজ্ঞেস করা হয়, “কেন বিশ্বব্যাপী এই রক্তচন্দন কাঠের এত কদর?“, তাহলে উত্তরে বেশ কিছু কারণ বলতে হবে। পুরো বিশ্বে এখন পর্যন্ত দুই রকমের চন্দন কাঠ রয়েছে- সাদা চন্দন, এবং লাল চন্দন। রঙের উপর ভিত্তি করে তাদের এমন নাম দেয়া হয়েছে। সাদা চন্দন কাঠের সুগন্ধ থাকলেও লাল চন্দন বা ‘রক্তচন্দন’ কাঠের তেমন কোনো সুগন্ধ নেই। বিশ্বজুড়ে রক্তচন্দন কাঠের বিশাল কদরের পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে- এই কাঠের ঔষধি গুণ রয়েছে। পৃথিবীর অনেক সমাজেই এটি বিশ্বাস করা হয় যে, রক্তচন্দন কাঠে এমন উপাদান রয়েছে, যেটি দূষিত রক্ত শোধন করতে পারে। শুধু তা-ই নয়, পোকামাকড়ের কামড়ের ফলে সৃষ্ট অসুখ থেকে মুক্তি পেতেও এই কাঠের ব্যবহার কাজে দেয়, এমন কথাও প্রচলিত আছে। পুড়ে যাওয়া ত্বকের চিকিৎসার জন্যও এই কাঠ ব্যবহার করা হয়। পুরো বিশ্বের মধ্যে বেশ কিছু আরব দেশ, পূর্ব এশিয়ার নানা দেশে এই কাঠের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।

মআকবকনলন
চীন ও পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে; image source: indiatoday.in

ভারতে কেন এই কাঠের সাথে সংশ্লিষ্ট যেকোনো ব্যবসা ‘নিষিদ্ধ’ ঘোষণা করা হয়েছে, তার উত্তর খোঁজা যাক। মূল কারণ, এই কাঠ পাচার হতে হতে এমন এক পর্যায়ে এসে ঠেকেছে যে বিলুপ্ত হতে খুব বেশি দেরি নেই। আন্তর্জাতিক বেশ কিছু সংস্থা ইতোমধ্যে এই কাঠ যে গাছ থেকে উৎপাদিত হয়, সেই গাছকে ‘বিলুপ্তপ্রায়’ কিংবা ‘বিপদাপন্ন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। পুরো বিশ্বে মাত্র পাঁচ শতাংশ রক্তচন্দন গাছ এখন পর্যন্ত টিকে আছে। পুরো পৃথিবীতে ভারত বাদে অন্য কোনো দেশে এই গাছ জন্মায় না, আবার ভারতেও একমাত্র অন্ধ্রপ্রদেশ ছাড়া অন্য কোনো রাজ্যে এই গাছ জন্মায় না। অন্ধ্রপ্রদেশেও সব জেলায় এই গাছ জন্মায় না। নেল্লোর, কুর্নুল, চিত্তোর ও কাদাপ্পা– অন্ধ্রপ্রদেশের এই চারটি মাত্র জেলায় দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে এই গাছগুলো জন্মায়। খোলা চোখেই বোঝা যাচ্ছে, এই গাছের যোগান খুবই কম। অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মানুযায়ী, কোনো পণ্যের যোগান যদি চাহিদার তুলনায় কম হয়, তাহলে সেই পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এ কারণে এই গাছের কাঠের দাম অন্যান্য কাঠের তুলনায় অনেক বেশি। আন্তর্জাতিক বাজারে এক টন রক্তচন্দন কাঠের দাম এক কোটি থেকে দেড় কোটি রূপি!

