আত্মজৈবনিক রচনা পড়া সবসময়ই আনন্দদায়ক, আর তা যদি হয় রেহমান সোবহানের মতো বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্বের, তাহলে তো কথাই নেই। রেহমান সোবহান তার শৈশব থেকে বর্তমান পর্যন্ত স্মৃতিকথাগুলো ‘Untranquil Recollections’ নামে তিনটি খণ্ডে লিখবেন, যার প্রথম দুই খণ্ড ‘The Years of Fulfillment’ ও ‘Nation Building in Post Liberation Bangladesh’ নামে প্রকাশিত হয়েছে ও তৃতীয় খণ্ডটিও অচিরেই প্রকাশ পাবে। এর মধ্যে প্রথম বইটি পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে।
রেহমান সোবহানের স্মৃতিকথার তিনটি খণ্ডই প্রকাশ করবে ভারতীয় প্রকাশনা সংস্থা সেজ পাবলিকেশনস, যার মধ্যে প্রথম বইটির বঙ্গানুবাদ প্রকাশিত হয়েছে সেজেরই অঙ্গসংস্থা ‘ভাষা প্রকাশনী’ থেকে ‘উতল রোমন্থন: পূর্ণতার সেই বছরগুলো’ নামে। বইটির প্রচ্ছদ, বাঁধাই সবই অত্যন্ত চমৎকার।
আলোচ্য বইটি পেপারব্যাক। হার্ডকভার বইয়ের তুলনায় পেপারব্যাকের কিছু সুবিধা আছে। এটি হালকা, সহজে ভাঁজ করে পড়া যায়, বহন করা সহজ, দামও কম।
রেহমান সোবহান বরাবরই বাংলার চেয়ে ইংরেজিতে বেশি স্বাছন্দ্য, বইগুলো লিখেছেনও তিনি ইংরেজিতে। প্রথম বইটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন অমিতাভ সেনগুপ্ত। তার অনুবাদ একদম ঝরঝরে, প্রাঞ্জল। পড়ার সময় পাঠকের মনেই হবে না তিনি কোনো অনুবাদ পড়ছেন।
রেহমান সোবহান বর্তমানে কাজ করছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের চেয়ারম্যান হিসেবে। তবে, তার বড় পরিচয় হলো তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সংগঠক। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বৈদেশিক জনমত সংগ্রহে কূটনীতিক হিসেবে কাজ করেন। কর্মজীবনে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বাংলাদেশ প্ল্যানিং কমিশন, বাংলাদেশ ইনিস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ, সাউথ এশিয়ান সেন্টার ফর পলিসি স্টাডিজসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের জন্য ২০০৮ সালে তিনি স্বাধীনতা পুরষ্কার লাভ করেন।
তিন খণ্ডের স্মৃতিকথার প্রথম অংশে তিনি কথা বলেছেন তার জন্ম থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ পর্যন্ত। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময়গুলোকে তার জীবনের পূর্ণতার সময় হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। রেহমান সোবহান জন্মসূত্রে বেশ অভিজাত শ্রেণীর মানুষ; বাবা-মা দুদিক দিয়েই তার পরিবার ছিল অত্যন্ত প্রভাবশালী। তিনি নিজেও এ কথা স্বীকার করে লিখেছেন যে, সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণীতে তার জন্ম।
পরিবার নিয়ে কথা বলার সময় তিনি দুই পরিবারের কথা লিখেছেন: ১) যে পরিবারে তার জন্ম, ২) যে পরিবার তিনি বেছে নিয়েছেন অর্থাৎ তার শ্বশুরবাড়ির পরিবারের কথাও তিনি বলেছেন। সাধারণত, আমরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষদের দেখি তাদের মাতুল বংশ ও শ্বশুরবাড়ি নিয়ে নীরব থাকতে; তবে রেহমান সোবহান এই দুই পরিবারকেই তার নিজের পরিবার বলে আখ্যায়িত করেছেন।
বাবা খন্দকার ফজলে সোবহানের উচ্চপদস্থ পুলিশের চাকরির সুবাদে রেহমান সোবহানের শৈশব কেটেছে কলকাতায়। কলকাতার অলিগলিতে চক্কর কেটে, বিখ্যাত দোকানের বিভিন্ন মুখরোচক খাবার চেখে, বড় বইয়ের দোকান থেকে কেনা কমিকস ও কিশোর ক্লাসিক সাহিত্য পড়ে তার শৈশব-কৈশোরের বেশ বড় একটা অংশ কেটেছে।
