মুজতবা আলী বলেছিলেন, বই কিনে কেউ তো কখনো দেউলিয়া হয়নি। তবে বই কিনে নয়, সম্প্রতি তাঁরই লেখা বই ‘দেশে বিদেশে‘ পড়ে দেউলিয়া হয়েছেন এমন একজনের কথা আমি জানি! সে গল্প বলছি বইটা নিয়ে আলোচনার পর।
বইয়ের শুরুটা হয়েছিল হাওড়া স্টেশন থেকে। এরপর লেখক গিয়েছেন পশ্চিমে। সেই ধূ ধূ করা পশ্চিম তাঁর ভালো লাগেনি। তারপর তিনি বইয়ের মাঝে পাঠককে নিয়ে গেলেন পেশাওয়ার। পরিচয় করিয়ে দিলেন সর্দারজির সাথে। সহজ সরল অতিথিবৎসল পাঠানদের সাথে। শোনালেন তাদের ছেলেমানুষী গল্প, শোনালেন তাদের খাবারের বহর। কী ভীষণ রকম আড্ডাবাজ তারা! একটুখানি সময় পেলেই তারা আড্ডায় বসে যায়। ইচ্ছে করে নাকি সাইকেলের চাকার পিন খুলে রাস্তায় ফেলে রাখে- যেন তাতে জুতো ছিঁড়ে গেলে এই ছুতোয় মুচির সাথে একটু গল্প করা যায়!
খাস পাঠানের লান্ডিকোটাল থেকে পেশাওয়ার যেতে নাকি দুই মাস সময় লাগে। এর মধ্যে সে সেখানকার যত বাড়িঘর আত্মীয়স্বজন আছে সবার বাড়িতে তিন দিন করে থাকে। দু’মাসের কমে পেশাওয়ার পৌঁছে গেলে বুঝতে হবে এর মধ্যে কোনো বাড়ি কাট করে গিয়েছিল সে!
তারপর তো লেখক গেলেন কাবুলে। লক্কড়ঝক্কড় রাস্তায় একপ্রকার জীবন হাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। কোনোমতে পার হলেন খাইবার পাস। গিয়ে জুটালেন এক চ্যালা। নামে চ্যালা, আসলে পার্সোনাল বাবুর্চি, নাম আবদুর রহমান। বাড়ি পানশির। সেখানে নাকি শীতে বরফ পড়ে। জানালার ধারে বসে একটানা সাতদিন বসে শুধু বরফ দেখেই কাটিয়ে দেওয়া যায়। এরপর কত লোকের সাথে পরিচয় হলো। এমনকি আফগান প্রধানের ভাই মইনুস সুলতানের সাথেও নিয়মিত টেনিস খেলা শুরু করলেন! কী অবস্থা ভাবা যায়! ভাবুন তো- গেলাম এক জায়গায় চাকরি করতে আর গিয়ে বন্ধু বানিয়ে ফেললাম সেখানাকার বাদশার বড় ভাইকে। কী সাংঘাতিক অবস্থা না?
রশীদ করিমের একটা লেখায় পড়েছিলাম, কলকাতায় বসে তিনি রোজ নিয়ম করে লিখতেন ‘দেশে বিদেশে’। আর পরিচিতদের পড়ে পড়ে শোনাতেন। একদিন পাড়াসুদ্ধ সব লোক আবদার করল আলী সাহেবকে- তাদেরও পড়ে শোনাতে হবে। আর আলী সাহেবের সে কী লজ্জা। আরেকটা জিনিস, আলী সাহেব সবসময় লিখতেন সবুজ কালির কলম দিয়ে। আমার কাছে তাঁর রেশন কার্ডের একটা ছবি আছে, সেখানেও দেখি তিনি স্বাক্ষর করেছেন সবুজ কালিতে।
বলা যায়, এটি বইয়ের মতো বই একটা। একেবারে মাইথলোজি থেকে কাহিনী টেনে এনে আধুনিক আফগানিস্তানের কথা লিখেছেন রসিয়ে রসিয়ে। মাঝে মাঝে ছেড়েছেন খৈয়াম আর ফেরদৌসীর বায়েত। সংস্কৃত-হিন্দি-উর্দু-ফারসি-ফরাসি-জার্মান কোনো ভাষাই বাদ দেননি এখানে। আর আলী সাহেব কায়দাটা জানতেন পাঠক ধরে রাখার। কোন লাইনের পর পাঠক কোন লাইনটা চায় সেসব যেন তার নখের আগায়। তাই বইটাও হয়েছে সেই রকম।
তো তাঁর বই পড়ে দেওলে হবার ঘটনাটা। এ দেশেই ঘটেছে সেটা। সেদিন এক আড্ডায় তিনি ঘোষণা করলেন ‘দেশে বিদেশে’ পড়ে তিনি দেউলিয়া হয়ে গেছেন।
কেন? কেন? দেউলিয়া হলেন কীভাবে?
