আগস্ট, বাঙালি জাতির কাছে ইংরেজি এই মাসটির রয়েছে আলাদা এক ইতিহাস। বাঙালির কাছে আগস্ট কোনো সুখের বার্তা দেয়নি, বরং বাঙালির ইতিহাসের অন্যতম কালো অধ্যায়টি রচনা করছে এই মাসটিই। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার গোটা পরিবারকে ধানমন্ডি-৩২ এর বাড়িতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। আগস্ট তাই বাঙালির চোখে ভীতি জাগায়, অবিশ্বাস জাগায়, ক্রোধ জাগায়। মনে জাগায় শোক। আর সেই শোক অবশ করে তোলে গোটা দেহটাকে। বইয়ের নাম দেখে তাই আন্দাজ করতে পারা যায়, এ ঘৃণ্য ঘটনাটিকে ঘিরে দাঁড়াবে এই বইয়ের গল্প। তবে মাসরুর আরেফিনের গল্পের ডালপালা বিস্তৃত হয়েছে আরো গভীরে।
‘আগস্ট আবছায়া’র গল্প গড়ে উঠেছে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের একজন অধ্যাপককে ঘিরে। এই অধ্যাপকই গল্পের নায়ক। তার উত্তম জবানিতে লেখা হয়েছে গল্পটি। তার ভাষ্যতেই পাঠক গোটা গল্পটি পড়েন। অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি একজন সাহিত্য অনুবাদক। বইয়ের লেখক মাসরুর আরেফিনের মতো বইয়ের নায়ক অধ্যাপকও অনুবাদ করেছেন ‘কাফকা গল্পসমগ্র’, যার প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে এবং দ্বিতীয় খণ্ডের অনুবাদ কাজ চলছে। ঠিক এখানটায় এসে লেখক মাসরুর আরেফিন তার গল্পের নায়ককে গল্প আর বাস্তবের মাঝের একটা ধূসর জায়গায় নিয়ে আসেন। বইয়ের অধ্যাপক তখন আরো বেশি বাস্তবিক হয়ে উঠেন, যেন লেখক মাসরুর আরেফিনেরই অন্য এক সত্ত্বা এই অধ্যাপক এবং গল্পের বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এ ধারণা আরো গাঢ় হয়।
এই ইতিহাসের অধ্যাপকের আগস্ট নিয়ে রয়েছে প্রচণ্ড আচ্ছন্নতা। প্রতি বছর আগস্ট এলেই তার স্বাভাবিক আচরণে ভিন্নতা আসে, তিনি দিশেহারা হয়ে পড়েন। আগস্টে সংঘটিত হওয়া বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড তাকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। এ হত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেন না অধ্যাপক। তার সকল সিদ্ধান্ত, সকল চিন্তা এসে বাধাপ্রাপ্ত হয় ১৫ আগস্টের কেন্দ্রবিন্দুতে। বইয়ের প্রারম্ভিক অংশে লেখকের পরিচয় করিয়ে দেওয়া মুম্বাইয়ের ট্যাক্সি ড্রাইভার আইয়ার বইয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে উঠত না, যদি না কথাপ্রসঙ্গে ১৫ই আগস্টের হত্যাকাণ্ড বা ইন্দিরা গান্ধী নিয়ে সে তার জানাশোনা প্রকাশ করত।