রেহমান সোবহানের বিদ্যালয় জীবন কেটেছে দার্জিলিংয়ের সেন্ট পল’স আবাসিক বিদ্যালয়ে। সেন্ট পল’স-এ তিনি জুনিয়র-১ থেকে সিনিয়র কেম্ব্রিজ পরীক্ষা পর্যন্ত দীর্ঘ আট বছর পড়াশোনা করেছেন। তিনি সেখানে ক্লাইভ হাউসে থেকে পড়াশোনা করেছেন। সেন্ট পল’স-এ পড়ার সময়ে তিনি পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলাও ভালোভাবে চর্চা করেছেন; তিনি ছিলেন তার স্কুলের হকি দলের ভাইস-ক্যাপ্টেন, আবার আরেকদিকে বক্সিং চ্যাম্পিয়ন, ম্যারাথন চ্যাম্পিয়নও ছিলেন। যদিও পরবর্তী জীবনে তিনি আর খেলাধুলার চর্চা খুব বেশি করেননি। খেলাধুলার পাশাপাশি তিনি পড়াশোনায়ও ছিলেন তুখোড়, পড়াশোনায় সাফল্যের জন্য পেয়েছেন ডাবল প্রমোশন ও সিনিয়র কেম্ব্রিজ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি অর্জন করেছেন যা তখন খুব মানুষই পেত।
সেন্ট পল’স বিদ্যালয় থেকে কেম্ব্রিজ এইচএসসি পরীক্ষায় বসার সুযোগ না থাকায় রেহমান সোবহান লাহোরের এইচিসেন কলেজে (Aitchison College, Lahore) ভর্তি হন। মূলত এই কলেজে পড়ার সময়েই রেহমান সোবহানের রাজনৈতিক চেতনার মূল জাগরণ ঘটে। সেখানে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন সামন্ত রাজপুত্রদের সাথে একই সাথে অধ্যয়ন করেছেন যেখান থেকে সামন্তবাদের প্রথমিক ও গভীর ধারণা তিনি লাভ করেন।
এইচিসেনের পাঠ চুকিয়ে তিনি ঠিক করতে পারছিলেন না পরবর্তী জীবনে কী করবেন। তাই তাকে তার বাবা ভবিষ্যতে যাতে তিনি তাদের চামড়ার ব্যবসার হাল ধরতে পারেন সেজন্য চামড়ার ব্যবসা পরিচালনা শিখতে লন্ডনে পাঠিয়ে দেন। তিনি সেখানে কিছুদিন কাজ দেখেন তবে তা তাকে খুব বেশি আকর্ষণ করতে পারে না। তিনি উচ্চ শিক্ষা নেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। তার ভর্তি হবার পেছনে তার নানা তৎকালীন পাকিস্তানের গভর্নর খাজা নাজিমুদ্দিনের সুপারিশের বেশ ভালো ভূমিকা ছিল। এই বিষয়টা রেহমান সোবহানের বৌদ্ধিক আত্মসম্মানকে কখনোই তুষ্ট করতে পারেনি যেটা তিনি তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন।
মূলত তার উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের পেছনে ইন্ধন যুগিয়েছিলেন তার ফুফাতো ভাই কামাল হোসেন। হ্যাঁ, আমাদের প্রসিদ্ধ আইনজীবি ও অন্যতম সংবিধান প্রণেতা ডক্টর কামাল হোসেনই এই কামাল হোসেন। মূলত কেম্ব্রিজে অধ্যয়নকালীন সময়েই রেহমান সোবহান স্থায়ীভাবে ঢাকায় বসবাস ও পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
ঢাকার পেশাজীবনের প্রথম অংশে তিনি হাজারিবাগে তাদের পৈতৃক চামড়ার ব্যবসা কিছুদিন দেখাশোনা করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। একইসাথে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনেও যোগাযোগ বাড়াতে থাকেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার সময়ে তিনি বাংলাদেশের বেশ কজন বরেণ্য ব্যক্তির সরাসরি শিক্ষক ছিলেন, যাদের মধ্যে আছেন— তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান ফখরুদ্দিন আহমেদ, নোবেল বিজয়ী ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুস, সৈয়দ আশরাফ প্রমুখ।
তিনি সেই সময়ে শিক্ষক হিসেবে লক্ষ্য করেছিলেন, শিক্ষার্থীদের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার চাইতে সিভিল সার্ভিস পেশা হিসেবে গ্রহণের প্রবণতা অধিক ছিল। সে সময় সরকারি আমলা হওয়া ছিল তাদের সামাজিক উচ্চাশার সর্বোচ্চ চূড়া এবং এর ফলে বৈবাহিক সুবিধাও লাভ করা যায় বলে তারা মনে করতো। পঞ্চাশ বছর পরেও সে অবস্থার বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়নি। এখনো তরুণেরা তাদের পূর্বসুরীদের ধ্যান-ধারণার বৃত্ত থেকে বেরুতে পারেনি।