যেহেতু এই কাঠের ব্যবসা নিষিদ্ধ, তাই বিশ্ববাজারের চাহিদা মেটাতে অবৈধ উপায়ে পাচার করা হয় এই কাঠ। অবৈধ ব্যবসায়ীরা স্থানীয় আদিবাসীদের মাধ্যমে জঙ্গলের গাছ কাটা, ও সেগুলো সাইজ মতো কাটিয়ে নেন। এরপর সেগুলো স্থানীয় বিভিন্ন গোডাউনে লুকিয়ে রাখা হয়। আদিবাসীরা স্থানীয়ভাবে আখ চাষ করে যা উপার্জন করেন, তার চেয়ে অনেক বেশি আয় করতে পারেন এই রক্তচন্দন কাঠ সংগ্রহের মাধ্যমে। পাহাড় থেকে কাঠ সংগ্রহ ও সেগুলো সাইজ মতো কাটার পর সুযোগের অপেক্ষায় থাকা হয়, তখন ট্রাকের মাধ্যমে নিরাপত্তারক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে সীমান্ত পার করে ফেলা যাবে। এরপর সীমান্তের ওপারের অবৈধ ব্যবসায়ীরা চালান হাতে পাওয়ার পর ওপারের নিরাপত্তারক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সেগুলো পাঠিয়ে দেন। অন্ধ্রপ্রদেশের স্থানীয় সরকার এসবের বিরুদ্ধে সজাগ, প্রায়ই তারা জঙ্গলে বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করেন এই গাছ কাটার জন্য যেসব কাঠুরিয়া রয়েছে, তাদের গ্রেফতারের জন্য। গত এক দশকে ত্রিশজনের বেশি কাঠুরিয়া ও অর্ধ ডজনেরও বেশি নিরাপত্তারক্ষী নিহত হয়েছে এসব অভিযানে। অভিযোগ আছে, অভিযানের সময় আদিবাসী কাঠুরিয়ারা হাতুড়ি, ছুড়ি, লাঠি ইত্যাদি দিয়ে নিরাপত্তারক্ষীদের উপর হামলা করেন। অপরদিকে মানবাধিকার সংস্থাগুলো নিরাপত্তারক্ষীদের বিরুদ্ধে দাবি করে, নিরাপত্তারক্ষীরা অনেক সময় নিরস্ত্র আদিবাসীদের উপর হামলা করে, যা মানবাধিকারের পরিপন্থী।

বম্্্কচচ
পুলিশের সাথে পাচারকারীদের নিয়মিত সংঘর্ষ হয় অন্ধ্রপ্রদেশে; image source: latestlaws.com

যদি এমন কোনো একক দেশের কথা বলা হয়, যেখানে রক্তচন্দন কাঠের চাহিদা সবচেয়ে বেশি, তাহলে চীনের নাম অবশ্যই আসবে। সে-ই প্রাচীনকাল থেকেই চীনের অভিজাতদের মাঝে এই দুর্লভ কাঠের তৈরি বাদ্যযন্ত্র ও আসবাবপত্রের বিশাল চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে যে পরিমাণ রক্তচন্দন কাঠ পাচার হয়, তার একটি বড় অংশ নেপাল হয়ে তারপর চীনে যায়। গত দশকে বেশ কয়েকবার ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে বেশ কিছু চীনা নাগরিক গ্রেফতার হয়েছেন, যারা এই রক্তচন্দন কাঠের অবৈধ ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন। চীনে এসব কাঠ দিয়ে প্রথমে আসবাবপত্র ও বাদ্যযন্ত্র তৈরি করার পর যে অংশ বেঁচে যায়, সেসব অংশ ওষুধশিল্পের কারখানায় পাঠিয়ে দেয়া হয়।

স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা হলেও এই কাঠের পাচার একেবারে বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। গত এক দশক ধরে অসংখ্য হতাহতের ঘটনা ঘটেছে, হাজার হাজার টন কাঠ জব্দ করা হয়েছে, কিন্তু এরপরও পাচার থেমে নেই। পাচারকারীরা পাহাড়ি অঞ্চলে স্থানীয় আদিবাসীদের এই কাঠ সংগ্রহের দায়িত্ব দিয়ে নিজেরা আড়ালে থাকেন, নিরাপত্তারক্ষীরা কখনোই তাদের সন্ধান পায় না। হয়তো খুব শীঘ্রই এমন দিন আসবে, যেদিন পাহাড়ে আর এই গাছ পাওয়া যাবে না। সেই সাথে এই গাছ কাটা, সংগ্রহ করা, ট্রাকে পরিবহন করা ইত্যাদি নানা কাজের সাথে জড়িত প্রায় তিন হাজার মানুষকে অন্য কোনো পেশা বেছে নিতে হবে।

Related Articles