আইয়ারের মুখে মুম্বাইয়ে তার মতো ট্যাক্সি ড্রাইভারদের দিনে মাত্র দু’ ঘণ্টা ঘুমিয়ে ছুটে চলার বেদনাতুর গল্প, পাম ক্রিক বিচে দু’দিন পর পর ভেসে ওঠা লাশের ভীতিকর ঘটনাবলি শুনে আপনমনে শিউরে ওঠেন অধ্যাপক। কিন্তু, বিদায়বেলায় আইয়ারকে কোনো বখশিস দেন না অধ্যাপক। পরে এই ঘটনাটি বারবার তার মনে অপরাধবোধ জাগায়। প্রতি বছর আগস্টের এই অস্থিরতায় এ বছর অধ্যাপকের মনে নতুন করে যোগ হয় আইয়ারকে বখশিস না দেওয়ার গ্লানি। দেশে ফিরে তিনি তার বন্ধু মাসুম ও নূর হোসেনকে মুম্বাই সফরের ইতিবৃত্ত জানাতে গিয়ে একটু চড়িয়ে উল্লেখ করেন আইয়ারকে মোটা অংকের বখশিস দেওয়ার বানোয়াট ঘটনা। মিথ্যে বলে অধ্যাপক নিস্তার পেতে চান ভেতরের অপরাধবোধ থেকে। কিন্তু ঘটে তার ঠিক বিপরীত।
বখশিস দেওয়ার মিথ্যা ঘটনা তার নিজের চেতনা, নীতিবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং তা করেন তিনি নিজেই। এ অপরাধবোধের হাত ধরে তিনি তার গল্পবয়ানে পাঠকদের দিয়ে যান অস্তিত্ববাদ নিয়ে তার নিজস্ব দর্শনে। ক্ষমতার জন্য মানুষের চিরন্তন লোভ, আত্ম-ধ্বংসমুখিতা, সময়ের কাছে এ নশ্বর জীবনের ক্ষুদ্রতার সামনে পাঠককে দাঁড় করান অধ্যাপক। মানবজীবনকে প্রলম্বিত করে সৃষ্টির রহস্যের আদি-অন্তে ঘুরে বেড়ান তিনি।
মানবজীবনের অর্থ সম্পর্কিত ভারি দর্শন সম্বলিত বইয়ের এই প্রথম অংশে খানিকটা আলতো পরশের জায়গা করে দেন অত্যন্ত যুক্তিবাদী এই মানুষটির দুই প্রেমিকা। একজন বাংলাদেশেরই। অধ্যাপকের ছাত্রী মেহেরনাজ। তেজস্বী মেয়ে এই মেহেরনাজ। তার অকপট কথা মাঝে মাঝে অধ্যাপককেও ক্ষণিকের জন্য চুপ করিয়ে দেয়। মেহেরনাজ অধ্যাপককে তাড়া দেয় কাফকা গল্পসমগ্রের অনুবাদ শেষ করতে। কিন্তু আগস্টের ভ্যাপসা গরম অধ্যাপকের মনোযোগ বিচ্ছিন্ন করে। অধ্যাপক তখন এই ভ্যাপসা গরমে শান্তির খোঁজে হাতে তুলে নেন ফরাসি সাহিত্যিক প্রুস্তকে (ফরাসি সাহিত্যিক)। চিন্তার নানান সুতো ধরে চলে যান তুর্গেনেভে (রাশিয়ান সাহিত্যিক)।
সুরভীর দীর্ঘ ইমেইলগুলো তাকে আবার নিয়ে আসে বর্তমানে। এই সুরভী অধ্যাপকের আরেক প্রেমিকা। ধনীর দুলালী, সুরভী ছেত্রী। বড়ই অভিমানী আর প্রচণ্ড জ্ঞানী ব্যক্তিত্বের মিশেল- সুরভী। অধ্যাপকের যথোপযুক্ত এই দুই প্রেমিকার মাঝে মেহেরনাজের জন্য প্রেমভাব তার মনে কাজ করলেও, সুরভির প্রতি তার আহ্লাদ শারীরিক সম্পর্ক পর্যন্তই সীমাবদ্ধ।
অধ্যাপক নিজের প্রেমিকপুরুষ সত্ত্বাকে অস্বীকার করে নির্মোহ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। কিন্তু সূক্ষ্মতায় দেখা যায়, প্রেমিকাদের জন্য অনেক তীব্র অনুভূতির প্রকাশকে তিনি দমিয়ে রাখতে পারেননি। অন্তরঙ্গতার একান্ত মুহূর্তগুলোতে শুধুমাত্র বাইরের প্রেমিক হিসেবেই থাকার চেষ্টাতেই সামনে এসে পড়ে অধ্যাপকের ভেতরকার প্রেমিক সত্ত্বা। কিন্তু এ প্রেমিকসত্ত্বার রোমন্থনে খুব বেশি সময় ব্যয় করতে পারেন না অধ্যাপক। আগস্ট এর আচ্ছন্নতা তাকে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়ায়। ছোট্ট