হুম! সে প্রশ্নের জবাব দিতে তো একটু পেছন ফিরতে হবে। তখন সবেমাত্র ক্লাস সিক্সে পড়ি বুঝলে। বাংলা বইয়ে সৈয়দ সাহেবের একটা লেখা পেলাম ‘নীলনদ আর পিরামডের দেশে’। তো সেখানে একটা লাইন এখনো মনে আছে। অনেকটা এমন- আমার প্রাণ, মানে সৈয়দ সাহেবের প্রাণ নাকি মিশরে যাওয়ার পর কাঁদছিল চারটি আতপ চাল, উচ্ছে ভাজা, সোনামুগের ডাল আর কি সব হাবিজাবির জন্য জানি।
আম্মা আমাকে পড়াচ্ছিল। বলল, দেখ দেখ বড় বড় মানুষেরাও এসব খায়। তুই তো করলা ভাজি খাসই না। দিনকয়েক পরে আমাকে ধরে বেঁধে করলা ভাজি খাওয়ানো হলো। সৈয়দ সাহেব কেঁদেছিলেন না খেতে পেয়ে, আমি কেঁদেছিলাম খেতে পেয়ে!
বড় হয়ে যখন তাঁর ‘জলে ডাঙায়’ পড়লাম তখন দেখি ঐ লেখাটা এই বইটা থেকে কেটেকুটে ছাপিয়ে দিয়েছে। সেখানে দেখি লেখা উচ্ছে ভাজা না খেতে পারার প্রায়শ্চিত্ত সৈয়দ সাহেব করেছিলেন একটা শসা খেয়ে। যেটায় দুহাত দিয়ে চাপ দিলে বেরিয়ে আসে পোলাওয়ের মতো কিছু জিনিস আর তাতে থাকে কিমা কিমা মাংস।
এই লেখা পড়ার পর আমি অগ্নিশর্মা হয়ে গেলাম। ওরা কিনা কেটেছেঁটে এই লাইনটা বাদ দিয়েছে। ওটা থাকলে আম্মা যখন আমাকে করলা খাওয়ালো, আমিও তো তখন শর্ত জুড়ে দিতে পারতাম করলা খেলে আমাকে ঐ শসার আইটেমও বানিয়ে দিতে হবে!
ঐ খাবারের লোভেই কি না ‘দেশে বিদেশে’ শুরু করলাম। বাপরে বাপস এলাহী কান্ড! কী সব পোলাও-কোর্মা-কোফতা-কালিয়া-কাবাব-রেজালা, আরো কত কিছু তোমরা হয়তো কখনো নামই শোনোনি। তাই বলেও লাভ নেই। এত খায় কীভাবে মানুষ! আমি তো ভেবেছিলাম পানি হয়তো পেটের ভেতরটা ঠাণ্ডা রাখবে। না গো না, অম্বুস্পর্শে উহা শীতল হইবে না!
কী আর করা, পেটের জ্বালা নাকি বড় জ্বালা। এন্টাসিডে সে জ্বালাপোড়া নিভবে না। তাই গেলাম এক রেস্টুরেন্টে। একা যেতে কেমন যেন লাগে। বলির পাঁঠা হলো শুভ। বেচারাকে দশ মিনিটের নোটিশে ঘর থেকে বের করলাম। গপগপ করে নান আর গ্রিল মেরে দিলাম দুজনে।
তারপর আবার শুরু করলাম পড়া, এবং আবারো সেই খাওয়া। চব্বিশ ঘণ্টাই যে তিনি খাওয়ার উপরই আছেন এমন না। মজা করে অনেক কিছুই লিখছেন। এটা খাইবারপাস, এটা কাবুলের রাস্তা, পুরোটাই রুক্ষ-শুষ্ক। এক লক্কড় মার্কা গাড়ি করে তিনি যাচ্ছেন কাবুল এবং রসিকতা করছেন।
আমি পড়ি আর হাসি। ভ্রমণকাহিনীগুলোতে সাধারাণত কী থাকে? লেখক দেশে অথবা বিদেশে কোথাও হয়তো যান, কীভাবে যান, কেন যান, কী খান, কী দেখেন, কাদের সাথে পরিচিত হন, কেমন লাগে সে জায়গা, কী সেখানকার ইতিহাস ইত্যাদি লিখে বই আকারে প্রকাশ করেন। ‘দেশে বিদেশে’ বইতে এ সকল বিষয় কেবল পর্যাপ্ত পরিমাণে ছিল তা-ই নয়, এত বেশি পরিমাণে ছিল যে এখন ভাবলেও ভয় হয়- পড়ে শেষ করলাম কীভাবে?