তিনি শিক্ষক থাকাকালীন সারা দেশব্যাপী পাকিস্তানি শোষকদের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে মুক্তির আকাঙ্খা দানা বাঁধতে থাকে। তিনি তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতি ও চূড়ান্ত সংগ্রামের পূর্বের অবস্থা বেশ কাছ থেকে লক্ষ্য করেছেন। পাঠক খেয়াল করতে পারবেন তার বইতে এসবের বিশদ বর্ণনা এসেছে।
রেহমান সোবহান শুরু থেকেই পাকিস্তানি সরকারের দুই অর্থনীতি নিয়ে বেশ সোচ্চার ছিলেন ও এই নিয়ে অনেক লেখালেখি করে পাকিস্তানি সামরিক শোষকদের কালো তালিকাভুক্ত হয়েছিলেন। ছয় দফার যে চার দফায় অর্থনীতি বিষয়ক দাবি-দাওয়া ছিল, সেগুলোতে তার ভালো রকমের অবদান ছিল। ছয় দফা প্রণয়ন থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দিন আহমেদ, ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার অন্যান্য কুশীলবদের সাথে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর তিনি বেশ ভালোভাবে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। এই সময় তিনি, ডক্টর কামাল হোসেন, জিয়াউল হক টুলু প্রমুখ মিলে ‘ফোরাম’ নামে একটি সাপ্তাহিক ইংরেজি পত্রিকা চালু করেন যেখানে পূর্ব পাকিস্তানের বৈষম্য, মানুষের দাবি-দাওয়া প্রকাশ পেত। অনেক স্বনামধন্য লেখক ও রাজনীতিবিদ উক্ত পত্রিকায় কলাম লিখেছেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ শুরুর থেকেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার। নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে তিনি ভারতে পৌঁছান ও তাজউদ্দিন আহমেদের সাথে দেখা করেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের নির্দেশে তিনি বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত হিসেবে বাংলাদেশের হয়ে প্রচারণা চালান; তার আরেকটি দায়িত্ব ছিল বিদেশে পাকিস্তানের কূটনৈতিক মিশনে নিযুক্ত বাংলাদেশি অফিসারদের পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণায় প্রলুদ্ধ করা। তিনি বাংলাদেশের হয়ে ইউরোপ, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রে প্রচারণা চালান। বিদেশে তার কূটনৈতিক অভিযান ছিল রোমাঞ্চকর ও বাংলাদেশের পক্ষে অত্যন্ত ফলপ্রসূ— যা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা তিনি তার বইয়ে করেছেন।
রেহমান সোবহান তার জীবনের শীর্ষবিন্দু বলে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তার কর্মকাণ্ডকে। বাংলাদেশের মুক্তিতে অবদান রাখতে পেরে তিনি গর্বিত এবং নিজের জীবনকে পূর্ণ মনে করেছেন। রেহমান সবহান এমন একজন মানুষ যিনি ভারতবর্ষ ভাগ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের জন্ম সবই একদম কাছ থেকে দেখেছেন। পাকিস্তান আমলে তার পারিবারের ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা তাকে সুযোগ করে দিয়েছিল পাকিস্তানি শাসকদের একদম ভেতর থেকে দেখার ও জানবার, তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একদম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সক্রিয় অবদান রেখেছেন।
এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে তিনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তাই তার আত্মজীবনী পাঠের মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশের জন্ম থেকে শুরু করে দেশ হিসেবে গড়ে উঠা পর্যন্ত আমরা বেশ ভালো ধারণা পাই। প্রাঞ্জল অনুবাদ ও রেহমান রোবহানের সরস লেখার মাধ্যমে ইতিহাস ঘুরে আসার অভিজ্ঞতা ছিল অত্যন্ত আনন্দদায়ক।