ঘটনাগুলো ভ্রুকুটি কেটে তাই অন্যভাবে ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন অধ্যাপক। তার এই অস্থিরতায় আইয়ারের ঘটনার পর আরো একটি নতুন মাত্রা যোগ করে সুরভির অভিমানী ইমেইলগুলোর মাঝে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি ইমেইল। নেপালে সংঘটিত সেই ভয়াবহ ভূমিকম্পে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পান সুরভী। মানবরচিত এক গূঢ় ষড়যন্ত্র।
সুরভীর এই ষড়যন্ত্রের কথা অধ্যাপককে আরো বিক্ষিপ্ত করে দেয়। তিনি মাথা ঝেড়ে উঠেছেন এবার, কিছু একটা ঘটানোর বাসনা নিয়ে। সে বাসনা থেকে ইব্রাহিমের দোরগোড়ায় কড়া নাড়েন অধ্যাপক। এবং গল্পে ইব্রাহিমের আগমনের মুহূর্তটি থেকে নতুন এক ধারায় প্রবাহিত হতে থাকে গল্পের স্রোত। অধ্যাপক ইব্রাহিমকে সম্বোধন করেন ‘আদি পিতা’ বলে। লেখক মাসরুর আরেফিন, ইব্রাহিম এবং অধ্যাপক দুজনের নিগূঢ় আলাপচারিতার মাঝ দিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের অভ্যন্তরীণ কারণের এপিঠ-ওপিঠ, দু’ পিঠকেই পাঠকের সামনে উন্মোচিত করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রেক্ষাপট এবং এর পেছনে লুকিয়ে থাকা অজানা এক বাস্তবতার বর্ণনা মেলে ইব্রাহিমের বয়ানে। বইয়ের এ অংশে, পরস্পরবিরোধী বাস্তবতার অত্যন্ত সংবেদনশীল বর্ণনা পাঠককে আরো বেশি আগ্রহী করে তোলে। সে আগ্রহের পারদ সর্বোচ্চে ঠেকে যায়, যখন বিজয় স্বরণীর মোড় পার হতে গিয়ে অধ্যাপক চলে যান ১৯৭৫ এর ১৪ আগস্টে।
বিজয় স্বরণীর ট্রাফিক সিগন্যালের লাল বাতিতে অধ্যাপক ১৯৭৫ সালের ১৪, ১৫, ১৬ আগস্টের সকল ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হন। পরাবাস্তবতার ছোঁয়ায় অধ্যাপকের চোখের সামনে পরিষ্কার করে অবস্থান নিতে থাকে ১৫-ই আগস্টের ঘটনার পূর্ববর্তী মুহূর্তগুলো। ১৫-ই আগস্টে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের হত্যা এবং ১৬-ই আগস্টে গোটা দেশের অবস্থা সবকিছু প্রত্যক্ষ করেন অধ্যাপক। তবে অধ্যাপককে পরাবাস্তবতা থেকে ঝট করে আবার বাস্তবতায় টেনে আনে ১৫-ই আগস্টের ভীতিকর আগমনী ঘণ্টা। বাস্তব দুনিয়ায় ১৫-ই আগস্টের প্রথম প্রহরে অধ্যাপকের বসবাসরত এলাকা বসুন্ধরা হঠাৎ এক বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে। এই শব্দকে মামুলি কিছু হিসেবে ভুলেও ভাবতে পারেন না অধ্যাপক। একদিকে সরফরাজ নেওয়াজ এবং তার মুরিদগণ এই শব্দের ব্যাখ্যা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দিচ্ছে, অপরদিকে অধ্যাপক, মেহেরনাজকে নিয়ে এ শব্দের উৎস খুঁজতে গিয়ে নেপালের ভূমিকম্প, আমেরিকা- ইসরায়েলের ষড়যন্ত্র সহ সকল ভূ-রাজনীতির মূলকে একই সুতোয় আটকে উৎপাটন করতে বদ্ধপরিকর !
