বিখ্যাত ফরাসি চলচ্চিত্রকার অ্যানিয়েস ভার্দা, তার সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘ভার্দা বাই অ্যানিয়েস’-এ নিজের শেষ ক’টি কাজকে ‘ক্লোজার টু হোম’ বলে বিশেষায়িত করেছিলেন। জীবনের শেষভাগে তার কাজগুলোতে আবেগ, স্মৃতিচারণের প্রকৃতিটা অনেক বেশি গাঢ় হয়ে ধরা দেয়। তাই অমন বিশেষণ। ভার্দার রেফারেন্স টানার কারণ হলো, তার সেই বিশেষণ দিয়েই ভারতের বিহার রাজ্যের এই সিনেমার প্রকৃতি ব্যাখ্যা করা যায়। ‘গামক ঘর’ দেখার সময় ক্লোজার টু হোম, এমন একটা অনুভূতি ফিরে ফিরে আসছিল। হ্যাঁ, ‘ক্লোজার টু হার্ট’ বিশেষণও কেউ কেউ জুড়ে দিতে পারেন কথার কিংবা আবেগের পিঠে। ঘর যেহেতু আছে, হৃদয় তো থাকবেই। ঘর, সে-তো তৈরি হয় ইটকাঠের চতুরঙ্গে, কিন্তু সাজে আবেগের বহিরঙ্গে।
গামক ঘর, একটি ঘরকে কেন্দ্র করে তিনটি সময়ের উপাখ্যান। ঘরটি এই সিনেমায় একটি চরিত্র। শুধু চরিত্রই নয়, বলা চলে কেন্দ্রীয় চরিত্র। একটা জীবন্ত প্রাণী যেন। আর প্রাণ থাকলে মৃত্যু তো আসবেই। এ ঘরের-ও মৃত্যু হয়। ঘরের মানুষের পদচারণায়, হৈচৈয়ে ঘর ‘ঘর’ হয়ে ওঠে। সেই সদস্যরা যখন আরেকটাবার ফিরে তাকানো ছাড়া তাকে পরিত্যাগ করে, তখন মৃত্যু হয় তার। পুনর্জন্ম তো হয়। তবে বয়স বাড়লে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে যৌক্তিক করে দেওয়া হয় তার অস্তিত্বের বিনাশকে। তার করুণ সুর শুনতে পায় না কেউ। সেই শুনতে না পাওয়া সুরই ছিন্ন খঞ্জনীর মতো বেজে বেজে উঠেছে এই সিনেমায়।
একটি পৈতৃক ভিটেবাড়ির গল্প গামক ঘর। প্রারম্ভিক দৃশ্যেই মন্তাজ ব্যবহার করে যার আশপাশে ছেয়ে থাকা গাছগাছালি, রোয়াক, দড়িতে ঝোলানো শাড়ির শট দেখিয়ে সিনেমায় এ বাড়ির গুরুত্ব এবং প্রভাব সম্পর্কে দর্শককে ধারণা দেওয়া হয়। একটা সাজ সাজ রবে ভরেছে গোটা বাড়ি। বাড়ির মূল কর্তা মারা গেছেন দর্শকের সাথে পরিচয়ের পূর্বেই। তার স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েরাই আছে। ছেলেরা বড় হয়ে বিয়েশাদি করে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে থিতু হয়েছে নানান জায়গায়। তবে আজ একত্র হয়েছে বাড়ির ছোট ছেলের সন্তান জন্মের উৎসবে। সব ভাইয়েরা এসেছে। বৌরা এসেছে। বাচ্চারা নির্মল আনন্দে ছুটে বেড়াচ্ছে প্রশস্ত আঙিনায়। এ চিত্র ১৯৯৮ সালের। সবার হৈ-হুল্লোড়ে দিন পার হবার পরে, বিদায়ের পালা এসেছে। বাড়ির ছোট ছেলেও দিল্লীতে ভেড়ার ভাবনাচিন্তা করছে। এ অংশের শেষে বুঝতে পারা যায়, শূন্য আঙিনা নিয়ে বিশাল ঘরটার একা পড়ে থাকার দিন চলে এসেছে।
এরপর সময় চলে যায় ২০১০ সালে। ফের সকল সদস্য একত্র হয়েছে। তবে এবার পরবর্তী প্রজন্ম। আগের বাবা-চাচাদের অনেকেই আজ নেই। তাদের সন্তানেরা সকলে জড়ো হয়েছে বিশেষ রীতি পালন করতে। পরিবারের বড় মাথা হিসেবে দাদীই আছেন এখনো। সে কারণেই ঘরটা আছে। সবাই এখন নাগরিক জীবনে ভীষন ব্যস্ত। বিশ্বায়ন, প্রযুক্তি নিয়ে গদগদ প্রশংসাবাক্য তাদের মুখেমুখে। একত্র তো হয়েছে সকলে, কিন্তু একাত্মতা আর নেই সেভাবে। বাড়ির আঙিনায় কোলাহল নেই আর। চুনকাম খসে পড়ছে বাড়ির। মেরামত জরুরি। কিন্তু করছে কে ?