তবে অন্য ভ্রমণ কাহিনীগুলোতে লেখক যেখানে যান শুধুমাত্র সে যায়গাটাই দেখেন। মুজতবা আলী কাবুল তো দেখলেনই সাথে নরক দর্শনও করে এসেছেন। ‘শবনম’ পড়লে বোঝা যাবে নরক দর্শন কেন বলেছি। এমন বেদনাবিধুর ভ্রমণ আমি আর পড়িনি। না পড়ারই কথা, প্রায় দুই বছর পর তিনি দেশে এসেছেন, কত চেনা-পরিচয়, কতজন মারা গেল এর মধ্যে, আহা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হয় শেষটায়।
তবে কি না আমার মন পড়ে থাকে কোথায় গিয়ে মুজতবা সাহেব দুটো মুখে দেবেন! তার খাওয়াদাওয়া নিয়ে তার পরম সুহৃদও বোধহয় এত চিন্তিত ছিল না, যতটা আমি ছিলাম। একটু ভালোমন্দ খেলে আমার চেয়ে খুশি যেন আর কেউ হয় না। কাবুল যাওয়ার পর তাঁর খাস বাবুর্চি আব্দুর রহমান যে রান্নাটা করলো, আহা! সেটা পড়ে পরদিন আবার গেলাম খাবারের দোকানে। পরম তৃপ্তিভরে খাচ্ছি। ওয়েটার এসে যখন বলল আর কিছু লাগবে কি না, আমি যেন মরীচিকার মতো দেখলাম এ যেন ঠিক মুজতবা আলীর বইয়ের আব্দুর রহমানের মতো- মাথায় পাগড়ি, গায়ে কুর্তা, গালভর্তি চাপা দাড়ি, ফর্সা গা, খাড়া নাক, ছ’ফুট লম্বা খাস পাঠান! যেন বলছে ‘হুজুর, আর কিছু চাই কি?’ চোখ বন্ধ করে বললাম -আরো একটা দিন!
মানিব্যাগ আফগানিস্তানের রাস্তাঘাটের মতোই শুষ্কং কাষ্ঠং হয়ে উঠতে লাগল। শেষকালে আব্দুর রহমানের মতো এমন একটা পার্সোনাল বাবুর্চি না থাকার দুঃখে পরদিন কাচ্চি বিরিয়ানি খাওয়ার পর মানিব্যাগটা হয়ে উঠল আস্ত এক গড়ের মাঠ! টাকা তাতে রাখলেই যেন সেগুলো কোথায় হারিয়ে যায়। আর এভাবেই আমি ‘দেশে-বিদেশে’ পড়ে খেয়ে খেয়ে দেউলিয়া হলাম।
অনেকে হয়তো ইতোমধ্যে বুঝে ফেলেছেন হতভাগা দেউলিয়া যে হয়েছে সে আসলে আর কেউ না, আমি নিজেই।
তবে মুদ্রার উল্টোপিঠও আলী সাহেব দেখেছেন। নিজে তো দেখেছেনই সাথে পাঠককেও দেখিয়েছেন। আফগানিস্তানের বাদশাহ আমানুল্লাহকে হটিয়ে ডাকু বাচ্চা সকাও যখন কাবুলের সিংহাসন দখল করলো তখন বেশ কিছুদিন কেবল রুটি আর লবণ খেয়েও থাকতে হয়েছে তাকে। সব দিক মিলিয়ে ‘দেশে বিদেশে‘ এক অনন্য ভ্রমণকাহিনী।
নাম: দেশে বিদেশে || লেখক: সৈয়দ মুজতবা আলী
প্রকাশক: বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র || অনলাইনে প্রাপ্তিস্থান: রকমারি