এই পৃথিবী নামক গ্রহে মানুষ নামের প্রাণীটির জীবনের সকল হিংস্রতা, ক্রুঢ়তা, অসহায়তা নিয়ে লেখক মাসরুর আরেফিন তার বিচলতা প্রকাশ করেছেন অধ্যাপকের বয়ানে। ধনী-গরীবের চিরন্তন বৈষম্য, আপাত ঘৃণার এ পৃথিবীতে জীবনের অর্থ দাঁড় করানোর চেষ্টা, বিশ্বাসহীনতা আর কিম্ভূত এক ব্যবস্থায় মানুষের এগিয়ে চলার মতো বিষয়গুলোকে মূল গল্পের সাথে সমান্তরালে মিশিয়েছেন লেখক মাসরুর আরেফিন। তার ভেতরে বাস করে এক দুর্বিনীত কবি। নিজের বিভিন্ন গুণাবলী দিয়ে সৃষ্ট ‘অধ্যাপক’ চরিত্রটিতে ইতিহাস, রাজনীতি, ধর্ম নিয়ে সচেতন অধ্যাপকের মাঝেও থেকে থেকে যেন উঠে আসে কবিত্ব।
চারটি অধ্যায় মিলে গঠিত এই ‘আগস্ট আবছায়া’ উপন্যাসের প্রথম অধ্যায়ে লেখক এই গোটা মানবজীবনের অর্থবহতা কিংবা অর্থহীনতাকে ছুঁয়েছেন কখনো কাফকা, কখনো নিৎশে, কখনো ফ্লবেয়ার, কখনো তুর্গেনেভ, কখনোবা প্রুস্তর দর্শনে। নানান সময়ে ও পরিস্থিতিতে উল্লিখিত লেখকদের বিভিন্ন ছোট অংশ বা মতবাদ মাসরুর আরেফিন উদ্ধৃত করেছেন। তার বইয়ের বিষয়াদির সাথে তিনি যেভাবে সাযুজ্য ঘটিয়েছেন এসবের, তাতে বেশ পরিষ্কার বোঝা যায়, মেটা-ফিকশনের ধারাটি নখদর্পণে আছে তার। মাসরুর আরেফিনের উপন্যাসের ভাষা গড়পড়তা নয়। অনুবাদক হওয়ার সুবাদেই হয়তোবা অনুবাদের একটা চাপা গন্ধ পাওয়া যায় উপন্যাসের প্রথম অধ্যায়ের গদ্যগুলোতে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র, অধ্যাপকের মানসিকভাবে বিক্ষিপ্ত অবস্থা বোঝাতে হয়ত গদ্যগুলো প্রথম প্রথম একটু এলোমেলো মনে হতে পারে। কিন্তু মনোযোগী পাঠক কিছু দূর এগোতেই বুঝবেন, ওই এলোমেলো ভাবটাতেই মাসরুর আরেফিন এক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেছেন, তার স্বতন্ত্র ধারাতে।
বইয়ের সর্বাপেক্ষা চমৎকার অংশ- তৃতীয় অধ্যায়। প্রথম অধ্যায়ের যুক্তিতর্ক, দর্শন, অস্তিত্ববাদ আর দ্বিতীয় অধ্যায়ে ইব্রাহীমের মুখোমুখি বসে ১৫-ই আগস্টের ঘটনার উল্টোপিঠ আবিষ্কারের পর এ অধ্যায়ে অধ্যাপক সময় আর বাস্তবতার শৃঙ্খল গুঁড়িয়ে চলে যান ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে। নির্দিষ্ট করে বললে ১৪, ১৫, ১৬ এই তিনটি দিনে। বইয়ের এই তৃতীয় অধ্যায় সম্পূর্ণই পরাবাস্তববাদী। মেজর ডালিম, ফারুক, রশিদ, খন্দকার মোশতাক এরা একত্র হয়ে কীভাবে ১৫-ই আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পটভূমি তৈরি করেছিল, তা নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করেন অধ্যাপক এবং তার যথাযথ বিবরণ পাওয়া যায় মাসরুর আরেফিনের লেখায়। দ্বিতীয় এই অধ্যায়কে আবার ৩টি উপ-অংশে ভাগ করা যায় ১৪, ১৫ এবং ১৬-ই আগস্ট ধরে। ১৫ই আগস্টের ঘটনার আগের দিন, অর্থাৎ ১৪-ই আগস্ট অংশে- ঘটনার প্রস্তুতি এবং মেজর ডালিম, ফারুক, রশিদদের মনস্তত্ত্ব বিশদ আকারে লেখা হয়েছে এখানে।