থাকার মধ্যে কেউই আর নেই বাড়িতে। দিন পার হলে, যে যার-যার মতো আচারে যোগ দিয়ে দায়িত্বের ভাগ শেষ করে নিজের পথ ধরছে। দাদীও আর থাকেন না বাড়িতে। বিষণ্ণ বাড়িটা একাই পড়ে রয় নিজের মাঝে। তারপর সময় আসে ২০১৯ সালে। একেবারে বর্তমান সময়ে। চুনকাম যখন খসে পড়ছিল, তখনই তো বাড়ির বিধান লেখা হয়ে গিয়েছিল। সামনে যখন গেট লাগানো হলো, তখনই তো এই বাড়িকে একঘরে করে দেওয়া হয়েছে। আশপাশে আধুনিক দালানকোঠা হচ্ছে। বিহারের এ গ্রাম আর আগের গ্রাম নেই। বাড়ি তার পরিণাম জেনে ভেতরে মুষড়ে পড়েছে তো সেই আগেই। বাইরে যেটা ধরে রেখেছিল, দাদীর মৃত্যুর খবর সেটার পরিণতিটুকুও অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছে। সদর্প, ভূমিতে মিশিয়ে দেওয়াই আজ তাই সময়ের দাবি !
চলচ্চিত্রের তিন অংকের প্রচলিত গঠনরীতিতে সিনেমার তিনটি সময়কে ভাগ করেছেন পরিচালক আঁচল মিশ্রা। প্রথম অংক চালিত হয়েছে পুরোপুরি নস্টালজিয়া দ্বারা। ৯৮-এর গল্প ব্যক্ত করে এ অংক। চিত্রনাট্যে প্রতিটি ক্ষুদ্র বিবরণের দিকে নজর দিয়েছেন পরিচালক। গ্রামীণ একান্নবর্তী পরিবারে বড় হয়ে থাকলে কিংবা কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়ে থাকলে দর্শক এই ছোট ছোট ঘটনার সাথে নিজেকে গাঢ়ভাবে যুক্ত করতে পারবেন। যেমন ধরুন, উৎসব বা বিশেষ দিনগুলোতে বাড়ির ছেলে-ছোকরাদের ভিসিআর ভাড়া করে এনে রাতভর সিনেমা দেখার বিষয়টি। বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠদের একসাথে বসে পান চিবোতে চিবোতে বিক্ষিপ্ত নানান বিষয়ের আলোচনা, স্ত্রীদের একত্র হয়ে অনুষ্ঠানে কে কী আনল/দিয়ে গেল সহ টিপ্পনি কেটে আরো হরেকরকম কথা- এই বিষয়গুলো বিবরণের জায়গা এবং নস্টালজিয়ার প্রকৃতি, দুটোকেই প্রগাঢ় করে তোলে।
দ্বিতীয় অংক বুকের উপর কিছু চেপে বসে ভারি হয়ে থাকার অনুভূতি দেয়। সময়ের সাথে সাথে সামাজিক অবস্থার, সাংস্কৃতিক অবস্থার পরিবর্তনটাকে চিত্রনাট্য তুলে ধরে। চেয়ারগুলো এখন খালি পড়ে থাকে। পান চিবোতে চিবোতে সরলমনে বিক্ষিপ্ত বিষয়াদির আড্ডা এখন আর চলে না। কে কোথায় পড়ছে, কোথায় পড়বে, আরো প্রতিষ্ঠিত হয়ে কী করে উঁচু সমাজের প্রতিনিধি হবে- সেসবই আলোচনার বিষয়। পিঠাপুলির জায়গা এখন ভাজাপোড়া আর ম্যাগি নিয়ে নিয়েছে। ভিসিআর ভাড়া করে রাতভর সিনেমা দেখার জোগাড়যন্ত্র হয় না আর। উচ্চাকাঙ্ক্ষার পেছনেই সকল মন্ত্রতন্ত্র। আগের সেই সরলতা আর নেই। জায়গাজমির কথা উঠলেই এখন আপন ভাইয়েরা আর ছেড়ে কথা কয় না।
কালের পরিক্রমায় আসে ২০১৯। সিনেমার শেষ অংক। ক্লাইম্যাক্সে চলেই এসেছে দর্শক। অবশ্য কী ঘটবে, তা এতক্ষণের সময়টায় আঁচল মিশ্রা ক্ষীণ সুরে জানিয়েই এসেছেন। এবার শুধু নীরব সাক্ষী হওয়াটাই বাকি। আধুনিকায়নে নতুন, বিলাসী সৃষ্টির মাঝে দাঁড়াতে না পারলে, তাকে গুঁড়িয়ে দেওয়াই একমাত্র পথ এবং সমাধান। সেই ধ্বংসাবশেষের উপরেই পুঁজিবাদের ভিত প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা যাবে।