১৫ই আগস্টে বাসভবনে ঢুকে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে হত্যা করার সেই বর্ণনার অংশটুকু মাসরুর আরেফিন যে উপায়ে লিখেছেন, সেটিকে বিশেষায়িত করতে একটি শব্দই যথেষ্ট, ‘প্যালপ্যাবল’ বা ‘স্পর্শনীয়’। মাসরুর আরেফিনের লেখনীতে পাঠকের কাছে রীতিমতো দৃশ্যমান হয়ে ধরা দিতে বাধ্য হত্যাকাণ্ডের বর্ণনার এই অংশটুকু। অধ্যায়ের শেষ অংশ অর্থাৎ, ১৬ই আগস্টের সার্বিক অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। লেখক নারকীয় এই হত্যাকাণ্ডের পেছনের গূঢ় রাজনীতিতে ঢোকানোর চেষ্টা করেননি, বরং এই হত্যাকাণ্ডকে মনে রেখাপাত করার মতো দারুণ এক কাব্যিক উপায়ে বর্ণনা করেছেন। এবং তেমনটি করতে ভাষাগত ও অাঙ্গিক দিক থেকে যতটা কারুকাজের প্রয়োজন ছিল, মাসরুর আরেফিন তার প্রজ্ঞা দিয়ে সেটা অতুলনীয়ভাবে সম্পাদন করেছেন।
কিন্তু, এমন দারুণ তিনটি অধ্যায়ের পর উপন্যাসটি খানিক নাজুক হয়ে পড়ে চতুর্থ অধ্যায়ে এসে। উপন্যাসের এই শেষ অধ্যায়ে মাসরুর আরেফিন যুক্তি আর পরাবাস্তবের ঘোর হতে নেমে প্রবল বেগে ছুটিয়েছেন তার কল্পনার ঘোড়াকে, নিয়েছেন বিজ্ঞানের আশ্রয়। এ অধ্যায়ে তিনি সায়েন্স-ফিকশনের মিশ্রণে ভূ-রাজনীতির বিষয়টি তুলে ধরেছেন। কিন্তু বিষয়গুলোতে ঠিক সংহতি খুঁজে পাওয়া যায় না। গোটা বইয়ের একটা বিচ্ছিন্ন অংশ মনে হয় এই অধ্যায়টিকে। মাসরুর আরেফিনের বক্তব্যের জায়গাটি পূর্বের অধ্যায়গুলোর মতো স্বচ্ছ নয়। এ অধ্যায়ে আসা নতুন চরিত্রদের গল্পে প্রভাব বিস্তারের জায়গাটি ঠিকঠাক গড়ে ওঠেনি। ফলত, খানিকটা লক্ষ্যহীন মনে হয় এই অধ্যায়টিকে।
যদিও উপন্যাসের শেষ অংশ দুর্বলতায় ভুগেছে, তবু যে অভিনব উপায় আর ভাষায় মাসরুর আরেফিন আগস্টের রক্তাক্ত ইতিহাস বর্ণনা, মানবজীবনের অর্থ-অনর্থের দর্শন বিশ্লেষণ করেছেন, তা বাংলা সাহিত্যে নতুন এক মাত্রা যোগ করেছে বললে অত্যুক্তি হবে না। এ বইয়ের ভাষা সম্পূর্ণ নতুন এক ভাষা দেশীয় আধুনিক সাহিত্যে। একইসাথে ক্ষুরধার আর প্রচণ্ড গম্ভীর তার এই ভাষা। ভিন্ন আর নতুন এক ন্যারেটিভ সৃষ্টি করেছেন তিনি। আধুনিক দেশীয় সাহিত্যে নতুন ভাষার নতুন এক মাইলফলক ‘আগস্ট আবছায়া’।
[আগস্ট আবছায়া বইটি কিনতে পারেন রকমারি থেকে]