পরিচালক আঁচল মিশ্রা, তার ব্যক্তিগত গল্প থেকেই এ সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছেন। তারই পৈতৃক ভিটার গল্প। তাই, এ যে হৃদয় নিংড়ানো গল্প এবং তার সেই বাড়িটির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলিস্বরূপ গল্প, সেটুকু বুঝতে বেগ পেতে হয় না। অমন ব্যক্তিগত গল্প বলেই যত্নআত্তির সর্বোচ্চটা লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে সিনেমায়। সেটা চিত্রনাট্য লেখায়-ও যতটা, ততটাই সে চিত্রনাট্যকে ক্যামেরার ভাষায় অনুবাদে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, সিনেমার তিনটি সময়ে তিন ধরনের অ্যাস্পেক্ট রেশিও ব্যবহার করেছেন পরিচালক। প্রথম অংকে, মানে ৯৮ সালের অংশে ‘স্কয়ার রেশিও’ ব্যবহার করা হয়েছে। এই রেশিওতে সেই সময়ে, মানে প্রযুক্তি আর বিশ্বায়নের উন্মত্ত হাওয়া পালে লাগার আগে পরিবারের সদস্যদের একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির জগত এবং তাদের মধ্যে গভীর পারস্পরিকতার দিকটিকে প্রকাশ করা হয়।
দ্বিতীয় অংকে; দর্শক ফুল স্ক্রিন রেশিওতে চরিত্রদের আশপাশের জগতটা আরো বড় এবং বিস্তৃত হওয়ার পাশাপাশি, তাদের বিচ্ছিন্নতা এবং বাড়িটির শূন্যতাকেও আরো বিশাল আকারে দেখতে পায়। শেষ অংকে; ওয়াইডস্ক্রিন রেশিও সিনেম্যাটিক লুক এবং আধুনিক ভাবটা আনার পাশাপাশি জড়িয়ে থাকা শূন্যতার আরো চেপে বসার ইঙ্গিতই হয়তো প্রদান করে। সফট লাইটিংয়ের কোমল ভাবটা চোখে প্রশান্তি দেয়। কালার গ্রেডিংয়ে ধূসর এবং নীলের আধিক্য বিষণ্ণ ভাবটাকে ভারি করে।
আঁচল মিশ্রা গোটা সিনেমাই ক্যামেরা স্ট্যাটিক পজিশনে রেখে শ্যুট করেছেন। এমন নির্জলা ড্রামা সিনেমায় স্ট্যাটিক স্টাইলটাকেই সাধারণত বেছে নেওয়া হয়, নীরবতা আর বিমর্ষ ভাবটাকে চড়াও করতে। বাড়িটাই যেহেতু মুখ্য চরিত্র এবং বাকিগুলো গৌণ চরিত্র, তাই কোনো চরিত্রের ক্লোজআপ শট এখানে দেখতে পাওয়া যায় না। আঁচল মিশ্রা শট বাছাইয়ে সাবজেক্টিভ বা বিষয়ভিত্তিক না হয়ে অবজেক্টিভ বা বস্তুভিত্তিক হতে চেয়েছেন। সে কারণেই, সিনেমায় প্রতিবারই মন্তাজের ব্যবহারে দর্শক বাড়িটা, নাহয় বাড়ির নানান জিনিসপত্রকেই দেখতে পায়।
ক্যামেরা সহসা তার জায়গা পরিবর্তন করে না এখানে। চুপচাপ বসে থাকে, আর দর্শককে পর্যবেক্ষণ করতে দেয়। শটগুলো সুচিন্তিত। কখন মিজ-অঁ-সেন ব্যবহার করতে হবে, কখন কাট করতে হবে- সেসব ঠিকঠাকভাবেই পরিকল্পিত। সে কারণেই কোনোরকম তাড়াহুড়ো ছাড়া শটগুলো নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেয় দীর্ঘক্ষণ ধরে। আবহসঙ্গীতেও বিভিন্ন বস্তুর শব্দ, নাহয় নানানরকম প্রাকৃতিক শব্দকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। অবজেক্টিভ সাউন্ড ছাড়া অংশুমান শর্মার কম্পোজ করা ‘সামার থিম’ এবং ‘ডেপারচার থিম’- এই দুটো সঙ্গীত শুনতে পাওয়া যায়। কান দিয়ে প্রবাহিত হয়ে হৃদয়ে আন্দোলন জাগানোর ক্ষমতা রাখে এই দুটোই। বিষাদ ভরা ঠোঁট নিয়ে কানকে চুম্বন করে যায় যেন। একইসাথে প্রশমিত ভাবও জাগায়।
অন্তিম দৃশ্যে, গোটা পর্দা কালোতে ঢেকে যাওয়ার আগ অব্দি বিশাল সেই ছাদকে অস্তিত্বের নিদারুণ পরাজয় মেনে নিয়ে ধূলিস্যাৎ হতে দেখে দর্শক। এবং সিনেমার সমাপ্তিতে উপলব্ধি করতে পারা যায়; ‘গামক ঘর’ গল্পসর্বস্ব সিনেমা নয়, অনুভূতিসর্বস্ব সিনেমা। সিনেমা শেষেও আবেগ আর বেদনাটা তাই রয়ে যায়। স্মৃতিচারণ এবং স্মৃতিভাঙনের সেই অনুভূতি।